বিজেপির জয় এবং বিএনপির রাজনীতি

ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপির বিজয়ের হাওয়া লেগেছে ঢাকার রাজনীতিতে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা রীতিমতো উল্লসিত।

সরকারি দল আওয়ামী লীগে অস্বস্তি লক্ষণীয়। ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ গল্পের মতো অবস্থায় তারা। সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা অনবরত বলছেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন নই।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তাদের ক্ষমতার পরিবর্তনে আমাদের কিছুই হবে না।’

আর মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখানেও অগ্রগামী। তিনি-ই প্রথম মুখ খুলেছেন। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিজেপির জয়ে কারো উল্লসিত কিংবা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’ এসব মন্তব্যই প্রমাণ করে ভারতে বিজেপির বিপুল জয়, আর কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয়ে আওয়ামী লীগে কি পরিমাণ অস্বস্তি।

বিগত ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনই বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভারত নির্ভরতার মুখোশ উম্মোচন করেছে। ঐতিহ্যগতভাবেই আওয়ামী লীগে ভারতপ্রীতি বিদ্যমান। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দীর্ঘদিন ভারতে বসবাস করেন। কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধান ইন্দিরা গান্ধীই তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার সঙ্গে কংগ্রেসের একটি পারিবারিক সম্পর্ক বিদ্যমান।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা জরুরি। সেটা হলো- ভারতে কংগ্রেস ও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শন এবং ক্রমবিকাশের ধারা একই রকম। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ নানা ক্ষেত্রে কংগ্রেসের অবদান অতুলনীয়। তেমনি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আওয়ামী লীগের অবদান অনস্বীকার্য। আবার, গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ভারত রাষ্ট্রের চেয়ে দল ‘কংগ্রেস’কে বড় মনে করে। এমনকি ভারত রাষ্ট্রকে ‘পারিবারিক সম্পত্তি’ ভেবেই কংগ্রেস/গান্ধী পরিবার ক্ষমতা পরিচালনা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে।

একইভাবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চেয়ে ‘মুজিব পরিবার’ ও ‘আওয়ামী লীগ’কে বড় করে দেখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ভেবেই সবকিছু করে চলেছে আওয়ামী লীগ। আর রাষ্ট্র পরিচালনা নীতিতে দুই দলই জনগণকে ‘প্রজা’ মনে করে।

আরো একটি বিষয়ে খুবই মিল কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগে। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধী ইতালি বংশোদ্ভুত ভিন্ন ধর্মের সোনিয়াকে বিয়ে করেন। এটা হিন্দু ধর্মের রীতি বিরুদ্ধ। তেমনি সোনিয়া গান্ধীর মেয়ে প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বিয়ে করেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যুক্তরাজ্যের রবার্ট বঢরাকে। এসব নিয়ে হিন্দুবাদী রাষ্ট্র ভারতের নাগরিকদের মধ্যে সমালোচনা রয়েছে।

আওয়ামী লীগেও একই ধারা বিদ্যমান। কংগ্রেসকেই যেন অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বিয়ে করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী ক্রিস্টিনাকে। বঙ্গবন্ধুর আরেক দৌহিত্র ও শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান সিদ্দিক ববিও একই পথে হেঁটেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যে এক বিধর্মীকে বিয়ে করেন। শোনা যাচ্ছে, শেখ রেহানার মেয়েও একই পথ অনুসরন করতে চলেছেন।

তবে এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের অবতারণা জরুরি। তা হলো- সমাজপতি কিংবা জ্ঞানজীবী পর্যায়ে বিয়ে বা ধর্ম বড় বিষয় নয়। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বিয়ে না করেও অন্যভাবে জীবন কাটালেও উচ্চ বর্ণের কাছে তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের সাধারণ ভোটার ও নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে নিজ ধর্মীয় রীতিকে অবমাননা বিরাট পাপ। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে বিপুলভাবে গ্রহণ করে এবারের নির্বাচনে ভারতের জনগণ এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছে।

এ বিষয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি ব্যাখ্যা উদ্ধৃত জরুরি মনে করছি। কংগ্রেসের জ্ঞানজীবী হিসেবেও পরিচিত তিনি। তিনি তার ‘আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। হিন্দু ধর্মকে বড় করতে গিয়ে তিনি ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেন। সেখানে তিনি ভারত রাষ্ট্র এবং হিন্দু ধর্মকে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হিসেবে ব্যাখ্যা দেন। বইটির দ্বিতীয় অংশে তিনি স্যেকুলারিজমকে ‘হিন্দু ধর্মের সন্তান’ হিসেবে চিত্রায়িত করেন।

ড. অমর্ত্য সেনের মতে, ‘স্যেকুলারিজম হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। হিন্দু ধর্ম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-বিরোধী নয়। কেউ ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিশ্বাস করলে তাকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে হবে। আর বিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে হিন্দু ধর্মের প্রথায়।’ এমন একজন বড় মাপের চিন্তাবিদের এই সাম্প্রদায়িক মতামতের বিশ্লেষণ নিয়ে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় আমি কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম।

গত ১৬ মে ভারতের নির্বাচনের ফল ঘোষণায় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে আমার ড. অমর্ত্য সেনের আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান বইটির কথা মনে হলো। তার বই আর বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের চিত্র মেলানোর চেষ্টা করলাম।

আমার প্রশ্ন, অমর্ত্য সেনের ব্যাখ্যা মেনে ভারতের জনগণ কী হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপিকে ‘অসাম্প্রদায়িক’ ভেবে এমন সমর্থন দিয়েছে! না-কি ভারতের জনগণ প্রকৃতপক্ষেই হিন্দু ধর্মের প্রতি আস্থাশীল। রাজনীতিতেও তারা কী সনাতন এই ধর্মকে প্রাধান্য দিলেন?

এ প্রশ্নের উত্তর অমর্ত্য সেনই ভাল দিতে পারবেন। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা। সেটা হলো- বিজেপি একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। কংগ্রেস একই দোষে দুষ্ট। কেননা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোট পেতে কংগ্রেস বরাবরই রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়েছে। এক্ষেত্রেও কংগ্রেসকে অনুসরন করে আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভোট পেতে রাজনৈতিক চাল খেলতে দেখা যায় আওয়ামী লীগকে। তবে বাংলাদেশে বিজেপির মতো দল হিসেবে জামায়াত ইসলামীকেই গণ্য করা হয়। ইসলাম ধর্মই তাদের রাজনীতির প্রধান পুঁজি, যেখানে বিজেপির পুঁজি হিন্দু ধর্ম। এভাবে দেখলে ভারতে ‘কংগ্রেসের’ সমর্থক বাংলাদেশে ‘আওয়ামী লীগ’, আর ভারতে ‘বিজেপির’ সমর্থক বাংলাদেশে ‘জামায়াত ইসলামী’।

তাহলে বিএনপির দর্শন কি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিজেপির জয়ে বিএনপির কী – এই প্রশ্নের অবতারণা। ৫ জানুয়ারির পর অব্যাহত গুম-খুনে বিএনপি বিপর্যস্ত। নিস্তেজ। গন্তব্যহীন। কিন্তু শুক্রবার ভারতের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিএনপি নেতাকর্মীরা উচ্ছসিত। শীর্ষ নেতারা নড়েচড়ে বসেছেন। সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অঙ্ক কষছেন। এবার বুঝি একটা কিছু হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সর্বাগ্রে নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন।

কংগ্রেসের ভরাডুবি আর বিজেপির জয়ে বিএনপিতে স্বস্তির মূল কারণ হলো- ‘শত্রুর বন্ধুর শত্রু, আমার বন্ধু’ এই ফর্মূলা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বন্ধু কংগ্রেস। কংগ্রেসের শত্রু  বিজেপি। এজন্যই বিজেপি বিএনপির বন্ধু – বলেই মনে করা হচ্ছে।

বাস্তবেও এমনটা ঘটেছে অনেকবার। ২০১২ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েও উল্লেখিত ফর্মূলা প্রয়োগ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাক্ষাত দেননি কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দিল্লি সফরে খালেদা জিয়ার দুই দিন হোটেলে বসে কাটানোর উপক্রম হয়েছিল। আমি সংবাদকর্মী হিসেবে ওই সফরে গিয়েছিলাম। সেদিন বিএনপি নেত্রীর সফরসঙ্গী নেতাদের দৌড়ঝাপ ও কালো মুখ দেখে যে কারো করুণা হওয়ার কথা। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর করুণা হয়নি। এমনকি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের নানামুখী চেষ্টা সেদিন স্বচক্ষে দেখেছি। চেয়ারপারসনের সফর সফল করতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে সচেষ্ট ছিলেন। শিডিউল নিশ্চিত করতে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ ও প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান ছুটাছুটি করেছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে।

তখন বিএনপি ঘরানার সবাই ছিলেন উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ থেকে বিএনপির একজন চিকিৎসক নেতা (সাবেক ছাত্রদল নেতা) রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বৈঠক নিশ্চিতে চেষ্টা করেন। মালয়েশিয়া থেকে একজন বিএনপি নেতা বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক অনুষ্ঠানের চেষ্টা করেন। সফরসঙ্গীদের বাইরে আমি এই দু’জনের চেষ্টার বিষয়টি তখনই অবগত ছিলাম। এভাবে অনেকেই চেষ্টা করেছেন। সবার চেষ্টায় সেদিন ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের বৈঠক হয়।

ওই সফরের আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল – যেদিন খালেদা জিয়া ভারতে যান, পরের দিন ভারতীয় হাই কমিশনারকে ডেকে পাঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভি চলে যান ভারত সফরে।

সেদিন শেখ হাসিনার চেষ্টা যে সফল হয়েছিল, তা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সোনিয়া গান্ধীর বৈঠক না হওয়া এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বৈঠকেই প্রমাণিত হয়। সংবাদকর্মী হিসেবে সেটা আমরাও স্পষ্ট হয়েছিলাম।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ২০১২ সালে খালেদা জিয়ার ভারত সফর কী ব্যর্থ হয়েছিল? প্রাথমিক ফলাফলে এর উত্তর নিশ্চয়ই ‘হ্যাঁ, ব্যর্থ’। বিগত ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে কংগ্রেস সরকারের দৃঢ় অবস্থানই – সেটা প্রমাণ করেছে। তবে খবর হলো- ভারত নিয়ে বিএনপির অবস্থান কিছুটা পাল্টেছে। সেটা খালেদা জিয়ার ভারত সফরেই স্পষ্ট হয়েছিল। বিএনপি মনে করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে ভারতকে কোনো ছাড় নয়, তবে পারস্পরিক সম-স্বার্থের ভিত্তিতে সব ইস্যুতে একটি সমাধানে আসা জরুরি।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তা একাধিকবার জানিয়েও দিয়েছে বিএনপি। তাছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তির আইন অনুযায়ি, যেসব ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে গেছে, দুই পক্ষ সম্মত না হলে তা বাতিলেরও কোনো সুযোগ নেই। এজন্য বিএনপিও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে তৎপর। আর ভারতের ক্ষমতার পরিবর্তনে এ সুযোগকে ভালভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করছেন দলটির কুটনীতি সংশ্লিষ্টরা। ‘শত্রুর বন্ধুর শত্রু, আমার বন্ধু’ এই ফর্মুলায় বিএনপি অনেক দূর এগিয়েছে। বিজেপির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছে। অন্তরালেও অনেক দৌড়ঝাপ হয়েছে। সেই চেষ্টা কতটুকু সফল হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

-পূর্ব প্রকাশিত আরটিএনএন

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *