লেখা –পার্থক্য দূরীকরণের একটি প্রয়াস

  প্রতিদিন অনেক ব্লগ লেখা হয় এবং এর পিছনে নানান কারণ থাকে। শিক্ষার উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে  ব্লগ বিষয়ে তিনটি কারণ মনে হয় বড় আকারে আসতে পারে। প্রথমত, কোন একটি লেখা যখন পাঠ করা হয় এবং পাঠে যদি নতুন কিছু পার্থক্য (difference) অনুভূত হয়, তখন সেটি বুঝিয়ে দেবার কারণে লেখা হয়। দ্বিতীয়ত, পঠিত বিষয়ের সাথে যদি অন্য কোন বিষয়ের সম্পর্ক/সংযুক্তি থেকে থাকে কিন্তু উক্ত লেখায় তা অনুপস্থিত থেকে যায়, তখন সেটিই হতে পারে লেখার আরেকটি কারণ। আবার পাঠ্য বিষয়ের সাথে অন্য বস্তুর সম্পর্ক/সংযুক্তি যদি এমনভাবে প্রতীয়মান হয় যে নতুন ধারণা গোটা বিষয়কে অন্যরূপে রূপায়িত করতে পারে, তবে সেটিও হতে পারে আরেকটি কারণ। এতে পাঠ্য বিষয়ে নতুন কিছু সংযোজনের ইচ্ছাও থাকতে পারে। তৃতীয়ত, পাঠ্য বিষয়ে যদি দেখা যায় যে লেখক বা সমালোচক বিষয়টিকে বিকৃত অর্থে উপস্থাপন করছেন, যেমনটি ইসলাম বিদ্বেষীরা প্রায়ই করে থাকেন, তখন সেই বিষয়টিকে তার আপন সঠিক স্থানে পুনর্স্থাপন করতে লেখার উদ্যোগ আসতে পারে। এতেও সমঝের দূরত্ব কমানোর উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু লেখার পূর্বাবস্থায়, পাঠকালে, লেখন-কালে, সর্বাবস্থায় চিন্তার তোলপাড় ও তরঙ্গের খেলা বাস্তবে আসে।

কোন লেখা পাঠ করার সময় যদি উপরোক্ত এক বা একাধিক কারণ অনুভূত হয়, তখন সাথে সাথে কিছু নোটস করতে পারলে ভাল হয়। তখন চিন্তার immediate রূপ ধরা যেতে পারে। লেখার কাজে  এক ধরণের “ধ্যান” জড়িত থাকে। এর সাথে থাকে চিন্তার আকার আকৃতি, অবয়ব, চিন্তার আভ্যন্তরীণ আলোক, দিক-দিগন্ত। তাৎক্ষণিক মুহুর্ত্তে কিছু নোটস করতে পারলে সেই অঙ্গুরিত অনুভূতির খানিক রূপ ধরে রাখা যায়। না হলে, সেই মূহুর্ত্তে সেই ধারণাগুলো যে আকার আকৃতিতে এসেছিল, সেগুলো বুদ্বুদের মত হয়ত চলে যেতে পারে, বিলীন হতে পারে।

কোন একটি ধারণা আমাদের চৈতন্যে (consciousness) যে জ্ঞান, যে আবেগ এবং যে যুক্তিতে ধরা দেয়, তার রূপ অন্য সময়ে আসা রূপ থেকে ভিন্ন হতে পারে। একটি ধারণা সাধারণত একই রূপে বার বার আসে না। সুতরাং দেখা যাবে একটি প্রবন্ধ একবার লেখার পর যদি তা কোন কারণে হারিয়ে যায় তবে তা আবার লিখতে গেলে সেই আগের প্রবন্ধ থাকবে না। এটা হবে ভিন্ন প্রবন্ধ। তার বাক্য হবে ভিন্ন, তার প্যারাগ্রাফ হবে ভিন্ন, তার গতি ও চলন হবে ভিন্ন এবং তার সর্বাঙ্গীণ আবেদনও ভিন্ন হতে পারে।

আবার এমনও হতে পারে যে একটি ধারণা মনের জগতে যেভাবে দেখা দিয়েছিল, লেখার পর মনে হতে পারে তা যেন অবিকল সেই বস্তু নয়। মন প্রথমে যা দেখেছিল আর কাগজে যা রূপায়িত হয়েছে তাতে যেন রঙের ভিন্নতা রয়েছে। এই বিষয়টি এবং আগের বিষয়টি চৈতন্যের সাথে জড়িত। আমাদের চৈতন্য ভিন্ন সময়ে ভিন্ন অবস্থানে থাকে। চৈতন্যের একেক অবস্থা একেক ধরণের যুক্তি ও অনুভূতির সঞ্চার করে এবং একেক ধরণের চেতনার কিছু মৌলিক রূপ থাকে যার চিন্তাগত রূপের সাথে ভাষাগত রূপের সঠিক সমন্বয় ঘটানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। এটাই কারণ।

উপরে যে কয়টি কারণের কথা উল্লেখ করেছি, তা শুধু বিশেষ ব্লগ পাঠেই সীমাবদ্ধ নয় বরং একাডেমিক ক্ষেত্রেও ব্যাপৃত। কোন বিষয়ের উপর কয়েক খানা বই পড়ার পর নতুন কোন পার্থক্যের স্থান মনের দিগন্তে উদয় হতে পারে এবং চিন্তার উদ্দীপনা শক্তিশালী হয়ে লেখার উদ্দেশ্যে পীড়ার কারণ হতে পারে। অর্থাৎ সেই উপলব্ধির স্থানকে কেন্দ্র করে আলাদা বই প্রণয়নের তাড়না হতে পারে। লেখার কাজ ও চিন্তার প্রকাশ এভাবেই অস্তিত্বশীল হয়, বিস্তার লাভ করে।

ব্লগ আলোচনায় (বা বৈঠকি আলোচনায়) বস্তু ভিত্তিক পার্থক্য, অপরাপর বিষয়-ভিত্তিক সমন্বয় এবং এদের মধ্যস্থিত সম্পর্ক ইত্যাদি অতি ব্যাপক পরিধিতে দেখা দিতে পারে। বিষয়টি যদি অত্যধিক বৃহৎ আকারে আসে তবে সে বিষয়ে লেখার আগ্রহ চলে যেতেও পারে। কেননা বড় জিনিস লিখতে সময়ের অভাব বড় হয়ে দেখা দেয়। নাস্তিক্যবাদ ও বিশ্বাসের আলোচনায় বিশ্বাস, আদর্শ, যুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংযুক্তি অনেক সময় এমন ব্যাপকতা উত্থাপন করে যে তার উপর লিখতে দীর্ঘ দিনের প্রয়োজন। নিচে উদাহরণ আসছে।

আস্তিক-নাস্তিকী আলোচনায় যেসব পার্থক্যের স্থান দেখা যায় সেগুলোর উপর ব্রিজিং আলোচনায় যেতে হলে ধর্ম, সাইকোলজি, ভাষাতত্ত্ব, যুক্তি, সমাজ বিজ্ঞান এবং অপরাপর কিছু ইন্টার ডিসিপ্লিনারী juxtaposition অতিক্রমের প্রয়োজন হয়। একটি উপপাদ্য অপরাপর ডিসিপ্লিনে কিভাবে বিতর্কিত ও আলোচিত হয়ে বিরাজ করছে, তা যদি উভয় পক্ষ সমভাবে অবগত না হন, তা হলে সফল আলোচনার স্থান নেই। যেমন যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানবাদের দুর্বলতা বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে যুক্তি, দর্শন ও ভাষাতাত্ত্বিক ডিসিপ্লিনে কিভাবে রূপায়িত হয়েছে সেই বাস্তবতা যদি আলোচনায় স্থান না পেয়ে সপ্তদশ/অষ্টাদশ শতাব্দীর মডার্নিস্ট এনলাইটনম্যান্টের পিছনে-পড়া, শেষ হওয়া (exhausted) যুক্তি স্থান পায়, তাহলে সে আলোচনা নিরর্থক হতে বাধ্য। কেননা পার্থক্য এখানে যেন উপসাগরের মত। এসব আলোচনায় কোনো ব্যক্তি কেবল hard science-এ ডিগ্রিধারী হলেই চলবে না। কেননা পদার্থ বিজ্ঞান বা রসায়ন বিজ্ঞানের epistemology and discourse ধর্মীয় epistemology and discourse থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। এই আলোচনায় ভাষা, যুক্তি, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতা এগুলোর উপর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। যে ব্যক্তি ১৫/২০ বৎসর ব্যাপী পদার্থ বিজ্ঞানের discipline আত্মস্থ করেনি, সেই ব্যক্তি শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দিকে তাকালেও শত শত আলোকবর্ষের দূরত্বে অবস্থিত গ্রহের বিস্ফোরণ, জন্ম অথবা মৃত্যুর বিষয়টি দেখেও দেখতে পাবে না। তার কাছে যা দৃশ্যগত হতে পারে তা হয়ত কিছু আলোক বিন্দুর বিচরণ। এখানে যে তত্ত্ব (data) দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে প্রকাশ পায় তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। আর সেই ব্যাখ্যার পিছনে রয়েছে এক ধরণের ভাষার ব্যবহার, এক ধরণের ব্যাখ্যার স্কিম, যে ব্যাখ্যার ইতিহাস আছে, discourse আছে –এগুলো আত্মস্থ করণের বিদ্যাগত পথ আছে, জানার injunction আছে। কিন্তু বিজ্ঞানী যদি ‘বিজ্ঞানবাদী’হয় এবং যুক্তিবিদ যদি যুক্তিবাদী হয় তবে যে জানার injunction তার বেলায় প্রযোজ্য, তা সে ধর্মতত্ত্বে, আধ্যাত্মিকতায়, ভাষাতত্ত্বে তা জানার প্রয়োজন মনে করবে না। সে রসায়নের উপর প্রাথমিক ডিগ্রি বা মাস্টার্স করেছে, এখন সে তার নিজেকে এমন ‘শিক্ষিত’ ভাবছে যেন সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। রসায়নের যোগ্যতাই এখন কোরানের যোগ্যতা, হাদিসের যোগ্যতা, ইসলামী আইনের যোগ্যতা। এই হচ্ছে পার্থক্যের উপসাগর। এখানে কিছু লিখে  উভয়ের মধ্যে সমঝোতার cross connection তৈরি করার আশা নেহায়েত কম। এটা যদি আল্লাহর তরফ থেকে আসে, তবে ভিন্ন কথা। যার জন্য আল্লাহ এই connection তৈরি করে দেবেন কেবল সে’ই তা দেখতে পাবে।

অনেক ধরণের পার্থক্য বুঝা ও কমিয়ে আনা সম্ভব, এমনকি দূর করাও সম্ভব। লেখনী একটি মাধ্যম হিসেবে সেই প্রয়াসের পথে চলে, সফলও হয়। এটা এক বাস্তবতা। কিন্তু আত্মার প্রকৃতিতে যে পার্থক্য জড়িয়ে আছে সেই পার্থক্য  দূরীকরণের উপায় নেই, যার ধারা অনন্তে, যা মরেও মরবে না, বেহেস্ত ও দোযখের সীমানায় বিলীন হবে। এর তেমন কোন সমাধান নেই। এটাও আরেক বাস্তবতা। কিন্তু সর্বাবস্থায় প্রয়াসের বিকল্প নেই। প্রয়াসই এক অনির্বাণ শিখা যা জ্বলে আছে আমাদের প্রকৃতিতে –এটিই আশার এক আলো। লেখনী সে প্রয়াসকে জাগিয়ে রাখুক –এটাই কাম্য।

 

________________

ফটো নোট:  গুগল ফটো, pictures of misunderstanding

Loading

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *