রজব মাসকে ঘিরে নানা অপসংস্কৃতি

  এখন আমরা রজব মাস অতিক্রম করছি। এ মাস চারটি সম্মানিত মাসের একটি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি। আসমান ও জমিনসমূহ সৃষ্টির দিন থেকেই। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি অত্যাচার কর না। (সুরা তাওবা : ৩৪) এ মাসের ফজিলতের ব্যাপারে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘বার মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক : জিলহজ, জিলকদ, মুর্হরম। চতুর্থটি হলো রজব, যা জুমাদাল উলা ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। (সহীহ বুখারি : ২/৬৭২, হাদিস নং ৪৬৬২) সম্মানিত চারটি মাসের মধ্যে যেহেতু রজব মাসও রয়েছে, তাই তার প্রতি সম্মান দেয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত। তবে সম্মানের অর্থ এই নয় যে, বাজারের অনির্ভরযোগ্য বই পুস্তকে রজব মাস সম্পর্কে যেসব ভ্রান্ত কথাবার্তা লেখা রয়েছে, সেগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করা। নিজেদের মনগড়া কোনো নফল নামাজ বা নফল রোজা আবিস্কার করা। কোরআন ও হাদিসে এই মাসের বিশেষ কোনো নামাজ ও রোজার প্রমাণ নেই। এ মাসের বরকত অর্জন করার জন্য বেশি বেশি নফল নামাজ, রোজা, কোরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য নফল ইবাদত বন্দেগি বেশি করার কথা বর্ণিত হয়েছে।

রজব মাসের আমলের ব্যাপারে দুইটি বিষয় হাদিস শরিফে পাওয়া যায়। একটি হলো এই মাসে অধিক পরিমাণে নফল আমল করা। দ্বিতীয়টি হলো এই মাসে বিশেষ একটি দোয়া অধিক পরিমাণে পাঠ করা, যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি পাঠ করতেন। দোয়াটি হলো ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ও শা’বান, ওবাল্লিগনা রমাদান’। হে আল্লাহ ! রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত দান করুন। আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। (মুসনাদে আহমাদ (যাওয়ায়েদ) ১/২৫৯, মুসনাদে বাজ্জার-মাজমাউজ জাওয়ায়েদ ২/১৬৫)
উল্লেখ্য, ৬২৭ হিজরি সনের ৬ই রজব আল্লাহ তায়ালার কুতুব খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি আজমীরী রহ. ইন্তেকাল করেছেন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আজমীরী শরিফে প্রতি রজব মাসে ওরসের আয়োজন করা হয়। সেখানে নারী পুরুষ এক সঙ্গে নাচগানসহ নানা অনৈসলামিক কাজে লিপ্ত হয়। এর পেছনে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ ব্যয় করে থাকে, যা ইসলামি শরিয়ত সমর্থন করে না। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগানের জন্য রজব মাস এলেই রাস্তার পাশে বিভিন্ন গলির মাথায় মাথায় লাল কাপড় পেছানো ডেগ পেতে রাখতে দেখা যায়। অনেক জায়গায় মাজারের আদলে অস্থায়ী মাজারও তৈরি করা হয়। সরলমনা সাধারণ মানুষ তাদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে এসব ডেগ ও মাজারে প্রচুর টাকা-পয়সা দান করে। এভাবে মাজার ব্যবসায়ীরা পূঁিজ বা মূলধন ছাড়া ব্যবসা করে রাতারাতি আঙ্গুল ফূলে কলাগাছ হয়ে যায়। অপরদিকে তাদের এসব অপকর্মের কারণে পীর-মুরিদির মতো একটি পবিত্র ও ধর্মীয় অধ্যায় কলঙ্কিত হয়। ইসলাম বিদ্বেষী মহল এটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ইসলামের বিরুদ্ধে ও পীর-মুরিদির বিরুদ্ধে নানা কুৎসা ও অরুচিকর কথাবার্তা ছড়িয়ে সমাজের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ধর্মকে ব্যবহার করে মাজাব্যবসায়ীরা গড়ে তোলে বিপুল সম্পদ। রাজধানী ঢাকায় জাকজমকপূর্ণ ভবন তৈরি করে তারা যাপন করে বিলাসী জীবন। অন্যদিকে বদনাম হয় ইসলামের চিরায়ত শ্বাশত বিধানের। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ভন্ডরা ইসলামের দোহাই দিলেও তাদের জীবনে ধর্মের কোনো স্থান নেই। মুখে দাঁড়ি নেই। পরনে সুন্নতি লেবাস নেই। নামাজ-রোজার বালাই নেই। পীর-মুরিদির নামে তারা নানা ভন্ড কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে থাকে।
ওরসকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মাঝে গরু ছাগল মান্নত করার একটি প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। এটি মূলত জাহেলি যুগের ‘আতিরা’ ও ‘ফারা’ এর অবিকৃতরূপ । ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগে মুশরিকদের মাঝে প্রতীমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু জবাই করার একটি রেওয়াজ ছিল। এটিকে আতিরা বলা হত। আরেকটি কুসংস্কার এই ছিল যে, তারা উট বা বকরির প্রথম বাচ্চা দেবতার নামে জবাই করত। এটিকে ‘ফারা’ বলা হত। ইসলামে ‘আতিরা’ ও ‘ফারা’ এর কোনো স্থান নেই। বর্তমানে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহ. এর ওরস উপলক্ষে তার মাজারে গরু ছাগল জবাই করা হয়। এসব কুসংস্কার মূলত জাহেলী যুগের ‘আতিরা’ ও ‘ফারা’ এরই বিকল্পরূপ। এ দুটির মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং এ ধরনের মান্নত করাও না জায়েজ। এগুলো থেকে কিছু গ্রহণ করাও না জায়েজ। এ ছাড়াও এই মাসকে ঘিরে আমাদের সমাজে নানা কুসংস্কার প্রচলিত আছে। সেগুলো থেকে বিরত থাকা উচিত। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

শিক্ষক, জামিয়া রহমানিয়া সওতুল হেরা, টঙ্গী, গাজীপুর।

Loading

Comments are closed.