কেস স্ট্যাডি ১–“ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৪টা হবে। এসময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তুহিন আমাকে বলে তুমি কৌশিকদের সঙ্গে (ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে) যাও। আমি তাদের কাছে বন্দি থাকায় তাদের কথামতো তাদের সঙ্গে শহীদুল্লাহ কলাভবনের দক্ষিণ গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। দক্ষিণ গেটে ঢুকতেই বাঁয়ে ভবনের সিঁড়ি। সিঁড়ির নিচে ওরা (ছাত্রলীগ) ১০-১২ জন আমাকে ঘিরে ধরে। প্রথমে কাওছার আহম্মেদ কৌশিক (ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক) আমাকে জিজ্ঞাসা করে তুই ছাত্রলীগের ওপর গুলি করেছিস। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই চাপাতি দিয়ে ডান হাতে কোপ দেয় কৌশিক। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে কৌশিকের হাত থেকে চাপাতি নিয়ে আমার ডান পায়ে কোপ দিয়ে গোড়ালি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে গোলাম কিবরিয়া (ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক)। সে সময়ও আমার কিছুটা জ্ঞান ছিল। শুধু ডান হাত এবং ডান পায়ে কোন শক্তি পাচ্ছি না। গোড়ালি থেকে পা বিচ্ছিন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে আমার ডান পায়ে ও পরে বাম পায়ের উরুতে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল আহম্মেদ রুনু। গুলি করার পরে আমার আর জ্ঞান ছিল না।” হাসপাতালের বেডে শুয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন শিবির নেতা রাসেল। গত ১৬ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে কোপায় ছাত্রলীগ কর্মীরা।
কেস স্ট্যাডি-২
“বাইরে তখন প্রচ- হৈ চৈ ও গুলির শব্দ। এর মধ্যে কয়েকজন পুলিশ এসে চিৎকার করে বলতে থাকে ক্যাম্পের কোনো বিহারী যেন ঘর থেকে বাইরে বের না হয়। একটু পরেই শোনা যায় অচেনা কিছু যুবকের কণ্ঠস্বর। টের পাচ্ছিলাম ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে তারা। আমাদের ঘরকে লক্ষ্য করে কিছু এটা ছুড়ে মারে তারা। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। এমন আগুন জীবনে দেখিনি। আগুন এসে আমার পিঠে লাগে। এরপর হাতে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। চিৎকার করে পাশের আন্টিকে বলতে থাকি আন্টি ঘরে আগুন লেগেছে, বাঁচান। মা ভাইয়ের শরীরেও তখন আগুন লেগেছে। বাঁচার জন্য তারাও চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ আমাদের বাঁচাতে আসেনি।” গত ১৪ জুন ঢাকার মিরপুরের কালসীর বিহারী পল্লীতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ফারজানা ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে শুয়ে হত্যাকা-ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন এভাবে। শাসক দলের স্থানীয় এমপির সমর্থকদের লাগানো এই আগুনে ফারজানার পরিবারের ৯ জন জীবন্তদগ্ধ হয়ে মারা গেছে।
কেস স্ট্যাডি-৩
“জিহাদ, মানিক, পাংকু, আরিফ এবং রুটি সোহেল একটি টমটম দিয়ে চেয়ারম্যানের গাড়িটি ব্যারিকেড দেয়। তখন ওই গাড়িটির সামনে কালো রঙের একটি প্রিমিও গাড়ি ছিল। কালো গাড়িটি অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে সবাই রামদা, রড দিয়ে গাড়িটি ভাংচুর করা শুরু করি। এ সময় বাকিরা গাড়িটিতে ইট মারা শুরু করে। এ সময় ড্রাইভার গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আইল্যান্ডের ওপর উঠিয়ে দেয়। ভেতর থেকে একরাম ভাই গুলি করেন। শানান গাড়ির ডান দিকে ছিল। বাম দিকে জিহাদ এবং রুটি সোহেল ছিল। জিহাদ ও শানান উপরের দিকে গুলি ছোড়ে। রুটি সোহেল গাড়ির ভেতরে গুলি করে। এ সময় পাপন, নয়ন এবং এদের বন্ধুরা পাশের দোকান থেকে কেরোসিন নিয়ে এসে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়”। গত ২০ মে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে প্রধান অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা আবিদুল ইসলাম আবিদ ২৪ মে র্যাব হেডকোর্টারে দেয়া স্বীকারোক্তিতে এভাবেই হত্যাকান্ডের বর্ণনা দেন।
কেস স্ট্যাডি-৪
“নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের খানসাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকা (ময়লা ফেলার স্থান) থেকে নজরুল ইসলামসহ ৫ জন এবং নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালককে র্যাবের গাড়িতে তুলে নেয়া হয়। গাড়িতে তুলেই তাদের প্রত্যেকের শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হয়। এতে তারা অচেতন হয়ে পড়ে। দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতে নজরুলের গাড়ি গাজীপুরের জয়দেবপুরে এবং চন্দন সরকারের গাড়ি গুলশানের নিকেতনে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। অচেতন অবস্থায় অপহৃত সাতজনকে র্যাবের গাড়িতে কয়েক ঘণ্টা রাখা হয়। এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীতে। গাড়ির ভেতরই অচেতন প্রত্যেকের মাথা ও মুখম-ল পলিথিন দিয়ে মড়ানো হয়। পরে গলা চেপে ধরার পর একে একে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় সাতজন। পরে সাতজনের নিথর দেহ গাড়ি থেকে নামানো হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৫নং ঘাট থেকে র্যাবের নির্দিষ্ট নৌকা নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর ব্রিজের নিচে। তৃতীয় গ্রুপ লাশগুলো নৌকায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে যাওয়ার পথে আদমজী ইপিজেড ঘাট থেকে লাশ গুমের উপকরণ নৌকায় তোলা হয়। লাশ যাতে ভেসে না ওঠে এজন্য নৌকার মধ্যেই একে একে প্রত্যেকটি লাশের সঙ্গে ইট বাঁধার পর লাশের পেট ফুটো করে দেয়া হয়। তারপর তিন নদীর (শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বর ও মেঘনা) মোহনায় লাশগুলো ফেলে দিয়ে অপারেশনের ইতি টানা হয়”। গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডার খুনের বর্ণনা এটি। ৩০ এপ্রিল ও ১ মে অপহৃত বিকৃত লাশ ভেসে উঠে শীতলক্ষ্যায়।
লেখার শুরুতেই নির্মম হত্যাকা-ের নিষ্ঠুর বর্ণনা উল্লেখ করে পাঠক হৃদয় বিদীর্ণ করায় দুঃখ প্রকাশ বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যত ভয়াবহ, পৈশাচিক বা নিষ্ঠুরই হোক বাস্তবতা, আমাদের সমাজে এ ধরনের হত্যাকা- প্রায়শ সংঘটিত হচ্ছে। উল্লিখিত হত্যাকা-গুলোর বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন যে অসংখ্য হত্যাকা- সংঘঠিত হচ্ছে সেসবের কেস স্ট্যাডি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তার মধ্যেও বহুক্ষেত্রে এ ধরনের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান রয়েছে।
এটা সত্যি যে অপরাধমুক্ত সমাজ অবাস্তব ও অলীক। সব যুগে, সব কালে, সকল সমাজে কমবেশি অপরাধ ছিল এবং আছে। সেখানে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র একটি দেশে অপরাধ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে জনসংখ্যা, সমস্যা, চাহিদা ও ধৈর্যহীনতা যেখানে প্রবল সেখানে অপরাধের উচ্চমাত্রা অনাকাক্সিক্ষত হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যেভাবে বা যে প্রক্রিয়ায় অপরাধগুলো, বিশেষ করে হত্যাকা-সমূহ সংঘটিত হচ্ছে তা আমাদের জাতীয় মানবিক মূলবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ ধরনের পৈশাচিক হত্যাকা- কেবলমাত্র বর্বর সমাজেই দৃশ্যমান হয়। তাই বিশ্বের ৮ম বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে, যাদের রয়েছে উন্নত শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, তাদের মধ্যে এ ধরনের বর্বর মানসিকতা খুবই বেমানান। তবে সমস্যাটি হঠাৎ উত্থিত নয়। এমনও নয় যে, বর্তমান সরকারের কোনো বিশেষ ব্যর্থতার কারণে আমাদের জাতীয় মানসিকতায় এ ধরনের বর্বর জিগীষা তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিগত ৪৩ বছর ধরেই বাঙালি সমাজে এ ধরনের নিষ্ঠুরতা দৃশ্যমান হয়েছে বিভিন্ন সময়।
১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংঘটিত হত্যাকা-গুলোতেও এ ধরনের নিষ্ঠুরতা দৃশ্যমান ছিল। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার রাজপথ থেকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি স্টুয়ার্ড মুজিবকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা নির্মমভাবে হত্যা করে। একই সময়ে গুপ্ত ঘাতকের হাতে খুন হন নরসিংদীর নেভাল সিরাজ। নভেম্বরে খুন হন কুষ্টিয়ার সিদ্দিক মাস্টার। নিহতরা প্রত্যেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সৈনিক ছিলেন। অথচ স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই তাদের নির্মমভাবে নিহত হতে হয়। সেসময় স্টাবলিশমেন্ট বিরোধী মতামতকে প্রতিহত করতে যে হত্যাকা-গুলো সংঘটিত হয় তার নির্মমতা নজিরবিহীন। লাল ঘোড়া দাবড়ানোর আদেশ পেয়ে বিরোধী মতাবলম্বীদের বিভিন্ন টর্চার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে যে নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে স্বাধীন জাতি হিসেবে তা ছিল আমাদের জন্য লজ্জাকর। সে সময় নির্যাতনের শিকার কমরেড অরুণা সেন, শান্তি সেন, তদ্বীয় পুত্র চঞ্চল সেন, পুত্রবধূ রীনা ’৭৫ পরবর্তীকালে দেয়া জবানবন্দিতে তার কিছু নমুনা দেশবাসী জানতে পেরেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ শুধু একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়, সে সময়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে নিহত রশিদের বাপ আবদুল আলীর বর্ণনা ছিল এমন, ‘বাপ বেটা দুজনকে ধরে মার শুরু করলো। কতো হাতে পায়ে ধরলাম। এরপর মাতু গুলি করলো রশিদকে। ঢলে পড়লো রশিদ। মরার পর একজন বললো, চল ওর কল্লাটা নিয়ে যাই ফুটবল খেলবো। মাতু বললো, হ্যাঁ তাই নেবো। তবে ওর কল্লা আমরা কাটবো না তার বাবায় কেটে দেবে। বলেই আমার হাতে কুঠার দিয়ে বললো কেটে দিতে। চুপ করে আছি দেখে বেদম প্রহার শুরু করলো। বুড়ো মানুষ আর কতোক্ষণ সহ্য হয়। সিরাজ এসে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে বললো, এক্ষুনি কাট নইলে তোকে গুলি করবো। তখন দেড় ঘণ্টার মতো পার হয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম না কাটলে আমাকেও গুলি করে মারবে। শেষে কুঠার দিয়ে কেটে দিলাম, তারা নিয়ে গেল”। (বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সূচনাপর্ব : ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ- আহমেদ মুসা)। ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি সিরাজ শিকদারকে গ্রেফতার করা হয়। তার পরদিন তিনি নিহত হন।
ইতিহাসের পালাবদলে একই বছরের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে পৈশাচিক কায়দায়, যে নিষ্ঠুরতার সাথে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে সপরিবারে (দুই প্রবাসী কন্যা বাদে) হত্যা করা হয়েছে তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। একই বছরের নভেম্বর মাসে নারকীয় কায়দায় বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবে খুন হন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ৪ সিনিয়র সদস্য, জেনারেল খালেদ মোশাররফসহ বেশকিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮১ সালের ৩০ মে নির্মমভাবে খুন হন আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। হত্যাকারীরা তার মৃতদেহের উপর এলএমজি রেখে যেভাবে ম্যাগাজিন খালি করে গুলি করেছে তাতে হত্যাকারীদের নিষ্ঠুর জিগীষার পরিচয় পাওয়া যায়। এরশাদের শাসনামলেও নিষ্ঠুরতার এই ধারা অব্যহত থাকে। তখন বিরোধীমত দমনে মিছিলের উপর ট্রাক চালিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এরশাদের পতনের পর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জামালউদ্দীনকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশ টুকরো করে পাহাড়ে পুঁতে দেয়া হয়। তবে একথা সত্য যে, হত্যাকা-ের এই নিষ্ঠুরতা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের খবর ব্যাপকভাবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে শুরু করে। হত্যার পর নিহত লাশগুলোকে ত্রিশ টুকরো, সাত টুকরো করার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, ফেনীতে যুবদল নেতাকে গাছের সাথে বেঁধে ড্রিল মেশিন দিয়ে শতাধিক ছিদ্র করে হত্যা করা হয়েছে। ৩ বছরের শিশু তানিয়া, ৬ বছরের শিশু সীমা ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষণের সেঞ্চুরী উদযাপিত হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেও নিষ্ঠুর নির্যাতন ও পৈশাচিক হত্যাকা- সংঘটিত হয়। মালিবাগের মেধাবীছাত্র রুবেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, সোর্স জালালের গলিত লাশ ডিবি পুলিশের পানির ট্যাঙ্কি থেকে উদ্ধার করা হয়। এসময় দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের ফলে বহু মানুষ হতাহত হয়। দ্বিতীয় মেয়াদে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসলে অপারেশন ক্লিন হার্ট পরিচালনা ও র্যাব সৃষ্টির ফলে রাজনৈতিক নির্মম হত্যাকা- নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে র্যাবের সাথে ক্রসফায়ারে বা তাদের হেফাজতে নিহতদের নিয়ে দেশের মধ্যে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এ সময়ের ভয়াবহ নারকীয় হত্যাকা-ের সাক্ষী। ২০০৮ সালের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর পিলখানাতে সেনাকর্মকর্তাদের উপর যে নিষ্ঠুরতম ও পৈশাচিক হত্যাকা- পরিচালনা করা হয় তা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনী ও তার দোসরদের নির্যাতনকে হার মানিয়েছে। এসময় সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের উপর বর্বর নির্যাতন পরিচালনা করা হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এই নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার দৃষ্টান্ত খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগের এ মেয়াদে নরসিংদীর মেয়র লোকমান, নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু, নিজ বাসায় সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার মতো বর্বর ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে এসময় গুম, গুম করে হত্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এসব গুমকা-ের সাথে বেশিরভাগ সময়ই শাসকদলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম উচ্চারিত হয়। বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেপরোয়া নির্যাতন চালায়। স্বাধীনতার পর যেমন বলা হতো, নকশাল দেখলেই গুলি করো; এসময় বলা হলো জামায়াত শিবির দেখলেই গুলি করো। ৫ মে ২০১৩ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে আলেম হত্যা দিবস হিসাবে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত হয়ে রয়েছে।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ৬ জানুয়ারি ঢাকার দোহারে নৃশংস এক হত্যাকান্ডে পাঁচ জনকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের সূত্রপাত। ঢাকা-১ (নবাবগঞ্জ-দোহার) আসনে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানকে পরাজিত করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সালমা ইসলাম। নির্বাচনে সালমা ইসলামের পক্ষে কাজ করায় ও নৌকা মার্কায় ভোট না দেয়ায় বিলাসপুরে ৫ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে হত্যা করা হয়। সালমা ইসলাম এই হত্যার জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে দায়ী করেন। এ হত্যাকা-ের জন্য শুরুতে নির্বাচন বিরোধীদের দায়ী করা হয়েছিল। একইভাবে নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, কালসীর ঘটনাসহ প্রায় সব আলোচিত হত্যাকা-েই বিরোধী দলের দিকে তীর ছোড়া হয়েছে। এ প্রবণতাটি সব সময়ের। ফলে ৪৩ বছর ধরে বেশিরভাগ আলোচিত হত্যাকা-ই বিচার সমাপ্তির সিঁড়ি দেখেনি। এই বিচারহীনতা আমাদের সমাজে অপরাধকে লাগামহীন-বেপরোয়া করতে অবদান রেখেছে অনস্বীকার্য।
সাবেক মার্কিন কূটনীতিক বিউটেনিস ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে একবার বলেছিলেন, বাঙালিজ আর ইন্ডিভিজ্যুয়ালি কাউয়ার্ড, কালেকটিভটি ক্রুয়েল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দুজন বিদেশি বাঙালির চরিত্র সম্পর্কে নিজ দেশে পাঠানো প্রতিবেদনে প্রায় অভিন্ন কথা লিখেছেন। পাকিস্তানী জেনারেল হামিদ আরশাদ কোরেশী লিখেছেন, ‘জাতি হিসাবে বাঙালিরা খুবই সংস্কৃতিমনা। তা সত্ত্বেও একটি বিক্ষুব্ধ দল হিসেবে তারা মৌমাছির ঝাঁকের ন্যায়। যখন কেউ তাদের বিরক্ত করবে তখন সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধী ও নির্দোষ ব্যক্তিদের বাছ-বিচার না করেই হামলা করবে’। অন্যদিকে ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড লিখেছেন, ‘সহসাই শত শত বাঙালি তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস- আদালত থেকে চিৎকার করতে করতে ছুঁটে চলেছে যা ছিল তাদের রাগ ও ঘৃণার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। আমার মনে হয়েছে তারা যেন এক ঝাঁক মৌমাছি আর তাদের মৌচাকে ঢিল ছোঁড়া হয়েছে। (ডেড রেকনিং- শর্মিলা বসু)। অন্যদিকে বাঙালি জি ডাব্লিউ চৌধুরী লিখেছেন, বাঙালিরা কঠোর পরিশ্রম ও গঠনমূলক কর্মসূচি অপেক্ষা নেতিবাচক ও ধংসাত্মক প্রকৃতির জন্যই পরিচিতি পেয়েছে।
সাধারণত প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে সংঘটিত অপরাধ নিষ্ঠুর হয়ে থাকে। এমন নয় যে, এসব হত্যাকা-ই প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে কিম্বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ব্যক্তিগত শত্রুতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, লোভ, পেশাদার খুন সব ক্ষেত্রেই আমাদের অপরাধীদের এহেন নৃশংসতার পরিচয় পাওয়া যায়। আবার শুধু অপরাধীদের মানসিকতাতেই এই নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান, তা কিন্তু নয়। যারা অপরাধ করাচ্ছেন, প্রশ্রয় দিচ্ছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন- সমাজের সেই প্রতিষ্ঠিত লোকেরাও আপরাধীদের নৃশংস হতে, নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের নির্দেশ দিচ্ছেন। সমাজের উচুঁতলার উচ্চশিক্ষিত গৃহকত্রীদের সামান্য অপরাধে গৃহকর্মীদের গায়ে আগুনের সেঁক, এসিড মারা, টয়লেটে আটকে নির্মম নির্যাতনের খবরও পত্রিকায় দেখে থাকি। তাই অপরাধের যে প্রবণতা, প্রকৃতি- যে নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা, বর্বরতা এ দেশের অপরাধীদের অপরাধে বিদ্যমান তার কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। অপরাধের নিষ্ঠুরতায় বিবেক কেন দংশিত হয় না, সক্রিয় থাকে না তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন আমাদের জাতীয় মানসিকতাকে পরিশুদ্ধ করা। মানবিকতাকে দৃঢ় করা। মূল্যবোধকে শক্তিশালী করা। কারণ এ ধরনের অপরাধ দেশের মাঝে এবং বিশ্বের বুকে জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের, বাঙালিদের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, হেয় করছে, নিন্দিত করছে।
পূর্ব প্রকাশিত: দৈনিক ইনকিলাব
Email: [email protected]