জানা ও অজানা

কোরআন শরিফ যারা অর্থ সহ পড়েন তারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন মহান আল্লাহ একটি কথা বার বার বলেছেন, “আক্ ছারুহুম লা তা'লামুন" অর্থাৎ "তাদের অধিকাংশরাই জানেনা", " ইন কুনতুম তা'লামুন – যদি তোমরা জানতে"। আসলেই আমার প্রভুর মহা মূল্যবান বাক্যগুলা পড়ে চিন্তা করলে মনে হয় এ পৃথিবীর বিশেষ করে মুসলিমদের একটি বিরাট সমস্যা হচ্ছে এই জানা ও অজানা নিয়ে। সে দিন আমার এক বন্ধু খুবই চিন্তাশীল একটি কথা বলেছেন তার মতে " বর্তমান যুগে মুসলিমদের আসল সমস্যা হচ্ছে তারা যা জানে তা তারা মানে না আর যা মানে তা জানেনা।"


আসুন প্রথমেই চলে যাই মুসলিম বিশ্বের প্রাণ কেন্দ্র মক্কা মদিনার দেশ সৌদি আরবে যেখানে ক্ষমতার মসনদে যারা আছেন তারা নিজেদেরকে “খাদে-মাইন হারা-মাইন” অর্থাৎ পবিত্র দুই স্থানের (মক্কা মদিনার) খাদেম বা সেবক হিসাবে দাবী করেন এবং বাদশাহ নিজেকে সে খেতাবে ভূষিত করেন গর্ব সহকারে। সৌদিতে যারা বাস করেছেন তারা জানেন সে দেশের সালাফী আলেমরা শিরক সম্পর্কে এত বেশী সোচ্চার যে তা অন্য কোথায়ও দেখা যায় না। শিরক্ সম্পর্কে সজাগ থাকা অবশ্যই একজন মুসলিমের জীবনে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ  বিষয় কেননা শিরক্ করলে বা শিরকের সাথে জড়িত হয়ে পড়লে পরকালের জীবনে দেউলিয়া ও ব্যর্থ হতে বাধ্য। শিরক্ মহা পাপ এবং আল্লাহর কাছে এ পাপের ক্ষমা নাই।


শিরক্ আসলে কি?

শিরক্ বলতে আল্লাহর সাথে দুনিয়ার কোন বস্তু বা ব্যক্তি বিশেষ শক্তিকে শরিক করাকে বুঝায়। তার মানে আপনি আল্লাহর উপর ভরষা না করে আন্যের উপর ভরষা করছেন। অন্য কথায় আল্লাহর এবাদতে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর শরিক করলে তা হবে শিরক্। তবে আল্লাহর এবাদত বলতে কি তা কি আমরা জানি? এবাদত বলতে কি শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিক তথা রিচুয়্যল সর্বস্ব উপাসনার কর্ম পালনকে বুঝায় না মানুষের জীবনের প্রতিটি কাজ, তার জীবনদর্শন, বিশ্ব পরিস্থিতিতে তার মানসিক ও শারীরিক অবস্থান, ওয়ার্ল্ড ভিউ (world view) এবং জীবনযাত্রার প্রণালী (way of life) ইত্যদি আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করাকে এবাদত বুঝায়? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। ইসলাম যদি আল্লাহ প্রদত্ত জীবনযাত্রা (way of life) হয়ে থাকে তাহলে একজন রাষ্ট্র প্রশাসক যে নীতেতে দেশ পরিচালনা করবে, যার ভিত্তিতে দেশের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করবে এর প্রতিটি ক্ষেত্রই এবাদতের অংশ এবং আল্লাহর সাথে সে অন্য কাউকে বা কোন দেশকে শরিক করছে কিনা সেটাও দেখতে হবে কারণ যদি সে তা করে তা হলে সেটা  কি শিরক্ হবে না?  সে তো মনে করে তার ক্ষমতার ও সম্মানের মালিক পরাশক্তি । তাদের কাছে উপরের আয়াতের কি কোন মর্যাদা আছে?


একজন সত্যিকার মুসলিমের জীবনে আল্লাহর প্রতি ঈমানের সবচেয়ে বড় যে প্রভাব পড়ার কথা, তা হল, মানুষের ভয় তার মন থেকে সম্পূর্ণ দূর হয়ে যাওয়া। কুরআন বলছে, জীবন ও মৃত্যু এবং সম্মান ও অপমান আল্লাহর হাতে। এ কথার মাধ্যমে মানুষকে মানুষের কবল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তাই কোনো মানুষের কাছে আমাদের মাথা নত করার দরকার নেই। কিন্তু আজ যদি আমরা মুসলিম দেশের রাজা বাদশাহের ও রাষ্ট্র প্রধানদের আচরণ দেখি তা হলে দেখা যায় তারা চরম শিরক্ করছেন।


এত গেল বড় লোক তথা ক্ষমতাসীনদের দুরবস্থার কথা এবার আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের অবস্থা কি? আমরা সকলে জানি এই পার্থিব জীবন অস্থায়ী। তবুও এই অস্থায়ী জীবনকে বিলাসিতায় ডুবিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আমরা কি না করছি! আমাদের উচিৎ এখানে আমরা চিরন্তন জীবনের প্রস্তুতি নিই। ফলে বস্তুবাদ, অহংকার বোধ প্রভৃতি স্বআরোপিত কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, পার্থিব জীবনের আকর্ষণের প্রতি মানুষের মনে যে আকুল আকাঙ্ক্ষা জন্মে তাকে নির্মূল করা যায় না। তবে সে আকুল আকাঙ্ক্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে বরং তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা চাই। অর্থাৎ “হুব্বুত দুনিয়া” বা দুনিয়ার মোহ মুমিনের হাতে থাকবে হৃদয়ে অন্তর্লিখিত (engraved) করে নয় যে তাকে প্রয়োজনে মুছে ফেলা যাবে না এটাই হচ্ছে ইসলামী দর্শনের শিক্ষা।


ক্রিকেট লিজেন্ড বর্তমানে পাকিস্তানে যুব সমাজের জনপ্রিয় রাজনৈতিক লিডার ইমরান খান সম্প্রতি ইসলামকে তিনি ভালভাবে জানা ও বুঝার প্রচেষ্টায় তার অনুভূতির এক অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। তার কয়েকটি কথা এখনে উল্লেখ করছি। “ইসলামের প্রতি বিশ্বাস আমাকে উন্নত মানুষ হওয়ার পথ দেখিয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে শুধু নিজের জন্য বাঁচার বদলে অনুভব করি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ যেহেতু আমাকে এত বেশি দিয়েছেন, এর বিনিময়ে তার সে করুণাকে ব্যবহার করব বঞ্চিত মানুষকে সাহায্য করে। ইসলামের মূলনীতির অনুসরণ করে আমি তা করেছি। কিন্তু কালাশনিকভ রাইফেলধারী ধর্মোন্মাদ হইনি। সহিষ্ণু হয়েছি। দিতে শিখেছি সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সহানুভূতির কারণে। এর কৃতিত্ব আমার নিজের নয়। আল্লাহর ইচ্ছায় এটা সম্ভব হয়েছে। তাই শিখতে পেরেছি ঔদ্ধত্যের পরিবর্তে বিনয়।”


পাক-ভারত উপমহাদেশে উপনিবেশ যুগের ক্রীতদাস মনোবৃত্তির জেনারেশন যারা ব্রিটিশদের ব্যাপারে ভুগত হীনমন্যতায় তারা কীভাবে মুসলিম সমাজে তথাকথিত বাদামী এলিট শ্রেণীর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল ইমরান খান তার বর্ণনা দিয়েছেন খুবই সুন্দরভাবে। বস্তুত এদেরই ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশেও ইসলামী সামাজিক মূল্যবোধকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে তথাকথিত প্রগতিবাদী এক সুশীল সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। ইমরান খান এদেরকে বলেছেন সাধারণ মানুষের প্রতি ‘নাক উঁচু’ বাদামি সাহেব। আমি বলি প্রতিটি মুসলিম দেশে এরা হচ্ছে মুসলিম নামধারী ইসলাম-অজ্ঞ বা অজানা ইসলাম বিদ্বেষী তথাকথিত সেকুলার গুষ্টি। এরা যে কত নিচু মনের, অমানবিক তথা মানবাধিকার বিরোধী ও অগণতান্ত্রিক হতে পারে তার প্রমাণ  দেখা যায়  মিশরসহ অনেক দেশে। আর এদের বন্ধু  স্বৈরাচারী শাসকগুষ্টি। 




এরা ইসলামকে মানতে চায় পছন্দমতো আংশিক। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এদের কাছে হল নিছক বিশ্বাসের দাবী এবং কিছু আচার প্রথা মেনে চলাই যথেষ্ট। তাদের মতে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় উত্তম মানুষ হতে হবে না বরং পাশ্চাত্যের সামাজিক মান অনুসারে জীবন পরিচালনা করতে পারলেই একজন উত্তম মানুষ ও সফলকাম ব্যক্তি হওয়া যায়। তবে এ প্রসঙ্গে একথা স্বীকার করতে হবে পশ্চিমা দেশের কোনো কোনো দেশে মুসলিম দেশের চেয়ে ঢের বেশি ইসলামি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ করে নাগরিকদের অধিকার রক্ষা এবং বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। পছন্দ করার মত চমৎকার অনেক মানুষ ওই সব দেশে আছেন। তবে পাশ্চাত্যের যা পছন্দ করা যায় না তা হল তাদের দ্বিমুখী নীতি, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। তারা নিজেদের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করে; অথচ অন্যান্য দেশের নাগরিকদের গণ্য করে নিম্নশ্রেণীর মানুষ হিসেবে। এই কারণে তৃতীয় বিশ্বে বিষাক্ত বর্জ্য পাঠানো হয়; নিজ দেশে সিগারেটের প্রচার না করে তৃতীয় বিশ্বে দেয়া হয় এর বিজ্ঞাপন; পাশ্চাত্যে নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য এখানে এনে বিক্রি করা হয়। তাদের দেশের প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধানরা তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক বা সামাজিক যত সমস্যা তার সমাধানে তেমন কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা করার পরিবর্তে তাকে জিয়ে রাখতে চান। সে সব দেশের আভ্যন্তরীণ বিরোধ ও গৃহযুদ্ধকে চিরস্থায়ী করে রাখতে পরস্পর বিরোধী যুদ্ধরত উভয় পক্ষকে অস্ত্র সাপ্লাই দিয়ে যায় এমন অভিযোগ করেন বিশ্বের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। এদের কুকীর্তির দ্রুত এক-ঝলক ধারণা পেতে নিচের  লিংক দেখতে ভুলবেন না। 

এখানে মনে রাখতে হবে যে সভ্যতা কেবল মাত্র জড়বাদী জিবন দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে ও মানব সভ্যতার বড়াই করে তাদের কাছে এসব কোন ব্যপারই না যখন তাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন থাকে। তাদের কাছে end justify the means.


লিংক এখানে


সে যাক এ পোষ্টের আলোচনার আসল কথায় ফিরে যাওয়া যাক, যা ছিল মুসলিমদের জানা অজানার প্রসঙ্গে। আসলেই ইসলাম সম্পর্কে জানা অজানার সমস্যার সমাধানে যে দিন আমরা এগিয়ে আসতে পারব তখনই হবে আমাদের মুক্তি।


তাই আজ প্রশ্ন হচ্ছে যারা মানে তারা কি আসলেই জানে কি মানছে? কেন মানে? না শুধু তোতা পাখির মত না বুঝেই এক ম্লান বিশ্বাসের ভিত্তিতে এসব করছে? আর যারা মানে না তার হয়তবা জানেনা কেন তারা মানেনা। আমি আশা করি বিজ্ঞ পাঠকদের মাঝ থেকে কেউ এগিয়ে আসবেন এ ব্যাপারে কিছু দিক নির্দেশনায় এবং সেই সাথে তাঁর সুচিন্তিত মতামত দিয়ে আমাদেরকে আলোকিত করতে।


Reference:

What is the true meaning of shirk and what are its types 


কেন ইসলামের পথে এসেছি : ইমরান খান

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *