যুক্তি, বিশ্বাস ও কোরান

এই দুনিয়ায় কেউ বিশ্বাসী, কেউ অবিশ্বাসী। যুক্তি বিজ্ঞানের আলোকে যদি বিশ্বাসের স্থানে পৌছা যেত, তবে এই বিশ্বের বড় বড় মহাবিদ্যালয়গুলোতে যারা আজীবন যুক্তি-শাস্ত্র, অংক ও দর্শনের উপর শিক্ষকতা করে আসছেন তাদের সকলকেই হয়ত বিশ্বাসী পেতাম। আবার যদি এই শাস্ত্রাদির মাধ্যমে বিশ্বাসকে উড়িয়ে দেয়া যেত, তবে সবাইকে হয়ত অবিশ্বাসীই পেতাম, কেননা যুক্তি বিদ্যার সংজ্ঞা ও তার ব্যবহারিক জ্ঞান তাদের অবশ্যই আছে।  বিশ্বাস আসলে যুক্তিবিদ্যার আয়ত্তাধীন কোন বিষয় নয়। মানুষের আয়ত্তে যেসব বস্তু রয়েছে এবং যেসব বস্তু তারা নিজেরাই চেষ্টা সাধনা করে বের করতে সক্ষম, সেসব বস্তু ওহীর (ঐশীর) মুখ্য বিষয় নয়। আল্লাহ আছেন কী নাই, মৃত্যুর পর জীবন আছে কী নাই, সেখানে জবাবদিহির কোন বিষয় আছে কী নাই –এগুলো মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয় অনুসন্ধানের বাহিরে। কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করে সেখানে নিঃসন্দেহভাবে উপনীত হবার কোন পথ নেই। তাই আল্লাহ নিজেই পঞ্চেন্দ্রিয় পথে মধ্যস্থতা (intervene) করে রিসালাতের ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের অস্তিত্ব যেমন এক মহান নেয়ামত, তেমনি এটাও।  পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে অতীন্দ্রিয়তে পাড়ি দেয়ার এই বিষয়টিও আবার আসমান জমিনের মত। এটা এক ধরণের সম্ভব/অসম্ভবের ব্যাপার। “মুহাম্মদ বলেছেন তাঁর কাছে সরাসরি এবং এক ফেরেশতার মাধ্যমে এই মর্মে বার্তা এসেছে যে আল্লাহ আছেন, তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং মানুষের মৃত্যুর পর পুনরুত্থান হবে অর্থাৎ পরকার আছে” –এখানের সত্য-মিথ্যা কীভাবে নির্ণয় করবেন? আবার কোন যুক্তিতে মুহাম্মদকে “আস্থায়” নিয়ে আপনার গোটা জীবন তাঁর সেই বাণীর আলোকে সাজাতে যাবেন? অবস্থানের প্রকৃতি হচ্ছে এই যে হয় তাঁকে বিশ্বাস করে সেই পথে পাড়ি জমাবেন, আর না হয় যেখানে আছেন সেখানেই থেকে যাবেন। এই সিদ্ধান্ত এক চরম সিদ্ধান্ত। তাই যে বিশ্বাস করতে পারল আর যে পারল না –এই দুজন কি এক? এমন ধরণের অলঙ্কারবহুল (rhetorical) অনেক প্রশ্ন কোরান বার বার করেছে। এই জটিল কাজ কেউ করতে পারবে আর কেউ করতে পারবে না, এটাই অনুমেয় এবং বাস্তবতাও বটে। মানব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস এই পারা না-পারার সাক্ষ্য বহন করে।

বস্তুত  যা পঞ্চেন্দ্রিয় পদ্ধতিতে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করা যায় তার জন্য ‘বিশ্বাস’ শব্দের প্রয়োগ যথাযথ নয়, এবং হয়ত সমীচীনও নয়। পঞ্চেন্দ্রিয়ের যুক্তিতে যদি অতীন্দ্রিয় ‘অকাট্য’ হয়ে পড়ত, তাহলে আল্লাহ, পরকাল নিয়ে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে এত মশগত করত না।

বিশ্বাস/অবিশ্বাস, আমার ব্যাখ্যায়, যুক্তিপূর্ব মুহুর্ত্তে সাধিত হয়। মানুষের প্রকৃতিতে একটি অতি সূক্ষ্ম প্রবণতা (disposition) রয়েছে যা ইতি/নেতির দোলকে (pendulum) সুপ্তভাবে বিচরণ করে, এবং স্থানভেদে কোমল অনুভূতিতে দোলন জাগায় আর এখানেই আসে তার তকদীর। যাকে যে পথের জন্য তৈরি করা হয়েছে,  তার সুপ্ত দোলন সেদিকে ইঙ্গিত করবে এবং সেই পথের ‘যুক্তি’ অনুভব করবে। একটি হাদিসে এসেছে যে মানুষের ক্বলব (অন্তরাত্মা) আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মধ্যে (রূপক কথা) অবস্থিত, তিনি তাকে যেদিকে ঘুরান, তার মন সেদিকেই যায়। যুক্তি অনেক পরের বস্তু। আবেগে ধারণা যখন সম্পর্কশীল (emotive sense associates with concept) হয়, যুক্তি তখন সৃষ্টি শৈলী প্রবণতায় স্ফূলিঙ্গিত হয়ে ব্যাখ্যার অনুকূল ভাষা লাভ করে। শব্দ ও বাক্যের, বিশেষ করে অনুকূল metaphor পেয়ে গেলে যুক্তির পথ সুলভ হয়ে পড়ে। যুক্তির আগের মূহুর্ত্তটি হচ্ছে সুপ্ত আবেগের পরশ লাভ, ইতি বা নেতির কোমল দোলনা লাভ। যুক্তি হচ্ছে simply একটা হাতিয়ার (tool). বৃহৎ অর্থে গোটা ভাষাটাই একটি tool. কোনো ছেলে যদি একটি মেয়েকে ভালবেসে ফেলে, তখন সে তাকে কেন বিয়ে করতে হবে –এর পক্ষে যুক্তি পেতে কোন অসুবিধে হবে না। প্রয়োজনে সে ১০১ যুক্তি দাড় করাতে পারবে। কিন্তু মেয়েটিকে যদি তার মা-বাবা অপছন্দ করেন, তবে তাদেরও যুক্তি পেতে অসুবিধে হবে না। তাদের সৃষ্টিশৈলী faculty-প্রজ্বলিত হয়ে উঠবে এবং ১০১ বিপরীত যুক্তির অনুভূতি পাবেন।  যুক্তি হচ্ছে ব্যাখ্যার একটি relative process and it is not an  infallible tool. It works largely around selective metaphors. Consider Marxism and their selective metaphors. What we see there is the use of ‘structural’ metaphors: base, structure, superstructures etc., and from there the Marxist argument lifts off.  দাউদ (আঃ) এঁর গৃহের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে যখন দুই ব্যক্তি বিচার চেয়ে প্রবেশ করেছিল তখন তাদের একজনের অভিযোগ ছিল যে তার একমাত্র ভেড়ীটি প্রতিপক্ষের অধিকারে থাকা ৯৯ টি ভেড়ীর সাথে দিয়ে দিতে হবে এবং যুক্তি দিয়ে তার প্রতিপক্ষ তাকে পরাস্ত করেছে সুতরাং সে ঐশী বিচার পেতে এসেছে!

ইতিপূর্বে ‘আবেগ’শব্দটি ব্যবহার করেছি এবং তা ব্যাপক অর্থের আবেগ, ইংরেজির বৃহত্তর emotion অর্থে।  আমাদের জীবনের ব্যাপৃত পরিমণ্ডল আবেগ সর্বস্ব, আমি এই আবেগের সাথে মূল্যবোধের মানসিক ইতি/নেতির সম্পর্কও (relationship) জড়াচ্ছি।

যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না, তাদের এই সিদ্ধান্ত যুক্তির অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে, যুক্তি এসেছে পরে, অনেক পরে। আমাদের মূল বিশ্বাসের আবেদন যৌক্তিক নয়, যুক্তি একটা পঙ্গু ব্যাপার। এ আবেদন (অর্থাৎ বিশ্বাসের আবেদন) যুক্তির পূর্ব-মুহুর্ত্তের ‘ক্বালবি’ অনুভূতির প্রতি। সেখানে সাড়া আসলে, যুক্তিও আসবে, আর না আসলে, কোন অসুবিধে নেই, (যুক্তি ব্যতিরেকে) ঈমান আনতে পারলেই হয়।

একটি উদাহরণ টানা যাক। মনে করুন আমি আপনাকে একটি বিল (bill) পাঠালাম, আপনাকে এই বিল পে করতে হবে। বিলের নিচে যদি ছোট অক্ষরে লিখা থাকে যে যদি ১৫ দিনের মধ্যে এই টাকা আদায় না করা হয়, তবে আপনার উপর কোর্টের শমন জারি করা হবে। এত্থেকে বুঝতে হবে যে এখানে কোন যুক্তি বা যৌক্তিক স্বাধীনতা বাকি থাকে নি। এখানে আইনি ‘হুমকি’ এসে গেছে। কোন যুক্তি থাকলে, তা আদালত সাপেক্ষ।

আমাদেরকে ঈমানের দিকে আহবান করা হয়েছে, আসমান জমিনের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করা হয়েছে, গোটা সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করতে আহবান করা হয়েছে যাতে করে আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করতে পারি এবং তাঁর অনুগত হতে পারি। কিন্তু সেখানে এই হুমকিও রয়েছে যে যদি আমরা ঈমান আনতে ব্যর্থ হই এবং তাঁর অবাধ্য হয়ে পড়ি, তবে আমাদেরকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। এখানে আবেদন যুক্তি সংগত থাকত যদি বলা হত যে আসমান আর জমিনের দিকে তাকাও এবং দেখ ঈমান আনতে পার কি না। পারলে পেরেছ, না পারলে নাই –এতে কোন জোরাজুরি নেই, এতে শাস্তি-পুরষ্কারের কিছু নেই। কিন্তু বিষয়টি এভাবে আসেনি। এখানে আসমান আর জমিনের দিকে তাকানোর আহবান প্রচলিত অর্থের নিছক যুক্তির আহবান নয়, কেননা এই যুক্তি হচ্ছে সামাজিক ও ভাষিক, এটা ভাষার প্যাচে সৃষ্ট একটি দুর্বল উপকরণ। তাই আহবান হচ্ছে অন্তরাত্মা দিয়ে ধ্যান ও তপস্যামূলক আহবান। এই তাকানোতে যুক্তিপূর্ব মুহুর্ত্তের ‘ক্বালবি’অনুভূতির প্রতি আহবান, এটা হচ্ছে লুবাবের ব্যাপার। কোরান এই শব্দটি (এক বচনে বাব্ব, বহুবচনে আলবাব) ও ক্বলব শব্দটি (বহু বচনে ক্বুলুব) বার বার ব্যবহার করেছে। কোরান বলছে, চিন্তা করো, মননিবেশ করো ‘ওহে উলুল আলবাব’।   ওহীর এই আবেদন হচ্ছে জীবন সঞ্জীবনী, ক্বালবকে (অন্তরাত্মাকে) তার নির্জীব, রুগ্ন, মুমূর্ষু অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য। জীবন মৃত্যু যেমন তকদীরে অংশ তেমনি ক্বালবের ব্যাপারটি। বৃষ্টি ঝরলে যেভাবে কিছু উদ্ভিদ জীবন্ত হয়ে ওঠে তেমনি ওহীর সয়লাবে কিছু ক্বালব জীবন্ত হয়ে হয়ে। এ জন্য ওহীর উপমা বার বার মেঘের বিচরণ, বৃষ্টির অবতরণ আর তরু-লতা ও নানা উদ্ভিদ এবং ফলফসলের কথা দিয়ে এসেছে। ওহী হচ্ছে বৃষ্টি-ঝরা পানি। এই পানিতে কিন্তু সব বীজ জীবন্ত হয়ে ওঠে না, কিছু উঠলেও মরে যায়, কিছু উদ্ভিদ মাটির গভীরে জড় গেড়ে উপরের দিকে প্রশস্ত হয় এবং কিছু জড় গভীরে যায় না, এগুলো ঝড় তুফানে নিঃশেষ হয়। এগুলিই হচ্ছে ক্বালবের জগতের উপমা। এগুলোর আবেদন ভিন্ন।

 

আল্লাহর ইচ্ছা –কেনোর কোনো মানি নেই

আল্লাহ কেন এক দল লোককে হেদায়াত দেবেন এবং কেন অন্যদলকে দেবেন না- এই প্রশ্নের উত্তর অনাদি, অনন্ত কালের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার কার্যকারণের সাথে জড়িত, চিরন্তনতার সাথে সংযুক্ত। আমরা সেই অনন্তে ছিলাম না, যেতেও পারব না, আল্লাহ আমাদেরকে এই বিশ্ব-লোকের সৃষ্টির সাক্ষ্য করেননি। এই বিষয়টি আমাদের সামাজিক ও ভাষিক যুক্তির উপকরণ দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। আল্লাহ কেন অসংখ্য গ্রহ উপগ্রহ কোটি কোটি বৎসরে সৃষ্টি করেন, কেন এগুলোকে নানান সৌন্দর্যে বিকশিত করেন, তারপর, ব্যাং!  এক আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলেন! আমাদের মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে এগুলো  বিচার করতে গেলে হিমসিম খেতে হয়।

এই বিশ্ব জগত আমাদের পুরোগামী (it precedes us)। এই অনন্ত লোকের দিকে তাকিয়ে তার নানান গঠন/সংগঠন কীভাবে হয় এবং কেন এটা এভাবে আর ওটা সেভাবে –এগুলো জানার মত বয়স আমাদেরকে দেয়া হয়নি। অনেক জিনিস বুঝার বস্তুও নয়। নবী রাসূলদেরকে আল্লাহ যা জানিয়েছিলেন, (একান্ত প্রয়োজন না হলে), তারা তাতেই তারা সন্তুষ্ট ছিলেন। কেননা তারা ছিলেন সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। বিলিয়ন বিলিয়ন বৎসরে গড়া আমাদের চারিধারের এই জগতের মার-প্যাচ জানার তেমন উপায় উপকরণ নেই। এটাই বাস্তবতা। আমরা সবকিছু জেনে শুনে এখানে আসি নি এবং সবকিছু জেনে শুনে এখান থেকে যাবও না। সবকিছু জেনে বুঝে তবেই যদি ‘বিশ্বাস’করতে হয়, তাহলে ৮০ মণ ঘিও আসবে না, রাধাও নাচবে না। সবকিছু জানার দুঃসাহস এক ধরণের ঔদ্ধত্য।

তকদীর

তকদীরের ব্যাপারটি যুক্তিজ্ঞানে জটিল থেকে যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে ওহীর প্রকৃতি এবং যুক্তি ও অযুক্তি তথা মানসিক সেন্টারের rationality/irrationalityএর অবস্থানিক পার্থক্য।  মানুষ একান্ত যুক্তি সর্বস্ব প্রাণী নয় আবার সে যুক্তির বাইরেও নয়। নবীর উপর যখন ওহী নাজিল হত, তখন তিনি আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় যৌক্তিক জগতের চেতনায় (consciousness-এ) থাকতেন না। তার অবস্থার পরিবর্তন হত। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত যেসব সাধকেরা ধ্যান-সাধনায় মনোনিবেশ করতেন, তাদের মানসিক চেতনা (consciousness) স্থানান্তরিত হত। অনুভূতির জগতে তারা অনেক কিছু বুঝতেন, যা সামাজিক/ভাষিক যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হত না। ভাষিক ব্যবহার হচ্ছে এক বস্তুর আলোকে (অর্থাৎ উচ্চারণ ও লিখার symbolic মাধ্যমে ) অন্য বস্তু বুঝানো, এটাই তার সিস্টেম, এবং এটা প্রকৃতিগতভাবে রূপক (metaphorical)। আর রূপকতা (metaphoricity) অকস্মাৎ যুক্তির ধারা ছেদন করতে পারে অর্থাৎ যুক্তির এক ধারাকে অন্য ধারায় মোড়িয়ে দিতে পারে, ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই ভাষায় যা কিছু বলা হবে তাতে দ্বৈততা, বৈপরীত্য থেকে যেতে পারে (because of its symbolic nature)। তাই সাধকেরা অনেক বৎসর অতিবাহিত না হলে নব্য-শিষ্যের সাথে তাত্ত্বিক আলোচনায় যেতেন না। যখন শিষ্যেরা ভাষায় নিহিত সমস্যার মার-প্যাচ অনুভূতিতে ধারণ করে, এই মাধ্যম বা tool-টির সীমাবদ্ধতার পর্যায়াদি আয়ত্ত করে, আলোচনার পর্যায়ে উপনীত হতেন, অর্থাৎ গুরুর বিবৃত কথার আপাতদৃশ্য ভাষিক অসামঞ্জস্যতা পুষিয়ে নেয়ার স্থানে পৌঁছতেন, কেবল তখনই গুরু-শিষ্য আলোচনা সংগঠিত হত।

কোরান নাজিলের সময় নবী করীম (সঃ) অর্থ-জগত ও রূপক জগতের  ( العالم المعنوي والعالم المثالي) যা কিছু হৃদয়ঙ্গম করতেন, বুঝতেন এবং তাঁর জ্ঞান-পরিধি যে সসব বস্তু পরিবেষ্টন করত, তা সর্বসাধারণ থেকে ভিন্ন। আমাদেরকে সে জগতের বিষয় ‘বিশ্বাস’ করতে বলা হয়েছে, যেহেতু আমরা সেই পর্যায়ে নেই। নবুওয়তের মাক্বামে পৌঁছার কোন পথ নেই –এটি হচ্ছে আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত।  ওহী নাজিলের মাধ্যমে আমরা যে বস্তুটি পাচ্ছি, যে বাণী পাচ্ছি, তা ‘ভাষায় প্যাক-করা’ বিবরণ। এ বিবরণ এমন এক জগত থেকে উদ্ভূত হয়েছে যেখানে যৌক্তিক/অযৌক্তিক (rationality/irrationality) এর পার্থক্য নেই, যেখানে স্থান ও কালের অনুভূতি ভিন্ন। এসব বিষয় বুঝতে হলে ধ্যানের জগতে চেতনা (consciousness) যেখানে rationality/irrationality -এর পার্থক্য অতিক্রম করে সেখানে পৌঁছতে হয়। যেহেতু বাণী ‘ভাষিক’ হয়ে পড়েছে, তাই ভাষা ও সমাজ কেন্দ্রিক তাবৎ জ্ঞান অর্জনও করতে হবে। এগুলো অনেক বৎসরের সাধনা ও ইবাদত-তপস্যার ব্যাপার।

কোরানের বিষয়াদি বুঝতে গিয়ে আবার কিছু আয়াতকে অন্য কিছু আয়াত দিয়ে চাবকানি (বাড়াবাড়ি) করলেই বুঝা সম্ভব নয়। এখানে সমস্যা হচ্ছে ভাষার এবং সামাজিক যুক্তির। যুক্তি আমাদের সৃষ্ট একটি মাধ্যম, এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে –যুক্তি স্থান ও কাল সর্বস্ব। মূল স্থানে না গিয়ে আয়াতকে আয়াত দিয়ে চাবকানি করাতে সমাধান নেই, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এটা করতে নিষেধ করেছেন। মসজিদে এমন কিছু বিতর্ক লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, তোমাদের কি হল যে তোমরা কোরানের এক অংশ অন্য অংশ দিয়ে কশাঘাত করছ? তোমাদের পূর্ববর্তীরা এভাবেই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। (আহমদ/ইবন মাজাহ)।

 

যা যুক্তির মত দেখা যায়

কোরানের যে সব আয়াতে জীবন-জগতের যুক্তির বিষয়াদি আসতে দেখা যায়, সেগুলো সাধারণত দুই ধরণের যুক্তি বহন করে। একটি চিরন্তন, যেখানে এই এহসাস পাওয়া যায় যে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া এখানে আর কিছুই ঘটে না, ভাল-মন্দ বিশেষণ আরোপণের ঊর্ধ্বে, সবকিছুই  তার দিকেই সমন্বিত। আর অন্যটা হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের সামাজিক যুক্তিবাহী কথা। যেমন আমরা দৈনন্দিন জীবনের কথাবার্তায় কর্তা ও ক্রিয়াপদকে সংগঠিত বিষয়ের সাথে সমন্বিত করি এবং তাতে যে যুক্তি অনুভব করি, তাই। যেমন আমি বললাম, ‘আমার পিতা একটি ঘর বানিয়েছেন’। এখানে ঘর বানানোর সাথে আমার পিতার কর্ম, ইচ্ছা ও সামর্থ্য সম্পর্কিত হয়েছে –আল্লাহর ইচ্ছা ও তার তকদীরের সাথে সম্পর্কিত নয়। মূল বাক্য যদি এভাবে বলা হত, ‘আমার পিতা আল্লাহর হুকুমে এবং তাঁর সাহায্যে একটি ঘর বানিয়েছেন’, তবেই তা বিশ্বাসের যুক্তিতে খাপ খেত, চিরন্তন যুক্তিতে যেত। কিন্তু সব কথা যদি এভাবে দীর্ঘায়ত করা হয় তাহলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তাই বস্তু জগতের কার্যকারিতার সাথে আমাদের কর্মকে সংযুক্ত করে আমরা সচরাচর যে আলাপ আলোচনা করে থাকি এবং যুগ যুগ ধরে করে আসছি, তাই প্রথাগত হয়ে পড়েছে। এখানে আমরা নিজেরাই কর্তা-পদে থাকি, বিশ্বাসে কোন বিঘ্নতা আসেনা। সব ভাষাতেই এই প্রথা, এই বৈশিষ্ট্য। আর কোরান যেহেতু আরবী ভাষায় বিবৃত হয়েছে তাই সেখানে ভাষার বৈশিষ্ট্যাদি স্থান পেয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর ব্যাখ্যা শুরু হলে সেখানে সব কিছুর উৎসই আল্লাহর দিকে সমন্বিত হবে।

যা মানুষের  কর্ম স্বাধীনতার মত দেখায়

দৈনন্দিন জীবনের ভাষিক-যুক্তির উৎস সমাজ ও সামাজিক বিশ্বাসের সাথেও সম্পর্কিত থাকে। ভাষা তার  ব্যবহার প্রক্রিয়ায় সেই বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে পরিবহন করে চলে। অনেক পৌত্তলিক সমাজ/সভ্যতার নানান বিশ্বাস ভাষার বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে প্রথাগত হয়ে থাকতে পারে। কোনো জাতি তাদের ধর্ম পরিবর্তন করে অন্য ধর্মে চলে গেলেও পূর্ব প্রথার কিছু কিছু জিনিস সেই ভাষার অংশ হয়ে নতুন ধর্মে প্রবেশ করে (migrates into the other) এবং যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকতেও পারে। ভাষিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান (linguistic archaeological investigation)   চালালে তা ধরা পড়তে পারে। একটি ভাষার সুদীর্ঘ জীবনে (within the long span of a language’s life) তার ব্যবহারকারীরা ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়। অন্য ধর্ম, বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে বিপরীতধর্মী অভিব্যক্তির (expression) আগমন ঘটে, সময়ের সাথে কিছু কিছু বৈপরীত্যের সামঞ্জস্য ঘটে আবার অনেক জিনিসের সামঞ্জস্য হয় না। পূর্ব ও পরের ধারণাগত বিগ্রহ থেকেই যায়। যেমন আমরা সিলেট জেলায় বলে থাকি, ‘আল্লাহ চাল ফুঁড়ে লাল দেন না’ –এই কথাটি Free Will এর বিশ্বাস থেকে এসেছে, তকদীরের বিশ্বাস থেকে নয়। কেননা, আল্লাহ যার তকদীরে ‘লাল’ (টাকা/সম্পদ) রেখেছেন, সে ঘরে বসে থাকার অবকাশ পাবে না, তাকে বেরিয়ে পড়তেই হবে, সেই অনুভূতি, সেই জ্বালা তার অন্তরাত্মায় সৃষ্ট হবে এবং সেই তাড়াই তাকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাবে। অথবা অন্য কোথাও থেকে আল্লাহ তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন –যার কল্পনাও সে করেনি। মানুষের স্বাধীনতা/অধীনতার দর্শন হাজার হাজার বৎসর থেকে স্থান, কাল, ধর্ম, দর্শনের ময়দান চরে বেড়াচ্ছে। সেক্যুলার জগতে এই টান-পোড়েন  free will versus social determination এবং free will versus genetic determination এ পর্যবেশিত হয়েছে। আমরা আল্লাহর ইচ্ছার determination-এ বা তকদীরেই বিশ্বাসী। এই বিশ্ব জগতে কেবল আল্লাহর শক্তি ছাড়া আর ছোট/বড় কোন কিছুই determine করতে পারেনা। আমরা ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলে এই ধারণার ঘোষণা দেই। আমার তকদীর আমিই গড়ি –এমন ধারণা ইসলামী নয়। এই বিশ্বে যদি আর কেউ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে এবং সে শক্তি যদি আল্লাহ থেকে ভিন্ন হয়, তবে এমন (গাইরুল্লাহর) ধারণা শিরক হবে। আমরা যে কাজ করার ইচ্ছা লাভ করি এবং যে কাজ সম্পাদন করার শক্তি পাই –তা আল্লাহ থেকেই আসে। আল্লাহ বলেন, ‘ওয়া তাশাউনা ইল্লা আউইয়াশা আল্লাহু রাব্বুল আলামীন’ –অর্থাৎ তোমরা ইচ্ছাই করতে পারবে না যদি আল্লাহ ইচ্ছা না করে থাকেন।

যা বলা হল তাতে ভুল কিছু থাকলে আল্লাহর ক্ষমা ও তাঁর আশ্রয় কামনা করি। সব সত্য কেবল আল্লাহই জানেন।

Loading

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

Comments

যুক্তি, বিশ্বাস ও কোরান — 4 Comments

  1. {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54} {54}

  2. খুবই তাত্মিক ও জ্ঞানগর্ভ একটি লিখা এবং অনেকের জন্য চিন্তার খোরাক জোগাবে বলে আমার বিশ্বাস।

    “যুক্তির আগের মূহুর্ত্তটি হচ্ছে সুপ্ত আবেগের পরশ লাভ, ইতি বা নেতির কোমল দোলনা লাভ। যুক্তি হচ্ছে simply একটা হাতিয়ার (tool). বৃহৎ অর্থে গোটা ভাষাটাই একটি tool. কোনো ছেলে যদি একটি মেয়েকে ভালবেসে ফেলে, তখন সে তাকে কেন বিয়ে করতে হবে –এর পক্ষে যুক্তি পেতে কোন অসুবিধে হবে না। “
    তার মানে সুপ্ত আবেগের পরশে আপ্লুত বিশ্বাস আগে তার পর আসবে যুক্তি। এ জন্যই হয়তো আল্লাহ বলেছেন : “ওমাই ইউমিন বিল্লাহি ইয়াহ্ দি কাল্বাহূ (সুরা তাগাবুন ৬৪:১১) যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে তিনি তার অন্তরকে (ক্ষাল্বকে) সুপথে পরিচালিত করেন।”

    এ প্রসঙ্গে কথা হল ধর্মনিপেক্ষবাদীরা প্রায়ই বলে থাকেন “ধর্ম হচ্ছে একটি অন্ধ বিশ্বাস এখানে যুক্তির কোন অবকাশ নাই”
    এখন প্রশ্ন হল ইসলাম কি সত্যিই অন্ধ বিশ্বাসের এক ধর্ম এখানে যুক্তির কি কোন প্রয়োজন নাই ? এ প্রশ্নের আংশিক কিছু উত্তর এসেছে নিম্নের বক্তব্যে:
    “আমাদেরকে ঈমানের দিকে আহবান করা হয়েছে, আসমান জমিনের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করা হয়েছে, গোটা সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করতে আহবান করা হয়েছে যাতে করে আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করতে পারি এবং তাঁর অনুগত হতে পারি। কিন্তু সেখানে এই হুমকিও রয়েছে যে যদি আমরা ঈমান আনতে ব্যর্থ হই এবং তাঁর অবাধ্য হয়ে পড়ি, তবে আমাদেরকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। এখানে আবেদন যুক্তি সংগত থাকত যদি বলা হত যে আসমান আর জমিনের দিকে তাকাও এবং দেখ ঈমান আনতে পার কি না। পারলে পেরেছ, না পারলে নাই –এতে কোন জোরাজুরি নেই, এতে শাস্তি-পুরষ্কারের কিছু নেই। কিন্তু বিষয়টি এভাবে আসেনি। এখানে আসমান আর জমিনের দিকে তাকানোর আহবান প্রচলিত অর্থের নিছক যুক্তির আহবান নয়, কেননা এই যুক্তি হচ্ছে সামাজিক ও ভাষিক, এটা ভাষার প্যাচে সৃষ্ট একটি দুর্বল উপকরণ। তাই আহবান হচ্ছে অন্তরাত্মা দিয়ে ধ্যান ও তপস্যামূলক আহবান। এই তাকানোতে যুক্তিপূর্ব মুহুর্ত্তের ‘ক্বালবি’অনুভূতির প্রতি আহবান, এটা হচ্ছে লুবাবের ব্যাপার। “

    তবে এ বিষয়ে অরো কিছু ব্যখা করা দরকার। অদৃশ্যে বিশ্বাস আর অন্ধ বিশ্বাস কি এক জিনিস?

    • প্রশ্নঃ “এ প্রসঙ্গে কথা হল ধর্মনিপেক্ষবাদীরা প্রায়ই বলে থাকেন “ধর্ম হচ্ছে একটি অন্ধ বিশ্বাস এখানে যুক্তির কোন অবকাশ নাই”। এখন প্রশ্ন হল ইসলাম কি সত্যিই অন্ধ বিশ্বাসের এক ধর্ম এখানে যুক্তির কি কোন প্রয়োজন নাই ?”

      অন্ধ বিশ্বাস

      ভাই, আমরা যে বিতর্ক পেয়েছি তার ইতিহাস অনেক পুরনো। এনলাইটনম্যান্টের উপর যে ব্লগটি আমি জানালায় ছেপেছিলাম, সেটি মনে থাকলে স্মরণ করুন। ‘অন্ধ’-ধারার কথাবার্তা আসছে ‘যুক্তিবাদ’ও ‘বিজ্ঞানবাদের’ আন্দোলন থেকে অর্থাৎ এনলাইটম্যান্টের আধুনিকতাবাদের (মডার্নিজমের) অত্যুৎসাহী অভিলাষ থেকে। এই আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় ১৭৮৯ ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে, বাদশাহ ষোড়শ লুইসের শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে এবং সমাপ্তি ঘটেছে ১৯৮৯ কমিউনিস্ট বাস্তবতার প্রতীকী পতনে, বার্লিন ওয়াল ধূলিস্যাতের মাধ্যমে, যদিও এর জের এখনও চলছে এবং আরো অনেক কাল পর্যন্ত চলার কথা, এটাই মানব দর্শন ও চিন্তার স্বাভাবিক নিয়ম।
      লক্ষ্য করুন, এখানে বিশ্বাসের সাথে “অন্ধ” বিশেষণটি মিছামিছি জোড়ে দেয়া হয়েছে। আপনি যে বিষয় সম্পর্কে জানেন না, যা আপনার যুক্তিতে ধরে না, তা “অন্ধ” বিশেষণে বিশেষায়িত করা হবে কেন? “খোদা নাই” –এটাও যুক্তিতে প্রমাণিত নয়, তাহলে নাস্তিক্যবাদও “অন্ধ”। প্রকারান্তরে অজ্ঞেয়বাদও “অন্ধ” হতে পারে, কেননা খোদা-প্রসঙ্গে এই অবস্থান “অজ্ঞতা” প্রকাশ করে এই অর্থে যে সে হ্যাঁ/না কিছুই জানেনা, তাই তার স্থান “অন্ধকার”না হলে নীরব থাকবে কেন?
      এই জগতের যা কিছু আপনার সামাজিক ও ভাষিক যুক্তি ধারণ করবে না, তার সবকিছুই কী “অন্ধ”? এই “অন্ধ” শব্দটি জোড়ে দেয়াই হচ্ছে একটা “চালাকি”। যারে দেখতে নারি, তার চরণ বাঁকা। আপনার চরণের দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন, আপনারটা সোজা না বাঁকা, [আপনাকে mean করছি না, বরং প্রেক্ষিতগত প্রবক্তাকে]। এখানে অন্ধ বিশ্বাস বলে যে ভাষিক চালাকি করা হল, এবং তা করতে গিয়ে ভাষাকে যেভাবে ব্যবহার করা হল, তা এখানে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কারণ এখানে অতি ক্ষুদ্রাকারে, বাক্যাংশে (phrase) ‘অপব্যবহারটি’ ধরা পড়ছে। ভাষার মার-প্যাচের বিষয়টি যখন পুস্তকাকারে বৃহৎ হয়, তখন সর্বসাধারণের পক্ষে তার মোকাবেলা করতে হিমসিম খেতে হয়। আপনি বিশ্বাসের সাথে “অন্ধ” বিশেষণ ঢালবেন কেন, “ঔজ্জ্বল্য” ঢালবেন না কেন? বিশ্বাসে অন্তরাত্মা ঔজ্জ্বল্য লাভ করে, মানুষ আল্লাহর অস্তিত্বে তার মনের সায় অনুভব করে। যারা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে “অন্ধ” বিশেষণ “নির্বাচন” করে, তাদের এই নির্বাচনই তাদের নিজ গোঁড়ামি অবস্থানের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
      পক্ষান্তরে প্রপোজিশন যদি এই হয় যে যা-কিছু প্রমাণ করা যায় না, তাই হবে “অন্ধ”, তাহলে বিজ্ঞানবাদ ও যুক্তিবাদের অনেক কিছুও অন্ধ। বিবর্তনবাদও অন্ধ, কেননা তা indisputable-ভাবে প্রমাণিত নয়।
      এখানে একটি ক্ষুদ্র phrase (‘অন্ধ বিশ্বাস’) -এর ভাষিক ব্যবহার কীভাবে বুঝের অবস্থানকে এক জাগা থেকে জাগায় নিয়ে যাচ্ছে -তার প্রতি লক্ষ্য রাখুন। এখানে ‘অন্ধ’বিশেষণের বাইরে গিয়ে metaphor হয়ে কাজ করছে, রূপকতার অবতারণা করে ‘যুক্তিকে’ স্থানচ্যুত করছে, metaphor breaks logic। এসব ধারণা অনেক জটিল, এগুলো সামান্যতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে দর্শনে যখন এই সত্য ব্যাপকভাবে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে,(that it’s a play of metaphors), তখন আধুনিকতাবাদের দর্শন প্রাণ হারায়, এনলাইটনম্যান্ট (বিজ্ঞানবাদ/যুক্তিবাদ) নিস্তেজ হয়ে পড়ে, মার্ক্সবাদও (যা ছিল সেই এনলাইটনম্যান্ট প্রজেক্টের অংশ) হোঁচট খেয়ে উলটে পড়ে, এখানে যা দেখা যায় তার সবই ভাষার খেলা. দেখি, সময় করতে পারলে আমাকে এর উপর আরো লিখতে হবে।
      শেষ কথা। আমরা ওহীতে প্রাপ্ত বাণীতে বিশ্বাস ও অন্তরাত্মার স্বীকৃতির পর, যুক্তিকে হাতিয়ার (tool) হিসেবে পাচ্ছি, হাতিয়ারকে অস্বীকার করছি না, এর ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি, এবং তার আপন স্থানে প্রয়োগও করি, যেমন একখানা ছুরিকাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি। ভাষার প্যাচের সামাজিক যুক্তিকে আমরা ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে (infallible) ভাবি না, এটাকে দেবতা করে নেই না, কোরান হাদিসকে এই দুর্বল ভিত্তির স্থাপন করি না। আমাদের আলেম/ওলামারা মু’তাজিলা আন্দোলন থেকেই এর দূর্বলতা ঠের পেয়ে গেছেন, তাই তাত্থেকে সরে গিয়ে আমরা বেঁচে গেছি এবং অনুবাদের মাধ্যমে মধ্যযুগে যখন মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞান বিস্তার লাভ করে তখন তারা মু’তাজিলি হাতে গ্রীকদের দর্শনের ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্ধনকেও বুভুক্ষ প্রাণীর মত গিলে ফেলে আর এতে যে বিষ-বীজ সুপ্ত ছিল তা সপ্তম শতাব্দীতে মহীরূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে, কারণ এখানকার গীর্জিয় নির্যাতন, রাজকীয় নির্যাতনের রাজনীতি, সামাজিক বাস্তবতার মৃত্তিকা সেই বীজের অংকুরণের অনুকুল ছিল। যদিও আমরা যুক্তিকে কোরান হাদিসের অগ্রমাগী করি না, তবে অনুগামী করতে বাধা দেখিনা, ব্যাখ্যার tool হিসেবে এর যথার্থ ব্যবহার করি, এটাই হচ্ছে যুক্তির আসল স্থান।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *