ইসলামি স্কলার হামজা ইউসুফের ভিডিওটা দিয়ে এ নিবন্ধটি ২য় পর্ব শুরু করতে চাই কেননা এ ভিডিওটা শুনলে এই পর্বের কথাগুলা বোধগম্য হত্তয়া সহজ হবে। (নোট: যারা বাংলাদেশ থেকে ইউটিউব ভিডিও দেখতে পারেন না তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হল ভিডিওটির লিংক কপি করে আপনার ফেইস বুক ওয়ালে পেইস্ট করলে দেখতে পাবার কথা।)
অসুস্থ হৃদয়
মানুষের হৃদয়ের রোগই তাকে জীবনে সঠিক পথে চলা থেকে বিপথগামী করে।
তাদের অন্তঃকরণ ব্যধিগ্রস্ত আর আল্লাহ তাদের ব্যধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন। (2:10) |
মানুষের অশুভ কর্মফলে সৃষ্ট হৃদয়ের রোগই তাকে সঠিক পথে চলা থেকে দূরে নিয়ে যায়। তবে হার্টের রোগ কি বর্ণনা করার আগে নফস সমর্পকেও কিছুটা ধারণা নেয়া প্রয়োজন কেননা অসুস্থ হৃদয় নফসকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
নফস কি?
এ বিষয়ে ড: হাসানের প্রদত্ত এনালজি অনেকের কাছে সহজ হতে পারে। মনে করেন, একটি প্রিন্টারে কিছু কাগজ রাখা আছে। এই কাগজকে কি আপনি খবরের কাগজ বা পুস্তক বলবেন? নিশ্চয় না । যতক্ষণ পর্যন্ত সে কাগজে প্রিন্ট আউট না আসবে সে কাগজকে বই বা খবরের কাগজ বলা সম্ভব নয়। এভাবে আত্মা দেহে প্রবেশ করে যে সত্তার প্রকাশ হয় বিভিন্ন বৈশিষ্টসহকারে তাকেই বলা যায় নফস। এ নফসের পরিশুদ্ধতার মাধ্যমেই মানুষ পরিশুদ্ধতা লাভ করে। মানুষ কু-কর্মে লিপ্ত হয় তার নফসের তাড়নায়। তাই নফসের বিরুদ্ধে মনের, জ্ঞানের যে যুদ্ধ বা জেহাদ তাকে ইসলামে শ্রেষ্ঠ জেহাদ (জেহাদে আকবর) বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ক্বাদ্ আফলাহা মান ঝাক্কাহা (সুরা শামস ৯-১০) অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজেকে (নফস) পরিশুদ্ধ করেছে; আর বিফল কাম হয়েছে সেই ব্যক্তি যে নিজেকে পাপাচারে কুলষিত করেছে। হযরত আলী (রাঃ) হতে বণির্ত-
মান আরাফা নাফাসাহূ, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহূ (আল হাদিস) অর্থ: “যে তার নফসকে চিনল, সে তার রবকে চিনল।” কোরানে আল্লাহ (SWT) নাফসের অন্তত তিনটি প্রধান ধরণের বর্ণনা করেছেন। যেমন (১) নফসে আম্মারা (২) নফসে লাওয়ামা (৩) নফসে মুৎমায়েন্না। যদিও অনেকে আরো দুটি স্তরের যোগ করেন যেমন, (৪) নফসে মুলহেমা (৫) নফসে রহমানী। আমি এখানে কোরআনে উল্লেখিত ৩ ধরণের নাফসের ব্যাপারেই আলোচনা করব।
১। নফসে আম্মারা:
অনেকে বলে থাকেন নফসে আম্মারার পজেটিভ দিক হল এটা মানুষকে তার নিজের স্বার্থ রক্ষা ও নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখে কিন্তু একে লাগামহীন ছেড়ে দিলে এই নফস মানুষের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। তাই ইসলামী স্কলাররা সাধারনত এই নফকে বলে থাকেন, “এটি মানস মহাসাগরে স্মৃতিজলে কামরুপে কুমির নিহিত, প্রেমাগ্নির জলন্ত শিখায় দুর্বল চিত্ত আত্মরূপ মানুষের ধর্ম কর্ম সাধনা বিনাশ করে দেয়।”
ইন্না নাফছা লা আম্মা রাতুম বিচ্ছুয়ে ইল্লামা রাহিমা রাব্বি (১২:৫৩)।
অর্থ: মানুষের মন (নফসে আম্মারা) অবশ্যই মন্দ কর্মপ্রবণ, কিন্তু সে নয়, যাহার প্রতি আমার প্রভূ দয়া করেন।
নফসে আম্মারাই মানুষের সকল কু-কাজ করায়। এটাকে দমনই তাই প্রথম কাজ। নাফছে আম্মারার অকল্যাণ থেকে বাঁচতে কোরআন পাকে বলা হয়েছে-
“রাব্বানা আতমিম লানা নূরানা (৬৬:৮) অর্থঃ হে আমাদের প্রভূ আমাদের জ্যোতিকে পরিপূর্ণতা দান কর।”
এবং বলা হয়েছে তওবা কর, বিশুদ্ধ তাওবা। নফসের উন্নতির ক্রম বিকাশে মানুষ নফসের পরবর্তী স্তরে বা নফসে লাওয়ামাতে পৌছতে পারে।
২। নফসে লাওয়ামা:
মানুষের এ নফসের বৈশিষ্ট হল, মন্দ পরিহার করা এবং হঠাৎ পাপ কার্য করে ফেললেও অনুতাপের অন্ত থাকে না।
“লা উকছেমু বি ইয়াওমুল কিয়ামা অলা উকছিমু বিন্নাফছে লাওয়ামা” (সুরা ৭৫:১-২)
অর্থ “আমি কসম করছি কেয়ামত দিবসের আরও কসম করছি (সেই আত্মার যে নিজেকে তিরস্কার করে থাকে – self-reproaching spirit- মন্দ পরিহার করা আত্মা eschew evil ) নফসে লাওয়ামার।”
নিজেকে তিরস্কারকারী। আত্ম সমালোচনাকারি আত্মাই হল নফসে লাওয়ামা এবং কেয়ামতের সংশ্রবে নফসে লাওয়ামা বলার তাৎপর্য হলো মৃত্যুর পর যে আত্মার হিসাব নিকাশের জন্য পুনরুত্থ্যান। তাই কিয়ামত। নফসের প্রথম উত্থ্যান হল নফসে লাওয়ামতে পৌছানো যা কিনা নফসে আম্মারার পতন। এই অবস্থায় নফসে আম্মারার প্রভাবে হঠাৎ পাপ কার্য করে ফেললেও অনুতাপের অন্ত থাকে না।
এই জন্যই তখনকার আত্মার কয়ফিয়ত (হাল) নফসে লাওয়ামা অর্থাৎ স্ব -নিন্দন ও নিজেকে ভৎসনাকারী, তিরস্কারকারী। বলা হয় আত্মার এ ধরনের অনুতাপের নামই তত্তবাতুন্নাছুহা, শুদ্ধ সরল অন্তঃকরণের তওবা বা অনুতাপ। আর এই অনুতাপ বা তওবা হচ্ছে ষড় রিপুর সঙ্গেঁ অভ্যন্তরীন লড়াইও বটে। এজন্য রাসূল (সাঃ) বলেছেন- আশাদ্দোল জেহাদে জোহাদ্দোল হাওয়া অর্থাৎ : রিপুসমূহের সংঙ্গে যুদ্ধ জেহাদে আকবর বা শ্রেষ্ঠ জেহাদ। নফসের এই স্তরকে অতিক্রম করতে পারলেই পরবর্তী স্তরে পৌঁছা যায়। বা আমরা বলতে পারি নফসের উন্নতিই হচ্ছে নফসে মুৎমায়েন্না।
৩। নফস মুৎমায়েন্না:
ইয়া আইয়াতুহান্নাফছুল মুৎমায়েন্না ইরজি’ই ইলা রাব্বিকি রাদিয়াতাম মারদিয়া ফাদখুলি এবাদি অ আদখুলি জান্নাতি (ফজর ৮৯: ২৭-৩০) ।
অর্থ” “হে প্রশান্ত আত্মা (নফসে মুৎমায়েন্না, পুরো শুদ্ধির কারণে শান্তি প্রাপ্ত আত্মা)! তুমি তোমার রবের কাছে ফিরে এস এমনভাবে যে, তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; অত:পর তুমি শামিল হয়ে যাও আমার বান্দাদের সাথে এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে।
কাজেই আল্লাহ্র সঙ্গে বান্দার তথা পরম আত্মার সঙ্গে আত্মার একটা নিবিড় যোগাযোগ হয় পাপ তাপের সঙ্গে লড়াইতে। রিপুগুলোকে পরাস্ত করতে পারলে তা হয় মানুষের আওতাধীন।
এই অবস্থায় সৎ ও মহৎ, প্রেম-প্রেরণা জন্মায় তার চরিত্রে অর্থাৎ আল্লাহ্র প্রিয়ভাজন হতে সক্ষম হয়। নিজে এই অবস্থা পৌঁছাতে পারলেই পরবর্তী স্তরে পৌঁছা যায়।
হৃদয়ের সাথে যাদের সম্পর্ক হতে পারে:
মানুষের হৃদয়ে ওস্ ওয়াসা
জিন ও শয়তান এবং মানব থেকেও মানুষের হৃদয়ে ওস্ ওয়াসা বা কুমন্ত্রণা (ফিস্ ফিস্) আসতে পারে। হার্ট যত অসুস্থ হবে কুমন্ত্রণার কুপ্রভাব তত বেশী ফেলতে পারবে। “আল্ লাঝি ওস্ ওয়াসু ফি সুদুর ইন নাস মিনাল জিন নাতি ওয়ান নাস্।’’ – যে কুমন্ত্রনা দেয় মানুষের অন্তরে, জিনের মধ্য হইতে ও মানুষের মধ্য হইতে।” (সুরা নাস)
অন্য দিকে ফিরিস্তা এমনকি মহান আল্লাহর সাথেও মানব হৃদয়ের যোগাযোগ সম্ভব যদি কেউ সুস্থ হৃদয়ের অধিকারী হয়।
[ ফেরেস্তারা বলে ] , ” তোমরা ভীত হয়ো না ,দুঃখিত হয়ো না। বরং সুসংবাদ গ্রহণ কর সে [ শান্তির ] বেহেশতের যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হয়েছে। – (সুরা ৪১:৩০)
হৃদয়ে যে সব রোগ জন্ম নিতে পারে:
উপরোক্ত প্রতিটি রোগই মানুষের কর্ম সম্পর্কিত নিজের নিষ্ক্রিয়তা তথা চারিত্রিক আচরণের সাথে জড়িত। এ প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন কিন্তু লিখা দীর্ঘায়ত না করতে সে দিকে যাচ্ছি না (বিস্তারিত এখানে দেখতে পারেন)। তবে এ সব রোগের কারণে ক্বল্ব যে অবস্থায় পতিত হয় তা হল নিম্নরূপ
অবিশ্বাসীর হৃদয়
নাস্তিক অন্তরে কোনো ধার্মিকতা ধারণ করে না কারণ তাদের হৃদয় এ ব্যাপারে বন্ধ। সে হৃদয় তার আদিম প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে ফলে তার পক্ষে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্ধান পাওয় দুষ্কর সে তখন আমোদিত পার্থিব বিষয়ের মাঝে নিজের জীবন দর্শনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এমন হৃদয়ে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসের আলো নির্বাপিত হয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
“তাহারা বধির,মূক, অন্ধ, সুতরাং তাহারা ফিরিবে না।” (সুরা বাকারা :১৮)
হৃদয়ে বধিরতা চরম আকার ধারণ করে বিশেষ করে অত্যাচারীর দেহে । যেমন গত ৬০ বছর থেকে চরম ঘৃণিত আকারে প্রকাশ পাচ্ছে ইসরাইলী যায়নিষ্টদের চরিত্রে বিশেষ করে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর তাদের জুলুম অত্যাচারে। তাদের জমি দখল থেকে শুরু করে নির্বিচারে বোমাবাজি ও বিভিন্ন মারণাস্ত্রের আঘাতে আহত নিহত মানুষের আহাজারি তাদের হৃদয় স্পর্শ করে না, মানুষের মৃত্যু বাড়িঘর ধ্বংস কিছুই তারা দেখতে পায়না তারা অন্ধ!
‘তাহাদেরকে যখন বলা হয়, “পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করিও না, তাহারা বলে, আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী।” (বাকারা :১১) এ তো হচ্ছে জাতিগত ভাবে একটি জন গুষ্টির অবস্থা। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের নিজেদের মাঝেও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের চারপাশে অন্যায় অত্যাচার দেখে কিংবা এসবে নিজেরা জড়িত হতে বা সমর্থন করতে আমাদের বিবেক বাধা দেয় না কারণ আমাদের হৃদয় বধির,মূক, অন্ধ, হয়ে গিয়েছ।
বিশ্বাসীর দূষিত হৃদয়:
নিজেকে মুসলিম মনে করলেও মাঝে মধ্যে আমরা জেনেশুনে বা অজান্তে অন্যায় অত্যাচারের সাথে জড়িত হলে কিংবা লোভ লালসা ও প্রচণ্ড স্বার্থবাদী, ইগো সেন্ট্রিক ও হিব্বুত দুনিয়ার কবলে পড়ে এবং আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বিভিন্ন পাপ কর্মে জড়িত হলে হৃদয়ে কালো দাগ পড়ে তখন সে পাপ কাজ থেকে দ্রুত ফিরে না আসলে, তওবা না করলে সে হৃদয়ে কালো দাগ বৃদ্ধি পায়। আর একসময় সে হৃদয় হয়ে যায় পাথরের মত শক্ত তখনই হয়ে যায় অন্ধকার। তাই একটি বিশ্বাসী হৃদয়কে অন্ধকার এবং পাপ কর্ম থেকে দ্রুত ফিরে এসে তওবা করে ঈমানের আলো দিয়ে আলোকিত এবং হেদায়েত প্রাপ্তির জন্য খোলা রাখতে হবে। সে জন্য আল্লাহ বলেন ” আনি বু ইলা রাব্বিকুম ওয়াসলিমুলাহ্ ……” তোমাদের পালনকর্তার অভিমুখী হও এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করো তোমাদের উপর শান্তি আসার পূর্বে তখন আর তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না। (সুরা জুমার- আয়াত :54)
রুহানি জগতের চিন্তাশীল ইসলামী দার্শনিকেরা তাই বলে থাকেন, হৃদয়ে যেহেতু শয়তান ও ফেরেশতাদের অভিগমন (access) আছে তাই ফেরেশতারা প্রবেশ করেন ইমানের আলোকিত হৃদয়ের দ্বার দিয়ে মুমিনকে সাহায্য করে কল্যানের দিকে নিয়ে যেতে আর শয়তান ঢুকে মানুষের হৃদয়ের সেই কালো দাগের অন্ধকার ছিদ্রপথে তাকে বিপথগামী করতে। আর শয়তান তো ঈমানদারের চির শত্রু। তাই মহান আল্লাহ বলেন,
হে ঈমানদারগন! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [Quran 2:208] O you who believe, you shall embrace total submission; do not follow the steps of Satan, for he is your most ardent enemy. |
কোরআনের শিক্ষা
মানুষের হৃদয়ের রোগ থেকে আরোগ্য (শিফা) পেতে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা দেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
“O mankind! There has come to you an instruction from your Lord,
a cure for whatever (disease) is in your hearts, a guidance and a blessing for the true believers.” [Yunus – 10:57]
হৃদয়ের পরিশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ একমাত্র পরিশুদ্ধ ও শুভ্র হৃদয়ই আল্লাহ কাছে গ্রহণযোগ্য ও সফলতা অর্জন করতে পারে। হৃদয়ের পরিশোধনে ইসলামে “তাজকিয়া” (তাজাক্কা)শব্দ ব্যবহার করা হয়।
নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয় |
References:
In a Nutshell: Diseases of the Soul
http://islaam.net/main/display.php?id=702&category=75
http://productivemuslim.com/how-to-fight-the-satanic-whispers/
http://www.irfi.org/articles2/articles_3451_3500/cure%20the%20hearts%20with%20quranhtml.htm
http://www.onislam.net/english/reading-islam/understanding-islam/ethics-and-values/456209-suhaib-webb-hard-hearts.html?Values=
Imam Ibn ul Qayyim al Jawziyyah