গাজার যুদ্ধে আসলে জিতল কে?

 ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে ইসরাইলি সেনাবাহিনী (আই ডি এফ) না হামাস জয়ী হল এ নিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকেরা মতা মত দিতে শুরু করেছেন।

ইসরাইলের প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ পরিচালিত এক জরিপে প্রশ্ন ছিল "তিন দিনের অস্ত্রবিরতির মধ্যদিয়ে দৃশ্যত: শেষ হওয়া গাজায় শেষ হওয়া অপরাশেন প্রটেক্টিভ এজ-কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?"- এমন প্রশ্নে ৫১ ভাগ ইসরাইলি মনে করে, এতে ইসরাইল কিংবা হামাস কেউ জয়ী হয়নি। তবে ৩৬ ভাগ মনে করে ইসরাইল জিতেছে।

টানেল ধ্বংস, আধিপত্য ধরে রাখা এবং হামাসকে কাবু করার ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ঘোষণা কতটুকু অর্জিত হয়েছে এমন প্রশ্নও করা হয়। এতে ৫৬ ভাগ ইসরাইলি মনে করে, আংশিক অর্জিত হয়েছে। ২৬ ভাগ মনে করে পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে আর ১৩ ভাগ মনে করে অর্জিত হয়নি।

জরিপ এই যুদ্ধে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালুন এবং সেনাপ্রধান বেনি গানৎজের কাজের মূল্যায়নও জানতে চাওয়ায় হয়।

এতে ৩৩ ভাগ ইসরাইলি মনে করে নেতানিয়াহু চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর ৩৩ ভাগ মনে করে ভালোভাবেই দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেলায় প্রায় একই মনোভাব। অবশ্য সেনাপ্রধান চমৎকারভাবে দায়িত্ব  সামলেছেন মনে করে ৫৩ ভাগ ইসরাইলি।

হামাসের  তৈরি  সুরঙ্গে এক ইসরাইলি সৈন্য এরকম অসংখ্য সুরঙ্গ পথ গাজার প্রতিরক্ষার জন্য হামাস তৈরি করেছে যার সবটিতে ইসরাইলি সৈন্য যেতে পারেনি। 

প্রসঙ্গত, ইসরাইলি হামলায় গাজায় প্রায় ২০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেসামরিক লোক ৭৯ ভাগ। আর হামাস যোদ্ধা ২৯৯ জন, শিশু ৪২৬ জন এবং নারী ২৫৫ জন। আহত হয়েছে ১০ হাজারের বেশি। বাস্তুচ্যুত হয়েছে পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনি।

ইসরাইলের ক্ষতি

যুদ্ধ চলাকালে এবার ৬৪ ইসরাইলি সেনা নিহত এবং ৪০০ এর বেশি সেনা আহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইসরাইল। এছাড়া ৩ জন বেসামরিক ইসরাইলি মারা গেছে। এবারের আগ্রাসনে ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রায় ২০০ কোটি ডলার বা প্রায় ১৬০০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির কর কর্তৃপক্ষের প্রধান মোশে আশার। 

বিজয়ী গাজাবাসী

গাজায় যুদ্ধবিরতি হামাসের বিজয় হিসাবে আরব বিশ্বের মূল্যায়ন হচ্ছে, তারা হামাসের সাফল্যে গর্বিত। এবারের ইসরাইলি আগ্রাসনের শুরু থেকেই হামাসের কাতার তার জনপ্রিয় আল জাজিরা চ্যানেলের হামাসের পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থন করে গেছে। আল জাজিরার রিপোর্টার ও উপস্থাপকরা সামাজিক গণমাধ্যমেও হামাসের পক্ষে তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছেন। সে চ্যানেলটির ‘উইদাউট বর্ডার’ প্রোগ্রামের উপস্থাপক আহমেদ মানসুর গত ৯ জুলাই ফেসবুকে লিখেছেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে তাতে আরব জাহানের অনেকেই গর্ববোধ করেন।

মানসুর লিখেছেন, ‘ মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও তার সরকার গাজা অবরুদ্ধ করে রাখার পরও ইসরাইলের গভীরে তেল আবিব, জেরুজালেম ও হাইফায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রকেট হামলায় ইসরাইল নির্বোধ ও হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে।’

‘(হামাস) যোদ্ধাদের হাতে যদি অস্ত্র থাকত এবং তারাও স্তব্ধ ইসরাইলি কাপুরুষের মত আঘাত করতেন তাহলে ইসরাইলিদেরও হয়তো আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই হতো অথবা দেশ ছেড়ে পালাতে হতো,’ গর্ব করেই লিখেছেন মানসুর। লেবাননের হেজবুল্লাহ ও ইরান জোটের সমর্থক দৈনিক পত্রিকা আল আখবারের শিরোনাম ছিল আল জাজিরার মতই- বিজয়ী গাজা (গাজা ট্রায়াম্ফান্ট)।

"অবরুদ্ধ গাজার নিরীহ নারী ও শিশুদেরকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে হামাস যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এ বিষয়ে ফিলিস্তিনের এবং হামাসের পক্ষে কলম তুলে ধরার ব্যাপারটি শুধু মমত্ববোধের বিষয় নয়, তবে নিঃসন্দেহে একটা নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের মমত্ববোধ থাকতেই হবে। এছাড়া হামাস যে প্রতিরোধ আন্দোলন করছে জায়ানবাদি ইসরাইলের বিরুদ্ধে সেটি হচ্ছে ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’র বিরুদ্ধে। ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’ এটা আসলে একটি বিশেষ ধরনের ‘কলোনিয়ালিজম’ সাম্রাজ্যবাদী যুগে আমরা দেখছি।" বলেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কলামিস্ট ফরহাদ মজহার।

গাজা আসলেই একটি কারাগার। ইসরাইল ফিলিস্তিনদের ভূমি অবৈধ দখল করে যেভাবে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং মিশরে যাওয়ার একমাত্র বর্ডার পোষ্ট রাফাকেও মিশরের সামরিক সরকার বন্ধ করে দেওয়ায় এখানকার জনগণের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এ অবস্থায় সেখানে হামাস যে প্রতিরোধ সংগ্রাম করছে- সুড়ঙ্গ করে, গর্তকরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে; তা নি:সন্দেহে মানব ইতিহাসে নির্যাতিত জনগণের এ ধরনের সংগ্রাম একটি অনুপম উদাহরণ হয়ে থাকবে চিরদিন। 

টানেলে আটকা পরা আল কাসসাম ব্রিগেডের ২৩ জন এলিট ফোর্সের মুজাহিদ অবশেষে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে

জায়নিস্টরা ইহুদিধর্মাবলম্বী হিসেবে পরিচয় দিলেও তারা মোটেও অতি ধার্মিক নয় কেউই। জায়নিস্টদের অধিকাংশই সত্যিকারার্থে নাস্তিক এবং চরম মেটেরিয়েলিষ্ট তথা বস্তুবাদী। কিন্তু তারা ইহুদীবাদ বা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করছে মূলত একটা ‘সেটেলার কলোনিয়ালিজম’"(Settler colonism) স্থাপনের জন্য। এ বিষয়টি খুবই পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন কলামিস্ট ফরহাদ মজহার:

"সেটলার কলোনিয়ালিজম কিন্তু প্রথাগত কলোনিয়ালিজম অপেক্ষা চরিত্রগত দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। উপনিবেশিক ইংরেজ আমলকে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন উপনিবেশিক শক্তি বাইরে থেকে আমাদেরকে শোষণ করেছে, শাসন ও লুণ্ঠন করেছে। তারা নানাভাবে আমাদেরকে নির্যাতন করেছে। কিন্তু তারা এদেশে এসে বসতি স্থাপন করে কাউকে উৎখাত করেনি।

‘সেটলার কলোনিয়ালিজমে’র অত্যন্ত ভালো উদাহরণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। অর্থাৎ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সাদা মানুষেরা সেখানে গিয়ে সেটেল করেছে এবং সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের তারা উৎখাত করেছে। আর তাদের অত্যাচারে বহুজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু জনগোষ্ঠী নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং যারা জীবিত আছে তাদেরকে সেটেলার কলোনিয়ালিস্টরা রিজার্ভ করে রেখে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বা অস্ট্রেলিয়াতে গেলে দেখতে পাবেন সেখানকার আদিবাসী যারা তাদের রিজার্ভ করে রেখেছে।

আজকে রেড ইন্ডিয়ানদের কথা বলুন বা আফ্রিকার কিছু অধিবাসীদের কথা বলুন- তারা কিন্তু সেখানে নেই। সেখানে যারা আছে তারা সকলেই বিদেশি। বাইরে থেকে এসে তারা মহাদেশ দখল করে নিয়েছে। এটাই ‘সেটলার কলোনিয়ালিজমে’র অত্যন্ত ভয়াবহ এবং নির্মম দিক। অবরুদ্ধ গাজাতে যখন হামাস লড়াই করছে তখন তারা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছে দীর্ঘ মানব ইতিহাসে ‘সেটলার কলোনিয়ালিস্ট’রা কিভাবে জায়গা দখল করেছে! তারা কিভাবে বিভিন্ন সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আর সেদিক থেকে হামাসের এই সংগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে, নৈতিকতার দিক থেকে, রাজনীতি এমনকি সাংস্কৃতিক দিক থেকে অসম সংগ্রাম। বাংলাদেশের মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছে তাদেরকে হামাসের প্রতিরোধ যুদ্ধের এ বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়া দরকার।

যখনই কোনো লড়াইয়ের প্রশ্ন আসে তখন মুসলিম বনাম ইহুদি এই দুয়ের মধ্যে রিডিউস করে ফেলা হয়। ইহুদিদের নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। ইহুদিরা হযরত মুসা (আ.) এর অনুসারী। ইহুদি এবং জায়নিজম সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। এ দুয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। বহু ইহুদি আছে যারা জায়ানিজমের বিরুদ্ধে। যেমন ধরুন আব্রাম নোয়াম চমস্কি, থিঙ্কেল স্টাইন। তারা সুস্পষ্টভাবে জায়ানিজমের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে জায়ানিজমের পক্ষে যারা তাদের অধিকাংশই ইহুদি নয়।"

ইহুদী কলামিস্ট জেফরি গোল্ডবার্জ Jeffrey Goldberg) লিখেছেন, "In a fight between a state actor and a non-state actor, the non-state actor can win merely by surviving. The party with tanks and planes is expected to win; the non-state group merely has to stay alive in order to declare victory."  অর্থাৎ  রাষ্ট্রীয় সামরিক শক্তি সঙ্গে অরাষ্ট্রীয় জন নায়কদের যুদ্ধে,  জনতার নায়কেরা শুধু মাত্র বেঁচে থেকেই যুদ্ধে জয়ী হতে পারে। বিরাট অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান রাষ্ট্র পক্ষের ধ্বংস যজ্ঞের মাধ্যামে জয়ী হওয়ার বাসনার মোকাবেলায় শুধু বেঁচে থাকতে পারলেই অরাষ্ট্রীয় জনতা নিজেদেরকে বিজয় ঘোষণা দিতে পারবে।" 

 

 Disasters Emergency Committee (DEC)

Ref:

Hamas vs. Israel: winning the diplomatic game | Al Jazeera

Why Is Israel Losing a War It's Winning? – The Atlantic

 

 

  

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *