নেলসন ম্যান্ডেলা ও আমাদের রাজনীতি

গত ডিসেম্বর ৫, ২০১৩ বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা মৃত্যু বরণ করেছেন। দুনিয়ার সকল দেশের সকল রেডিও টেলিভিশন থেকে তার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার জীবন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। এবং এক জন আর এক জনের সাথে প্রতিযেগিতা করছে তার জীবনের গভীরে গিয়ে নতুন নতুন তথ্য দিয়ে শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেওয়ার জন্য। নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয় সারা দুনিয়ার সকল মানবতাবাদি নেতাদের বিবেক এবং নির্যাতিত মানুষের কন্ঠস্বর। নেল্সন ম্যান্ডেলাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না, তার সম্বন্ধে আমি যা বলবো তার চেয়ে আপনারা অনেক বেশী জানেন। তাই মা’র কাছে মামার বাড়ীর গল্প করার দুঃসাহস করতে যাবোনা। শুধু মাত্র ‘রবিন আয়ল্যান্ডে’ অর্জিত আমার ব্যক্তিগত বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো আপনাদের সাথে। রবিন আয়ল্যান্ড কেপটাউন থেকে কয়েক কি. মি. দুরে অতিক্ষুদ্র একটি সাগরদ্বীপ। অথৈই মহাসমুদ্রের মাঝে উত্তাল জলরাশি বেষ্টিত এই ক্ষুদ্র দ্বীপটি শুধু পৃথিবীর কোলাহলময় জনপদ থেকেই বিচ্ছিন্ন নয়, মনে হবে যেন পৃথিবী থেকেই বিচ্ছিন্ন একটি ছোট্ট প্ল্যানেট। আমাদের আন্দামানের মতো বর্ণবাদি সাদা সাউথ আফ্রিকার সরকার এই দ্বীপটি বেছে নিয়েছিল স্বাধীনতাকামি সাউথ আফ্রিকানদেরকে শায়েস্তা করার জন্য। নেল্সন মেন্ডেলা তার সাতাশ বছর কারাজীবনের আঠারো বছর কাটিয়ে ছিলেন এই হায়নার খাঁচায়। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যার পক্ষে এই হয়নার খাঁচাটি স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার সাথে ছিল আমার স্ত্রী ও চার মেয়ে। আমার ছোট মেয়ে যে এখন ইউনিভার্সিটি পড়ছে তখন তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। নেল্সন ম্যান্ডেলার প্রিজনের সামনে থেকে নেওয়া ছবিটি তার এলবামের সর্বশ্রেষ্ট ইতিহাস হিসাবে সে গণ্য করে থাকে। পাঁচ ডিসেম্বর ছিল তার ফাষ্ট সেমিষ্টারের ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম দিন। নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতি তার ছোট্ট মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে, পরীক্ষার খবর না দিয়ে সে আমাদেরকে কল দিয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর খবর দেওয়ার জন্য। নেলসন ম্যান্ডেলা সারা দুনিয়ার ছেলে বুড়ো সকল মানুষের জাগ্রত অনুভূতি। আর যারা রবিন আয়ল্যান্ড গিয়েছেন তাদের কাছে এই অনুভূতি একটি জীবন্ত দলিল।

নেল্সন ম্যান্ডেলা অসংখ্য ভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় ‘লাইম ষ্টোন কারি’ (খরসব ঝঃড়হব ছঁধৎৎু) শাস্তি ছিল প্রিজনারদের সহিত শাসক গুষ্টির একটি নিষ্ঠুর তামাসা। অন্যান্য প্রিজনারদের সহিত নেলসন ম্যান্ডেলাকে প্রতিদিন নিয়ে যাওয়া হতো ‘লাইম ষ্টোন কারি’। সেখানে তাদের কাজ ছিল চুনা পাথর কেটে ‘লাইম ষ্টোন কারী’র একপাশ থেকে অন্য পাশে নেওয়া। এবং পরের দিন এই চুনা পাথর কেটে কেটে আবার আগের যায়গায় নিয়ে যাওয়া। প্রিজনারদেরকে এই কাজ করতে হতো খালি চোখে কোন প্রকার প্রটেকশন না নিয়ে বছরের পর বছর ধরে। রবিন আয়ল্যান্ডে গাছপালা বলতে বিশেষ কিছু নেই। উম্মুক্ত মহাসমুদ্রের মাঝে একটি ছোট্ট কারাদ্বীপ। কারাগার ছাড়া অন্য আর কোন বসতি এই দ্বীপে ছিলনা এখনো নেই। চারদিক থেকে প্রবাহিত প্রবল বাতাস এই দ্বীপবাসীদের সার্বক্ষণিক প্রতিবেশী। এই প্রতিবেশীদের সাথে যুদ্ধ করেই ‘লাইম স্টোন কারি’তে অসহায় বন্দিদেরকে কাজ কাজ খেলাটি খেলতে হতো নিষ্ঠুর নিরাপত্তা কর্মীদের শাণিত দৃষ্টির সামনে থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। চুনাপাথর কাটার এই কাজটির কোন বাণিজ্যিক মূল্য ছিলনা। তাই প্রিজনারদের মনে এই টুকু সেটিসপেকশন ছিলনা যে তাদের কাজ কারো কোন কাজে লাগতে পারে। আসলে প্রিজনাররা যেমন অপদার্থ তাদের কাজকর্মও তেমনি অপ্রয়োজনীয় (ঁংবষবংং) তা বুঝানোর জন্যই এভাবে তাদেরকে শারিরীক শাস্তির সহিত এই ইমোশনাল শাস্তিটি দেওয়া হতো। নেলসন ম্যান্ডেলার লিখা খড়হম ডধষশ ঃড় ঋৎববফড়স বইটি পড়ুন, দেখবেন শুধু এই একটি নয় আরো কতশত প্রকার শাস্তি দেওয়া হতো তার মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য।

রবিন আয়ল্যান্ড ট্যুরের শুরুতে ট্যুর বাসের সকল পর্যটকদেরকে ওরিয়েন্টেশন দিয়েছিলেন একজন প্রাক্তন প্রিজনার। তিনি নিজেও এই মেক্সিমাম জেল খানায় বেশ কিছুদিন বন্দি ছিলেন। ওরিয়েন্টেশনের এক পর্যায়ে তিনি বললেন  যে, ‘জেল জীবন আমাদের হিংসা বিদ্বেষ কবর দিয়ে আমাদেরকে তৈরী করেছে এক সহনশীল একমোডেটিং জাতী হিসাবে। অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার প্রাক্তন এই বন্দি কমরেডের কথা শুনে সেদিন আমি খুশী হতে পারিনি। আমার টিপিক্যাল বাঙালী মাইন্ড আমাকে বলছিল, ‘তাহলে কি লোকটি বলতে চাইছে যে সাদারা কঠোর অত্যাচার করেছিল বলেই তারা সহনশীল একমোডেটিং হতে পেরেছে?’ কিন্তু আজকের বাংলাদেশের অবস্থা দেখে মনে হয় লোকটির সেদিনের কথাই সঠিক ছিল। আমরা নয় মাসে স্বাধীন না হয়ে, স্বাধীনতা লাভের জন্য যদি অন্তত: নয় বছর সময় নিতাম তাহলে আমাদেরকে আজ এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে হতোনা। নিজেরা স্বাধীন না হয়ে যদি অন্য কেহ স্বাধীনতা এনে দেয় তাহলে স্বাধীনতা ক্রয়ের দিনই স্বাধীনতা বিক্রয়ের পরোয়ানা জারী হয়ে যায়। বলুনতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কে শুরু করেছিল? পাকিস্তানীরা শুরু না করলে মুক্তি যুদ্ধের জন্য আমাদের প্রস্তুতি থাকতো। অসহায় হয়ে ভারতের সাহায্যের জন্য ভারতের কাছে অধীনতা মূলক সাত দফা চুক্তির বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধকে বন্ধক রাখতে হতো না। আমরা যুদ্ধ করেছি কিন্তু আত্মনিন্ত্রনের জন্য যে আত্মনিয়ন্ত্রন মূলক স্বাধীনতা তা আমরা পাইনি। আমরা পেয়েছি ভারতের অধীনতা মূলক সাতদফা চুক্তির বিনিময়ে অধীনতা মূলক স্বাধীনতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আমাদের জানা থাকলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমরাই শুরু করতাম। আর পরাজিত শক্তি স্বাধীনতার বুনিয়াদ মজবুত করে দিয়ে যেতো আমাদের কাছে আত্মসর্ম্পণের মাধ্যমে। দুর্ভাগ্য বশতঃ পরাজিত শক্তি সেদিন আমাদের কাছে আত্মসর্ম্পণ না করে ভারতের কাছে আত্মসর্ম্পণ করেছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ কালীন পুরোটা সময় পাকিস্তানে ছিলেন। যুদ্ধের পর তার হাতে আমরা একটি গনতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ তুলে দিয়েছিলাম। তিনি রিকন্সিলিয়েশনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করেন নি। তবে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি পরাজিত শক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হল তাঁর এ মহানুভবতা প্রকাশে পরাজিত শক্তিরা তো অখুশী হওয়ার কথা নয় এবং সে জন্য হত্যা করার কথা নয়।

কিন্তু যারা চায়নি দেশ রিকন্সিলিয়েশনের পথে চলুক  তারাই তাকে বেশীদিন দুনিয়াতে থাকতে দেয়নি। তারা পরিকল্পিত ভাবে বেওয়ারিশ লাশ আর তলাহীন জুড়ি বানিয়ে দেশটিকে প্রায় একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছিল। একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাধ্য হয়েছিলেন দেশটিকে একটি এক দলীয় একনায়ক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। অথচঃ একদলীয় রাষ্ট্রের বৈশিষ্টের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের চারিত্রিক বৈশিষ্টের কোন মিল ছিলনা। কারন বাঙালী জাতীকে তিনি গনতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন ত্রিশ বছর ধরে। বাঙ্গালীরা গনতন্ত্র মনা কিনা সে’ই বিতর্কে আমি গেলাম না। কিন্তু যে লোকটি গনতন্ত্রের জন্য ত্রিশ বছর জেল খেটেছিলেন তিনি গণতন্ত্র হত্যা করতে পারেন না। বাকশাল গঠনের পর বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন ভগ্ন হয়েছিল। ভুল করলে ভুলের মাশুল দিতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তার ভুলের অনেক বড় মাশুল দিয়েছিলেন। এবং আমরাও আমাদের ভুলের মাশুল দিচ্ছি আজ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রতিদিন।

বাংলাদেশ আজ প্রতিশোধের নেশায় মাতাল হয়ে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীর পিতা হিসাবে সাধারণ ক্ষমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অথচঃ প্রতিশোধের নেশায় আমরা আজ এতটাই মাতাল হয়ে গিয়েছি যে জাতীর পিতার সিদ্ধান্তটির প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার তা’ই ভুলে গিয়েছি। আমরা না হয় শেখ মুজিবুর রহমানের  বৈধ সন্তান নয়; কিন্তু শেখ হাসিনা তো তার ঔরষজাত সন্তান। তিনি কি পারেন তার পিতার সিদ্ধান্তের প্রতি এতটা অশ্রদ্ধাবোধ দেখাতে? যদি পারেন তাহলে এত বছর পর এখন তিনি মুক্তি যুদ্ধের এই পরাজিত শক্তিকে তার প্রতিপক্ষ বানাতে গেলেন কেন? ২০০৮ সালে ইলেকশনের পর ধানমন্ডির বত্রিশ নং রাস্তার মূখে নির্মিত পুরো তোরণটি জুড়ে লেখা একটি স্লোগান দেখেছিলাম। স্লেগানটি ছিল ‘আর নয় প্রতিরোধ এবার নেবো প্রতিশোধ।’ এই প্রতিশোধ অবশ্যই যুদ্ধ অপরাধী বা পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে ছিলনা। যদি বলি যে, এই প্রতিশোধ ছিল পঁচাত্তর সনে স্বপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার জন্য পুরো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাহলে কি অত্যুক্তি বলে মনে হবে?

শেখ হাসিনাকে বোকা মনে করার কোন কারন নেই। তিনি অবশ্যই জানেন তার প্রতিপক্ষ কারা এবং কারা তার পিতার মৃদদেহের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে মোস্তাক সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এবং কারা তার বাবার মৃর্ত্যু খবর শুনে একটি বারের জন্য ইন্নালিল্লাহ্ পড়েনি। খোন্দকার মোস্তাক নিজেও ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন বড় মাপের নেতা এবং শেখ মুজিবের মন্ত্রী সভার সদস্য। তাই যদি বলা হয় যে, আওয়ামী লীগাররাই শেখ হাসিনার প্রথম প্রতিপক্ষ তাহলে কি ভুল বলা হবে? আওয়ামী লীগ যে আজ কমিউনিষ্ট লীগে রূপান্তরিত হয়েছে তাকে কি এর আলামত বলে মনে করা যায় না?

শেখ হাসিনা অবশ্যই জানেন অবস্থা বেগতিক দেখলে আজকের এই নব্য আওয়ামী লীগাররাও তার বাবার মতো প্রথমে তাকে পরিত্যাগ করবে। তবে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও একটি দৃশ্যমান পক্ষ বিপক্ষ থাকতে হয়। তাই সময়ের অনিবার্য কারনে এখন আওয়ামী লীগ এক পক্ষ এবং অন্যরা প্রতিপক্ষ। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রথম পক্ষ নয়, দ্বিতীয় পক্ষও নয়; তিনি  তৃতীয় পক্ষ। তৃতীয় পক্ষ হিসাবে পক্ষ বিপক্ষের যুদ্ধ তিনি এখন মহানন্দে উপভোগ করছেন। প্রতিপক্ষের লোক মারা গেলে তিনি খুশী হন, কিন্তু পক্ষের লোক মারা গেলে যে তিনি অখুশী হন এমনটা মনে করা ঠিক হবে না। তা যদি ঠিক না হতো তাহলে নিজকে ঢাকার প্রধান মন্ত্রী বানিয়ে ফেলার আগে কি তিনি একবারও ভাবতেন না যে গ্রামে গঞ্জের অসংখ্য নেতা কর্মী সমর্থকদের কি হবে? বলতে পারেন, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে যদি বিনা ইলেকশনে ইলেকটেড হওয়া যায় তাহলে নেতা কর্মীদের কথা তিনি ভাববেন কেন? মনে রাখবেন, মন্ত্রী এমপি হতে যদি পাবলিক সমর্থন না লাগে তাহলে কর্মী সমর্থকের দরকার হয় না। বিষয়টি নেতা কর্মী সমর্থকদের বিশেষ ভাবে ভেবে দেখা দরকার। ভারত কোন কিছুই এখন আর রাখঢাক করে করছে না। প্রধানমন্ত্রীও এখন আর প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষ নেই। বাংলাদেশীদের তাই এখন আর রাজনীতি করার সময় নেই। দেশ বাঁচলে রাজনীতি করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। 

বাংলাদেশীরা মরছে! শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য যারা ইন্নালিল্লাহ্ পড়েনি তারা মরছে! এটা শেখ হাসিনার জন্য খুশীর খবর! খুশির খবর শুনে কেহ ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না। সারা দেশের সকল আওয়ামী লীগার মারা গেলেও না। বাংলাদেশকে নিয়ে শেখ হাসিনা একটা খেলা খেলছেন। এই খেলা কোন ভাবেই একটি সুস্থ খেলা নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড ইতিমধ্যে কার্যকর হয়ে গিয়েছে। তাদের জন্য কেহ ইন্নলল্লাহ্ পড়েনি এবং এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার কারনে। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যও কেহ চোখের পানি ফেলেনি। বাঙ্গালীরা দুপক্ষের দায় শোধবোধ করে দিয়েছে। তবুও আজ সরকার চোখের বদলে চোখ তুলে নেওয়ার খেলার উম্মাদনায় মত্ত হয়ে গিয়েছে। এই খেলায় যদি সারা দেশের সকল লোক অন্ধ হয়ে যায় তাতেও যেন সরকার প্রধানের কিছু আসে যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান যদি মুক্তি যুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে ঢালাও ভাবে ক্ষমা না করে দিতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব মতলব বাজদের হাতে পড়ে এমন ভাবে হুমকির মুখে পড়তোনা। তবে মনে রাখবেন, যারা মহান তারা ত্যাগের বিনিময়ে কিছু গ্রহন করেনা এবং প্রতিশোধ নিয়ে ম্লান করে দেননা ত্যাগের সুগৌরব মহীমা। নেল্সন ম্যান্ডেলা চবধপব ধহফ জবপড়হপরষরধঃরড়হ এর মাধ্যমে এই মহীমা সমুন্নত করেছেন। নেল্সন ম্যান্ডেলার মত নির্যাতন  গত কয়েকশত বছরে কেহ ভোগ করেনি। তিনি দেশের মুৃক্তির জন্য তার নিজস্ব সকল সুখ শান্তি উৎসর্গ করেছিলেন। দেশ মুক্ত হয়েছে, তার ত্যাগ তিতিক্ষা সফল হয়েছে। দেশ তাকে মহানায়কের মর্যাদায় স্থান দিয়েছে। প্রতিশোধ না নিয়ে তিনি মহানায়কের মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। না হয় মাটির মানুষ আকাশ থেকে আবার মাটিতে পড়ে যেতেন। ত্যাগ করে ত্যাগের বিনিময় নিলে ত্যাগ মূল্যহীন হয়ে যায় এবং প্রতিশোধ নিতে গেলে নক্ষত্রের ছন্দপতন ঘটে। মক্কা বিজয়ের পর ইচ্ছা করলে মোহাম্মদ (সাঃ) আধুনিক যুদ্ধের নীতি অনুযায়ী হাজার হাজার মক্কাবাসীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে দিতে পারতেন। অথচঃ তিনি হিন্দার মতো মহিলাকেও অবলীলায় মাফ করে দিয়েছিলেন। নেতা যদি মাস্তানের উপর প্রতিশোধ নিয়ে মাস্তানী করে তখন নেতা আর মাস্তানের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। বলুন! প্রতিশোধই যদি নিলাম তাহলে ত্যাগ করলাম কি ভাবে?

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির একজন অকুতোভয় সৈনিক। তিনি তার জীবন যৌবন উৎসর্গ করেছেন নিষ্ঠুর বর্ণবাদী সরকারের কবল থেকে কালো আফ্রিকানদেরকে উদ্ধার করার জন্য। কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি জীবনের অতগুলো মূল্যবান বছর কারাগারে উৎসর্গ করেন নি। ছাড়া পেয়ে তিনি সাদা-কালো, আফ্রিকান-ইন্ডিয়ান  সবাইকে এক মোহনায় এনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটি রেইনবো কান্ট্রিতে রূপান্তরিত করেন। নেল্সন ম্যান্ডেলা শান্তি ও ঐক্যের মহানায়ক হিসাবে দুনিয়া ত্যাগ করেছেন। নেল্সন ম্যান্ডেলার শেষ কৃত্যে বিশ্বের একশতটিরও বেশী দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান যোগ দিয়েছেন। অপরদিকে আমরা আমাদের মহানায়ককে স্বপরিবারে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছি। এবং এখন প্রতিশোধের নাটক সাজিয়ে তাকে দিগম্বর করে দিচ্ছি সারা দুনিয়ার কাছে। নেল্সন ম্যান্ডেলার জন্য আমরা তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছি। এই মুহুর্তে কি কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়া খুবই জরুরী ছিল? আত্মত্যাগ করে প্রতিশোধ নিলে আত্মত্যাগ আর প্রতিশোধ কাটাকাটি হয়ে যায়। উচ্ছিষ্ট হিসাবে থেকে যায় শুধু আত্মত্যাগী মানুষটির স্কেলেটন। শেখ মুজিবুর রহমান পরাজিত শক্তির বিচার করেননি এবং তাদের এদেশীয় সাহায্যকারীদেরকেও তিনি মাফ করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান বেয়াকুফ ছিলেন না। কিন্তু আজ আমরা তার সুযোগ্য সন্তানরা তাকে বেয়াকুফ বানাচ্ছি সারা দুনিয়ার কাছে। প্রতিশোধ নিলে ত্যাগের মহিমা বিনষ্ট হয়। আর ত্যাগের মহিমা বিনষ্ট হয়ে গেলে ত্যাগী ব্যক্তিটির মৃত্যু হয়ে যায় এবং তার মর্যাদা নেমে যায় সাধারণ মানুষের পর্যায়ে।

Loading

About ওয়াহিদুর রহমান

লেখক একজন কষ্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্ট। ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধানের উপর গবেষনা মূলক চিন্তা ভাবনা করে থাকেন। কম্পারেটিভ ধর্ম চর্চা লেখকের একটি পুরনো অভ্যাস। লেখকের গবেষনা মুলক গ্রন্থ ‘ইসলাম ও আমাদের দৈনন্দিন জীবন’ সমাপ্তির পথে। বইটি টরন্টস্থ বাংলা সাপ্তাহিক ‘দেশের আলো’ পত্রিকায় অনেকদিন থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। লেখক টরন্টস্থ ’বৃহত্তর নোয়াখালী এসোসিয়েশন ওন্টারিও’ এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *