আধুনিক সমাজের শান্তি -না বিশ্বাসে, না অবিশ্বাসে

আজকের সমাজের অবস্থা জানতে হলে তার প্যাথোলজির দিকে তাকাতে হয়। আমেরিকায় প্রত্যেক ১৭ মিনিটে এক জন লোক আত্মহত্যা করে এবং এভাবে বৎসরে ৩০,০০০ হাজারের বেশি লোকের আত্মাহুতি ঘটে। এর পিছনে থাকে নানান নৈরাশ্য, মনঃপীড়া আর মুক্তির প্রত্যাশায় মাদক সেবন। (দেখুন মতপ্রণীত ‘আত্মহত্যা ও বিশ্বাস’)। আমাদের ব্রিটেনের অবস্থা এত্থেকে দূরে নয় বরং আশেপাশে -অনেক পরিসংখ্যান আবার শঙ্কিত করে তুলে। ব্রিটেনে প্রতি ৩ বিয়ের দুটি ভেঙ্গে যায়। এক বিরাট সংখ্যক লোক নানান ধরণের মানসিক সমস্যায় (ডিপ্রেশনে) ভোগেন এবং সমস্যা লাঘবের জন্য এন্টি ডিপ্রেসেন্ট সেবন করেন। ধনতান্ত্রিকদের পরিবেষ্টনে সর্বসাধারণ নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিত্ত সংরক্ষণে ইঁদুরের দৌড়ে ব্যস্ত। মিথ্যাচার, ঠকা-ঠকি, ওয়াদা খেলাফি, অপরের অধিকার নষ্ট ও আত্মসাৎ -এগুলো হচ্ছে সামগ্রিক বাস্তবতা। সর্বত্র চাচা আপনা জান বাঁচা।

রাজনৈতিক দলগুলো কর্পোরেট সত্তাসমূহের ক্রীড়নক। এখানে কেবল ধাপ্পাবাজি, ভাষার মারপ্যাঁচ আর ভিতরে মিথ্যাচার। সার্বিক বাস্তবতা এই যে সকলের মুখের ভাষা জুড়ে আছে গণতন্ত্র, অধিকার, সমতা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, প্রগতি। কিন্তু এগুলোর ভিতরের বাস্তবতা ও প্রকৃতি বুঝার সক্ষমতা সর্বসাধারণের নেই। যারা বিগত ৩ শো বছর ধরে এগুলো চালিয়ে দিয়েছে তাদের কাছে এসবের প্রকৃতি সর্বসাধারণে ব্যাখ্যা করার গরজ নেই, কেননা এতে থলের বিড়াল নিজেরাই বের করে দিতে হয়। আজ, পতঙ্গ যেভাবে অগ্নিতে ঝাঁপ দেয়, সেভাবে সর্বসাধারণ আধুনিকতার ম্যাজিক্যাল শব্দ ও ধারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের সমতা ও স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে সর্বদা ঝগড়ার স্থানে; কর্মস্থানে দ্রুত উন্নতির জন্য করাপশন; উন্নতির জন্য স্বামী –স্ত্রী দিন-রাত কাজে ব্যস্ত আর শিশু-বাচ্চারা কেয়ার ওয়ার্কারের লালনে। কেউ কেউ ক্ষমতার বাইরের সম্পদের জগত ঠিকিয়ে রাখতে হিমসিম খাচ্ছেন। এসবের মানসিক প্রতিক্রিয়া জীবনকে দুর্বিষহ, অশান্ত করছে। আবার হঠাৎ করে বিরাট অঙ্কের টাকা পেলে দ্রুত মুক্তি ঘটবে –এই আশায় জুয়া (gambling) খেলায় এক গোষ্ঠী এডিক্টেড, আর সামাজিক ব্যাধি যতই বাড়ছে, জুয়াও দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। আগে পুরুষেরা জুয়া খেলতেন, এখন নারীরাও আক্রান্ত। আগে জুয়া ছিল হাই-স্ট্রিটে। এখন তা কম্পিউটার, টিভি ও ফোনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে। নানান বিজ্ঞাপন “আশার” চিত্র দেখিয়ে নিরাশায় সর্বনাশ করছে। যা বলছি তার সবকিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জড়িত, একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কশীল।

বিশ্বাসের জগতের ঘটনা কী? বিগত ৩ শো বছর ধরে বিশ্বাসের সমাজ আধুনিকতাবাদের (modernism) সয়লাবে নির্মূল হয়ে গিয়েছে। উপরের চিত্র সেই প্যাথোলজি বহন করে। ভাঙ্গা সমাজের বিশ্বাসের টুকিটাকি এখানে সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

বিশ্বাসের জীবন বিশ্বাসে নিয়ন্ত্রিত হতে হয়। বিশ্বাসের প্রতিটি কর্ম বিশ্বাসের বাইরের জগত বা অবিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সন্দেহ’ করা যেতে পারে –যেমন আল্লাহ সত্যি সাহায্য করলেন, না ওখানে মূলত কোনো সাহায্য আসেনি, এমন সন্দেহের অসংখ্য স্থান থাকতে পারে, কেননা অদৃশ্য খোদার অস্তিত্ব যেমন, তার গুণও তেমন, তার সাহায্যের স্বরূপও তেমন, এগুলো বিশ্বাসের বিষয়। ইসলাম ধর্মের খোদাতে বিশ্বাসের প্রকৃতি হচ্ছে ‘আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করলাম তিনি যেমন তেমনি’ অর্থাৎ এখানে খোদার উপর বিশ্বাস একান্ত বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে এই যে শান্তি আসে মূলত দৃঢ় প্রত্যয় বা বিশ্বাস থেকে –সাইকোলজিক্যাল বাস্তবতা ও চরিত্রে আত্মস্থ হয়ে। এই বিশ্বাস বা প্রত্যয়ের দৃঢ়তা হারিয়ে আজকের আধুনিক সমাজের কী হয়েছে, সেটাই হচ্ছে ভাবার বিষয়। প্যাথোলজিক্যাল ফিরিস্তি দেখলে তা প্রস্ফুটিত হয়। যে বিশ্বাস জীবনে শান্তি আনবে, সেই বিশ্বাস আজ কতটুকু আছে? আমার দৃষ্টিতে নেহায়েত কম। এই বিশ্বাস চাষ করতে হয়; শিক্ষা-দীক্ষায় পেতে হয়; সাধনা-তপস্যায় অর্জিত হতে হয়। বাচ্চা-বয়স থেকে মনোমানসিকতা সেভাবে প্রোগ্রাম করতে করতে হয়। তা না হলে, বিশ্বাস মুখেই থেকে যায়, অথবা ভিতরে প্রবেশ করা কঠোর সাধনা সাপেক্ষ হয়। এটা না করলে বিশ্বাসের সার্থক স্থানে উপনীত হওয়া যায় না। আর সেই স্থান উপনীত না হয়ে মুখের বিশ্বাস, মুখেই থেকে যায়। আর এতে বাস্তবতা এও হতে পারে যে অবিশ্বাসী জীবনের যত ধরণের জ্বালা ও ভোগান্তি আছে, মৌখিক অর্থের ‘বিশ্বাসীরাও’ সেগুলো থেকে মুক্তি পাবেন না। যখন ক্রাইম ও ভোগান্তির সয়লাব দু’ তীরেই সমভাবে পাওয়া যাবে, তখন অনেকের কাছে এটাই অনুভূত হতে পারে যে বিশ্বাস অবিশ্বাসে কোনো পার্থক্য নেই -বিশ্বাস যেন নিছক “পরিচিতি”। আজকের এই বাস্তবতা আমাদের সমাজের লোকদের কথাবার্তায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই পরিণতি থেকে কী পরিত্রাণ আছে অর্থাৎ এই স্থূলধর্মী বা মৌখিক বিশ্বাসের বাস্তবতা থেকে কী মুক্তি পাওয়া যাবে? হ্যাঁ, যাবে কিন্তু সেই সম্ভাবনা বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ক্ষীণ বা ক্ষীণতম (হয়ত একটু বেশি নেতিবাচক করে বলছি) । আজ প্রতিকূলতা সার্বিক, বৃহত্তর সমাজের আচরণ ও ধ্যান ধারণা সর্বত্র প্রবল ও প্রভাব-বিস্তারকারী। এত্থেকে বেরিয়ে আসতে পারিপার্শ্বিকতা থেকে যে সাহায্যের প্রয়োজন সেটা পাওয়া যাবে না। কারণ আধুনিকতা সর্বগ্রাসী হয়ে পড়েছে। ধরুন কেউ সেই বিশ্বাসের প্রক্রিয়া সমাজে প্রতিষ্ঠা করার আওয়াজ তুলল। কিন্তু দেখবেন, আপনি হয়ত তার প্রথম সমালোচক। আপনিই তার মধ্যে ছিদ্র দেখবেন। কারণ আপনি হয়ত না-বুঝে গণতান্ত্রিক/সমাজতান্ত্রিক আদর্শের লোক। আপনি সব ধর্মের দোহাই তুলবেন। আবার বিশ্বাসের অনুকূলবর্তি শিক্ষা ও নৈতিকতা আপনি পক্ষান্তরে নাও চাইতে পারেন, কেননা আপনার ধারণায় হয়ত বিশ্বাসের শিক্ষা বাচ্চাদের মানসিকতাকে “প্রোগ্রাম” করে ফেলে। কিন্তু আপনি যে ‘বিশ্বাসে’ “প্রোগ্রামড” হয়ে আছেন এবং আপনার শ্রেণী ও সমাজ যেভাবে রূপায়িত হয়ে আছে, তাতে কী শান্তি বিরাজ করছে? সামাজিক প্যাথোলজি কী দেখাচ্ছে? আপনি আধুনিক সমাজ দর্শনের খোদাহীনতা কী বুঝতে পেরেছেন?

আজ বিশ্বাসের অভাবে মানুষ যন্ত্রণায় পীড়িত। সার্বিকভাবে অবিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত স্বর্গ-সমাজের (আধুনিকতাবাদী) আশা মানুষকে ৩ শো বছর ধরে যেখানে হাজির করেছে, এই স্থানটি এক ধরণের দোযখ। আবার যারা এই আধুনিকতার ভিতরে, এই সমাজ-শিক্ষার আওতায় বড় হয়ে নিজেদেরকে “বিশ্বাসী” ভাবছেন, তারাও এই অশান্তির অনল থেকে মুক্ত নন, কেননা এই বিশ্বাস সেই বিশ্বাস নয়।

[দ্রষ্টব্য: এই লেখায় সামগ্রিকতা দেখাতে দু/একটি স্থানে ‘সাধারণী’ দৃষ্টিভঙ্গি টানা হয়েছে।]

Loading

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *