ডিম পাড়ে হাঁসে! খায় বাগডাসে!

কথাটি প্রায়ই বলতেন আমাদের ‘হাঁটা বাবা’। আমার খুবই দুঃখ লাগছে যে, কথার দাপটে একজন নামকরা রাজনীতিবিদের আসল নামটি হারিয়ে গেল। একশ্রেণীর লোক তাকে বলছে উনি হলেন হাঁটা বাবা। আরেক দল বলছেন আরে না, উনি হাঁটা বাবা নন; উনি হলেন ফাটা কেষ্ট। এর বাইরে অনিল কাপুর কিংবা নায়ক উপাধিও দিয়েছেন কেউ কেউ। ব্যক্তিগতভাবে ওসব লোকের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। আমার কাছে তিনি একজন সফল রাজনীতিবিদ, কৌশলী মন্ত্রী এবং সর্বোপরি ভালো মানুষ হিসেবেই পরিচিত। কারণ বর্তমানের যোগাযোগমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদেরকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে এবং একান্ত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে দু-একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উপস্থাপন করলে আশা করি সম্মানিত পাঠকগণের একেবারে মন্দ লাগবে না।

asddad

তো যা বলছিলাম ডিম পাড়ে হাঁসে! খায় বাগডাসে! ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার আগে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কথাটি বলতেন। তখন তার চুল বেশ লম্বা ছিল, অনেকটা সেমি বাবরি টাইপের। চাকরি করতেন বাংলার বাণী পত্রিকায় আর সম্ভবত থাকতেন খিলগাঁও-বাসাবো এলাকায়। সিগারেট-টিগারেট খেতেন কি না তা বলতে পারব না; তবে ইদানীং তিনি ধূমপান করেন না। তার প্রথম বক্তব্য শুনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। আর ওই দিন থেকেই আরো অনেক ছেলেমেয়ের মতো আমিও তার ‘প্রেমে পড়ে যাই’। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সভা-সমিতি, রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সরকারি কাজকর্মে পাশাপাশি বসে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তার স্বভাবটা একটু কাব্যিক ঢংয়ের, অর্থাৎ মরমিয়া প্রকৃতির। সেই কবি কবি ভাবের মরমিয়া অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে তিনি প্রায়ই বক্তৃতার মাঝে বলতেন, ‘ডিম পাড়ে হাঁসে! খায় বাগডাসে!’

ওবায়দুল কাদের ছাড়াও আরো একজন কথাটি বলতেন, তবে একটু অন্যভাবে। তিনি বলতেন, ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় দারোগা বাবু। লোকটি ওবায়দুল কাদেরের মতো জাতীয়পর্যায়ের কোনো নেতা নন। তিনি আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা। এক সময় ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন, আর ছিলেন ওখানকার আওয়ামী লীগের সম্পাদক। নাম তার ছাত্তার ফকির। আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে শত শত নেতা আছেন, যারা জনসভায় বড় বড় জাতীয় নেতার চেয়েও ভালো বক্তৃতা দিতে পারেন; ছাত্তার ফকির তাদেরই একজন। তিনি এই কথা কেন বলতেন? বলতেন মনের দুঃখে। সারা বছর স্থানীয় লোকজন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দলীয় রাজনীতি করে। বিরোধী পক্ষের সাথে মারামারি-কাটাকাটি ছাড়াও মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জুলুম ইত্যাদি ভোগ করে; কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের কিছু দিন আগেই শুরু হয় ‘অতিথি পাখির’ আগমন। শহর থেকে এমপি হওয়ার জন্য দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে এলাকায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন হয়তো কোনো ব্যবসায়ী, নয়তো কোনো আমলা। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, এসব অতিথি পাখিই দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যান। আর তৃণমূলের নেতারা কলুর বলদের মতো দারোগা বাবুদের ডিম খাওয়ানোর জন্য লেগে যান উঠে পড়ে।

ছাত্তার ফকিরের দুঃখ এবং ওবায়দুল কাদেরের দুঃখ প্রায় একই রকম। ছাত্তার ফকির যখন তৃণমূলের নেতা ছিলেন তখন দুঃখের কথা বলতেন; কিন্তু যে দিন তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন, সে দিন থেকে তার দুঃখের মাইকটি অন্য কথা বলা শুরু করল। অন্য দিকে ওবায়দুল কাদেরের ডিমও আর বাগডাসে খাচ্ছে না, বিশেষ করে যে দিন থেকে তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, তার পরের দিন থেকে; কিন্তু সারা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের লাখো কোটি নেতাকর্মী চরম হতাশা নিয়ে দেখছেন, তাদের ডিমগুলো হয় বাগডাস, নয়তো দারোগা বাবুরা খেয়ে ফেলছেন। বাগডাসে ডিম খেয়ে চোরের মতো ইতিউতি করে বেশি একটা ঝামেলা করে না; কিন্তু যত সমস্যা দারোগা বাবুদের নিয়ে। এরা একটা দুইটা নয়, জনমের মতো ডিম খাবেন। খেয়ে খেয়ে পেট ফুলিয়ে ফেলবেন। তারপর পেটের মধ্যে ঘুটঘাট শব্দ শুরু হলে ডিমপাড়া হাঁসগুলোকে কাছে ডাকবেন, বলবেন ওরে, হতচ্ছাড়া অভাগার দল! আয় আমার কাছে আয়। আমার পেটে তেল মেখে দে। হাঁসেরা দারোগার কাছে যায় এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে তেল মাখতে শুরু করে। হুজুর পরম আয়েশে তার পেটের ঘড়ঘড় নাকে নিয়ে আসেন। তন্দ্রা যাওয়ার আগে পিট পিট চোখে হাঁসের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলেন, এই ব্যাটা, ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত যাবি না, তেল মাখতেই থাকবি। হুজুর ঘুমান আর হাঁস তেল মাখে। ঘুমের ঘোরে হুজুরের নাকের ঘড়ঘড় শব্দ আবার পেটে চলে আসে। হাঁস মালিশ বাড়িয়ে দেয়, ঘড়ঘড় এবার তলপেটে যায়, তারপর আরো নিচে। এক সময় ঘড়ঘড় পেটের অন্ধকার জগৎ থেকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে বের হয়ে আসে। হাঁস তখন হাসে কারণ, তার নাক অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

সে দিন হোটেল সোনারগাঁয়ে এনটিভির একটি লাইভ অনুষ্ঠানে ছিলাম। বড় এক ‘দারোগা বাবু’ এলেন। ঘাড় আর থুতনিতে চর্বি থল থল করছে। এত বড় ঘাড় ডান-বামে ঘুরিয়ে তিনি আশপাশের লোকজনের দিকে বহুবার তাকালেন। কেউ একটা সালামও দিলো না অনুষ্ঠানের আয়োজক ছাড়া। দারোগা বাবু তার আসনে গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ কাচুমাচু করে তারপর ফটাস করে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার একপাশে ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতা এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য খোন্দকার গোলাম মাওলা; অন্য পাশে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। অঙ্গুলি নির্দেশ করে দারোগা বাবুর ঘুমানোর দৃশ্য দেখালাম। তারা খুবই মজা পেলেন। গোলাম মাওলা সাহেব যেহেতু মহাজোট সরকারের শরিক, তাই তিনি দারোগা বাবুর নানা দিক, বিশেষ করে পদ্মা সেতুর বিষয় নিয়ে অনেক কথা বললেন।

আওয়ামী লীগের লাখো কোটি নেতাকর্মীর মতো আমি ইদানীং বাগডাস এবং দারোগা বাবুদের উৎপাত ও বাড়াবাড়িতে ভীষণ রকম বিরক্ত। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় যারা প্রাণ দিলেন, তাদের পরিবার-পরিজনের খোঁজখবর এই সরকারের কোনো মন্ত্রী রেখেছেন কি না সন্দেহ। আমার নির্বাচনী এলাকার আলীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মামুন মিয়া জননেত্রীর বডিগার্ড ছিল। নেত্রীর জীবন বাঁচাতে সে দিন মামুন প্রাণ হারায়। যখন ছিলাম এমপি কয়েকবার মামুনদের বাড়ি গিয়েছি এবং ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সাধ্যমতো সাহায্য করেছি; কিন্তু সরকার বা দলের এহেন বসন্তকালে কোনো মন্ত্রী, দলীয় নেতা কিংবা দারোগা বাবুরা একবারও মৃত মামুন মিয়ার খোঁজখবর করেননি। এমনকি কেউ কোনো দিন আমাকে এ ব্যাপারে একটা প্রশ্ন পর্যন্ত করলেন না। যাদের কারণে একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে একজন নারী জননেত্রী হয়ে উঠলেন কিংবা যাদের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে তিনি বেঁচে আছেন আজ সেই লোকদের আত্মত্যাগ, আত্মা এবং রক্ত-মাংসের ওপর বাগডাস আর দারোগা বাবুরা লাফালাফি করছেন। এই জুলুম যদি বঙ্গবন্ধু দেখতেন তাহলে নির্ঘাত ওদেরকে মেরে ফেলতেন, নয়তো আত্মহত্যা করতেন।

কোথাকার কোন শেখ বাচ্চুর কারণে বেসিক ব্যাংকটির অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। গত পাঁচ বছরে বাচ্চু মিয়ার দাপট দেখে আমার মনে হয়েছে, লোকটি বোধ হয় আওয়ামী লীগের জন্মদাতা। কিছু দলীয় ক্যাডার যারা কিনা জীবনে ১০ লাখ টাকা গুনে দেখেনি, ধান্ধাবাজি ছাড়া ব্যবসায়-বাণিজ্যের কোনো অভিজ্ঞতা পর্যন্ত নেই; সেসব নবীনকে ধরে এনে দারোগা বাবুরা বিভিন্ন ব্যাংক, করপোরেশন ও রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোতে পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এত বড় অনিয়ম, অনাচার আর দৃষ্টিকটু বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশে আজ অবধি হয়নি। এতে লাভ হয়েছে দারোগা বাবুদের। তাদের সুপারিশে অখ্যাত সব কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে শত শত কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। এই ঋণ কোনো দিন আদায় না হলেও ক্ষতি নেই; কেননা দারোগা বাবুরা তাদের কমিশন ঠিকই কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে এই প্রশ্ন করা আমার জন্মগত অধিকার কার কথায় এবং কার স্বার্থে আমরা সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক ধ্বংস করতে যাচ্ছি? আবার কার স্বার্থে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারি প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। এক ড. ইউনূসের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, জাপান ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল তার বিনিময়ে আমাদের লাভ কতটুকু? যাদের কেলেঙ্কারি ও কুকর্মের কারণে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিলো, সেসব লোক আওয়ামী লীগের কয়জন নেতাকর্মীকে কত টাকা দিয়েছে? দলটির পেছনে এসব লোকের অবদানই বা কতটুকু? শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারির খলনায়ক কিংবা হলমার্ক কেলেঙ্কারির ভিলেনদের চেনে না বা নাম জানে না এ রকম বোকা বাঙালি এ দেশে কয়জন আছে, তা আমার জানা নেই। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ ইবলিস শয়তান কিংবা ফেরাউনের চেয়েও ওইসব লুটেরাকে বেশি ঘৃণা করে। এসব ঘৃণিত বস্তু যদি মানুষের সম্মান, ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের জায়গায় সকাল-বিকেল উদয় হয়ে সেখানকার পরিবেশ অপবিত্র ও কলঙ্কময় করে দেয়, তবে লোকজন কার কাছে বিচার চাইবে, কার কাছে জানাবে ফরিয়াদ?

আওয়ামী লীগের শত্রুরাও স্বীকার করবে, তৃণমূলনির্ভর এমন শক্তিশালী দল বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। ঝড়-বৃষ্টি-বাদল কিংবা বন্যা-খরা উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী সারা বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দলের প্রতীকের সম্মান এবং নেতানেত্রীর হুকুম তামিল করার জন্য কেবল রক্ত নয়, দরকার হলে জীবনও দিয়ে দেন। নেতার একটু স্বীকৃতি, পিঠ চাপড়ানো কিংবা একটু হাসির জন্য তারা সারা জীবন চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কোনো কিছু না পেলেও তারা কষ্ট পান না; কিন্তু প্রিয় নেতানেত্রীর চার পাশে যখন বড় বড় কেলেঙ্কারির খলনায়কদের দেখে বুক টান করে চলাফেরা করতে, তখন বিশ্বাস ও ভালোবাসার পাহাড় ভেঙে খান খান হয়ে যায়। অপমানের জ্বালায় দল করার নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলে।

বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন। ক্ষমতার পাদপীঠে যেসব বসন্তের কোকিলকে তারা দেখতে পাচ্ছেন, তাতে করে নৈতিক মনোবল থাকারও কথা নয়। দলের তৃতীয় ও চতুর্থ সারির অযোগ্য নেতাদের এক বিরাট অংশই কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে আছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এমন সব মুখ দেখা যাচ্ছে, যাদের সাথে সারা দেশের তৃণমূলের সম্পর্ক খুবই কম। বেশির ভাগ নেতাই কেবল নিজকে নিয়ে ভাবছেন, দলকে নিয়ে নয়। আবার যারাও বা দলকে নিয়ে একটু-আধটু ভাবছেন, তারা কেবল বর্তমানকাল নিয়ে কথাবার্তা বলছেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়। যদি তৃণমূলের নেতৃবৃন্দ কোনো সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে প্রশ্ন করেন আগামী ২০ বছরে দলটির পরিকল্পনা কী? সে ক্ষেত্রে কতজন দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে কথা বলতে পারবেন তা আমার জানা নেই হয়তো দু-একজন, কিংবা একজনও নয়।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগ খুবই রক্ষণশীল প্রকৃতির। ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রায় একই মনমানসিকতা ধারণ করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাইরের লোক, যারা কেবল তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কিংবা মন্ত্রীফন্ত্রী হয়ে নাম-যশ ও টাকা কামানোর জন্য জোঁকের মতো দলের সাথে লেগে থাকে, সেইসব লোককে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। কোনো অবস্থাতেই তাদের মেনে নিতে পারেন না। অন্য দিকে ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ী, ফন্দিবাজ অবসরপ্রাপ্ত আমলা, উঁচু গলায় কথা বলা সন্ত্রাসী গডফাদার, পরিবহন নেতা, বিভিন্ন সিবিএ নেতা ইত্যাদি প্রজাতির রঙ-বেরঙের মানুষজনকেও দলীয় নেতাকর্মীরা ভালো চোখে দেখেন না। এদেরকে হয় বাগডাস, না হয় দারোগা বাবু মনে করেন।

বর্তমান সময়ে দেশে বলতে গেলে, কোনো রাজনীতি নেই। নানামুখী অন্তর্দ্বন্দ্ব, চক্রান্ত, ভুল সিদ্ধান্ত এবং ‘পল্টিবাজি’র রাজনীতির কারণে বিরোধী দলগুলো প্রায় ধ্বংস হতে চলেছে। যে ক্ষতি বিরোধী দলগুলোর হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি সুষ্ঠু ও সুষম রাজনৈতিক পরিবেশে তাদেরকে অন্তত ১০ বছর ধৈর্য ধরে কাজ করে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তিকে মজবুত করতে হবে। বিরোধী দলের এই ভগ্নদশা অতি অল্প সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলে দেবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা যখন দেখবেন, তাদের দলের ভবিষ্যৎ বেশি একটা ভালো নয়, তখন তারা দলে দলে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিলীন হতে চাইবেন। এই নবাগতদের চাপ আওয়ামী লীগ সামাল দিতে পারবে না। কারণ সরকারে থাকার কারণে তারা টের পাচ্ছে না যে, তাদের ভিত্তি, এ দলের পিলার বা খুঁটি কতটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্বল ভিত্তি এবং ঘুণে ধরা খুঁটির ওপর তৈরি করা প্রাসাদের ছাদে যদি অতিরিক্ত লোক ওঠে, তবে তা বিধ্বস্ত হওয়া প্রায় নিশ্চিত এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র।

যাদের কারণে দলটি বিভিন্ন সময়ে পরাজিত, লাঞ্ছিত ও বিপদের সম্মুখীন হয়ে পতনের গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গিয়েছিলেন সেই তারাই এখন নৌকার কাণ্ডারি। এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডারিরা আবার তাদের নিজেদের পছন্দমতো মাঝিমাল্লা নিয়োগ দিয়েছেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদেরকে নৌকায় আরোহণ করিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অজানা গন্তব্যে। যারা বঙ্গবন্ধুর খুনের নেপথ্য কারিগর, মদদদাতা এবং সরাসরি সুফলভোগী, তারাই আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার উত্তম সহচর, রক্ষাকর্তা ও উপদেষ্টা বনে গেছেন। বিগত বিএনপি জোট সরকার এবং ১/১১-এর কুশীলবদের কাছ থেকে সুবিধাপ্রাপ্তরা ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চরম লড়াকু সৈনিক বনে গেছেন। এই সরকারের দুধ-মাখন কিংবা ঘিয়ের এক বিরাট অংশ তারা দখল করে নিয়েছেন এবং মুখ ভেংচিয়ে ভেংচিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বলছেনÑ ‘কী রে ব্যাটারা! কিছু পেলি! হবে না, তোদের দিয়ে হবে না! সারা জীবন শুধু কলুর বলদই থেকে যাবি, ভারবাহী হবি; কিন্তু ফল ভোগ করতে পারবি না।’

ইদানীং একটা বিষয় সবার কাছে চমক হিসেবে দেখা দিয়েছে। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতার স্বর্ণসুধা যেসব ক্যান্সার শুষে খেয়েছিলো এবং যারা ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিতাড়িত ছিলো, সেই কুশীলবেরা সবাই ফিরে এসেছেন বিপুল গৌরবে এবং আগের চেয়ে আরো অধিক শক্তিমত্তা নিয়ে। শুধু কি তাই! ১/১১-এর সময় যারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে মাইনাস করে, এমনকি তার জীবন নাশ করে নেতৃত্বের শীর্ষপর্যায়ে পৌঁছতে চেয়েছিলেন, তারাও ফিরে এসেছেন। অন্য দিকে পোলাও খাওয়া মজনু, বাগডাস এবং দারোগা বাবুরা তো আছেনই। এসব অপশক্তি এক হয়ে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বে এমনভাবে কামড় বসাচ্ছে, যেভাবে উইপোকা বা ঘুণপোকা কোনো মজবুত কাঠের খুঁটিকে কামড়াতে থাকে। ফলে ঘুণে ধরা খুঁটি যেমন এক সময় ধসে পড়ে তেমনি আওয়ামী লীগও ওদের কারণে মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না।

এহেন পরিস্থিতিতে সত্যিকার আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা সবাই নিরাপদ দূরত্বে থেকে হা-হুতাশ করছেন ঠিক নাসির উদ্দিন বুগরা খানের মতো। কাহিনীটি সুবে বাংলার; কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষাপট ছিল দিল্লির মসনদ। এটা ১২৬৬ থেকে ১২৮৭ সালের কথা। দিল্লির সিংহাসনে এত ক্ষমতাবান, এত দাপুটে এবং এত বড় স্বৈরাচারী শাসক কোনোকালে আর দ্বিতীয়টি পয়দা হয়নি। বড় বড় মন্ত্রী পর্যন্ত সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে যেন পেশাব করে দিতেন। তার একমাত্র সন্তান নাসির উদ্দিন বুগরা খান বুঝলেন, পিতার মৃত্যুর পর এই সাম্রাজ্য টিকবে না। আর তিনি যদি দিল্লির সিংহাসনে বসেন, তবে তা হবে আত্মহত্যার শামিল। তিনি সুলতানের কাছে আবেদন করে সুবে বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেলেন এবং কর্মস্থলে যোগ দিলেন। এর অল্প ক’দিন পরই সুলতান বলবন মারা যান। শুরু হয় সিংহাসন নিয়ে সীমাহীন অরাজকতা। এরই মধ্যে রাজদরবারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা সুলতানের পৌত্র এবং বুগরা খানের পুত্র মুইজ উদ্দিন কায়কোবাদকে সিংহাসনে বসান। বুগরা খান তার প্রিয় পুত্রকে সতর্ক করে পত্র লিখলেন। সেই পত্র নবীন সুলতানের হাতে পৌঁছানো হলো না, বিনিময়ে তাকে নির্মমভাবে খুন করা হলো। যে জালাল উদ্দিন খিলজি দীর্ঘ দিন ধরে সুলতান বলবনকে বিভ্রান্ত করছিলেন এবং খুব কাছাকাছি থেকে বৃদ্ধ সুলতানকে দিয়ে একের পর এক সর্বনাশা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ে পুরো সাম্রাজ্যকে নেতৃত্বশূন্য করেছিলেন, তিনিই সুযোগ বুঝে নবীন সুলতান কায়কোবাদকে খুন করে নিজের সিংহাসন আরোহণের পথ সুগম করেন। ফলে পতন হলো বিখ্যাত দাস বংশের (মামলুক সুলতান), আর সেখানে পত্তন হয় খিলজি বংশের।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *