স্মার্টফোনের যুগে ওভার স্মার্ট অবক্ষয়

একজন যুবক একটা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম চালিকা শক্তি। সৎ, দৃঢ়চেতা এবং কর্মঠ যুবক অনেক সহজেই তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। পরিণত হতে পারেন পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে। আর যুবকদের সম্মিলিত শক্তি সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র পৃথিবীতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় বিপ্লব যুবকদের দ্বারাই সংগঠিত এবং সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। ১৭৮৯ সনের ফরাসি বিপ্লব, ১৭৭৫ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৬৮৮-তে বৃটেনের গ্লোরিয়াস রেভ্যুলেশন, ১৭৯১ সালে হাইতির বিপ্লব, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ১৯০৮ সালে তুরষ্কের যুব বিপ্লব, ১৯১১ সনের চায়না বিপ্লব, ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব প্রভৃতিতে যুবসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সর্বোপরি আমাদের মহান ভাষা অন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সকল আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্র-যুবকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই যুব সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যদি কলুষিত হয়ে যায়, বিপথগামী হয়, অশ্লীলতা, সন্ত্রাস আর মাদকে আসক্ত হয়, তাহলে সমাজের মেরুদণ্ডটাই এক সময় ভেঙে পড়ে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নয়ন পৃথিবীটাকে একটা গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করেছে অনেক আগেই। পুঁজিবাদী ভাবধারা পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিপরীতে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি চরম অনীহা দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিশোর-যুবকেরা আজ তাদের শিক্ষক, গুরুজনদের এমনকি পিতা-মাতাকেও মান্য করছে না। পারিবারিক শিক্ষা আর মূল্যবোধকে গ্রহণ না করে যুবসমাজ এখন স্মার্টফোন কালচার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় ব্যয় করার চেয়ে ওরা এখন কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে। ইলেক্ট্রনিক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অনেক আবিস্কার আজ মোবাইল নামক ক্ষুদ্র একটা ডিভাইসে সন্নিবেশিত হয়েছে। বিজ্ঞানের এই গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কারটি বর্তমানে নৈতিকতার নীরব ঘাতক রূপে আবির্ভূত হয়েছে। মোবাইল বিনোদনের নামে সহজলভ্য অশ্লীলতা আজ ছাত্র, যুবক এমনকি কোমলমতি শিশুদের পকেটে পকেটে, যার ভয়াবহ পরিণতি আস্তে আস্তে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। এক সময় স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে হলে গিয়ে একটা সিনেমা দেখাকে যতটা অপরাধ মনে করা হতো আজ তুচ্ছ কোনো ব্যাপার নিয়ে কাউকে মেরে ফেললেও মানুষের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা পুরুষের কাছে নারীকে এবং নারীর কাছে পুরুষকে আকর্ষণহীন করে তুলছে। বিকৃত মানসিকতার পুরুষরা নারীকে এখন কন্যা, জায়া, জননী কিংবা ভগ্নী হিসেবে ভাবতে পারছে না। তাদের কাছে নারী এখন শুধুমাত্র একটা ভোগের আর দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা কিংবা চ্যাটিং হচ্ছে কিন্তু স্বামী বা স্ত্রীর একটা দুটো কথা শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অবাধ মেলামেশার কারণে পরনারী কিংবা পুরুষকে ভালো লাগলেও নিজের স্বামী কিংবা স্ত্রীর চেহারা আর ভালো লাগছে না। মোবাইলের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক প্রসার ঘটার কারণে অবাধ মেলামেশা বেড়ে গেছে। যার ফলে এইচআইভি/এইডস ঝুঁকি বাড়ছে। যুবসমাজের এই ভয়াভহ চারিত্রিক স্খলন সমাজকে একটা গহীন খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষকরূপী পরিমলরা ছোট বোন বা সন্তান তুল্য ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি ঘটাচ্ছে। মোবাইলে সেসব ঘটনার ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের নতুন ফাঁদ পাতা হচ্ছে। এ ধরনের হাজারো ঘটনার খুব কমই আমরা জানতে পারছি। শিক্ষক আর বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ একেবারেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররা আজ পিতৃতুল্য শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে এমনকি মেরে ফেলতেও দ্বিধা করছে না। আসলে এক সময় সৎ, মেধাবীরাই শিক্ষকতা পেশায় আসতো। কিন্তু আজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত অর্থ, পেশীশক্তি, স্বজনপ্রীতি আর রাজনৈতিক প্রভাবের জয়জয়কার। যার ফলে এক সময়কার কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্বের শিক্ষকের দেখা মিলছে না। শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা এখন একটা ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্ররা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। পিতা-মাতার অতি ব্যস্ততা অথবা উদাসিনতার কারণে সন্তানরা তাদের প্রাপ্য স্নেহ আর অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যার কারণে তারা বিদ্রোহী আর মারমুখি হয়ে উঠছে। তাদের মনোযোগ নানা দিকে ডাইভার্ট হচ্ছে। পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মায়া-মমতা উঠে যাচ্ছে। আধুনিক মিডিয়া, চলচ্চিত্রে সেক্স-ভায়োলেন্সকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপনার মাধ্যমে এগুলোকে গ্লামারাইজ করা হচ্ছে। তরুণ সমাজ এতে আকৃষ্ট হচ্ছে। তারা তাদের স্বপ্নের নায়ক, নায়িকা কিংবা ভিলেনদের নানা রকম অবাস্তব আচরণ আর বিপদজনক কর্মকাণ্ডকে অনুকরণ করছে। আসলে একদিকে আধুনিকতা আর প্রগতির নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা আর অশ্লীলতাকে লালন করা হচ্ছে। অপরদিকে কোনো অঘটন ঘটে গেলে ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই বলে চিৎকার চলছে- এমন দ্বিমুখী নীতির পরিবর্তন না ঘটলে নারীর প্রতিসহিংসতা কেয়ামত পর্যন্ত কমবে না। কোনো একটা দেশে যখন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিপন্ন হয়, রাজনীতিবিদরা যখন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা আর ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য তাদের সমস্ত মেধা, শ্রম, শক্তি ব্যবহারে মত্ত থাকে তখনই অরাজকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। আইনের শাসন বিপন্ন হয়, অন্যায়-অবিচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অপরাধ প্রবণতা লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে এবং এক সময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বর্তমানে দেশে আইনের শাসনের কাঠামো অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেকটা ভেঙে পড়েছে। যার ফলশ্রুতিতে অশ্লীলতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক দ্রব্য অত্যন্ত সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এর ফলে ঐশির মতো মেয়েদের জন্ম হচ্ছে- যে কিনা তার জন্মদাতা পিতা-মাতাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই কঠিন আর ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সচেতন নাগরিক, দায়িত্বশীল আর রাজনীতিবিদদের এখনই এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করা। সেই সঙ্গে পারিবারিকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং অপরাধীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থ বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাসহ আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ বন্ধ করতে হবে, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব পালনে আরও সচেতন হতে হবে। হয়রানিমূলক মামলা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার বন্ধ করতে হবে। বেকারত্ব হ্রাসে সরকারকে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি নৈতিক অবক্ষয় রোধে সরকার এবং বিরোধী দল উভয়কেই সুষ্পষ্ট ও শক্তিশালী পলিটিক্যাল উইল নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কেবল নৈতিক অবক্ষয় মুক্ত একটা সুখী, সমৃদ্ধ আর ন্যায়ভিত্তিক সমাজ আমরা গড়তে পারব। অন্যথায় অবক্ষয়ের এই ভয়াবহ থাবা এক সময় পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ফেলবে। লেখক: নূরে আলম সিদ্দিকী, ব্যাংকার ও কলাম লেখক ই-মেইল: [email protected]

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *