হেফাজতে ইসলাম, হেফাজতে ইনসান

হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ এবং মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকে ৬ এপ্রিল রাজধানীর শাপলা চত্বরে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটাই ছিল দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। দেশ কাঁপানো একটি দিন ৬ এপ্রিল পেরিয়ে গেছে। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া লোকজন এখনও ‘দেখিয়াও না হয় প্রত্যয়’-এর ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ধর্ম প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে হাফেজ্জী হুজুর যখন সরাসরি রাজনীতিতে নামলেন, সেটাকে যদি আমরা প্রথম মাইলফলক বলে ধরে নেই, তবে ধর্ম রক্ষার ডাকে সাড়া দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাশ্রয়ী মহাজনতার এই মহাসমাবেশকে অবশ্যই এই ধারার দ্বিতীয় মাইলফলক বলে স্বীকার করে নিতে হবে। কোথা দিয়ে কী ঘটে গেল সেটা ভালো মতো বুঝে ওঠার আগেই শাপলা চত্বরকে কেন্দ্র করে মূল ঢাকার এক বিরাট এলাকা জনসমুদ্র। আসলে শুধু জনসমুদ্র বলা কি ঠিক হবে? কোনো সমাবেশে লাখখানেক বা তার কাছাকাছি জনসমাগম ঘটলে আমরা সেটাকে জনসমুদ্র আখ্যা দিয়ে থাকি। এর দশগুণের বেশি মানুষ যেখানে সমবেত হয়েছিল সেটার উপমা টানতে জনমহাসমুদ্র বললে কিছুটা যুত্সই হয়। আমরা হিন্দুরা মনে করি সবার মঙ্গল চিন্তায় উদ্বেলিত হয়ে ধর্মের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ যদি কোথাও দলে দলে সমবেত হয় তবে সেই স্থানটি তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে; সমবেত মানুষগুলোও অন্তত সেই সময়ের জন্য দেবতায় পরিণত হন। তাই একজন হিন্দু হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বর মহাতীর্থে পরিণত হয়েছিল এবং সেখানে গণদেবতার জাগরণ ঘটেছিল। এই জাগ্রত চেতনাকে ধরে রাখা গেলে জাতির বিরাট উপকার হবে। হেফাজতে ইসলামের মূল নেতা আল্লামা আহমদ শাহ শফী যদি উদ্যোগ নিয়ে প্রতি বছর ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরে ধার্মিকদের মহামিলনমেলার আয়োজন করেন এবং তাতে অন্যান্য ধর্মের মানুষজনকেও শরিক করে নেন তবে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলার চিরায়ত সম্প্রীতির চেতনা গোটা দুনিয়ায় আলো ছড়াতে শুরু করবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ এবং শাপলা চত্বরের কয়েক ঘণ্টার মহাসমাবেশ এমন কী ঘটিয়ে ফেলল যে, একজন হিন্দু হয়েও গোটা ব্যাপারটা আমাকে এত আনন্দ দিচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে; লংমার্চ এবং মহাসমাবেশে যোগদানকারীরা শুধু ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন না, একই সঙ্গে তারা ছিলেন ধর্ম অবমাননার কারণে চরমভাবে ক্ষুব্ধ মুসলমান। মুসলমানরা ধর্মের কারণে একবার ক্ষেপে গেলে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে এবং তখন তারা করতে পারে না হেন কাজ নেই—এমন একটা কথা পাশ্চাত্য থেকে আমাদের এখানে আসুক অথবা এখান থেকে পশ্চিমে চালান্ যাক, বাজারে বেশ চালু আছে। এমনকি মুসলমানের ঘরে জন্ম নেয়া অনেককে এই কথা রসিয়ে রসিয়ে বলতে আমি নিজ কানে শুনেছি। অথচ হেফাজতে ইসলামের ডাকা লংমার্চে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা লাখে লাখে এসেছেন, আসার সময় পথে পথে নির্যাতিত-নিগৃহীত-অপমানিত হয়েছেন, যানবাহন না পাওয়ার বাধা হেঁটে টপকেছেন, অনেকে (সংখ্যায় অযুত হবে) বাধার মুখে আসতে না পেরে বিভিন্ন জেলা শহরে সমাবেশ করেছেন; কিন্তু কোথাও তারা নিজেরা অশান্তির কারণ হননি। ধর্ম যে বিশ্বাসী মানুষকে কতটা ধৈর্যশীল ও সহ্য ক্ষমতার অধিকারী করে তুলে ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের মানুষ সেটা অবাক হয়ে দেখেছে। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল—মঞ্চ থেকে বক্তারা আপন ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে আপসহীন অবস্থানে থেকে দৃঢ় কণ্ঠে কথা বলেছেন; কিন্তু কোনো বক্তার মুখ থেকে অন্য ধর্মের মানুষ আহত বোধ করতে পারেন তেমন একটি বাক্যও শোনা যায়নি। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করতে দিলে কী কী বিপদ ঘটতে পারে তা নিয়ে দিনের পর দিন নানা কুিসত কথাবার্তা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য অপপ্রচার ছিল একবার মহাসমাবেশ করতে দিলে হুজুররা শাপলা চত্বরে এবং আশপাশে বসে পড়বেন; দেশে সামরিক শাসন জারি না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখান থেকে নড়বেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সেদিন মিলিটারিদের সাঁজোয়া যান রাস্তায় নামেনি এবং হুজুররাও কাঁটায় কাঁটায় বিকাল পাঁচটায় মহাসমাবেশ শেষ করে এলাকা ছেড়েছেন। ওইদিন আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেককে মোহিত করেছে ইনসানের (মানুষের) জাগরণ। জটিল যান্ত্রিকতায় পিষ্ট হয়ে ঢাকাবাসী মনুষ্যত্ব কাকে বলে সে কথা ভুলতে বসেছিল। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ সেই হারিয়ে যাওয়া মানবিক সহমর্মিতা খুঁজে বের করে ফিরিয়ে এনেছে। মহাসমাবেশে আগত হুজুরদের খাওয়ানো এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য কয়েক হাজার মানুষের সাধ্যমত চেষ্টা দেখেও যাদের চোখে পানি আসে না তাদের পাষাণ হৃদয় সীমারের চেয়েও কঠিন। আমার দেশ অফিসের অত্যন্ত কম বেতনের দু’জন তরুণ কর্মচারী নিজেদের টাকায় ১২ বোতল পানি কিনে সেদিন শাপলা চত্বরে গিয়েছিল আগত হুজুরদের পানি খাওয়াতে। তাদের কাছ থেকে শোনা, তারা সেখানে যাচ্ছে দেখে একজন গরিব মানুষ একশ’ টাকা দিয়ে তাদের বলেছেন, এই টাকায় যেন হুজুরদের কিছু একটা কিনে দেয়া হয়। তারা দেখেছে একজন শসা বিক্রেতা বিনামূল্যে শসা বিলাচ্ছে। হয়তো এই সেবা দিতে গিয়ে সেদিন তাকে সপরিবারে উপোস থাকতে হবে; কিন্তু সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। তারা একজন সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলেছে, যিনি গাজীপুর থেকে হেঁটে এসেছেন মহাসমাবেশে যোগ দিতে। মুসলমানদের যে কোনো ধর্মীয় সমাবেশের রেওয়াজ হচ্ছে একজন কেউ ‘নারায়ে তকবীর’ ধ্বনি দিলে অন্যরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে তাতে সাড়া দেন। আমার দেশ অফিস থেকে যাওয়া দুই তরুণ দেখে যে, একজন বয়স্ক লোক সাড়া দিচ্ছেন না। তারা তার কাছে গিয়ে কারণ জানতে চাইলে তিনি ফিসফিস করে বলেন, ‘বাবারে, কুমিল্লা থেকে হেঁটে এসেছি; আর দমে কুলাচ্ছে না।’ মনে রাখতে হবে, এরপরও কিন্তু লোকটি গনগনে রোদের মধ্যে বসেছিলেন; মহাসমাবেশ ছেড়ে যাননি। মহাসমাবেশের আগে, মহাসমাবেশ চলাকালে এবং মহাসমাবেশের পর এই কর্মসূচি নিয়ে কুত্সা রটনা অব্যাহতভাবে চলছে। কয়েকটি পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের আচরণ দেখলে মনে হয় তারা যেন ধার্মিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, হেফাজতে ইসলাম একটা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী; তারা দেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানাতে চায়; তাদের কথা শুনলে সমাজ হাজার বছর পিছিয়ে যাবে; নারী অধিকার বলে কিছু থাকবে না; তারা উগ্র, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ায় বিলেতে অবস্থানকারী এক সাংবাদিক এটাকে ‘গোদা পায়ের লাথি’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন। এতে অবশ্য তার নিচতাই প্রকাশ পেয়েছে। হুজুরদের উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার এতটা ‘সফল’ হয়েছিল যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে দারুণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। মহাসমাবেশ থেকে হুজুররা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাবে এবং হিন্দু-বৌদ্ধদের বাড়িতে কোনো মূর্তি থাকলে সেগুলো ভেঙে ফেলবে—এমন গুজবে আতঙ্কিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অনেকে তাদের বাড়িতে থাকা বুদ্ধমূর্তি ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে এনে রেখেছিল নিরাপত্তার খাতিরে। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি ও ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের মহাধ্যক্ষ সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের ৭ এপ্রিল নিজে আমাকে ব্যাপারটা বললেন এবং মূর্তিগুলো দেখালেন। আমি গুনে দেখি ১৯টা বুদ্ধমূর্তি বিভিন্ন বাসা থেকে রেখে যাওয়া হয়েছে। ঠাট্টা করে বললাম, লাঠি নিয়ে কোনো হুজুর আসেননি? তিনি মৃদু হাসলেন। সমাজ এক হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে আমার বাসায় আলোচনা জমে উঠেছিল। আমার স্ত্রী এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন, এক হাজার বছর আগে অর্থাত্ অতীশ দীপঙ্করের যুগে কি বাংলায় এই হারে গণধর্ষণ আর খুন-খারাবি হতো? তার এই জিজ্ঞাসার পর আলোচনা বিশেষ জমেনি। নানান কুত্সা প্রচার ও গুজবের মোকাবেলায় হেফাজতে ইসলামকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রেগে যেতে পারেন, ব্যথিত হতে পারেন এমন কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা মুসলমানদের দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা চালাতে পারে। এই ফাঁদে পা দেয়া চলবে না। অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমুন্নত রাখতে না পারলে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট না থাকলে সেটা হবে ধার্মিকতার পরাজয়। আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে মুসলমানরা ভালো মুসলমান হওয়ার জন্য, অর্থাত্ ইসলাম নির্দেশিত পথে থাকার জন্য সক্রিয়, সোচ্চার ও শপথবদ্ধ হয়েছেন। তারা সফল হলে আমার নিরাপত্তা, আমার ইজ্জতের সুরক্ষা আরও বাড়ার কথা। ৬ এপ্রিল দেখিয়ে দিয়েছে—মানুষ কত উপরে উঠতে পারে, আবার মানুষ কত নিচে নামতে পারে। আসুন আমরা সবাই মিলে নিচতা পরিহার করি এবং উচ্চতার সাধনায় মগ্ন হই। তাতে ইসলামের হেফাজত হবে, ইনসানের হেফাজত হবে, ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে।

(পর্ব প্রকাশিত:আমার দেশ)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *