সঙ্গে আছি

১৯৯৫ সালের প্রায় পুরোটাই এবং ১৯৯৬ সালের প্রথম তিন মাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সাংঘাতিকভাবে উত্তাল ছিল। আন্দোলনকারী ছিলেন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী একসাথে। পুনরায় ২০০৬ সালের শেষাংশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সাংঘাতিকভাবে উত্তাল ছিল। আন্দোলনকারী ছিলেন আওয়ামী লীগ ও তদীয় জোটের শরীকেরা। আন্দোলনের মাধ্যমে এরা কিছু অর্জন করতে পেরেছিলেন। অতএব রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক ও রাজপথের আন্দোলন অপরিহার্য। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে এক দিকে যেমন রাজনৈতিক সাফল্য আসে, অপর দিকে ওই আন্দোলনের কারণেই ত-বিত হয়ে যাওয়া একটি সমাজ ও অর্থনীতি পাওয়া যায়। অতএব রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্যের কারণে মতায় যাওয়ার পর সফল রাজনৈতিক দলের কাঁধেই পড়ে তবিত সমাজ ও অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার দায়িত্ব। এই মুহূর্তে সামনের দিকে তাকালেই আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের আগামী দিনগুলো কঠিন, কঠোর এবং দুঃখময়। এ জন্য দায়ী কে? বিস্তারিত উত্তর দেয়া উচিত কিন্তু স্থানাভাবে দিচ্ছি না। সংপ্তিতম উত্তর হচ্ছে, আমার মতে, এর জন্য দায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার। কারণ, প্রায় দুই বছর আগে, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, হঠাৎ করেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছিলেন। সেদিন থেকেই আন্দোলন শুরু। কে দায়ী সেটা বের করা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বা হবে, তিগ্রস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ মানবীয় সম্পর্ক ইত্যাদি পুনর্গঠন করা। পুনর্গঠন কাজে যে কর্মী দল প্রয়োজন হবে তার নেতৃত্বে কে থাকবে এটা আমরা জানি না, তবে যথাসম্ভব রাজনীতিবিদদের পাশে পেশাজীবী সহকর্মীর প্রয়োজন হবে। কেন প্রয়োজন হবে, সেটাও বলা প্রয়োজন। গত ৪ বছরে মতাসীন সরকার দেশটিকে অত্যন্ত নাজুক ও স্পর্শকাতর পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এত নাজুক এবং স্পর্শকাতর যে আরেকটু বেশি চাপ প্রয়োগ করা হলে দেশ বা সমাজ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পৃথিবীতে এরকম ভেঙে যাওয়ার উদাহরণ আছে এবং ওই রূপ ভেঙে যাওয়া দেশের ও সমাজের জনগণ কি নিদারুণ কষ্টে আছে, সেটা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি বলেই আমরা আমাদের দেশ ও সমাজকে কোনোমতেই ভেঙে যেতে দিতে পারি না। এই ভাঙার প্রক্রিয়া রোধ করতে হলে যে কর্মীবাহিনী প্রয়োজন, সেই কর্মীবাহিনীর নেতৃত্বে কে থাকবেন এটাও প্রশ্ন। অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্বে রাজনীতিবিদেরা থাকবেন কিন্তু তাদের সাথে পেশাজীবী সহকর্মীদেরও থাকতে হবে। কারণ, এই মুহূর্তে আছে রাজনীতিবিদেরা এবং তাদের কারণেই সমাজ প্রায় ভেঙে যাচ্ছে, আবার আন্দোলন করছেন যারা তারাও রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবিদদের ছাড়া কোনো দিনই পুনর্গঠন হবে না, কারণ পেশাদার ও আন্তরিক রাজনীতিবিদেরাই জনগণের দৈনন্দিন সুখদুঃখ, আশা-আকাক্সা ইত্যাদির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং পরিচিত। আমি দু’টি শব্দ ব্যবহার করেছিÑ পেশাদার ও আন্তরিক। তার মানে হচ্ছে, কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদ যারা পেশাদার ও আন্তরিক, তারা দেশ ও সমাজকে ভেঙে যাওয়া থেকে রা করার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বের অংশীদার হবেন এবং দেশকে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায়ও নেতৃত্বে অংশীদার হবেন। আর কারা কারা এই উভয়প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবেন, সেটা হচ্ছে পরবর্তী প্রশ্ন। অবশ্যম্ভাবীভাবে জড়িত থাকবেন ওই সব বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাবেক সুনামধারী সরকারি কর্মকর্তারা, সুনামধারী সাবেক সেনাকর্মকর্তারা, সফল ও সুনামধারী ব্যবসায়ীরা, সুনামধারী মুক্তিযোদ্ধা এবং সুনামধারী সব সংবাদকর্মী, যারা হয় মধ্যপন্থা অবলম্বন করে অথবা সমন্বিতভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন। কোনো সম্মেলন ডেকে হাজার হাজার উপস্থিত বরেণ্য ব্যক্তির সম্মতি নিয়ে এই কর্মযজ্ঞ শুরু বা পরিচালনা সম্ভব নয়। এই কর্মযজ্ঞ শুরু এবং পরিচালনা স্বাভাবিক নিয়মেই চলতে থাকে; লোক জড়িত হতে হতে প্রক্রিয়ার কলেবর বৃদ্ধি পায় আবার কোনো কোনোেে ত্র লোকজন বিযুক্তও হয়ে যায়। বাংলাদেশের সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত, এটা বলতে লজ্জা পেলে ভুল করা হবে। বিভক্ত বাংলাদেশের ছবিটা আঁকলে এবং এর তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে, পরবর্তী কাজটা সহজ হবে। বাংলাদেশের সমাজে রাজনৈতিক বিভক্তিটা মোটামুটিভাবে আওয়ামী লীগপন্থী ও বিএনপিপন্থী, এভাবেই চিহ্নিত করা যায়। আবার অনেকে এ রকমও বলেন, একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পরে শক্তি এবং অপরটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিপরে শক্তি। কেন জানি আবেগের অঙ্গনে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ উভয়কে বিভাজনের উপাত্ত বা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে (যেটা আমি কোনোমতেই সমর্থন করছি না)। ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়। সব মুক্তিযোদ্ধার ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ মূল্যায়নের ত্রে এবং মানদণ্ড এক রকম নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এই মুহূর্তে বিদ্যমান বিভাজন বা মতপার্থক্যের কারণ বা অজুহাত বা উপাত্তের মধ্যে অন্যতম আরেকটি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আঙ্গিকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের গভীরতা বা অগভীরতা। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। অতএব মনের গভীরে পাকিস্তানের প্রতি বৈরী মনোভাব থাকা স্বাভাবিক। এই বৈরিতা আংশিকভাবে কেটে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আংশিকভাবে অস্বাভাবিক করে তুলেছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালি বা বাংলাদেশী পাকিস্তানপন্থীদের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের কিছু কিছু চিন্তাভাবনা এবং সেসব চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাঙ্গীণভাবে সাহায্য করেছিল ভারত। সাহায্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কদাচিৎ উল্লিখিত ও আলোচিত আঙ্গিক বা মাত্রা ছিল প্রায় এক কোটি বাঙালি বা বাংলাদেশী শরণার্থীকে ভারতের মাটিতে আশ্রয় ও বেঁচে থাকার উপকরণ জোগান দেওয়া। সাহায্যের চরমপর্যায়ে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতেই পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। যেহেতু সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছিল, সেহেতু অতি স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশের মাটিতে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সাথে ভারতেরও আবেগপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান এবং মুক্তিযোদ্ধারাও ভারতের ব্যাপারে স্বাভাবিক নিয়মেই আবেগময়। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে গত ৪২ বছরে ভারতের প থেকে বাংলাদেশের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও আধারাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতি ও আচার-আচরণের কারণে, বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাই আংশিকভাবে ভারতবিমুখ এবং বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাই পূর্ণভাবে ভারতবিমুখ। ভারতবিমুখতা মানে কোনোক্রমেই পাকিস্তানমুখিতা নয়। কিছু আগেই বলেছি, আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অতএব এ পর্যায়ে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধ কি ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল? মুক্তিযোদ্ধারা কি ধর্মভীরু হতে পারবেন না? অথবা ধর্মভীরু বা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা কি মুক্তিযুদ্ধের পে থাকতে পারেন না? প্রশ্নগুলো জটিল, উত্তরগুলোও জটিল। কিন্তু এই জটিলতা নিরসন করে মধ্যপন্থা নিরূপণ করে সামনের দিকে এগোতে হবে। মধ্যপন্থা নিরূপণ করতে গেলেই মধ্যপন্থীরা জড়িত হয়ে পড়বেন। ১৯৭১-এর পর এবং আশির দশক, নব্বইয়ের দশক এবং এই শতাব্দীর প্রথম দশকব্যাপী সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রত্যভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ এবং পরোভাবে ইসলাম ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নাটক এবং সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি বা বিরোধিতাকারীদের প্রতীকী পরিচয় দিতে গিয়ে সব সময় টুপিধারী ও দাড়িওয়ালা মানুষ ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই যেহেতু টুপি মাথায় দিতেন বা দাড়ি রাখতেন সেহেতু আমাদের নাটক ও সিনেমায় দাড়ি ও টুপি নেতিবাচক প্রতীক হয়ে আসে। এর তিকারক দিক হলো, যারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল না বিবিধ কারণে, তাদের মধ্যে যারা ধর্মভীরু, পরিস্থিতি তাদের মুক্তিযুদ্ধের পরে সমালোচক বানিয়ে ফেলল। এটা আমাদের জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় সমন্বয়ের অভাবের একটি উদাহরণ। ১৯৭১ সালে বস্তুতই যারা পাকিস্তানের সহযোগিতা করেছিল তারা অবশ্যই টুপি পরত এবং দাড়ি রাখত, হয় আন্তরিকভাবে নয়তো পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে ধর্মভীরু মুসলমান হিসেবে পরিচিত হওয়ার জন্য। আমার ব্যক্তিগত মত, ১৯৭১ সালের আগের পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি কোনোমতেই ইসলামের মূলনীতিগুলো মোতাবেক শাসিত হয়নি। অতএব ইসলাম রা ও বিকাশের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রকে রা করতে হবে এই মর্মে ১৯৭১ সালে যে প্রচার ও মোটিভেশন করা হয়েছিল সেটা অবশ্যই ভুল ছিল বলে এখন প্রতীয়মান। ওই প্রচার ও মোটিভেশনে আপ্লুত হয়ে যেসব ইসলামপন্থী ব্যক্তি বা ধর্মীয় নেতা ও দলীয় অনুসারী যে একটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন, সেটাও এখন প্রতীয়মান। যারা ভুলগুলো করেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই ভুলটি বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেই মর্মে অনুভব করেন। অনেকেই সে ভুলটি বুঝতে পারলেও স্বীকার করেন না। অনেকেই আদৌ ভুল হয়েছে বলে মনেই করেন না। এই তৃতীয় ক্যাটাগরির ব্যক্তিরা অর্থাৎ যারা ভুল হয়েছিল বলে অনুভব করেন না, স্বীকারও করেন না তারা আগামী দিনের বাংলাদেশ পুনর্গঠনপ্রক্রিয়ায় একটি বড় বাধা। অপর প,ে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ যারা আবেগের পরিমণ্ডলে ভারতের বলয় থেকে বের হতে পারছেন না তারাও বাংলাদেশের পুনর্গঠনপ্রক্রিয়ায় বাধাস্বরূপ। দু’টি ভিন্ন ক্যাটাগরির ব্যক্তি বাধাস্বরূপ চিহ্নিত হওয়ার পর যারা বাকি থাকে তাদের সবাইকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত রাখতে হবে। বাস্তবতা বড়ই কঠিন এবং বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক বর্তমানের। তাই এই মুহূর্তে বাস্তবতা হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন একটি সড়ক সংযোগ বা ক্রস রোডে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আমাদের অবশ্যই মধ্যম রাস্তাটি বেছে নিতে হবে। এটাই ন্যাশনাল রিকন্সিলিয়েশন বা জাতীয় সামঞ্জস্য বিধান বা জাতীয় পুনর্মিত্রতা এবং ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন বা জাতীয় পুনর্গঠনের অন্যতম মাধ্যম। যে ক্রস রোডে বা সড়ক-সংযোগে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে রাস্তা অবনতির দিকেও যায়, উন্নতির দিকেও যায়। তাই যাচাই-বাছাই করেই রাস্তাটি গ্রহণ করতে হবে। চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে এটাই আমার আবেগ ও আবেদন। ওপরের পাঁচটি অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। শনিবার ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের আহ্বানে ঢাকা মহানগরীতে যেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো সেই পরিপ্েেরিতই আমার ওপরের বক্তব্য। গত ৫ ও ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে থাকবে একাধিক কারণে। একটি কারণ হলো, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, সাহায্যে এবং নির্দেশে হরতাল পালিত হওয়া। আরেকটি কারণ হলো, সরকারি বাধার কারণে বাধ্য হয়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে যুগপৎ হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়া। ২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের ৫ তারিখ থেকে ঢাকা মহানগরীর শাহবাগকে কেন্দ্র করে যেই আন্দোলন সরকার সূত্রপাত করেছিল, সেটাতে যে অভিজ্ঞতা আন্দোলনকারীরা অর্জন করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার সব হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশগুলো যতটুকুই সফল হয়েছে, তার জন্য জনগণের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শাহবাগ আন্দোলনকে সরকার নিবিড় এবং সার্বণিক নিরাপত্তা দিয়েছে, হেফাজতকে সরকার নিবিড় নিরাপত্তা দেয়নি। শাহবাগ আন্দোলনকে সরকারপীয় মিডিয়া যতটুকু প্রচার করেছে, হেফাজতের আন্দোলন ততটা মিডিয়া সমর্থন পায়নি। সবশেষে হেফাজতের আন্দোলনের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হলো যে, শাহবাগের চেতনাই একমাত্র চেতনা নয়। এ প্রসঙ্গে আমি একাধিকবার লিখেছি। এই মুহূর্তের বাংলাদেশ সরকার সব দিক রা করতে গিয়ে পরিস্থিতি গুলিয়ে ফেলছে। তারা সব দিক রা করার নামে একটি দিককে পৃষ্ঠপোষকতা বেশি করছে। সরকার অদৃশ্য কোনো ছায়া নয়। সরকার কিছু ব্যক্তির সমন্বয়, যেই সব ব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকে। সরকার মানে প্রধানমন্ত্রী একা নন। সরকার মানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডানে-বামে-সামনে-পেছনে যারা আছেন তারাও। আমার অভিজ্ঞতায়, আমার পর্যালোচনায়, আমার মূল্যায়নে তার চার পাশে যারা আছেন, তারা সবাই স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী নন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য সহায়ক চিন্তার অধিকারী নন। অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির মুখের কথা বা লিখিত বক্তব্য আমার এই অনুভূতির সাথে মিলে যায়। সবার নাম উল্লেখ করতে পারছি না, কিন্তু একজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি হলেন, বহুল প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান। গত ৪ এপ্রিল তার পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় তিনি যেই মন্তব্য প্রতিবেদনটি লিখেছেন, সেটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। হেফাজতে ইসলাম প্রসঙ্গে ফিরে আসি। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে হেফাজতে ইসলামের প্রতি কী দৃষ্টিভঙ্গি হবে বা হবে না সেটা রাজনৈতিক নেতারা বলতে পারবেন। আমি নিজে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে, আমি ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের একজন। ১৮ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির মাননীয় চেয়ারপারসন অবশ্যই জোটেরও মাননীয় চেয়ারপারসন। জোটের প থেকে হেফাজতের সমাবেশে মতিঝিল শাপলা চত্বরে প্রতিনিধি গিয়েছিল। আমি (ইবরাহিম) রাজনীতিবিদ ছাড়াও একজন সামাজিক ব্যক্তি, কলাম লেখক, টেলিভিশনে অংশগ্রহণকারী আলোচক। আমার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার ১৫ নম্বর বুড়িশ্চর ইউনিয়নের উত্তর-বুড়িশ্চর গ্রামে। আমি রণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মেছি, উদাহরপন্থী পরিবেশে বড় হয়েছি, সামরিক বাহিনীতে চাকরি করেছি, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি, পরিণত বয়সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর (অর্থাৎ মাস্টার্স) ডিগ্রি পেতে উৎসাহিত হয়েছি। অতএব আমারও একটি ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া থাকতেই পারে। আমার প্রতিক্রিয়া গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ২ এপ্রিল ২০১৩ প্রকাশ করেছি। আবারো করছি। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির প্রত্যেকটির বিশ্লেষণে আমি যাবো না। আমি তাদের মূল দাবিকে ও চেতনাকে সমর্থন করি। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনাকে সম্মান করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় আক্রমণ থেকে দ্বীন ইসলামের চেতনাকে রা করতে হবে, ভুল পথে পরিচালিত তরুণদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে এবং আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন তরুণদের প্রতিরোধ করতে হবে। এই মুহূর্তের বাংলাদেশ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অতএব, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের যথাসম্ভব চলতে হবে, কিন্তু ঈমান ও আকিদা বিসর্জন দিয়ে নয়। তাই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সমন্বয় করতে হবে। মৃত্যুর পর কবরে আমাকে যে তিনটি প্রশ্ন সবার আগে করা হবে, আমি তার জন্য প্রস্তুত থাকতে চাই। আবার, বেঁচে থাকাকালে, আধুনিক পদ্ধতিতে দ্বীনের খেদমতও করতে চাই।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *