২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে ‘শোক দিবস’ পালন করা হোক

সামনে ২৫ ফেব্রুয়ারি। ঠিক তিন বছর আগে ২৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবসি’ত পিলখানায় একটি জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। সে হত্যাকাণ্ডের ফলে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন মেধাবী তরুণ বা মধ্যবয়সী কর্মকর্তা নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিক কর্তৃক। বিডিআরের বর্তমান নাম বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ, সংক্ষেপে যার নাম বিজিবি। নাম বদল করলেই সব স্মৃতি মুছে যাবে, নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে- আসলে এমনটা নয়। বিডিআরের পিলখানা হত্যার সাথে দুর্বিষহ স্মৃতি সমগ্র বাংলাদেশের সচেতন মানুষের মনে আজো সমুজ্জ্বল হয়ে ভাসছে। তাই আজ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এ প্রসঙ্গে দু-চারটি কথা লিখছি।

সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা করার প্রবণতা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ। অনেক কলামে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এ সম্পর্কে লিখেছি। আমার লেখা পুস্তক মিশ্র কথন নামের গ্রনে’ দীর্ঘ আলোচনা করেছি এ বিষয়ে। বিখ্যাত প্রকাশনা সংস’া ‘অনন্যা’-এর একুশের বইমেলার স্টলে, পুরনো বিমানবন্দরের কাছে প্রধান সড়কে অবসি’ত শোরুম ‘বুক ওয়ার্ম’-এ এবং বেইলি রোডে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস’া ‘সাগর পাবলিশার্স’-এর শোরুমে বইটি পাবেন। এই পুস্তকে কৃত আলোচনাটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য এবং বর্তমান প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তরুণ সেনাকর্মকর্তাদের জন্য।

ওই সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে একটি গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস’া নামে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সে সৈনিক সংস’ার সদস্য ছিলেন কিছু জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং কিছু সাধারণ সৈনিক। তাদের প্রয়োজন ছিল একজন রাজনৈতিক মুরব্বির বা একটি রাজনৈতিক সংগঠনের যারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবেন। অপরপক্ষে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জন্ম নেয়ার পর ’৭৩-৭৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক প্রতিবাদী ও সংগ্রামী রাজনৈতিক দল ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, যাকে আমরা জাসদ হিসেবে চিনি। জাসদ চিন্তা করল, নিয়মতান্ত্রিকভাবে বা রাজপথে রাজনৈতিক আন্দোলন করে সরকারকে উৎখাত করা যাবে না, পরিবর্তন করা যাবে না। তাই অনিয়মতান্ত্রিক পন’ায় তাদের উৎখাত করতে হবে। তাদের লক্ষ্য ছিল, হয় সেনাবাহিনীর অফিসারেরা বিদ্রোহ করবেন অথবা সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা বিদ্রোহ করবেন। সে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেবে জাসদ। উভয়ের সম্মিলিত শক্তিতে গঠিত হবে নতুন জাতীয় রাজনৈতিক সরকার। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ সৃষ্টি করেছিল একটি রাজনৈতিক যোদ্ধাবাহিনী। এর নাম ছিল ‘গণবাহিনী’। সে বাহিনীর প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম। সে সময় জাসদের নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তা মেজর (অব:) এম এ জলিল, হাসানুল হক ইনু (যিনি বর্তমান সরকারের একজন মাননীয় সংসদ সদস্য), আ স ম আবদুর রব (বর্তমানে জাসদ একটি অংশের সভাপতি এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমলে বিরোধীদলীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগের সাবেক আমলে মন্ত্রী)। যখন বিপ্লবী সৈনিক সংস’ার উদ্যোগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্ররোচনায় একটি বিদ্রোহ সংঘটনের প্রস’তি প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন পরপর দু’টি দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হয়। তার মধ্যে একটি হলো, ১৫ আগস্ট একদল অফিসার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় যার ফলে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। দ্বিতীয় দুঃখজনক ঘটনা ছিল, ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার কর্তৃক একটি ক্যু বা সামরিক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এসব কর্মকাণ্ড দেখে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস’া অসি’র হয়ে পড়ে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, আর দেরি নয়। তাই তারা এ সুযোগে তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস’াসহ যৌথ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলো, বিপ্লব ঘটাবেই। তারিখ ছিল নভেম্বর মাসের ৭। ওই আমলে জাসদের প্ররোচনায় বিপ্লবী সৈনিকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অথবা বিপ্লবী সৈনিক সংস’ার প্ররোচনায় জাসদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিশেষ পদ থেকে অপসারণ করতে হবে, বিদায় করতে হবে। এর একটি মাত্র পন্থা; তা হলো তাদের হত্যা করা। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা করতে হবে। কারণ, তাদের সব বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রধান বাধা হচ্ছেন সেনাবাহিনীর অফিসারেরা। কারণ সেনাবাহিনীর অফিসারেরা সি’তিশীলতায় ও প্রথাগত নিয়ম-শৃঙ্খলার মতাদর্শে বিশ্বাসী। অতঃপর বিপ্লব এগিয়ে যাবে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ সন্ধ্যায় আমি শুনতে পাই সৈনিকের মুখে মুখে এ স্লোগান- ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’ এবং একটি লিফলেটে স্পষ্ট আকারে লেখা ছিল, অফিসারের রক্ত চাই। সে সময়ের বিপ্লবসংক্রান্ত নানা লেখা চোখে ভেসে ওঠে।

যেই কথা সেই কাজ। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ রাত ১২টার পর যে বিপ্লব শুরু হয়, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে খতম করা। বেশ কিছু সেনাকর্মকর্তা নিহত হন। কথাগুলো বলার পেছনে কারণ হলো, ১৯৭৫ সালে একটি মন্দ দৃষ্টান্ত  স্থাপিত হয়েছে, যা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ছিল। সেটাকে অনুসরণ করে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫ তারিখের আগে ষড়যন্ত্রকারী (বর্তমান) বিজিবির কিছু সদস্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেনাবাহিনীর অফিসারদের খতম করতে হবে। তাদের হত্যা করতে পারলে উদ্দেশ্য দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্য মাথায় নিয়ে ২৫ তারিখ সারা দিন-রাত মোট ৫৭ জন সেনাবাহিনীর অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। এটা এতই ন্যক্কারজনক যে, তার উপমা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন সাধারণ বাঙালি সৈনিক দলের ওপর মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গুলি করে হত্যা করেছিল। অথবা, ১৯১৮ সালে পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা ব্রিগেডিয়ার ডায়ার নামে একজন ব্যক্তির হুকুমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর গুলি করেছিল। এমনই একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ পিলখানায় ঘটে যায়।

এ হত্যাকাণ্ডকে জাতীয়ভাবে উপযুক্ত মূল্যায়ন করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব, একটি আহ্বান, একটি দাবি। তা হলো- দিবসটিকে জাতীয়ভাবে শোক দিবস পালনের ঘোষণা করা হোক। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ৫৭ জন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, তা জাতীয়ভাবে শোক দিবস হবে কেন? আমাদের পক্ষ থেকে বিনীত ব্যাখ্যায় বলব, সেনাবাহিনী কোনো দলের সম্পত্তি নয়, কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পদ নয়। তারা সমগ্র জাতির সম্পদ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী ও স্বাধীনতাকামী মানুষের গর্ব। সেনাবাহিনীর ওপর যে আঘাত এসেছে, তাতে সমগ্র জাতি সেদিন মর্মাহত হয়েছে। আজো হৃদয় থেকে তার রেশ কাটেনি। সে শোকের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা যেন প্রতিনিয়ত দৃঢ় থেকে সুদৃঢ় হয়, তাই দিবসটিকে জাতীয়ভাবে শোক দিবস পালন করার আহ্বান জানাচ্ছি, প্রস্তাব করছি, দাবি জানাচ্ছি। আশা করি, কর্তৃপক্ষ এর উপযুক্ত মূল্যায়ন করবেন। যে ক্ষতি ২০০৯ সালের ২৫ তারিখ হয়েছে সে ক্ষতি তাৎক্ষণিক পূরণ হওয়ার নয়। গত তিন বছরেও তা পূরণ হয়নি। কারণটি একটু ব্যাখ্যা করলে বোঝা যাবে। যদি একজন কর্নেল শহীদ হন, যার চাকরির মেয়াদ ২৪ বছর, তার স’লে পদোন্নতি দিয়ে একজন লে. কর্নেলকে কর্নেল বানাতে পারবেন, লে. কর্নেলের স’লে একজন মেজরকে পদোন্নতি দিয়ে লে. কর্নেল বানাতে পারবেন, মেজরের স’লে একজন ক্যাপ্টেনকে পদোন্নতি দেবেন, ক্যাপ্টেনের জায়গায় একজন লেফটেন্যান্টকে পদোন্নতি দেবেন এবং একজন লে.-এর জায়গায় একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্টকে পদোন্নতি দেবেন। কিন’ সেকেন্ড লে. হতে গেলে আরো দু’বছর প্রশিক্ষণ লাগবে; তার আগে ছয় মাসের নির্বাচনপ্রক্রিয়া লাগবে। যদি হঠাৎ করে সব পাওয়া যেত, তাহলে চাকরির অভিজ্ঞতার আর কোনো মূল্য থাকত না। তাই সে অপূরণীয় ক্ষতিতে আমরা আজো শোকাহত। সে শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকে আমরা সহানুভূতি জানাই। কামনা করি, তারা যেন সে শোক কাটিয়ে ওঠেন। আনন্দের একটু পরশে তাদের মনটাও ভরে উঠুক। তাদের সন্তানেরা যেন বড় হয়ে সমাজে যথাযোগ্য জায়গা করে নিতে পারে।

আজকের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ স্মরণে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলা। সে প্রসঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পরোক্ষ নিয়মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় স্তম্ভ। জাতিসঙ্ঘ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুর্যোগপূর্ণ, রাজনৈতিক গোলযোগপূর্ণ, সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি স্থাপনের জন্য অনেককে দাওয়াত দিয়ে থাকে। যাদের দাওয়াত দেয়া হয়, তাদের বলা হয় শান্তিরক্ষী বাহিনী। তারা বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর অংশ। কেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকাণ্ড পররাষ্ট্রনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণস্তম্ভ সেটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা তথা সেনাসদস্যের দল জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কর্তব্য পালনের মাধ্যমে দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করে সুনাম বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন। সিয়েরা লিয়ন দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দল এতই সুন্দর ভূমিকা পালন করেছে যে, কাজের মাধ্যমে তারা ওই দেশের মানুষের মন জয় করে ফেলেছে। ওই দেশের মানুষের মনে, সরকারের মনে বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। এ কারণে তারা বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানাতে সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তটা ছিল, সিয়েরা লিয়নের সরকার বাংলা ভাষাকে তাদের দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা তাদের দেশে বাংলা ভাষাকে সরকারিভাবে চর্চা করছে। এটা যে কত বড় গৌরবের বিষয় আমাদের জাতির জন্য, তা হয়তো আমরা অনেকেই কল্পনা করতে পারছি না। এই সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জনের পেছনে শতভাগ অবদান সে দেশে অতীতে অবস’ানরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ও সৈনিকদের। দ্বিতীয়ত, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা যে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন সেটা বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারে পান এবং সেই ডলার বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের দেশে পাঠানো হয়। এর একটি অংশ পান বাংলাদেশ সরকার। বৃহৎ অংশ সৈনিকেরা পেয়ে থাকেন। এটা বর্তমানে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরাট ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন যানবাহন এবং বিভিন্ন বড় বড় যন্ত্রাংশ, যা বিভিন্ন দেশে কর্তব্য পালনকালে লাগে। যদি আমাদের সৈনিকেরা বিদেশে দায়িত্ব পালনে না যেতেন, তাহলে এসবের প্রয়োজন পড়ত না। পরে এসব আধুনিক যন্ত্রপাতি ও যানবাহন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াতে সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হয়।

শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সদস্য প্রেরণ প্রসঙ্গে দু’টি কথা এখানে বলা প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ থেকে যাদেরকেই পাঠানো হয়, তারা সবাই চাকরিরত। তারা এক বছর বা এর অল্প কিছু বেশি সময়ের জন্য যান। উদাহরণস্বরূপ এই মুহূর্তে যদি চার শ’ সেনাবাহিনী অফিসার ও ১০ হাজার সৈনিক বিদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কর্মরত থাকেন, তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। যেহেতু দীর্ঘ দিন ধরেই এই রেওয়াজ চলছে, তাই এই ঘাটতি নিয়ে দায়িত্ব পালনের বিষয়টিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। তবে ঘাটতি নিয়ে দিন কাটানোর নেতিবাচক প্রভাব আছে। বিশেষত সেনাবাহিনীর ওই অংশগুলো সেবামূলক কাজে নিয়োজিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কর্নেল, লে. কর্নেল ও মেজরদের মধ্যে যারা জ্যেষ্ঠ তাদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগই বিদেশে একবার শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন, অনুমান মতে অন্তত ৫০ ভাগ দু’বার করেছেন এবং আনুমানিক অন্তত ১০ ভাগ আরো একবার করেছেন। সৈনিকদের মধ্যেও দু’বার যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রস্তাব হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে যারা যাবেন, তাদের মধ্যে অন্তত ২৫ বা ৩০ ভাগ লোক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বেছে নিলে চাকরিরতদের ওপর চাপ কমবে। তবে অবসরপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রেও বয়সের শর্তাবলী, লেখাপড়া ও শারীরিক যোগ্যতার জাতিসঙ্ঘের বেঁধে দেয়া নিয়ম মোতাবেকই হবে। সম্ভবত ৫০ বছরের বেশি বয়স এমন সৈনিক বা অফিসার যেতে পারবেন না। আমার জানা মতে, বেশ কিছুসংখ্যক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজ নিজ উদ্যোগে জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বা ‘নড়াচড়া নেই’ (স্ট্যাটিক)- এমন দায়িত্বের চেয়ারে কর্তব্যরত আছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রমাণিত কর্মদক্ষতার কারণেই জাতিসঙ্ঘ কর্তৃপক্ষ এই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পছন্দ করেন। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্য অনেক দেশে উদাহরণ আছে, বিশেষত উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো থেকে। এর কারণ, তারা তাদের সেনাবাহিনীর ‘যুদ্ধের জন্য প্রস’তি’র যে একটা স্তর আছে সেটাকে জাতিসঙ্ঘের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমরা যুগপৎ দু’টি প্রত্যাশা করি। প্রথমত, শান্তিরক্ষা বাহিনীতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুনাম ও আর্থিক কল্যাণ বৃদ্ধি করা এবং আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত করা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর আদি ও মূল দায়িত্ব পালনের প্রস’তি ক্ষতিগ্রস্ত না করা।

এই অনুচ্ছেদ এবং ওপরের দু’টি অনুচ্ছেদে আলোচনাকালে ‘সেনবাহিনী’ বললেও, বাস্তবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীও আমার পক্ষ থেকে ইতিবাচক মূল্যায়ন ও প্রশংসার অনুরূপ অংশীদার। পিলখানার ঘটনায় ফিরে আসি। সেই নারকীয় ঘটনার পেছনে যে ষড়যন্ত্র আছে বলে দেশবাসী বিশ্বাস করে, তা আজো জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়নি। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছড়া এটা সম্ভব হয়নি এটা যেমন তাঁরা বিশ্বাস করে; আবার এটাও বিশ্বাস করে যে, এর সাথে কোনো না কোনো দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী যুক্ত আছে। তাই জাতীয় সংহতির স্বার্থে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের মনোবল বাড়ার স্বার্থে এসব ষড়যন্ত্রকারীর মুখ অবিলম্বে উন্মোচিত হোক, এটাই আমাদের কামনা। আমরা ওই দিনের অপেক্ষায় থাকলাম যে দিন সত্য সবার সামনে প্রকাশিত হবে।

[youtube]http://www.youtube.com/watch?v=MkPwhMIV0Wk[/youtube]

Loading


Comments

২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে ‘শোক দিবস’ পালন করা হোক — 2 Comments

  1. লেখাটি পড়ে অনেক ভালো লাগলো, আমি আপনার সাথে একমত যে ২৫ ফ্রেব্রুয়ারী জাতীয়ভাবে শোকদিবস পালন করা হোক। আশা করি সরকার এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিবে।

  2. ধন্যবাদ জেনারেল ইব্রাহিম। আমি আপনার সাথে একমত। আপনার রাজনৈতিক জোটকে বলুন ২৫শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় শোক দিবস পালন করতে। আপনি উদ্যোগ নিলেও আমি সমর্থন করবো।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *