২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের প্রেরণা

গত বুধবার ৬ আগস্ট নয়া দিগন্ত পত্রিকায় এবং গত রোববার ১০ আগস্ট কালের কণ্ঠ পত্রিকায় আমার লেখা দু’টি কলাম প্রকাশিত হয়েছে মূলত ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে। আগ্রহী পাঠক যদি না পড়ে থাকেন তাহলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই পত্রিকার আর্কাইভে ঢুকে কলাম দু’টি পড়তে পারেন অথবা আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে ভিজিট করেও পড়ে নিতে পারেন। ৬ আগস্টের নয়া দিগন্তের কলামে বলে রেখেছিলাম, ১৩ আগস্ট আমার কলামটি শেষ হবে। এ মুহূর্তে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিবেদন হলো, ৬ আগস্ট নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত দীর্ঘ কলামে আমার নিজের বক্তব্য খুব কম ছিল। কেউ কলামটি পড়ে, কেউ কলামটিতে মাত্র চোখ বুলিয়েই সন্তুষ্ট হয়েছেন অথবা অসন্তুষ্ট হয়েছেন এবং কলামের বেশির ভাগ কথা যে অন্য ব্যক্তির, সেটা উপলব্ধি করতে দেরি করেছেন। শুভাকাক্সীরা বলেছেন, আমার নিজের বক্তব্য যেন ১৩ তারিখে দিই। আজকের কলামে শুরু করতে চাই ৯টি পয়েন্ট দিয়ে, অর্থাৎ জনগণ কী চায় অথবা জনগণের অনুভূতি কী, তার একটা সারমর্ম দিয়ে।

জনগণের অনুভূতি ও চাওয়া

গত এক মাস ১০ দিনে ২০ দলীয় জোট কর্তৃক পরিচালিত করা হবে, এমন সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনামূলক সংবাদ বা কলাম প্রচুর ছিল। ওইসব সংবাদ বা কলাম বা ভাষ্য ও প্রাসঙ্গিক টকশোগুলো শুনে আমার যে ধারণা জন্মেছে, সেটার সারমর্ম পয়েন্ট আকারে উপস্থাপন করছি। (১) নেতৃত্বে আস্থা। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি মানুষের আস্থা এখনো অটুট। জনগণের দৃষ্টিতে তারেক রহমানের কর্মকাণ্ড, লেখালেখি ইত্যাদি অতি উৎসাহব্যঞ্জক এবং আন্দোলনকারীদের জন্য প্রেরণাস্বরূপ। সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রধানতম নির্বাহী হিসেবে বিএনপি মহাসচিবের ওপরেও ২০ দলীয় জোটের কর্মীদের আস্থা নিরবচ্ছিন্ন আছে। সরকারের প থেকে দেয়া অগণিত কেসের ভারে কাবু না হয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার স্পৃহা সমুজ্জ্বল রেখে তিনি নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করছেন। (২) সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জগুলো। বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ, তবে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ঢাকা মহানগরকে সচল ও গতিশীল করা। এই কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। ঢাকা মহানগর গতিশীল হলে, বাকি বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। প্রধান শরিক বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্বকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে হবে। কেউ কেউ এই প্রক্রিয়াকে সংস্কারও বলেন। (৩) সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা। দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা প্রয়োজন। সমগ্র দেশব্যাপী সাংগঠনিক স্তরগুলোতে পারস্পরিক সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। (৪) কর্মসূচির প্রকৃতি। শুরুতেই কোনো আক্রমণাত্মক কর্মসূচি না দিয়ে নিতান্তই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা এবং পারস্পরিক আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির উদাহরণ, মৌন কিংবা সরব গণমিছিল, কালো পতাকা মিছিল, ডোর টু ডোর বা অলিগলিতে জনসংযোগ, গণ-অবস্থান, গণ-অনশন, বিােভ সমাবেশ, প্রতিরোধ সমাবেশ, বিােভ মিছিল, মৌন মানববন্ধন, কালো পতাকাসহ মৌন মানববন্ধন ইত্যাদি। হরতাল-অবরোধ অবশ্যই দেয়া যাবে, তবে সেটা প্রথম দিকে নয়। (৫) আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে বাধ্য করতে হবে নতুন নির্বাচন দিতে। আন্দোলনবিহীন সরকারবিরোধী জোটকে কোনো বিদেশী শুভাকাক্সীও সহায়তা করবেন না। রাজপথে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি অন্যান্য সম্পূরক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। যেমনÑ কূটনৈতিক মহল থেকে শুভেচ্ছাপ্রাপ্তি অব্যাহত রাখা, দেশের ভেতরে পেশাজীবীদের প থেকে শুভেচ্ছাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা ইত্যাদি। (৬) জোটের শরিক সম্পর্কিত। জোটের শরিকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি একটি সুসংবাদ। শরিক দলগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক ও আস্থার সম্পর্ক যেন অব্যাহত থাকে ও বৃদ্ধি পায়, সেটা সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। জোটের সব শরিকের সাংগঠনিক বা অর্থনৈতিক বা নেতৃত্বভিত্তিক বা মেধাভিত্তিক সমতা ও দতা এক নয়। বাংলা ভাষার প্রবাদ মোতাবেক, কোনো শরিকের ভার বেশি আবার কোনো শরিকের ধার বেশি। কোনো শরিকের উভয়টাই বেশি, কোনো শরিকের দু’টিই দুর্বল, কোনো শরিকের দু’টিই কিছু কিছু। জোটের শরিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে; বিশেষত প্রধান শরিক বিএনপি এবং দ্বিতীয় বৃহৎ শরিক জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে। জোটে যেহেতু অনেক শরিক, তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখা, তাদেরকে আস্থায় রাখা, তাদের ুদ্রাতিুদ্র শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য অভিনব বা সময়োপযোগী পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। (৭) অঙ্গসংগঠনের সমন্বয় ও আস্থা। শরিক দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যেও সমন্বয় সৃষ্টি করতে হবে, বিশেষত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধ্যে। গত ৫০-৬০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়, ছাত্রসমাজ সরকারবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকেছে। এখনো কোন পন্থায় এ কাজটি নতুনভাবে করানো যায়, সেটা চিন্তা করতে হবে। (৮) মতবিনিময়। আন্দোলন সম্পর্কিত রাজনীতির কিছু তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিষয়ের ওপর সব সাংগঠনিক স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা ও মতবিনিময় প্রয়োজন। তার জন্য সিনিয়রদের প থেকে দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। (৯) রাজনৈতিক প্রতিপরে কৌশল মোকাবেলা। ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক প্রতিপ হচ্ছে, বর্তমান শাসক দল বা শাসক জোট এবং তাদের ছদ্মবেশী সহযোগীরা। শাসক দল তাদের হাতের নাগালে পাওয়া, সর্বপ্রকারের রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অথবা আধা সরকারি অথবা নিজেদের নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত সম্পদ ও মাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে ২০ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে। তাদের অন্যতম কৌশলী পদপে হচ্ছে জোটের শরিক দলগুলোর ভেতরে নেতাদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি, নেতা ও কর্মীদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি, দলের ভেতরে ভাঙন সৃষ্টি করা, জোটের ভেতরে ভাঙন সৃষ্টি, নেতাদের চরিত্র হনন করা ইত্যাদি। অজস্র টাকা ব্যয় করা তাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। সরকারপন্থী ইলেকট্রনিক মিডিয়া, মুদ্রণ মিডিয়া বা সম্পূরক মিডিয়া যথাÑ ওয়েবসাইট, অনলাইন নিউজ পেপার ইত্যাদি ব্যবহার করেই তারা এ কাজে এগিয়ে যেতে চায়। এটাকে অনেকেই সাইকোলজিক্যাল-ওয়ার বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ অথবা মিডিয়া-ওয়ার কিংবা প্রোপাগান্ডা-ওয়ার নামে অভিহিত করেন। এ কাজটির প্রতি ২০ দলীয় জোটের প থেকে অতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

ভাগ্যের লিখন অজ্ঞাত থাকে

যত বড় হৃদয়বিদারক ঘটনাই হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, দেশে দেশে যুগে যুগে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় নেতারা জাতির বা দেশের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্রের বা দুঃখজনক ভুল বোঝাবুঝির কারণে আততায়ীর হাতে বা বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ও জন এফ কেনেডি, ভারতের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত প্রমুখের নাম হচ্ছে শত নামের মধ্যে কয়েকটি মাত্র। নিহত হওয়া ছাড়াও রাজনৈতিক ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে যায়। ১৯৯০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরীর সকালবেলা ছিল স্বচ্ছ নীল আকাশ, শান্ত রাজপথ। ওই দিন সকাল ৯-১০টার দিকে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল নুরুদ্দীনের সফরসঙ্গী হয়ে সৌদি আরবের পথে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্লেনে উঠেছিলাম। দুবাইতে যাত্রাবিরতি হওয়ার কথা ছিল। প্লেন যখন দুবাইয়ের আকাশে, অবতরণের আনুমানিক ৩০-৪০ মিনিট আগে, প্লেনের পাইলট জেনারেল নুরুদ্দীনকে সৌজন্যের মাধ্যমে ককপিটে ডেকে নিয়ে যান। পাঁচ-ছয় মিনিট পর জেনারেল নুরুদ্দীন ফিরে আসেন। তখন জানতে পারি, ঢাকায় নাকি সাঙ্ঘাতিক গণ্ডগোল হয়েছে, কারফিউ জারি হয়েছে, বাংলাদেশের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং এ রকম আরো আনুষঙ্গিক কথা। যেহেতু বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি, সেহেতু জেনারেল নুরুদ্দীনের মনে এবং আমার মনে হাজারও প্রশ্ন ছিল। কারণ, আমাদের দেখে যাওয়া ঢাকার শান্ত নীল আকাশ এবং শান্ত রাজপথ কী কারণে অশান্ত হলো? এই কলামের পাঠকদের মধ্যে যারা ভুলে গিয়েছেন বা যারা বয়স কম হওয়ার কারণে ওই সময়ের কথা জানেন না, তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি। ওইদিন সকালে শাহবাগ এলাকায় রিকশায় যাচ্ছিলেন চিকিৎসক নেতা ডাক্তার মিলন। সরকারপন্থীদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ ডাক্তার মিলনের দিকে তাক করে গুলি করে। এতে তিনি শহীদ হয়ে যান। ঢাকার রাজপথ উত্তাল হতে মাত্র ২ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। সেই উত্তাল তরঙ্গে ৯ দিনের মাথায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি পদত্যাগ করেছিলেন সন্ধ্যাবেলা। যেদিন পদত্যাগ করেন, ওই দিন সকালেও রাষ্ট্রপতি এরশাদ অনুমান করেননি যে, আজ দিনের শেষেই তিনি পদত্যাগ করবেন।

আমাদের দেশ থেকে বহু দূরে, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাংশে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত তেলসমৃদ্ধ একটি দেশের নাম লিবিয়া। ৪০ বছরের বেশি, প্রায় ৪২ বছর দেশটি শাসন করেছেন জনৈক কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি। ২৭-২৮ বছর বয়সে, ১৯৬৯ সালে ক্যাপ্টেন র‌্যাংকে লিবিয়া সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময় তিনি ক্যু দ্য তা বা সামরিক বিদ্রোহ করে মতা দখল করেছিলেন। তার নিরাপত্তাব্যবস্থা, গোয়েন্দাব্যবস্থা ইত্যাদি ছিল অভিনব ও নিখুঁত। মুয়াম্মার গাদ্দাফি রাতে কোথায় ঘুমোতেন এটা রাত শুরু হওয়ার আগে তো দূরের কথা, শুতে যাওয়ার সময়ও দু-একজন ছাড়া কেউ জানতেন না। তারপরও জনবিদ্রোহে গাদ্দাফি রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হন এবং একপর্যায়ে প্রায় অরতি অবস্থায় কতকগুলো বড় সুড়ঙ্গের মতো পাইপের মধ্যে যখন লুকিয়েছিলেন, সেখানে বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েন। ওখানেই তার মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন জার্মানি নামে শক্তিশালী দেশের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলার যুদ্ধে নিশ্চিত চূড়ান্ত পরাজয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে আত্মহত্যা করেন, যেন শত্র“পরে কাছে আত্মসমর্পণ করতে না হয়। পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন আধা স্বৈরশাসক আধা নির্বাচিত শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধানের কাছে মতা হস্তান্তর করেছিলেন। এখন থেকে আনুমানিক ৪৩ বছর আগে ১৩-১৪ বছরের গেরিলাযুদ্ধের পর ভিয়েতকং গেরিলা বাহিনী যখন তৎকালীন দণি ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন নগরী দখল করেছিল, তখন দণি ভিয়েতনামের শাসকগোষ্ঠী মার্কিন দূতাবাসের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে উঠে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। এখন থেকে আনুমানিক ৩৫ বছর আগে ইরানের রাজধানী তেহরানের পতন ঘটেছিল ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট রেজা শাহ পাহলভি সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানে তেহরান থেকে সপরিবারে পলায়ন করেছিলেন মার্কিন সহযোগিতায়। এ অনুচ্ছেদে এই কথাগুলো বললাম এ জন্য যে, দেশে দেশে যুগে যুগে জাতীয় নেতারা বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন এবং অনেক েেত্রই জীবন দিয়েছেন, যার কোনো পূর্বাভাস তারা সাধারণত আগেভাগে পাননি বা পূর্বাভাস পেলেও সেটাকে আমলে নেননি। অর্থাৎ বিধাতার দেয়া ভাগ্যের লিখন সব সময় পড়া যায় না। আরেকটি বাংলা প্রবাদ আছেÑ ‘দেয়ালের লিখন’ পড়তে হয়। রাজনৈতিক নেতারা যদি দেয়ালের লেখা পড়তে না পারেন তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য।

বাংলাদেশের অবস্থা

বাংলাদেশের জনগণ সার্বিকভাবে ও সাধারণভাবে গণতন্ত্রমনা। ’৯০-এর ডিসেম্বরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করার পর পুরো দেশ আনন্দের সাথে, উৎফুল্লতার সাথে পরবর্তী পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিকে ধাবিত হয়েছিল। তৎকালীন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল নুরুদ্দীন যেমন গণমানুষের আকাক্সার বিরুদ্ধে যাননি, তেমনি গণমানুষও একজন জেনারেল এরশাদের বদলে আরেকজন জেনারেল নুরুদ্দীনকে পাওয়ার জন্য অস্থির হননি। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে, ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামক ঘটনার সময় দেশের পরিস্থিতি অস্থির ছিল এটা যেমন সত্য, ওই অস্থিরতা যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল সেটাও সত্য। আজ ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট বলতে চাই, এই মুহূর্তের বাংলাদেশে ‘ষড়যন্ত্র’ নামক শব্দটি কোনো অবস্থাতেই অনেক দূরে নয়। সাধারণ মানুষকে তার ন্যায্য পাওনা ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে প্রোথিত। স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনাকে মলিন ও অবদমিত করার জন্য ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে প্রোথিত। বিরোধী দলের আন্দোলন যেন সফলতা লাভ না করে, তার জন্য ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে প্রোথিত। সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে আছে, সাধারণ মানুষ উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে এবং তারা রাজনৈতিক পরিবর্তন চায়; কিন্তু পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে মানুষ চায় শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন। এই সমন্বয় (অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিবর্তন ও শান্তিপূর্ণ পন্থা) বাস্তবেই কঠিন। ৬ আগস্ট নয়া দিগন্তে এবং ১০ আগস্ট কালের কণ্ঠে লিখেছি। অন্যান্য অনেক পত্রিকায় আরো অনেকেই লিখেছেন; কিন্তু সব লেখাতেই একটি গ্যাপ বা ফাঁক থেকে যায়। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন যদি সরকারি শক্তি দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে কী হবে? কেউ এই প্রশ্নের উত্তর বা সম্ভাব্য সমাধান লিখিতভাবে কোথাও দিচ্ছেন না বা টকশোতেও বলছেন না।

বর্তমান আন্দোলন রূপক অর্থে

২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত পাঁচ দিন ছিল অতি থমথমে। তারপরে বিবিধ কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠ বলতে গেলে শীতকালের দীঘির পানির মতো শান্ত। শীতকালেও কিন্তু পানিতে মাঝে মাঝে কিছু ঢেউ থাকে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন গত সাত মাস ঢেউবিহীন। সুতরাং প্রথমে প্রকৃতির আকাশে, বাতাস বা বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে, অতঃপর সেই বাতাসের প্রভাবে পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি করতে হবে। প্রবল বাতাসের কারণে ঢেউ যদি উত্তাল হয়, তখনই মাত্র পানিতে ভাসমান বা চলমান রাজনৈতিক নৌকা বা লঞ্চ দুর্ঘটনায় পড়বে। শুনতে বা পড়তে মনে কষ্ট লাগতেই পারে, কিন্তু এটাও তো সত্য, আজ থেকে ১১ দিন আগে কাওরাকান্দি থেকে পদ্মা নদী দিয়ে মাওয়া ঘাটের দিকে আসার সময় পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ে পিনাক-৬ নামে লঞ্চ ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়ার এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, চার ঘণ্টা আগে পিনাক-৬ নামক লঞ্চটির কী বৈশিষ্ট্য ছিল? বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, ুদ্রাকৃতির দুর্বল অবয়বের পুরনো লঞ্চ, যত ব্যক্তি ধারণ করার মতা ছিল তার থেকে প্রায় দ্বিগুণ প্যাসেঞ্জারের ওজনে লঞ্চটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। লঞ্চটির ডুবে যাওয়ার ঘটনা এবং পরবর্তী উদ্ধার অভিযানের ঘটনা সব কিছুই টেলিভিশন ও পত্রিকার বদৌলতে বাংলাদেশের মানুষ প্রায় সাথে সাথে জানতে পেরেছেন, সেহেতু এ উদাহরণটি দিলাম। মনে করুন, আওয়ামী লীগ নামক বর্তমান শাসক দলটি হচ্ছে পিনাক-৬ নামক লঞ্চ। পদ্মা নদী হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শাসন ও প্রশাসন। মানুষের মনের কষ্ট ও সরকারের প্রতি বিুব্ধতা হচ্ছে দুই কূল ছাপিয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর পানি। এখন দরকার বাতাস, যে বাতাসের প্রভাবে পদ্মায় প্রচণ্ড ঢেউ হবে, এমন উঁচু উঁচু ঢেউ হবে যে, পিনাক-৬ নামক লঞ্চটি (আওয়ামী লীগ সরকার) ভারসাম্য হারিয়ে ডুবে যাবে। এখন থেকে ১১-১২ দিন আগে লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার সময় মাওয়া ঘাট বা নিকটবর্তী অন্য কোনো নৌযান থেকে অনেকেই মোবাইলে ওই দৃশ্যটি ভিডিও করেছিলেন। পাঁচ মিনিটেরও কম সময় লেগেছে লঞ্চটি ডুবতে। ফেসবুকে সেই ভিডিওটি দেখেছি। যখন লঞ্চটি এক দিকে কাত হচ্ছিল তখন আরো মানুষ ওই কাত হওয়া দিকে ধাবিত হচ্ছিল, দেখার জন্য বা বোঝার জন্য যে, লঞ্চটি কেন কাত হলো? এতে করে লঞ্চটির ভারসাম্য তাৎণিকভাবে নষ্ট হয়ে গেল। বর্তমান সরকারকে যদি পিনাক-৬ লঞ্চ মনে করি, তাহলে নির্ঘাত ধরে নেয়া যায়, শাসক সরকারে এমন প্যাসেঞ্জার আছে যারা একটুখানি ব্যতিক্রম হলেই দৌড় দেবে দেখার জন্য যে, কী হলো? কী হলো? কারণ, গত ছয় বছরে অনেক কিছু ঘটেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির অঙ্গনে, যেগুলো শাসক দলের আমলনামায় ব্ল্যাক স্পট, তথা লঞ্চের অভ্যন্তরে অস্থিরচিত্তের প্যাসেঞ্জারের মতো। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের অন্যতম ল্যবস্তু হতে পারে ওই ধরনের অস্থিরচিত্তের প্যাসেঞ্জারদের অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়ার জন্য কিছু পদপে নেয়া।

মানুষের অধিকার ও আবেগ

বিগত জুলাই মাসের ৭-৮ তারিখ থেকে ইসরাইল পার্শ্ববর্তী গাজা অঞ্চলে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপরে যে আক্রমণ চালাচ্ছে সেটা নজিরবিহীন। তার বিরুদ্ধে দেশে দেশে ােভ ও বিােভ হচ্ছে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। টকশোতে আলোচনা হচ্ছে। পত্রিকায় কলাম লেখা হচ্ছে। ১৯ জুলাই দৈনিক যুগান্তরে আমার কলাম ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন আলোচনা ও প্রতিবাদ কর্মসূচি করছে। ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কাউন্সিল’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন আহ্বান করেছি। শুক্রবার ৮ আগস্ট সংগঠনটি চট্টগ্রামে কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্যালেস্টাইনের ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের সদিচ্ছা ও একাত্মতা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বে এ ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও শুভেচ্ছাকে সংগঠিত করা প্রয়োজন। এটা হলো আবেগ-অনুভূতির প্রতি সম্মান। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’ নামে একটি কালো আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি হচ্ছে বাংলাদেশের কণ্ঠকে রোধ করা তথা গলা চিপে ধরার একটি উদ্যোগ। শুধু বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিকামী মানুষের কথা বলার এবং মতপ্রকাশের অধিকার রার জন্য এই কালো আইন ঠেকাতেই হবে। এই প্রক্রিয়া দিয়েই শান্তিপূর্ণভাবে ২০ দলীয় জোটের সাম্প্রতিক আন্দোলনের সূচনা করা যেতে পারে।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *