পরিবর্তনের স্বপ্ন

আজকের এই কলামে আমি স্বপ্নের গুরুত্ব নিয়ে লিখব। রাতে বা দিনে ঘুমে দেখার স্বপ্ন নয়, জীবন গড়ার স্বপ্ন, দেশ গড়ার স্বপ্ন প্রসঙ্গে বলব। কিন্তু কলামের আকৃতি ছোট রাখতেই হবে, তাই সীমিত কথা বলব। আমি নগণ্য ব্যক্তি, এখন কী স্বপ্ন দেখি এবং সেটি কালক্রমে এই পর্যায়ে কিভাবে এলো তার একটু বর্ণনা দেবো। আরেকজন ব্যক্তি যিনি অতি বিখ্যাত, তার জীবনের হাজার কথা থেকে মাত্র দু’টি কথা ধার করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করব। স্বপ্ন দেখা পাপ নয়, স্বপ্ন দেখা পুণ্য। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দেবেন। শহীদ জিয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তুলবেন, নবতর রূপ দেবেন। নেলসন ম্যান্ডেলা, মাও সে তুং, ইমাম খোমেনি, মোশে দায়ান, জোমো কেনিয়াত্তা এরা সবাই স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমার নিজের কথা দিয়ে শুরু করি।

ক্যাডেট কলেজে প্রবেশ

পোর্ট নর্থ কলোনির ভেতরে অবস্থিত প্রাইমারি স্কুলেই কাস ফাইভ বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করি। কাস সিক্স বা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার জন্য অল্প দূরে চট্টগ্রাম বন্দর হাইস্কুলে ভর্তি হই। হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। জানুয়ারি ১৯৬২তে কাস এইটে প্রোমোশন পেয়েছিলাম। ফেব্র“য়ারিতে তখনকার আমলের একমাত্র ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। মার্চে লিখিত পরীায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। জুন মাসের কোনো এক দিনে চূড়ান্ত ভাইভা (মৌখিক ইন্টারভিউ) ও মেডিক্যাল (অর্থাৎ শারীরিক) পরীার জন্য ক্যাডেট কলেজের হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রের পশ্চিমে উন্মুক্ত বাগানে শামিয়ানার নিচে উপস্থিত ছিলাম। পরীার্থীদের সবার বয়স ১১ থেকে ১৩-এর মধ্যে ছিল। অনেকের সাথেই অভিভাবক গিয়েছিলেন। সবাই শামিয়ানার নিচে ছিলাম। ওই আমলের কিশোর ইবরাহিমের দৃষ্টিতে ভীষণ স্মার্ট বা কেতাদুরস্ত দু’জন সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ পোশাক পরা ভদ্রলোক আমাদের এখানে উপস্থিত হয়ে সবার সাথে ভালোমন্দ আলাপচারিতা করলেন। পরে জেনেছিলাম তারা ঠিক ওই সময় একাদশ শ্রেণীতে পড়য়া দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ছিলেন। আমাদের মতো কিশোরদের জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছিলেন : বড় হলে তুমি কী হতে চাও বা তোমার জীবনের ল্য কী, ইত্যাদি। যে যার মতো উত্তর দিয়েছিল, সব এখন মনে নেই, এমনকি আমার নিজেরটাও সন্দেহাতীতভাবে মনে নেই। একজন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আই ওয়ান্ট টু বি দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান’। ওই কিশোর উত্তরদাতা আমাদেরই ব্যাচে ক্যাডেট কলেজে ঢুকেছিলেন, আমরা একসাথে ছয় বছর লেখাপড়া করেছিলাম। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তার নাম বলব না। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন, পিএইচডি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকতা করেন এবং আরো দায়িত্ব পালন করেন। ওই কিশোর বর্তমানে আমার মতো প্রবীণ। ক্যাডেট কলেজে তিনি যেহেতু মেধাবী ছিলেন, তার সাথে আমার বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিটাও ছিল লেখাপড়াসংক্রান্ত। ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই আমি বা আমরা ক্যাডেট কলেজে ঢুকেছিলাম এবং ছয় বছর পর ১৯৬৮ সালের মে মাসের কোনো এক তারিখে, এইচএসসি পরীা শেষ হওয়ার পর ক্যাডেট কলেজ ছেড়েছিলাম।

রাষ্ট্র কর্তৃক লালনপালন

ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়, প্রতি ক্যাডেটের জন্য মাথাপিছু কত খরচ হতো সেটা হুবহু কোনো দিন জানতে পারিনি। একটি বছরের মোট চলতি খরচ অর্থাৎ স্থায়ী নির্মাণকাজের ইত্যাদি খরচ বাদে যে খরচ থাকে ওই খরচকে বছরের মোট ক্যাডেট সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে মাথাপিছু খরচ বের হবে। সেটা কোনো সময় মাসিক ৩৫০ টাকা হতো, কোনো সময় কিছু বেশি হয়ে ৪০০ টাকা পর্যন্ত যেত বলে আমি শুনেছি। কিন্তু যেকোনো ক্যাডেটের জন্য সর্বোচ্চ প্রদেয় মাসিক ফি ছিল ১৫০ টাকা। অর্থাৎ, যেই ক্যাডেট কোনো বৃত্তি পায়নি এবং যেই ক্যাডেটের অভিভাবক সচ্ছল, তিনি ১৫০ টাকা দিতেন সরকারকে। ক্যাডেটদের মেধা এবং অভিভাবকের মাসিক আয় এই দুইয়ের সমন্বয়ে নির্ধারিত হতো ক্যাডেট মাসে কত দেবে। আমাদের কাসে বেশ কয়েকজন ছিল যারা কোনো টাকা দিত না। আমি এবং আমার মতো আরো কয়েকজন মাসে ২৫ টাকা দিতাম। এই তথ্যগুলো বলার উদ্দেশ্য একটাই, তথা এ স্যা দেয়া যে তৎকালীন সরকার চেষ্টা করেছিল কিছু ভালো মেধাবী ছাত্রকে ভালো পরিবেশে উন্নতমানের সার্বিক শিা দিতে, যেন ওই শিার্থীরা কালক্রমে দেশের উন্নয়নে সার্বিকভাবে প্রশাসনে বা জনকল্যাণে অবদান রাখতে পারেন। ১৯৬০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মে-জুন পর্যন্ত কতজন ক্যাডেট ফৌজদারহাট থেকে বের হয়েছে বা দেশের মোট ১২-১৩টি ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়েছে সেটা আমার হুবহু মনে নেই। কিন্তু যেই তত্ত্ব বা থিওরি এখানে প্রকাশ করলাম, সেটি গত ৫৪ বছর ধরেই প্রযোজ্য। প্রযোজ্য এ কথা বলা এক জিনিস, প্রয়োগ হয়েছে কি না বা বাস্তবায়ন হয়েছে কি না এটা আরেক জিনিস। ক্যাডেট কলেজে উপস্থিত বক্তৃতার প্রতিযোগিতা হতো। আমিও আমার ভবন বা হাউজের প থেকে অনেকবারই এ সব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। রচনা প্রতিযোগিতা হতো। বক্তৃতা বা বিতর্ক বা রচনা ইত্যাদিতে অনেকবারই বিষয় হিসেবে আলোচনায় এসেছে একটি প্রশ্ন যথা তোমার জীবনের ল্য কী? বা তুমি কী হতে চাও? বা তোমার আশা-আকাক্সা কী ইত্যাদি। ক্যাডেট কলেজ যেই পরিবেশ দিয়েছিল সেখানে, স্বাভাবিকভাবেই মনের অভ্যন্তরে জন্ম নেয়া জীবনের ল্যবস্তু অতি সীমিত ছিল।

স্বপ্ন দেখতেও সময় লাগে

যেদিন আমি ক্যাডেট কলেজ ছাড়ি, সেদিনও শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম না যে, জীবনে কোন পেশাটি বেছে নেবো। কারণ, যেই সিদ্ধান্তই নিই না কেন, লেখাপড়া শেষ করতে হবে আগে। এইচএসসির রেজাল্ট বের হওয়ার আগে আমি কোনো দিন চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা আসিনি। ১৯৬২ সালের জুলাই মাসের কোনো এক তারিখে আমাদের এইচএসসির রেজাল্ট বের হয়েছিল। তখনই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রশ্ন উঠেছিল। সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্ন ছিল অজ্ঞাত অপরিচিত তৎকালীন ঢাকা শহরের কোথায় উঠব? ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী মীর মোখলেসুর রহমানের (ডাক নাম ফরিদ) সাথে ১৫ দিনের জন্য ওদের বাসায় উঠেছিলাম ১৩ নম্বর ওয়্যার স্ট্রিট, উয়ারী। ভর্তির পর ইউনিভার্সির কাস শুরু হওয়ার আগেই তৎকালীন জিন্নাহ (বর্তমানে সূর্যসেন) হলে একটি সিঙ্গেল সিটেড (অর্থাৎ এক বিছানার) কামরা পেয়েছিলাম, নিচের তলার উত্তর অংশে। সিঙ্গেল সিটেড রুম পাওয়ার একমাত্র কারণ ছিল আমার এইচএসসির ফলাফল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ আমাকে ‘এ’ ক্যাটাগরির বৃত্তি দিয়েছিল। পরিমাণ ছিল মাসিক নব্বই টাকা। ইউনাভার্সিটিতে পড়ার জন্য মাসিক ফি মওকুফ ছিল। এই নব্বই টাকা থেকেই যাবতীয় খরচ মেটাতে হতো। এটাই স্বাভাবিক ছিল। ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হওয়ার পর, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, জীবনের ল্যবস্তুর কল্পনা বা আশা-আকাক্সার সীমারেখা আরেকটু বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া বাদ দিয়ে, ১৯৭০ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে যোগদান করেছিলাম। ওই সময়েও মনের মধ্যে আশা-আকাক্সা সৃষ্টির জন্য উদ্যোক্তা বা পৃষ্ঠপোষক বা প্রশিকেরা চেষ্টা করতেন। ১৯৭১-এর মহান রণাঙ্গনে যখন ব্যস্ত ছিলাম তখন নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য বা ল্যবস্তু আরেকটু প্রস্ফুটিত হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল একান্তভাবেই শুধু দেশকে নিয়ে এবং নিকটবর্তী ল্য তথা, শত্র“কে পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করা। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে ১৫ জুন ১৯৯৬ পর্যন্ত মুক্ত বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে চাকরিরত থাকা অবস্থায় মনের অভ্যন্তরে, চিন্তা জগতের গভীরে ল্যবস্তু চলাচল করছিল। পেশাদার সৈনিকের জন্য অন্যতম ভদ্র ল্যবস্তু হচ্ছে, পেশার সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়া। দুর্ঘটনাক্রমে যখন ১৯৯৬ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে গেলাম, তখন ল্যবস্তু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তায় বসলাম। একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কোথাও আর চাকরি করব না। কিন্তু আমার চিন্তা জগতের মোড় তথা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো, ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে, ঢাকা মহানগরের বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। নিজের চিন্তা ও আগ্রহকে পরিশীলিত এবং প্রস্ফুটিত করতে সাহায্য করেছে ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আমার নাগরিক জীবনের কর্মকাণ্ড এবং সাথীরা। ২০০৭ সালে সেই ল্য স্থির হয়েছিল এই রূপ : স্বীকৃত পন্থায় জনগণের খেদমত ও সেবা করার সুযোগ চাই। তাহলে আমার কণ্ঠকে, আমার আহ্বানকে, আমার বক্তব্যকে, আমার নিবেদনকে যত বেশি সম্ভব বাংলাদেশী নাগরিকের কাছে পৌঁছাতে হবে। মাহাথির মোহাম্মদ একুশ-বাইশ বছর বয়সে যা চিন্তা করছিলেন, আমি সেটা ৫৭-৫৮ বছর বয়সে চিন্তা করছিলাম। বলে রাখা ভালো, ৫৭-৫৮ বছর বয়সে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়া নামক দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

আমার আহ্বান ও স্বীকৃত পন্থা

যা হোক, আমার কথায় ফিরে আসি। যাদের কাছে আমার এই আহ্বান, বক্তব্য ও নিবেদন পৌঁছাব, তাদের মধ্য থেকেই সহকর্মী ও সহযোদ্ধা পেতে হবে। গত সাড়ে ছয় বছর ধরে পেয়ে আসছি, আরো পেতে হবে। একের বোঝা, দশের লাঠি Ñ এটি একটা বাংলা প্রবাদ। আরেকটি বাংলা প্রবাদ হচ্ছে, দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন এবং এই পরিবর্তন একা কোনো একজন ব্যক্তি পূর্ণভাবে আনতে পারবেন না, সমষ্টিগত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই সমষ্টিগত প্রচেষ্টার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে রাজনীতি। আন্দোলন হচ্ছে রাজনীতির একটি অংশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের চলমান আন্দোলনকেও ওই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। প্রতি আন্দোলনের একাধিক পর্যায় থাকতে পারে, যথা একরকম হচ্ছে : শর্টটার্ম বা নিকটমাত্রা বা তাৎণিক বা অতি সাম্প্রতিক। আরেক রকম হচ্ছে : দীর্ঘমেয়াদি বা দূরবর্তী মাত্রার। তাই বর্তমান আন্দোলনেরও এই রূপ দু’টি সময়ভিত্তিক মাত্রা থাকতে পারে; কিন্তু দিনের শেষে তথা আন্দোলনের শেষে আমরা পরিবর্তন চাই। সরকার কারা পরিচালনা করবেন, তাদের মধ্যে যেমন দলীয় পরিবর্তন চাই, আবার পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের মধ্যেও গুণগত পরিবর্তন চাই। তাহলেই আন্দোলন যথার্থ মর্যাদা পাবে।

মাহাথির মোহাম্মদ প্রসঙ্গ

এই কলামের প্রোপটকে একটু বিস্তৃত করার জন্য, মাহাথির মোহাম্মদের জীবনী থেকে অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ পর্যালোচনা করে এখানে উপস্থাপন করছি। মোট ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদ। এই ২২ বছরে তিনি একটি অনগ্রসর পশ্চাৎপদ কৃষিমুখী দেশ ও সমাজকে পরিণত করেছিলেন শিল্পমুখী বা শিল্পের পথে অগ্রসরমান উন্নত দেশে, যেই দেশটি পৃথিবীর সব দেশের তালিকায় ব্যবসার পরিমাপে ১৭তম বৃহৎ ব্যবসায়ী দেশ হয়ে উঠেছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী থেকে অবসর নেয়ার পর, কয়েক বছর সময় নিয়ে তার আত্মজীবনী লেখেন। ইংরেজি ভাষায় লিখিত বইটি ৮৪৩ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে। ২০১২ সালের শুরুতে আমার কনিষ্ঠতম ভাই ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রাথমিক কেমোথেরাপি দেয়া ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিল। তার সাথে কে থাকবে এটা একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় ছিল। যেহেতু রোগাক্রান্ত ভাইয়ের ছোট পরিবারে দু’টি সন্তানই শিশু ছিল, তাই পেশায় প্রকৌশলী ভ্রাতৃবধূর পে সিঙ্গাপুর যাওয়া সম্ভব নয়। আমার কনিষ্ঠ ভাইয়েরা-বোনেরা বা আমার ছেলে, আমার ভাগিনা Ñ এরা ভাগাভাগি করে রোগাক্রান্ত ভাইয়ের পাশে সিঙ্গাপুর থাকে। ২০১২ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আমার একমাত্র ছেলে ওই কারণেই সিঙ্গাপুর গিয়েছিল। ঢাকা ত্যাগের আগে আমার ছেলের প্রশ্ন ছিল, ‘আসার সময় তোমার জন্য জরুরি কিছু আনব কি না?’ এরূপ একটি প্রশ্ন বা প্রস্তাব একজন ছেলের প থেকে বাবার প্রতি মায়া-মমতা ও সৌজন্যের অতি স্বাভাবিক প্রকাশ। আমি বলেছিলাম, যদি পারো তাহলে খুঁজে দেখবে, ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদের আত্মজীবনীমূলক বইটি। যদি পাও একটি কপি কিনে আনবে। আমার ছেলে কিনে এনেছিল। ওই বইয়ের নাম ‘এ ডক্টর ইন দ্য হাউজ : দ্য মেমোয়েরস অব তুন ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদ’। বাংলাদেশে যদি এই বইটির অনুবাদ থাকত তাহলে অনেক লোক পড়ে উপকৃত হতো বলে আমি মনে করি। যেহেতু নেই, কিছু করা যাবে না। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হলো, ডাক্তার মাহাথিরের আত্মজীবনীমূলক বই এবং সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ’র আত্মজীবনীমূলক বই দু’টি বাংলাদেশ নিয়ে যারা চিন্তা করে তাদের জন্য উপকারী। মাহাথিরের বইয়ের দশম অধ্যায় হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি এবং ওই সময়ের গল্প। ১৯৪৭ সালে মাহাথির মোহাম্মদ ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজটি সিঙ্গাপুর শহরে অবস্থিত ছিল। কলেজটির নাম ছিল ‘কিং এডওয়ার্ড-৭ কলেজ অব মেডিসিন’।

মাহাথিরের স্বপ্ন ও অনিচ্ছায় চিকিৎসক হওয়া

তার পুস্তকের দশম অধ্যায়ে মাহাথির নিজে যা বলেছেন, সেখান থেকে দু’-একটি কথা এখানে আমার ভাষায়, ভাবার্থ হিসেবে তুলে ধরছি। পুনরায় নিবেদন করছি, কথাগুলো মাহাথিরের, ইবরাহিমের নয়। এখানে ‘আমি’ শব্দ মানে মাহাথির, ইবরাহিম নয়। আমি নেতা হতে চেয়েছিলাম যেন আমি স্বপ্নের কাজগুলো করিয়ে নিতে পারি এবং আমার চিন্তাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি। আমার স্কুলজীবনের সহপাঠীরা আমাকে নেতা হিসেবে মেনে নিত কিন্তু যারা একটু বয়স্ক তারা আমাকে সিরিয়াসলি গ্রহণ করত না। অতএব বয়স্করা যেন অন্তত আমার কথা ও প্রস্তাবগুলো শোনেন, তার জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয়তা হলো আমার ক্রেডেনশিয়ালস বা আমার জীবনের অর্জন বৃদ্ধি করা। জীবনে অর্জন বা পরিচিতি বৃদ্ধি করতে হলে অন্যতম কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডিগ্রি নেয়া। কারণ আমাদের এই সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডিগ্রিধারী ব্যক্তি পুরো দেশেই অতি নগণ্যসংখ্যক ছিল। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করা শুরু করলাম। আমি চেয়েছিলাম একজন আইনজীবী হতে। কারণ আমি বিতর্ক পছন্দ করতাম এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রশংসা পেতাম। কিন্তু ওই সময় আইনজীবী হওয়ার জন্য যে ভালো ডিগ্রি প্রয়োজন সেটা ইংল্যান্ড ছাড়া কোথাও পাওয়া যেত না। আমার পরিবারের আমাকে ইংল্যান্ডে পড়াবার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না, তাই আমি উচ্চশিার নিমিত্তে, স্কলারশপি বা বৃত্তির জন্য আবেদন করলাম। আমার অনেক বন্ধুই বৃত্তি পেয়েছিল কিন্তু আমি পেলাম না। আমাদের সরকার, আমাকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাবিদ্যা গ্রহণের জন্য স্কলারশিপ দিলো। আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আগ্রহী কোনো দিনই ছিলাম না, কিন্তু নিয়তি আমাকে চিকিৎসাবিদ্যায় জড়িত করল। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতাম আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। এ েেত্রও ভাগ্য আমার উপকার করল। কারণ, আমি যখন পরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলাম তখন আবিষ্কার করেছিলাম যে, একটি দেশের প্রশাসন পরিচালনা করা ও একজন রোগীর চিকিৎসা করার মধ্যে প্রচুর মিল আছে। একটি দেশ চালানো মানে শুধু পার্লামেন্টে তর্ক করা নয় বা শুধু আইন বানানো নয়। একটি দেশ চালানো মানে ওই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসুস্থতাগুলো সারিয়ে তোলার জন্য চিকিৎসা করা। অন্তত নীতিগতভাবে, একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যাধিগুলো চিকিৎসা করার যেই প্রক্রিয়া বা প্রসিডিউর, সেগুলো কোনো একজন মানুষের দেহের অসুস্থতার চিকিৎসা করার জন্য প্রযোজ্য প্রক্রিয়া বা প্রসিডিউরের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায়। আমি যেই সময়ের কথা বলছি, তখনো আমরা ব্রিটিশদের অধীন ছিলাম। ব্রিটিশরা মনে করত ডাক্তারেরা নিরীহ এবং গোবেচারা, তারা শাসনকারী ব্রিটিশদের জন্য কোনো ঝামেলা করে না। কারণ তারা করতেও জানে না। অপর প,ে ব্রিটিশরা মনে করত আইনজীবীরা একজন মানুষের শরীরে ঘাড় ব্যথার মতো, তার শাসনকারী ব্রিটিশ কর্তৃপরে জন্য সর্বদাই একটি ঝামেলার কারণ হতে পারে। এই প্রোপটেই ভাগ্য আমাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে জড়িত করে দিলো আমার ২২ বছর বয়সে। মেডিক্যাল কলেজে আমার সব ফি বা বেতন মওকুফ ছিল। আমি সরকার থেকে পেতাম ১৫ ডলার ও বাবা-মার কাছ থেকে পেতাম ১০ ডলার। এই ২৫ মালয়ান ডলার দিয়ে আমার খরচ মেটাতাম। ২০১১ সালে এই ২৫ ডলারের মূল্যমান হচ্ছে ২০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা অল্প কিছু কম। আমি সিঙ্গাপুর শহর থেকে প্রকাশিত ‘স্ট্রেইটস টাইমস’ ও ‘সানডে টাইমস’ নামে দু’টি পত্রিকায় কিছু লেখালেখি শুরু করলাম এবং এর মাধ্যমে ৪০ থেকে ৫০ ডলার অতিরিক্ত উপার্জন করতাম। এই দিয়ে আমি মোটামুটি ভালোমতোই জীবনযাপন করছিলাম।

এই কলামের উপসংহার

বিখ্যাত ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক মাহাথির মোহাম্মদের স্বপ্ন ছিল, তিনি তার দেশ ও সমাজের নেতৃত্ব দেবেন। ১৯৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষেদের নেতা ও মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং একটি বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন, যেই ভাষণের শিরোনাম ছিল ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ অর্থাৎ আমার একটি স্বপ্ন আছে। আমি আজকের কলাম এই বলে শেষ করতে চাই যে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই যেন স্বপ্ন থাকে। সেনাবাহিনীর অফিসার ইবরাহিমের স্বপ্ন ছিল, রাজনীতিবিদ ইবরাহিমের স্বপ্ন আছে। রাজনীতিবিদ ইবরাহিমের স্বপ্ন দেশকে নিয়ে, জাতিকে নিয়ে। তবে সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সহকর্মী, সহযাত্রী, সহযোদ্ধা প্রয়োজন। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সাংগঠনিক চেষ্টা প্রয়োজন, আন্দোলন প্রয়োজন। এখন যেই আন্দোলনে ব্যস্ত সেটা শর্টটার্ম বা নিকট মাত্রার। এই শর্টটার্ম বা নিকট মাত্রার আন্দোলন সফল হলে, দীর্ঘমেয়াদি বা দূরমাত্রার দেশ গড়ার স্বপ্ন, সমাজ বদলের স্বপ্ন, পরিবর্তনের স্বপ্ন পূরণ করা সহজ হবে।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *