২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের আত্মসমালোচনা

 

আন্দোলনে পরিবর্তন চাই

পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের কর্মকাণ্ডের বেশির ভাগ প্রক্রিয়া বা সব প্রক্রিয়াই পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে বা হবে। অতএব রাজনীতিতে কেন পরিবর্তন হবে না, এটা একটা সঙ্গত প্রশ্ন। রাজনীতিতে পরিবর্তন বলতে বোঝাচ্ছি গুণগত পরিবর্তন। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নীতিবাক্য ইংরেজি পরিভাষায় ‘মটো’ হচ্ছে ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ বা পলিটিক্স ফর চেইঞ্জ। রাজনীতি একটি ব্যাপক শব্দ। এই ব্যাপকতার মধ্যে একটা অঙ্গ বা অংশ হচ্ছে রাজনৈতিক আন্দোলন। আন্দোলনের মধ্যেও একটি অংশ হচ্ছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। এখন থেকে দুইশত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ফরাসি দেশে আন্দোলন হয়েছিল তৎকালীন অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে। শেষপর্যায়ে আন্দোলনটি একটি বিপ্লবে রূপ নেয় যার নাম ফরাসি বিপ্লব। অন্ততপে ১৮৫৭ সাল থেকে ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের একেকটি পর্যায়ে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়, নতুন নতুন দাবিদাওয়া উপস্থাপিত হয়, নতুন নতুন কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে আংশিকভাবে অহিংস ও আংশিকভাবে সহিংস আন্দোলনের প্রোপটে ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র আবির্ভূত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৮ সালে আন্দোলন হয়েছে ঢাকা মহানগরীতে, ১৯৫২ সালে আন্দোলন হয়েছে সারা প্রদেশে, ১৯৬২-৬৬ সালে আন্দোলন হয়েছে সারা প্রদেশে, ১৯৬৯ এ গণ-আন্দোলন হয়েছে সারা প্রদেশে এবং ১৯৭১ এর মার্চে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায় মুক্তিযুদ্ধে। আন্দোলন হয়েছে কথাগুলো যেমন সত্য। কিন্তু আন্দোলনের প্রক্রিয়া এবং আন্দোলনের কর্মসূচিতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন এসেছে এটাও সত্য। কারণ, পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও বাস্তবসম্মত বিষয়গুলো

আন্দোলনের সাথে কয়েকটি তাত্ত্বিক বিষয় (ইংরেজি পরিভাষায় থিওরিটিক্যাল বা ইনট্যানজিবল) ও বাস্তব বিষয় (ইংরেজি পরিভাষায় প্র্যাকটিক্যাল বা গ্রাউন্ড-রিলেইটেড) অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাত্ত্বিক বিষয়ের উদাহরণ হচ্ছে (১) আন্দোলনের ল্যবস্তু, (২) আন্দোলনকারীদের মনোবল, (৩) আন্দোলনকারীদের প থেকে আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বের ওপর আস্থা, (৪) আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, (৫) শত্র“পরে প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার, (৬) আন্দোলনকে বিপথগামী করার জন্য শত্র“পরে কূটকৌশল ও ডিসেপশন (বা ছলনা) সাবোটাজ (বা নাশকতামূলক কর্ম) ইত্যাদি। বাস্তব বিষয়ের উদাহরণ হচ্ছে (১) আন্দোলনকারীদের থাকার জায়গা, (২) আন্দোলনকারীদের জন্য চলাচলের নিরাপদ মাধ্যম, (৩) আন্দোলনকারীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম, (৪) আন্দোলনকারীদের পরিবারের খাওয়া-দাওয়া ও থাকার নিরাপত্তা, (৫) আন্দোলন যদি সফল হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকারীদের পুরস্কার, (৬) যেই ভূমিতে তথা রাস্তাঘাট, সড়ক জনপদ বা মাঠ-ময়দানে আন্দোলন হবে সেখানে যাওয়ার আসার বন্দোবস্ত ইত্যাদি।

এসব কিছু মাথার মধ্যে নিয়েই, সদ্য সমাপ্ত রমজান মাসের পরে, ২০ দলীয় জোটের প থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার কথা। সেই সরকারবিরোধী আন্দোলন এই মুহূর্তে কোনো পর্যায়ে আছে সেটা সম্মানিত সব পাঠক নিজেরাই অনুধাবন ও মূল্যায়ন করতে পারেন। এই অনুচ্ছেদে আমি তাত্ত্বিক বিষয়ের উদাহরণ দিয়েছি ছয়টি এবং বাস্তব বিষয়ের উদাহরণ দিয়েছি ছয়টি। মোট বারোটি বিষয়ে আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদ না করে আমি সার্বিকভাবে, কলামের শব্দসীমার পরিধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, সংপ্তি আকারে আলোচনা করছি। আজ বুধবার ৬ আগস্ট পাঠক এই কলাম পড়ছেন এবং আশা করি, আগামী বুধবার ১৩ আগস্ট, একই ধারাবাহিকতায় লেখা পরবর্তী কলামটি পড়বেন। উভয় কলাম পড়ার পরই একটি ধারণা প্রস্ফুটিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

চিন্তাশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য

আজকের কলামটিতে আমি, ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন প্রসঙ্গে দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা কী বলেন সেটি উপস্থাপন করব। মানুষের মনে যে ধারণা (ইংরেজি পরিভাষায় পারসেপশন), কোনো অবস্থাতেই অবহেলা করার বিষয় নয়। আমি ১ ফেব্র“য়ারি ২০১৪ তারিখের একটি পত্রিকা থেকে এবং ১২ থেকে নিয়ে ২৫ জুলাই তারিখের মধ্যকার ৮টি ভিন্ন ভিন্ন তারিখের একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত কলাম অথবা সংবাদের উদ্ধৃতি এখানে দেবো। উদ্ধৃতির সাথে সাথে সারমর্মও উল্লেখ করব। পাঠক নিজেই উপসংহার টানবেন বলে আমার বিশ্বাস। কারণ চিন্তাশীল পাঠককে চিন্তার খোরাক দেয়ার জন্যই কষ্ট করে সময় ব্যয় করে মেধা ব্যয় করে কলাম লেখা।

নয়া দিগন্ত (শনিবার ১ ফেব্র“য়ারি ১৪)

প্রথম পৃষ্ঠায় লাল কালিতে বড় অরের সংবাদ শিরোনাম ছিল, “বিএনপির সামনে বহু চ্যালেঞ্জ : মূল সমস্যা কেন্দ্রে, নজর তৃণমূলে… আন্দোলনে ‘দুর্বল’ ঢাকা মহানগর… নির্দেশনাহীন তৃণমূল”। সংবাদের সারমর্ম। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর এক মাস পার হতে চলল। জানা গেছে, দলের তৃণমূল এখনো নির্দেশনাহীন… মূল সমস্যা কেন্দ্রে রেখে শুধু তৃণমূলের দিকে নজর দেয়া কার্যকর ফল বয়ে আনবে না বলে তারা মনে করছেন। চট্টগ্রাম বিএনপির এক নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচনের পর নেতাকর্মীদের ভূমিকা কী হবে, তা আমরা কিছুই জানি না। হাই কমান্ড কী করতে চায় তা স্পষ্ট নয়। দিনকে দিন তারা মনোবল হারিয়ে ফেলছেন। একই দিনের একই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার আরেকটি শিরোনাম ছিল, ‘নতুন নির্বাচনের সময় বেঁধে দেয়ার আহ্বান : ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিতর্ক’।

নয়া দিগন্ত (শনিবার ১২ জুলাই ১৪)

প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও প্রস্তুতি ধীর বিএনপির’। সংবাদের সারমর্ম। বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে আলাপের সময়, নেতাকর্মীরা সংবাদদাতাকে বলেছেন, সরকার পতন আন্দোলনের জন্য যে সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজন, তা এই মুহূর্তে দলের নেই… রাজধানীতে দল শক্তিশালী না করে আন্দোলনে নামলে তার ফল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনের মতোই হবে… দলের হাই কমান্ডের উচিত দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে এনে যোগ্য নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়া।

যুগান্তর (শুক্রবার ১৮ জুলাই ১৪)

প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘ঈদের পর কী হবে। আন্দোলন ঠেকাতে সক্রিয় প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মী। আসছে হরতাল-অবরোধসহ শান্তিপূর্ণ প্যাকেজ কর্মসূচি।’ সংবাদের সারমর্ম। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো পরিকল্পিত প্যাকেজ কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করার পরিকল্পনা করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। শুরুতেই আক্রমণাত্মক কোনো কর্মসূচি না দিয়ে শান্তিপূর্ণ গণমিছিল ও গণ-অবস্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে। এর মাধ্যমে চাঙ্গা করা হবে ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের মনোবল।… ফিরিয়ে আনা হবে নেতাকর্মীদের পারস্পরিক আস্থা… মতায় যাওয়ার জন্য নয়, মানুষের ভোটের অধিকার… ভবিষ্যৎ আন্দোলনে স্ট্রাইকিং পজিশনে ঢাকা মহানগরীর নেতা কর্মীদের খেলানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে…।

কালের কণ্ঠ (সোমবার ২১ জুলাই ১৪)

পৃষ্ঠা পনেরোতে একটি কলাম ছিল। কলামের শিরোনাম : ‘বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি : অভাজনদের ভাবনা’। কলামের লেখক ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ। কলামের মাঝখান থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে ধরছি।… আন্দোলন শানানোর আগে বিএনপি যদি আত্মসমালোচনা করতে পারত তবে বুঝতে পারত… হরতাল অবরোধের নামে সাধারণ মানুষের জীবন, সম্পদ ও অর্থনীতির ওপর আঘাত হেনে সরকার পতন ঘটাতে পারেনি… কিন্তু হতাশ হতে হলো, বিএনপি নেতাদের মন্তব্যে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানালেন, তাদের আন্দোলন হরতাল-অবরোধের দিকে গড়াতে পারে। অর্থাৎ সেই গণবিরোধী পুরনো ছক। খালেদা জিয়া ইফতার মাহফিলগুলোতে ঈদের পরের আন্দোলন নিয়ে যেভাবে কথা বলছেন তার মধ্যে বাহ্যত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা রয়েছে।… বিএনপি নেতাকর্মীরা আজ আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব ব্যর্থতা নিয়ে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছেন… নিজেরা মতায় থাকতে একই কাণ্ড করেছেন।

সমকাল (বুধবার ২৩ জুলাই ১৪)

চতুর্থ পৃষ্ঠায় দুইটি কলাম আছে। একটি কলাম লিখেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল আলম হানিফ। কলামের শিরোনাম ‘তিনি পাঁচ বছর ধরে একই কথা বলছেন’। একই পৃষ্ঠায় পরবর্তী কলামটির লেখক হচ্ছেন বিএনপি ঢাকা মহানগর নব মনোনীত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য-সচিব ও সাবেক তুখোড় ছাত্র নেতা হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। সোহেলের কলামের শিরোনাম ‘এবার জিতবে জনগণ’। মাহবুবুল আলম হানিফ তার কলামে বেগম খালেদা জিয়া অতীতের দু-একটি তারিখে কী বলেছেন সেটা উদ্ধৃত করেছেন, যথা ২৪ আগস্ট ২০১০ সাল, ১৪ আগস্ট ২০১১, ৬ অক্টোবর ২০১২ ও ২৩ জুলাই ২০১৩ সাল। হানিফ বলেছেন,… দেশে কেউ অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এবং আওয়ামী লীগ তা চুপচাপ বসে দেখবে… এটা হতে পারে না। আমরা দলীয়ভাবে বিএনপি ও তাদের জোটের যে কোনো দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে মাঠে থাকব। হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেছেন,… ঈদের পর আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন দেশনেত্রী।… নির্দলীয়-নিরপে সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেই মানুষ তাদের ভোটাধিকার স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারবে।… দেশনেত্রী ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছেন, আমাদের আন্দোলন হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।… বিএনপি ঢাকা মহানগরের কমিটি প্রসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকায় মনগড়া প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, এই কমিটির মধ্যে কোনো বিভাজন নেই।… সবশেষে বলব,… এই প্রোপটে আমি সবার প্রতি বিশেষ করে রাজধানীবাসীকে আহ্বান জানাব আসুন আবার ঐক্যবদ্ধ হই।

যুগান্তর (বুধবার ২৩ জুলাই ১৪)

পাঁচ নম্বর পৃষ্ঠায় (বাতায়ন) একটি কলাম আছে যার শিরোনাম ‘বিএনপি কি রাজনীতির মূল মঞ্চে ফিরতে পারবে’? কলামের লেখক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম আব্দুল হাফিজ। তার কলামের শুরুতে লেখা আছে এরকম… দেশের রাজনীতিতে এক সময়ের চমক সৃষ্টিকারী বিএনপি এখন আর তার আগের অবস্থানে নেই। দলটি এখন বড়জোর একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠন। এখন তার অন্য কোনো পরিচিতি নেই… না সরকারে, না বিরোধী দলে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি আবার জাতীয় রাজনীতিতে তার গৌরবের স্থানটি পুনরুদ্ধার করতে পারবে? অনেকে ঢালাওভাবে বলে থাকেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির আজকের এই দুরবস্থা হতো না। কথাটি বিতর্কসাপে। মতাসীনদের দুরভিসন্ধিমূলক নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি হয়তো কিছু আসনে জয়লাভ করতো কিন্তু সরকার গঠনের মতো… কারণ আওয়ামী লীগকে জেতানোর পরিকল্পনা নিয়েই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল।… বিএনপি ও তার নেতৃত্বের রাজনীতি করার প্যাটার্ন সম্পূর্ণ আলাদা। আন্দোলন কোনো দিনই বিএনপির বৈশিষ্ট্যসূচক গুণ ছিল না, এখনো নেই…।

কালের কণ্ঠ (বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই ১৪)

পৃষ্ঠা পনেরো (মুক্তধারা)। কলামের শিরোনাম ‘বিএনপির আন্দোলনের হুমকি ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি প্রসঙ্গে’। কলামের লেখক বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা তথা বাসসের সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাংবাদিক গাজীউল হাসান খান। তিনি যা লিখেছেন তার থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত।… বর্তমান রাজনীতির কঠোর সমালোচকেরা বলেন, এত দিন বিএনপি ভেবেছিল, এত পরিশ্রম করে সংগঠন করার প্রয়োজন কী? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার থেকে কোনো মতে একটা নির্বাচনের প্রতিশ্র“তি আদায় করতে পারলে বিএনপিকে আর কে ধরে রাখে। জনগণ যেভাবে েেপ আছে, মতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনামূলক প্রচারাভিযানেরও প্রয়োজন হবে না। বিএনপি এমনিতেই… বিএনপির কিছু কিছু কেন্দ্রীয় নেতা আমাদের রাজনীতিতে দ্বৈব-দুর্বিপাকের আবির্ভাব ঘটুক, সেটাই কামনা করছিলেন… আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে অবিলম্বে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল ডাকা।

নয়া দিগন্ত (শুক্রবার ২৫ জুলাই ১৪)

পৃষ্ঠা ৭ এ একটি কলাম আছে। শিরোনাম ‘ঈদের পর বিএনপির রাজনীতি’। লেখক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: সামছুল আলম। অধ্যাপক আলমের কয়েকটি বাক্য।… ঈদের পরই সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার নিমিত্তে বিএনপি চেয়ারপারসন, বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দকে প্রস্তুত হতে বলেছেন। দলীয় চেয়ারপারসনের এ ঘোষণার বাস্তবায়নের জন্য শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ থেকে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। প্রায় দুই বছর ধরে বিএনপির আন্দোলন সরকারের দমনপীড়ন ও অন্য নানাবিধ কারণে সফলতা অর্জন করতে পারেনি।… এ কারণে বিএনপির আন্দোলনের হুমকি কিংবা আন্দোলনের কর্মসূচি সরকারকে ভাবিয়ে তোলে না।

ওপরের বক্তব্যগুলো ছিল প্রতীকী অর্থে

আমি ওপরে কালের কণ্ঠ, নয়া দিগন্ত, যুগান্তর ও সমকাল পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি। তার মানে এই নয় যে, অন্যান্য পত্রিকার প্রতি আমার অনীহা আছে। ঢাকা মহানগরেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির দুইটি কার্র্যালয় আছে। ঢাকা মহানগরের নয়াপল্টন এলাকায় মসজিদ গলিতে একটি সাত তলা দালানের ছয় তলায় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জাতীয় ও ঢাকা মহানগর কার্যালয় অবস্থিত। ডিওএইচএস মহাখালীতে পাঁচ তলা দালানের পুরো পাঁচ তলাটাই কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় এবং তার নিজস্ব লেখাপড়া ও গবেষণার আস্তানা। মহাখালীতে ছয়টি পত্রিকা আসে সৌজন্য সংখ্যা এবং পাঁচটি পত্রিকা আমরা ক্রয় করি। দিনে দিনে না পারলেও, দু-চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই সব পত্রিকা ওলট-পালট করে দেখা হয়ে যায়। শুধু প্রতীকীভাবেই (বা ইংরেজি ভাষায় র‌্যানডম নির্বাচনের মাধ্যমে) চারটি পত্রিকা থেকে সংবাদ ও কলামের উদ্ধৃতি দিয়েছি। পুরো রমজান মাস ধরেই অনেক পত্রিকায় ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি চলছে। অনেক পত্রিকার মালিক বা টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক ঘোরতরভাবে আওয়ামী লীগ পন্থী হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি-সাংবাদিকদের বলিষ্ঠতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার কারণেই পত্রিকার পাঠকেরা এখনো একটা বাস্তবসম্মত চিত্র পাচ্ছে দেশের হাল-হকিকত সম্পর্কে।

সাংবাদিকেরা এবং আন্দোলন

সাংবাদিক ভাইদের অতি স্বাভাবিক আগ্রহ হচ্ছে, ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন কী রকম হবে, সেটা জানা। কারণ রোজার মাসের চতুর্থ দিন থেকে বিভিন্ন ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে, ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একাধিকবার বলিষ্ঠ কণ্ঠে, আপসহীন দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেছেন, রমজানের পরই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে। আমি এই আন্দোলন সম্পর্কেই এই নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ১৩ আগস্ট  কলাম প্রকাশ করব বলে আগের থেকে বলে রেখেছিলাম; কিন্তু নয়া দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগ এবং অন্যান্যা পত্রিকা বা টেলিভিশনের সাংবাদিক ভাইদের অনুরোধে, আন্দোলন সম্পর্কে বক্তব্য দিতেই হচ্ছে। ২০ দলীয় জোটে সবচেয়ে বড় শরিক হচ্ছে বিএনপি। অন্য একটি দল যথা জামায়াতে ইসলামীকে বলা যায় মাঝারি শক্তির শরিক। বাকি শরিক দলগুলোকে নিম্ন মাঝারি অথবা ুদ্র শরিক বললে অত্যুক্তি হবে না। সব শরিক দলের শক্তি ও সামর্থ্য কোনোমতেই সমান নয়। কোনো দলের ভার বেশি, কোনো দলের ধার বেশি। কোনো দলের দুটোই বেশি। কোনো দলের দুটোই দুর্বল। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। আন্দোলন নিয়ে আগাতে গেলে আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আত্মসমালোচনার প্রক্রিয়া খুব বেশি পরিষ্কার বা দৃশ্যমান নয়।

আত্মসমালোচনার গুরুত্ব

আত্মসমালোচনাকে অনেকেই নেতিবাচক সমালোচনা মনে করেন। এ কথা মনে রেখেই এই কলামের প্রথম অর্ধেকে, ২০ দলীয় জোটের আত্মসমালোচনা অন্যের ভাষা ধার করে উদ্ধৃত করলাম। যারা দেশ শাসন করবেন, যারা দেশের জন্য কিছু অবদান রাখবেন, তাদের একত্রে অনেক কাজ করা প্রয়োজন। ঢাকা মহানগরের রাজপথে মিছিলে যাওয়া প্রয়োজন, মুদ্রণ মিডিয়ার লিখিত সমালোচনা হজম করা প্রয়োজন। টেলিভিশনের সময়ের অনেক দাম। টেলিভিশনের নিউজের মধ্যে রাজনৈতিক সাাৎকার প্রচার হয় ৩০ সেকেন্ড বা এক মিনিট সময়ের জন্য। এই ৩০ সেকেন্ড বা এক মিনিটের বক্তব্য থেকে অনেক কিছু বুঝে নেয়ার মতো মেধা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচুর টকশো হয়। বলতে গেলে রাত দশটা থেকে একটা পর্যন্ত কোনো-না-কোনো চ্যানেলে টকশো চলতেই থাকে। একটা মাত্র চ্যানেল আজ বারো বছর ধরে মধ্য রাত ১টা থেকে বা দু-চার মিনিট দেরিতে হলেও তাদের টকশো শুরু করে (চ্যানেল আই তৃতীয় মাত্রা)। টকশোগুলোতে উপস্থাপকের দতার ওপর নির্ভর করে আলোচকদের মেধাভিত্তিক বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক বক্তব্য উদঘাটিত হয়, কম বা বেশি। তবে বেশির ভাগ টকশোতেই প্রবণতা হলো অতীতমুখী বা অতীত ইতিহাসের আলোচনা। আলোচনাতে তো অতীত আসবেই, কিন্তু তার সীমারেখা প্রয়োজন। টকশোগুলো যদি আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ার চিন্তার আধার হয়ে উঠতে পারে, তাহলেই টকশোগুলোর যথার্থ সাফল্য মূল্যায়ন হবে। কাউকে আক্রমণ বা হেয় করার জন্য নয়, প্রায় বারো-তেরো বছর ধরে নিজে বিভিন্ন টকশোতে অংশগ্রহণ করেই যাচ্ছি, বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টকশো উপস্থাপনাও করেছি এবং পত্রিকায় কলাম তো লিখছিই। এই টকশোগুলোতেও (সাম্প্রতিক রোজার মাসে) ২০ দলীয় জোটের প থেকে আন্দোলনের কথাবার্তা উঠে এসেছে। এই আলোচনাগুলোকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, কেন? এই কেন-এর উত্তর পেলে আন্দোলন গুছানো সহজতর হবে। আন্দোলনটি হবে ২০ দলীয় জোটের প থেকে। এই প্রসঙ্গে আগামী সপ্তাহের কলামে বক্তব্য থাকবে বলে আশা করি। এই সপ্তাহের এই কলামটি এবং আগামী সপ্তাহের কলামটি যৌথভাবে পড়ার আমন্ত্রণ থাকল।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *