পলাশী সিকিম ও বাংলাদেশ

২৩ জুন তারিখের গুরুত্ব:
যেকোনো জাতির বা জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে কিছু তারিখ গুরুত্বপূর্ণ। কিছু তারিখে আনন্দ ও উৎফুল্লতা বেশি হয়। কিছু তারিখে গুরুগাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়। কিছু তারিখে আত্মসমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসা গুরুত্ব পায়। কিছু তারিখ সাম্প্রতিক কালের; কিছু নিকট অতীতের এবং কিছু তারিখ সুদূর অতীতের। কথাটি বা যদিও সুপরিচিত নয়, তথাপি আমি ব্যবহার করলাম; যথা, ‘মধ্যবর্তী অতীত’। মানে নিকটেরও নয়, আবার অনেক দূরেরও নয়, মাঝামাঝি একটা সময়ের একটা তারিখ। মধ্যবর্তী অতীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হলো ২৩ জুন ১৭৫৭। আমার নিজের এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের কাছে ২৩ জুন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার জন্য সম্ভাব্য দু’টি কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো, ২৩ জুন ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন পুরনো রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ জন্মগ্রহণ করেছিল ১৯৪৯ সালের জুন মাসের ২৩ তারিখে। দ্বিতীয় কারণটি নিয়ে এই কলামে কিছু লিখব না আজ।

পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব :
পলাশীর যুদ্ধটি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, এই যুদ্ধে ওই আমলের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নামের বিরাট প্রদেশের স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট কাইভের বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়েছিল। ওই পরাজয়ের রেশ ধরে ইংরেজরা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশে নিজেদের কর্তৃত্ব বহাল করে এবং ক্রমান্বয়ে সেই কর্তৃত্ব সমগ্র ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করে। ২৩ জুন ১৭৫৭ তারিখে, বিকেল ৫টায় পলাশী প্রান্তরের যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সন্ধ্যা ৬টা ৫৭ মিনিটে ভাগীরথী নদীর তীরে নীল আকাশের পশ্চিম প্রান্তে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। একই সাথে শুধু বাংলার নয়, মূলত তৎকালীন মোগল সাম্রাজ্যের তথা ভারতের স্বাধীনতাসূর্যও অস্তমিত হয়েছিল। পরদিন, অর্থাৎ ২৪ জুন সকাল ৫টা ১৭ মিনিটে, একই ভাগীরথী নদীতীরে, সূর্য পুনরায় উদিত হয়েছিল সত্য, কিন্তু বাংলা বা ভারতের স্বাধীনতাসূর্য উদিত হতে আরো ১৯০ বছর লেগে গিয়েছিল। অতএব, পলাশীর যুদ্ধ সম্বন্ধে কিছু জানা এবং শিণীয় কিছু বিষয়বস্তুর দিকে মনোযোগ দেয়া একটি সময়োপযোগী ও যথার্থ বিষয়। এই কলামটি লিখছি সোমবার ২৩ জুন ২০১৪ তারিখে যে দিন পলাশী দিবস। পলাশী দিবসের আলোচনা : আজকের কয়েকটি পত্রিকায় পলাশীর যুদ্ধ সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। বহুল প্রচারিত নয়া দিগন্ত পত্রিকায় একটি পূর্ণপৃষ্ঠা আলোচনা আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন আলোচনাসভা বা সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছে। পাঠক এ কলামটি পড়ছেন বুধবার ২৫ জুন। পলাশীযুদ্ধ সম্বন্ধে আলোচনা শুধু ২৩ জুন তারিখে হবেÑ এমনটি নয়। সারা বছরের যেকোনো দিনই হতে পারে, যদি আমরা চাই। শত ব্যস্ততা ও সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা ওই আলোচনা করে উঠতে পারি না। কিন্তু বাংলাদেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পলাশীর যুদ্ধ ও এর গুরুত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা উচিত জাতীয় স্বার্থেই।

নবাবের পরাজয়ের কারণ:
পলাশীর যুদ্ধে মোটা দাগে নবাবের সৈন্য বাহিনী ছিল পদাতিক ৫০ হাজার, অশ্বারোহী ১৮ হাজার ও কামান ৫৩টি। একই যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্য বাহিনীর লোক ছিল তিন হাজার ও কামান নয়টি। নবাবের পে নিহত হয়েছিল প্রায় ৫০০ জন এবং ইংরেজের পে নিহত হয়েছিল দুই হাজার ২০০ জন। সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা থেকে যেকোনো পাঠক অনুমান করবেন যে, নবাব বাহিনীর পরাজয়ের কোনো কারণই ছিল না। কারণ, নবাব বাহিনী নিজেদেরই জায়গায় বা এলাকায়, নিজেদের আবহাওয়ায়, নিজের দেশের নদীতীরের ময়দানে যুদ্ধ করছেন। অপর প,ে রবার্ট কাইভের অধীনস্থ বাহিনী অপরিচিত ভূখণ্ড ও আবহাওয়ায় যুদ্ধ করছিল। তা হলে নিশ্চয়ই সংখ্যা, স্থান, আবহাওয়া প্রভৃতি উপাত্ত ছাড়াও কোনো-না-কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত (ফ্যাক্টর বা কারণ) নিশ্চয়ই আছে, যার প্রভাবে বা যার অজুহাতে নবাব বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। সেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো নবাবের অতি কাছের কয়েকজন অমাত্য ও সেনাপতি কর্তৃক নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তাদের মাতৃভূমি বাংলার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করা। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধকালে অথবা স্বাধীনতা রার জন্য যুদ্ধকালে, সব েেত্রই জনগণের প্রতি বিশ্বাস রাখা, জনগণ কর্তৃক শাসক বা সেনাপতিদের ওপর অর্পিত বিশ্বাসের মর্যাদা রাখা, ঊর্ধ্বতন অধিনায়ক কর্তৃক কনিষ্ঠ অধিনায়কের ওপর প্রদত্ত বিশ্বাস ও আস্থা রা করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা তথা ভারতে গণতন্ত্র ছিল না। রাজা বা বাদশাহ বা নবাবগণই ছিলেন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। পলাশীর যুদ্ধে, ওই আমলের বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক নবাব সিরাজউদ্দৌলা, তার অধীনস্থ অমাত্য ও সেনাপতিদের ওপর যে বিশ্বাস রেখেছিলেন, কয়েকজন অমাত্য ও সেনাপতি তার মর্যাদা রাখেননি। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। প্রধান বিশ্বাসঘাতক ছিলেন প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান। এই যুদ্ধের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনচ্যুত এবং মীর জাফর নতুন নবাব হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তবে, ইতিহাস মোতাবেক, দুই বছর পার হওয়ার আগেই মীর জাফরকে ইংরেজরা গদিচ্যুত করে এবং রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে নিপে করে। ইংরেজরা নতুন নতুন নবাব বানানোর খেলায় লিপ্ত হলো। আমার মূল্যায়নে যে শিাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো আনুগত্য ও বিশ্বাস। এ দুইয়ের বিপরীত শব্দ বা কর্ম হলো ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। মীর জাফর ছিলেন দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার প্রধান সেনাপতি। আধুনিক বাংলা ভাষায় বিশ্বাসঘাতকের অপর নাম বা বহুল প্রচলিত বিকল্প শব্দ হচ্ছে ‘মীরজাফর’।

মীরজাফর দেশে দেশে যুগে যুগে :
মীরজাফর শুধু বাংলা বা বাংলাদেশে নয়, প্রত্যেক জাতি বা জনগোষ্ঠীর ইতিহাসেই কোনো-না-কোনো সময় মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় জেলার ঠিক উত্তরে সিকিম নামে একটি দেশের কথা বলা যায়। এককালে সিকিম স্বাধীন দেশ ছিল; কিন্তু ১৯৭৪ সালে সিকিমেরই প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জির মীরজাফরির কারণে স্বাধীন দেশ সিকিম পরাধীন হয়ে যায়; সিকিম বর্তমানে ভারতের একটি প্রদেশ মাত্র। সিকিম সম্বন্ধে এখানে দু’টি কথা বলে রাখা ভালো। সিকিমের স্বাধীন রাজাদের উপাধি ছিল চোগওয়াল বা ছোগিয়াল। সিকিমের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ভারতের ইংরেজ শাসকগণের কাছে এবং আগস্ট ১৯৪৭ সালের পরে ভারতীয় শাসকগণের কাছে সিকিম ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরা সিকিম দখল করেছিল, আবার দখল ছেড়েছিল। কিন্তু ভারত ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে চূড়ান্তভাবে সিকিম দখল করে নেয়। দখলের আগে প্রায় দশ-বারো বছর ধরে জন্য ত্রে প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই পুরো কাজটির অপ্রকাশিত তত্ত্বাবধানকারী ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী ছিল একটি সংস্থা। সংস্থাটির নাম ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং" সংক্ষেপর। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সিকিম দখলই ছিল তাদের ওপর প্রদত্ত প্রথম দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব। এ জন্য সিকিম কংগ্রেস নামে একটি রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করা হয়েছিল। তারা যেন নির্বাচনে জয়ী হয় তার জন্য টাকা-পয়সা দেয়া হয়েছিল, নেতাদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা হয়েছিল, সিকিম কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল একদল বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং টাকার বিনিময়ে, বিভিন্ন লোভ ও লাভের বিনিময়ে সিকিমের সরকারি কর্মকর্তাদের আনুগত্য ক্রয় করা হয়েছিল। আয়তনে ও সামরিক শক্তিতে সিকিম একটি ক্ষুদ্র রাজ্য। অতএব, সিকিমের সীমান্ত রার জন্য গায়ে পড়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের সামরিক বাহিনীকে বা আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকে প্রশিণ দেয়ার জন্য ভারত উঠেপড়ে লেগেছিল। সাধারণ নাগরিক ও শ্রমিক সমাজের মাঝে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অজুহাতে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছিল। শ্রমিক ও নাগরিক আন্দোলন শুরু করা হয়েছিল। ওই পরিস্থিতিতে সিকিমের রাজা বা ছোগিয়ালের নিরাপত্তার জন্য ভারত সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি অংশকে সিকিমে পাঠিয়েছিল। ইতোমধ্যে নির্বাচন বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, যেই নির্বাচনে ভারতের প্রতি অতি বন্ধুপ্রতিম সিকিম কংগ্রেস বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। সেই সরকার তথা সেই পার্লামেন্ট প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজতন্ত্র বাতিল করা হোক। এই সিদ্ধান্ত থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি; যথার্থ সিকিম স্বাধীন থাকার প্রয়োজন নেই, সিকিম ভারতের সাথে একত্র হলেই খুশি। দশ বছরব্যাপী প্রস্তুতিমূলক নাটকের প্রযোজক ও পরিচালক ছিল বহুলালোচিত প্রতিষ্ঠান যার নাম। নাটকের চূড়ান্ত পর্যায়ের খলনায়ক ছিলেন ১৯৭৫-এর সিকিমের প্রধানমন্ত্রী, যার নাম লেন্দুপ দর্জি। ১৭৫৭ সালের মীরজাফর আর ১৯৭৫ সালের লেন্দুপ দর্জি একই অর্থ বহন করে। বাঙালির কাছে মীরজাফর আর সিকিমবাসীর কাছে লেন্দুপ দর্জি জাতীয় ও চিরস্থায়ী বিশ্বাসঘাতক।

যুদ্ধের সাধারণ প্রেক্ষাপট :
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এসে ব্যবসায়-বাণিজ্য শুরু করে। ইংল্যান্ডের অধিবাসী ইংরেজদের একটি ব্যবসায়িক কোম্পানি ছিল, যার নাম ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। তারা ১৬৫০-এর দশকে প্রথম থেকে তৎকালীন মোগল সাম্রাজ্যের বঙ্গ বা বাংলা প্রদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। দিল্লির মোগল সম্রাটের প্রতিনিধি যারা বঙ্গ বা বাংলা প্রদেশ শাসন করতেন, তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলার মাটিতে বসবাস, বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্য পরিচালনার অনুমতি দেন। প্রথম বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল হুগলি ও কাশিম বাজারে। বাণিজ্যে ভালো করার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জায়গা কেনা শুরু করে। তারা প্রথম যে তিনটি গ্রাম কেনে সেগুলোর নাম ছিল কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি। কলকাতা নামে ওই আমলের গ্রামে তারা একটি দুর্গ নির্মাণ করে যার নাম দিয়েছিল ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ অর্থাৎ, উইলিয়ামের দুর্গ। কয়েক বছর পর তারা কলকাতার আশপাশে আরো ৩৮টি গ্রাম ক্রয় করে। ইংরেজরা ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি করছিলÑ এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য যে, বঙ্গ বা বাংলা প্রদেশের শাসনকর্তারা এটা পছন্দ করছিলেন না। অন্যতম শাসনকর্তা সুবাহদার (অথবা সুবাদার) শায়েস্তা খান, নওয়াব মুর্শিদকুলি খান প্রমুখ শাসনকর্তা যতটুকু সম্ভব পরোভাবে ইংরেজদের বাধা দিয়ে আসছিলেন। ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে তরুণ নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি দেখলেন, বিগত প্রায় ১০০ বছরে, তার পূর্বপুরুষদের আমলে, ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক চরিত্র কলুষিত করেছে এবং নবাবদের প্রতি একটি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ উপস্থাপন করেন; যথা, 
১.
অনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়ামের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কার;
. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নামে অবৈধভাবে ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ;
. ইস্ট ইন্ডিয়া কর্মচারীরা দিল্লির মোগল সম্রাট কর্তৃক ফরমানের মাধ্যমে প্রদত্ত ব্যবসায়িক সুবিধাগুলো, যেগুলো শুধু আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্র ব্যবহার হওয়ার কথা, সেই সুবিধাগুলো অবৈধ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও প্রয়োগ করা;
. নবাবের অবাধ্য প্রজাদের বেআইনিভাবে আশ্রয়দান। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন এই অভিযোগগুলো নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ইংরেজদের তাগাদা দিলেন, তখন ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা ও ষড়যন্ত্র শুরু করল। একপর্যায়ে নবাব কাশিমবাজারে অবস্থিত ইংরেজ কুঠি অবরোধ এবং তাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এরপর নবাব সিরাজউদ্দৌলা অভিযান পরিচালনা করে কলকাতা দখল করেন। এরই পরিপ্রেেিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের সৈন্যরা নবাবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। ভারতের পূর্ব উপকূলের একটি শহর মাদ্রাজ। বর্তমান নাম চেন্নাই। তৎকালীন মাদ্রাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরেকটি বড় ঘাঁটি ছিল। কলকাতায় পরাজিত ইংরেজদের অনুরোধে মাদ্রাজ থেকে রবার্ট কাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসন নামে দুই ব্যক্তির অধীনে একদল ব্রিটিশ সৈন্য বাংলায় আসে। ওই সৈন্যদল স্থানীয় ইংরেজ সৈন্যদলের সাথে মিলে কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সাথে ‘আলী নগরের সন্ধি’ স্বাক্ষর করেন। সময়টা ছিল ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি।

তাৎণিক প্রেক্ষাপট :
ইংরেজরা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। নবাবের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ (যেটি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের একটি জেলা, বাংলাদেশের রাজশাহীর দক্ষিণে ও কুষ্টিয়ার পশ্চিমে)। ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ দরবারের নবাববিরোধী প্রভাবশালী কিছু অমাত্যের সাহায্য নেয়। নগদ অর্থপ্রাপ্তির কারণে ভবিষ্যতে বৃহৎ সম্পত্তি, প্রতিপত্তিশালী মতাধর ব্যক্তি ও বড় ব্যবসায়ী হওয়ার লোভে, নবাব-ঘনিষ্ঠ বেশ কিছুসংখ্যক অমাত্য, তলে তলে ইংরেজদের সাথে নবাববিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ‘মীর জাফর’। প্রায় অনুরূপ কারণে, কলকাতার কয়েকজন ব্যবসায়ীও ষড়যন্ত্রকারী ও ইংরেজদেরকে অতিরিক্ত আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতা প্রদান করেন। ওই ব্যবসায়ীদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উমি চাঁদ, দেওয়ান রায় দুর্লভরাম ও জগৎশেঠ। ষড়যন্ত্রকারী অমাত্য ও ব্যবসায়ীদের সাথে গোপন পরিকল্পনা পরিপক্ব বা চূড়ান্ত করার পরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চূড়ান্ত যুদ্ধে নামার জন্য অভিযান রচনা করে।

যুদ্ধের বর্ণনা :
১৩ জুন ১৭৫৭ তারিখে রবার্ট কাইভ তার সৈন্যদলসহ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ১৯ জুন কাইভ ও তার বাহিনী কাটোয়া নামক স্থানে পৌঁছে। ২২ ইংরেজ বাহিনী কাইভের নেতৃত্বে পলশীর পথে যাত্রা করে। ইতোমধ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা দেন এবং শত্র“কে মোকাবেলা করার জন্য ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী নামে এক গ্রামের আম্রকাননে শিবির স্থাপন করেন। ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়। তখনকার আমলের প্রখ্যাত সাহসী সেনাপতি মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আবদুল হাজি খান, নব সিং হাজারি প্রমুখ তাদের অধীনস্থ সেনাদল নিয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। অপর পে তিনজন সেনাপতি মীর জাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভ রাম নিজেদের অধীনস্থ সেনাদল নিয়ে নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকেন। তা সত্ত্বেও যুদ্ধ তুমুল হয়েছিল। বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরও কোনো চূড়ান্ত ফলাফল কোনো পই পাচ্ছিল না। নিজেদের অনুকূলে অগ্রগতির অভাবে ইংরেজ সেনাপতি কাইভ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ইতিহাসবেত্তাগণ কাইভের মানসিক অবস্থাকে মূল্যায়ন করেছেন এই বলে যে, কোনোমতে দিনের বেলাটি যুদ্ধময়দানে পার করে রাতের অন্ধকারে কাইভ কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। কাইভের মূল্যায়নে, যদিও কাইভের সাথে ষড়যন্ত্রকারী তিনজন সেনাপতি নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তথাপি নবাবের বাহিনী যুদ্ধে জয়ী হতে চলছিল। এ রকম একটি পরিস্থিতি বা পরিবেশে আনুমানিক বেলা ৩টার সময় ইংরেজ পরে একটি কামানের গোলা নবাবের পরে বিশ্বস্ত ও সাহসী সেনাপতি মীর মর্দানকে আঘাত করে এবং এই আঘাতে তার মৃত্যু হয়। মীর মর্দানের অভাবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা হতভম্ব হয়ে যান। নবাব তার প্রধান অমাত্য ও সেনাপতি মীর জাফরকে অনুরোধ করেন নবাবের জীবন, সম্মান এবং বাংলার সম্মান রার জন্য মীর জাফর যেন আপ্রাণ চেষ্টা করেন। নবাবের এই দুর্বল মুহূর্তে মীর জাফর একটি পরিকল্পিত চাল চালেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে প্রস্তাব করেন যে, ওই দিনের মতো যুদ্ধ যেন বন্ধ করা হয় এবং পরদিন ২৪ জুন সকালে নতুন শক্তিতে নতুন উদ্যমে যেন যুদ্ধ শুরু করা হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফরের প্রস্তাব মেনে নেন এবং নিজ সৈন্যবাহিনীকে ওই মোতাবেক আদেশ দেন। কিন্তু চতুর বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীরজাফর এই পরিকল্পনা ও নবাবের আদেশের সংবাদটি গোপনে ইংরেজ সেনাপতি কাইভের কাছে পৌঁছে দেন। নবাব মীর জাফরের পরামর্শ গ্রহণ করে সৈন্য বাহিনীকে পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার আদেশ দেন। তারা নিশ্চিন্ত মনে পেছনের দিকে হটা শুরু করে। নবাবের সৈন্য বাহিনীর এরূপ অবস্থায় তাদের ওপর দ্রুত গতিতে পলাশী সিকিম ও বাংলাদেশক্ক্তার সাথে রবার্ট কাইভের সৈন্য বাহিনী আক্রমণ। ইংরেজ বাহিনীর পক্ষ থেকে এরূপ চালায় আক্রমণ আসবে, তার জন্য নবাব বাহিনী অপ্রস্তুত ছিল। ফলে নবাবের বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ইংরেজদের অনুকূলে, ইংরেজদের জয়ের মাধ্যমে, পলাশীর যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।

স্বাধীনতাসূর্য পুনরায় উদিত :
পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেটি পুনরায় উদিত হয়েছিল ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখে। কিন্তু পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির কর্ণধারগণ না গণতান্ত্রিক ছিলেন, না ইসলামি চেতনার অনুসারী ছিলেন। তাদের আগ্রাসী ও শোষণকামী মনোভাবের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতাকামী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর চরম ও চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রোপটে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে। হাজারো সাহসী বাঙালি নিজ নিজ ক্ষেত্রে ২৬ মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং যুদ্ধ শুরু করে। ওই আমলের চট্টগ্রাম শহরের অল্প উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ২৭ মাচ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন, একাধিক প্রয়োজনে নিজেকে অস্থায়ী সরকার প্রধান বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই স্বাধীনতাকে সুসংহত করার নিমিত্তে সাংবিধানিকভাবে পদপে নেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলার বা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। স্থানটি ছিল আরেকটি আম্রকাননে। গ্রামের নাম বৈদ্যনাথ তলা, মহকুমা মেহেরপুর, জেলা কুষ্টিয়া, তারিখ ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। সেই গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘মুজিবনগর’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। কিন্তু ২৬ মার্চ বা ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ এক দিনে বা হঠাৎ করে আসেনি। এরও দীর্ঘ প্রস্তুতি আছে।

অনুভূতি এবং আবেদন :
২০১৪ সালের জুন মাসের ২৩ তারিখ, আমরা কী করতে পারি? আমরা পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে অতিরিক্ত কিছু জানতে চেষ্টা করতে পারি। ওই আমলের বিশ্বাসঘাতকদের সম্পর্কে একটু গভীরভাবে জানতে চেষ্টা করতে পারি, যেন অনুরূপ কিছু ২০১৪ সালে বা ভবিষ্যতে না ঘটে। আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরো জানতে চেষ্টা করতে পারি। আমরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অধিকতর জানতে চেষ্টা করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সৈনিক জিয়াউর রহমান বীর উত্তম সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করতে পারি। আম্রকানন আমাদের ইতিহাসের প্রতীক। আমরা আম্রকানন সৃষ্টি করতে পারি। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি ভাটিয়ারীতে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলাম সহকর্মীদের সহযোগিতায়। ওই ভাস্কর্যের নাম ‘স্বাধীনতা মানচিত্র’। ভাস্কর অলক রায় ছিলেন অন্যতম প্রধান সহকর্মী। ওই ভাস্কর্যের ঠিক পাশেই শূন্য ময়দানে একটি আমবাগান সৃষ্টি করেছিলাম। কারণ, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে আমবাগান গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। 

পূর্ব প্রকাশিত: দৈনিক নয়াগিন্ত।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *