মিশরে ফ্যাসিবাদের উত্থান

  মিশরে সদ্যবিদায়ী সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দেশটির সাবেক কোন নেতার মত- এ নিয়ে গত বছর জুড়েই বেশ আলোচনা হয়েছে। বস্তুত সিসি এবং তার নীতির সাথে মিশরের অতীতের কোনো নেতার মিল নেই। তিনি শুধু তার মতই। 

জনগণের কাছে জনপ্রিয় হলেও এই আলোচনায় আমাদের আপত্তি আছে। আমরা বরং মিশরের হবু নেতা সম্পর্কে নতুন একটি প্রশ্ন  উত্থাপন করতে পারি- কে এই সিসি এবং তার গন্তব্য কোথায়?

সমসাময়িক প্রশ্ন নিয়ে মিশরীয়দের উচিৎ নিকট অতীতের প্রবণতার দিকে দৃষ্টিপাত করা। সে যাই হোক, মিশরীয় জাতি এখন কোথায় যাচ্ছে তা বোঝার জন্য আমাদের অন্য জাতির ইতিহাসের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

আমাদের সামনের চিত্রটি বিপজ্জনক।  মিশর একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। এটা অনিবার্য নয়, অবশ্যই। দেশটির অবস্থা স্থিতিশীলও নয়। তবে আমাদের আশঙ্কা, দেশ এখন যেদিকে যাচ্ছে তা আমাদের মোটই কাঙ্খিত নয়।

মিশরের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ফ্যাসিবাদের ঐতিহাসিক উত্থানের সাথে সংগতিপূর্ণ। এমনকি ইতিহাসের দিকে ক্ষণিক দৃষ্টিপাত করলেও দেখা যাবে যে অতীতের ফ্যাসীবাদীরা ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা রেখে গেছেন।

মিশরের বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। বর্তমান সরকার ব্যাপক বৈষম্য এবং  কাঠামোগত ঘাটতির মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছে। তবে সিসি-গংরা এমন কোনো সংস্কার করেনি কিংবা সংস্কারের প্রস্তাব দেয়নি যাতে বর্তমান দুরাবস্থার অবসান হতে পারে।

অন্যদিকে কৃচ্ছতা নিয়ে যে গলাবাজি হচ্ছে তা যদি সত্যিকার কৃচ্ছতায় পরিণত হয় তবে নতুন শাসকগোষ্ঠী আহত অর্থনীতির ওপর আরো আঘাত করার ঝুঁকি নেবেন। এক্ষেত্রে মিশরের অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য নাগরিকে দাতের চামড়া দিতে হবে, জাতীয় রাজনীতির কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এর সমাধান হবে না।

অবশ্যই ক্ষমতা সংহত করার একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ হচ্ছে জাতীয় জীবনে কৃচ্ছতাসাধন।

সিসি যখন মিশরীয়দের বলেন, ‘তোমরা যা নেবে তার চেয়ে বেশি দিতে হবে’ তখন কার্যত তিনি একথাই বলেন যে, ‘তোমাদের সামর্থের চেয়েও বেশি কিছু আমাদের দিতে হবে।’

এই গলাবাজির মাধ্যমে সিসি তার দেশের ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিকদের দেশদ্রোহীতে পরিণত করতে চাইছেন। যারা তার সরকারের কাছ থেকে ইনসাফ ও স্বচ্ছতা  দাবি করছেন তিনি তাদেরকে অকৃতজ্ঞ এবং ধৈর্যহীন মনে করছেন।  এই কৌশলের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ‘আমরা ও তোমরা’ মানসিকতার জন্ম নিচ্ছে এবং  সরকার ও তার সমর্থকদের বিরোধীদের মূলোৎপাটন সহজ হচ্ছে।

মিশরের সমসাময়িক অর্থনীতি নিয়ে জাতীয় জীবনে যে মনোভাব বিরাজ করছে তা মিশরের বর্তমান বৃহত্তর মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। অতীতের ফ্যাসীবাদী শাসকরা গণতন্ত্রায়ণে ব্যর্থ হলেও জাতীয়তাবাদী মনোভাব তুঙ্গে নিয়ে গেছেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইতালি ও জার্মানির ভঙ্গুর গণতন্ত্রও সে সময়কার রাজনৈতিক ইস্যুর প্রয়োজনীয় সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়। এরফলে জনগণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপরই আস্থা হারিয়ে ফেলে।

পরবর্তীতে জনগণ গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যারা স্থিতিশীলতা এবং অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। এসব নেতারা জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে সহিংসতার পক্ষে ওকালতি করেন এবং জার্মান ও ইতালির জনগণ জাতীয়তাবাদী স্বপ্ন-তাড়িত হয়ে কথিত নিরাপত্তার জন্য নিদ্বির্ধায় তাদের নাগরিক স্বাধীনতা এবং জনগণের জীবন পর্যন্ত বিজর্সন দেয়।

গত কয়েক বছর ধরে মিশরের রাজনীতিকে যারা পর্যবেক্ষণ করছেন তারা এই কাহিনীকেই স্বীকৃতি দিচ্ছেন।  

অধিকন্তু,  মিশরীয় জাতীয়তাবাদ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্কের কথাও মনে রাখতে হবে। এদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মিশরে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম এবং সামরিক বাহিনীর ভূমিকা যেন একে অপরের পরিপূরক।  অনেক মিশরীয়র কাছে মিশরের সামরিকন্ত্র যেন অতুলনীয়। কিন্তু বাস্তবে তা নয়।  বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মানি, ইতালি এবং স্পেনে এভাবেই সামরিকতন্ত্রকে গিরে ফ্যাসীবাদের বিকাশ লাভ করে।

মিশরে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কথা শুধু আমরাই প্রথম বলছি না। আমাদের যুক্তিগুলো বরং অন্যদের প্রতিষ্ঠিত।  ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উত্তর আফ্রিকায় ফ্যাসীবাদী মতবাদের বিকাশের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। যেমন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জ্যাক স্নিডার যুক্তি দেখিয়েছেন যে গণতন্ত্রায়ণের ব্যর্থতা এবং জাতীয়তাবাদী  মনোভাবের কারণে সৃষ্ট সংঘাত,  স্বৈরশাসকদের পতনের পর গণতন্ত্রায়ণ করতে গিয়ে জনগণের ত্বরিত আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থতার কারণে জনগণ গণতন্ত্রের পরিবর্তে সেইসব মতাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা ত্বরিত ফল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

সিসি এবং বর্তমান শাসকগোষ্ঠী জনগণের এই মরিয়া এবং উচ্চাশার সম্মিলিত ফল ভোগ করছেন।

এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তারা একটি রাজনৈতিক দলকে (মুসলিম ব্রাদারহুডকে) সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে এবং জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দিয়ে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে জায়েজ করেছে।

মোবারক অত্যন্ত ভালো কাজ করেছিলেন। তিনি জনগণের ক্রোধ ও ক্ষোভকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তার পতনের পর এখন সমস্যা আর একটি নয়, বহুবিধ। দেশ নিশ্চল হয়ে পড়েছে। আনাড়ি ব্রাদারহুড নিজেদের দোষ দেখছে না। তারা মিশরীয় সুযোগসন্ধানী সামরিক বাহিনীর বলির পাঠায় পরিণত হয়েছে। অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপতর হয়েছে এবং মিশরীয় জনগণকে তাদের অধিকার, স্বাধীনতা, নিজেদের এবং অন্য নাগরিকদের জীবন বিসর্জন দিতে হচ্ছে।

আমরা আশাবাদী দৃষ্টিভংগী নিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি হতাশাজনক। সিসির নির্বাচনের ফল প্রায় নিশ্চিত এবং তার জাতীয়তাবাদী গলাবাজি আরো নিবিড় হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো এই যে, এই ফিল্ড মার্শাল তার পূর্বসূরীদের মত নয়।

যে নেতা তার জনগণকে একদিন বলেন যে, মনের ভাব প্রকাশে সরব হইও না এবং এরপর তাদের কর্তৃত্ব নিয়ে নেন, তিনি একজন হাতুড়ে ডাক্তার ছাড়া অন্য কিছু নয়।  

আশার কথা হলো- মোবারকের পতনের সময় মিশরীয় জনগণ তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, মুরসি শাসনেও আমরা সেকথা ভুলে যাইনি এবং সিসির শাসনেও আমরা তা মনে রাখব। মিশরীয়রা যেরকম বীর বা খাদেম চায় সিসি তেমন কোনো ব্যক্তি নয় এবং মিশরের ধ্বংসও তিনি ঠেকাতে পারবেন না।

রাশেদ হামুদা মিশরীয় বংশোদ্ভূত একজন মার্কিন গবেষক। The fascist tendencies of a proud nation শিরোনামে ডেইলি নিউজ ইজিপ্ট পত্রিকায় প্রকাশিত তার নিবন্ধটির ভাষান্তর করেছেন ইলিয়াস হোসেন

– পূর্ব প্রকাশিত আরটিএনএন

 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *