বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্বনেতারা। ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে বিশ্বনেতা ও বিশিষ্ট জনেরা শোক প্রকাশ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমুখ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টায় জোহানেসবার্গের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্ববরেণ্য এই রাজনীতিক ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা। বিশ্বের এমন কোন মিডিয়া নাই যে গত সপ্তাহে নেলসন ম্যান্ডেলা নিয়ে আলোচনা হয় নাই। তবে আজ পাঠকদের জন্য আমি এ বিষয়ে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে কয়েকটি কথা বলতে চাই।
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, তিক্ততা ভুলে বৈরি প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মত উদারতা এবং বর্ণাঢ্য ও নাটকীয় জীবন কাহিনী মিলিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। দীর্ঘ ২৭ বছর শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের দ্বারা কারা যন্ত্রণা ভোগের পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। সেদিন কারাগারের সামনে দেয়া বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা তার সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সেই কথা, যা তিনি তাঁর বিচারের সময় আদালতে বলেছিলেন। মান্ডেলা বলেন, এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন তিনি, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে। বলেন, এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন তিনি, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে। তিনি বলেন, ‘এটা এমন এক আদর্শ, যেটির আশায় আমি বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু যদি দরকার হয়, এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।’ বর্ণবাদের অবসানের পর ১৯৯৪ সালের ১০ মে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘একজন মানুষ যা অর্জন করতে পারে ম্যান্ডেলা তার থেকেও বেশি কিছু অর্জন করেছেন। তিনি অন্যদের স্বাধীনতার জন্য নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন, ‘আজ তিনি চলে গেছেন এবং আমরা হারিয়েছে সবচেয়ে প্রভাবশালী, সাহসী ও সুগভীর ভালো মানুষটিকে।’
পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে নতুন আফ্রিকা গড়ার কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা অতীতের তিক্ততার প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে তার সাবেক শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন। শুরু হলো এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পথ চলা। বস্তুত ম্যান্ডেলা অতীতের তিক্ততার প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা ভুলে জাতীয় ঐক্য সুসংগত করতে “ফরগেট এন্ড ফর-গিভ” তথা reconciliation এর নীতি অনুসরণ করেন এমন এক সময় যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো এবং সাদা জাতিবিদ্বেষের তিক্ততার ক্ষত বা জখম ছিল তাজা। আর সে জন্যই পৃথিবীর মানুষের হ্রদয়ে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ম্যান্ডেলা।
অবশ্য জন মুসলিমের কাছে কিন্তু এরকম মহানুভবতা উদাহরণ নতুন কিছু নয়। আমারা জানি আজ থেকে ১৪ শত বছর আগে পৃথিবীতে এমনি এক অসাধারণ ক্ষমা ও মহানুভবতার উদাহরণ রেখে যান ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদ। যে কাফিররা মাসের পর মাস তাকে বয়কট করে, তার অনুসারীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে শেষ পর্যন্ত নবী ও তাঁর অনুসারী মুসলিমদেরকে ঘর ছাড়া করেছিল, মুসলিমদেরকে হত্যা করেছিল সেই কাফিরদেরকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন (স:) মক্কা বিজয়ের পর।
ব্যক্তি ম্যান্ডেলাকে আজ সবাই শ্রদ্ধা করতে দেখা যাচ্ছে ঠিকই, তার মৃত্যুতে শোক বার্তা দিতে দেখা যায় অনেককে । কিন্তু এর মাঝে কতটুকু আসল আর কতটুকু নকল সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। যারা আজ ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে আবেগ জড়িত সুন্দর বানী রাখছেন তাদের দেশেইবা ম্যান্ডেলের আদর্শের কতটুকু পালন করা হচ্ছে সত্যিকার অর্থে ? তা বিবেচনার দরকার। তখনই বুঝা যাবে কে নকল আর কে খাটি।
১৪ শত বছরের সেই মহামানবের ক্ষমার উদাহরণ অসনুসরন করে ম্যান্ডেলা যে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন সে সম্মান অনেকের ভাগ্যেই ঘটতে পারে যদি তারা দ্বৈতনীতি পরিত্যাগ করেন। ব্যক্তি ম্যান্ডেলা মহান হয়েছেন, তাঁর মৃত্যুতে সম্মান করা হচ্ছে ভাল কথা কিন্তু ম্যান্ডেলা যে আন্দোলনের ফসল সে আন্দোলন সম্পর্কে কেউ ভাবতে চান না এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। ম্যান্ডেলা অনেকবার বলেছেন “এ পৃথিবীতে বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য তখনই সাফল্য অর্জন করবে যখন ইসরাইলি অবৈধ দখল হতে ফিলিস্থানী জনগণ মুক্তি পাবে এবং তাদের প্রতি ইসরাইলি অত্যাচার বন্ধ হবে”। কিন্তু বিশ্ব নেতাদের কেউ কি সঠিকভাবে এর প্রতিকারে বা সমাধানে এগিয়ে আসছেন? মাত্র কয়েক বছর আগেও আমেরিকার সন্ত্রাসী তালিকায় ম্যান্ডেলার নাম ছিল! “সব জাতি, সব বর্ণের মানুষের সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারার” ম্যান্ডেলার স্বপ্নের সাউথ আফ্রিকায় আজ অতীতের শ্বেতাঙ্গ এলিটদের মত নব্য কৃষ্ণাঙ্গ এলিটদের স্বার্থ রক্ষার শাসন ব্যবস্থা থেকে কি সাধারণ মানুষ মুক্তি পেয়েছে? আর বাংলাদেশের অবস্থার কথাই দেখেন স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও আজ চলছে স্বাধীনতার পক্ষের ও তথাকথিত বিপক্ষের যুদ্ধ চালানোর অবিরাম সংগ্রাম। চলছে ক্ষমতা আখড়ায়ে ধরার অবৈধ প্রচেষ্টা। দেশে একটি সুষ্ঠু নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জনতার দাবীকে না মানার বিপক্ষে বর্তমান প্রশাসনের কি জঘন্য অত্যাচার। তাই মহান নেতা ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে এদের শোক প্রকাশ করতে দেখলে প্রশ্ন জাগে এরা আর কতদিন মানুষকে প্রতারণা করবে, আর কত দিন চলবে এ আত্ম প্রতারণা?