কুরআন-হাদিসের আলোকে মেরাজ

রাসুলুল্লাহ সা. এর নবুওয়তী যিন্দেগীতে যে সকল অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল, তন্মধ্যে মে’রাজের ঘটনা অন্যতম। পবিত্র কুরআন কারীম এবং মাশহুর, মুতাওয়াতীর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তা অস্বীকার করা কুফরী। মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,”পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রী বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন- মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত । যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যেন আমি তাকে আমার নিদর্শনাবলী (কুদরতিভাবে) দেখাতে পারি । নিশ্চয়ই তিনি অধিক শ্রবণকারী ও দর্শনশীল” ।
-বনী ঈসরাঈল: ১
কুরআনের পরিভাষায় ‘ইসরা’ শব্দ দ্বারা মেরাজের ঘটনার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। হাদিসের পরিভাষায় ‘উরজুন’ শব্দ দ্বারা মেরাজের ঘটণা বর্ণনা করা হয়েছে। ‘ইসর’া ধাতু থেকে ‘আসরা’ শব্দটি উৎসারিত । আভিধানিক অর্থে রাত্রে নিয়ে যাওয়া। সফরটি রাত্রের একাংশে সম্পাদিত হয়েছে বিধায় ইসরা বলা হয়। ‘উরজু’ন ধাতু থেকে ‘মেরাজ; শব্দ উদগত হয়েছে। তার শাব্দিক অর্থ সিঁড়ি । রাসুল সা. মসজিদে আকসা থেকে সিঁড়ির মাধ্যমে (‘রফরফ বা বোরাকের’ মাধ্যমে) আরোহন করে,‘বায়তুল মামুর’ এবং ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত পৌঁছে ছিলেন বিধায় উপরিউক্ত সফরকে মেরাজ বলা হয়।
আরবী মাস ‘রজবের’ ২৭ তারিখ নবুওয়ের দশম বর্ষে নবী করীম সা. এর ৫০ বৎসর বয়সে পবিত্র মেরাজ সংঘটিত হয়। (- সীরাতে মোস্তফা
আশেকে এলাহি মিরাঠী,তারিখুল ইসলাম,মাওলানা হিফজুর রহমান সিহারভী)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,”তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়নি এবং তিনি সীমালঙ্গনও করেননি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন”।- আন নাজম : ১৭-১৮
বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী ইরশাদ করেন, “রজবের সাতাইশ তারিখ রাতে হঠাৎ আমার কাছে জিবরাইল একটি সাদা রঙের ‘বোরাক’ নিয়ে উপণিত হলেন। বোরাক হচ্ছে, সাদা রঙের এক প্রকার আরোহনের যন্ত্র। সে প্রতিটি কদম ফেলে দৃষ্টির শেষ সীমানায়। তিনি বলেন আমি এতে আরোহান করলাম। অতপর আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং সেখানে দ’ুরাকাত নামাজ আদায় করলাম। এরপর আমি মসজিদ থেকে বের হলাম। তখন জিবরাঈল আ. একটি ‘শরাব’ এবং একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তখন আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাঈল বললেন আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন।
-মুসলিম শরীফ খন্ড: ৯১
আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ.বলেন,একদা রাত্রিবেলা রাসুল সা. উম্মে হানী রা. নিঝুম নিলয়ে নিভৃতে আরাম নিচ্ছলেন। রাসূল সা. তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় বিস্ময়করভাবে ঘরের ছাদ ফেটে যায় এবং ছাদপথে ফিরিশতা জিবরাঈল আ. অন্তকুঠরিতে অনুপ্রবেশ করেন । জিবরাঈল আ. এর সাথে অন্য ফিরিশতারাও ছিলেন। জিবরাঈল রাসুল সা. কে ঘুম থেকে জাগিয়ে হারাম শরিফে নিয়ে আসেন। রাসুল এখানে এসে ‘হাতীমে কাবায়’ ঘুমিয়ে যান,জিবরাঈল আ. ও মিকাঈল আ. পুনরায় রাসুলকে জাগিয়ে দেন এবং ‘যমযম’ কূপের প’শে তাকে নিয়ে আসেন। সেখানে রাসুল সা.এর বক্ষবিদারণ করে পবিত্র জমযম পানি দ্বারা তার বক্ষ মোবারক ধৌত করেন। অতপর একটি আরোহনের যন্ত্র বোরাক আনা হয়। রাসুল সা. সে যানবাহনে আরোহন করেন। রহমতে আলমের কুদরতি বাহন বোরাক বায়ূগতিতে চলছে। যাত্রাপথে রাসুল সা. ‘ইয়াসরীব’ নগরীতে উপস্থিত হন। জিবরাঈল আ. বলেন এটা ইয়াছরিব উপত্যকা। এটা আপনার হিজরতের স্থান । রাসুল অবতরণ করে সেখানে দু’রাকাত নামাজ পড়েন । বোরাক চলতে থাকে দ্রুতগতিতে । ‘তুর’ পর্বতের পাদদেশে সানাই প্রান্তরে উপস্থিত হয়। জিবরাঈল রাসুলকে পরিচয় করিয়ে দেন এটা ‘তুর’ পর্বত । এখানে অল্লাহ মুসা নবীর সাথে কথা বলেছিলেন। এখানেই মুসা আ. নবুওয়াত লাভ করেছিলেন। রাসুল সেখানে অবতরণ করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। এভাবে টর্নেডু গতিতে চলছে বোরাক । ক্রমেই ঈসা আ.এর জন্মসহান ‘বায়তু লাহাম’ ফিলিস্তিনে উপস্থিত হন। জিবরাঈল উক্ত স্থান পরিচয় দিয়ে সেখানে দুরাকাত নামাজ পড়েন। এভাবে বিভিন্ন পয়গাম্বরদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান সমুহ জিয়ারত করে ‘বায়তুল মোকাদ্দাসে’ উপস্থিত হন । -সীরাতে মোস্তফা ইদ্রীস কান্দলবী
বায়তুল মোকাদ্দিসে পৌঁছে পূর্ববর্তী সকল নবী রাসুলগণকে নিয়ে মসজিদে দু’রাকাত নামাজ পড়েন এবং তিনি নামাজের ইমামতি করেন। বায়তুল মাকদিসে ইমামতির পর জিব্রাঈল আ. কে নিয়ে বোরাকের মাধ্যমে উর্ধ্বকাশে যাত্রা করলেন । মুহুর্তের মধ্যে প্রথম আসমানের প্রবেশ দ্বারে এসে উপস্থিত হন। সেখানে আদম আ: এর সাথে সালাম- কুশল বিনিময় করেন। এভাবে সাত আসমানে অবস্থানকারি অন্যান্য নবী-রাসূলদের সাথে সাক্ষাত করে সালাম বিনিময় করেন। সেখানে প্রত্যেক নবী-রাসূলগণই তাকে অভ্যর্থনা জানান। সপ্তম আকাশের পর রাসুল সা. আর ও‘ সিদরাদুল মুনতাহা’ পর্যন্ত উপণিত হন। হুজুর সা.আরও উর্ধ্বে গমন করেন, এমনকি ‘লাওহে মাহফুজে’র কলম চালনার আওয়াজ শুনতে পান । জিবরাঈল বলেন,আমার যাত্রা আপাতত এখানেই শেষ । এতদপেক্ষা আপনার সঙ্গ দেয়ার সাধ্য আর আমার নাই। অতপর রাসুল সা.আল্লাহর এত কাছে চলেন যান এবং আল্লাহর তাঁর বন্ধুকে নিবিড় সান্নিধ্য দান করেন এবং এখানেই আল্লাহর দিদার লাভ করেন। একটি পর্দার আড়াল টেনে আল্লাহ তাঁর আত্মরুপ দর্শন করান তার প্রিয় নবীকে । সেখানে রাসুলকে আল্লাহ রাব্বুল আলিামিন মহা অপ্যায়ন করান। এখানেই রাসুল সা. মহান রাব্বুল আলামিনের সাথে একান্ত আলাপের সৌভাগ্য নসিব হয়। এখান থেকে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে উম্মতে মোহাম্মদির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উপহার নিয়ে আসেন। কিন্তু সাওয়াব ৫০ ওয়াক্তেরই রয়েছে ।
কুরআন-হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে মেরাজ প্রমাণিত । তা স্বীকার করা কুফরি। মেরাজ আমাদের লক্ষ্য ও গন্তব্যের সন্ধান দেয় । মেরাজ আল্লাহর সাথে মানুষের সর্ম্পক গভীর করে তুলে। মেরাজের তাৎপর্য অনস্বীকার্য। মেরাজ রজনীতে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারীত কোন আমল নেই। রজব বরকতময় একটি মাস। রজব ও শা’বান মাসদ্বয়কে রাসুল সা. রমজানের প্রস্তুতি মাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেহেতু রজব শুরু হয়ে শেষের পথে। তাই এখন থেকে নফল রোজা, নফল নামাজ, নেক আমলগুলোর প্রতী মনোনিবেশ হওয়া দরকার। রাসুল সা. রজব মাসে এই দোয়া বেশি বেশি পাঠ করতেন। দোয়াটি হচ্ছে, “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ও শা’বানা ওয়াবাল্লিগনা রামাজান”। আসুন আমরা রজবে এই দোয়াটি বেশী বেশী পাঠ করি।
লেখক: ধর্মীয় নিবন্ধকার,তরুণ আলেম

সুত্র: তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন,বুখারী ও মুসলিম শরীফ, তাফসিরে ইবনে কাসীর,
-সীরাতে মোস্তফা ইদ্রীস কান্দলবী আশেকে এলাহি মিরাঠী,
তারিখুল ইসলাম,মাওলানা হিফজুর রহমান সিহারভী)

 

Loading

Comments are closed.