মোদির সংগ্রাম থেকে নেওয়ার মতো বার্তা

১৫ জুলাই ২০০৫ জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে একটি ‘সংস্কার প্রস্তাব (!)’ উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ জাতীয় সংসদে মোটামুটি একই ধরনের মর্ম ও কথায় সজ্জিত ‘সংস্কার প্রস্তাব (!)’ উপস্থাপন করা হয়েছিল। ওই সংস্কার প্রস্তাবকে আওয়ামী লীগ কর্তৃক আন্দোলনে রূপান্তর করা হয়েছিল। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর আওয়ামী লীগ কর্তৃক উপস্থাপিত ওই তথাকথিত ‘সংস্কার আন্দোলনের’ ফসল হয়েছিল তিনটি। প্রথমত, সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান সংবিধান মোতাবেক হকদার হওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে না পারা বা হতে না দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বিচারপতি এম এ আজিজ, যিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেই দায়িত্ব পালন থেকে সাময়িকভাবে বিরত থাকা, ছুটির ছদ্মাবরণে। তৃতীয়ত, জানুয়ারি ২০০৭-এর তৃতীয় সপ্তাহে অবশ্যম্ভাবীভাবে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদ্য সাবেক বিরোধী দল তথা আওয়ামী লীগ ও তাদের সঙ্গীদের অংশগ্রহণ না করা। এই তিনটি অর্জনের (!) জন্য পুরো জাতি, সর্বপ্রধান রাজনৈতিক দল, জাতীয় অর্থনীতি এবং জাতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে যে মূল্য দিতে হয়েছে বা হয়েছিল, সেটি ভীষণ নেতিবাচকভাবে আনুপাতিক ভারসাম্যহীন। এ জন্য কে দায়ী হবে সে উত্তর এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে পূর্ণাঙ্গভাবে বা এই কলামের শতভাগ পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য যুক্তিসহ দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া উত্তরটি নিরূপণে আমি একা কোনো শক্তি বা উপাত্ত মোটেও নই। দেশের জনগণ মধ্য-মেয়াদের অতীতে (২০০৯) এই রায় প্রদান করেছিল এবং অতি-নিকট অতীতেও (জানুয়ারি ২০১৪) এই রায় প্রদান করেছে। তবে জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত সেই রায় দুটি উচ্চ আদালতের কোনো কোনো বেঞ্চ কর্তৃক প্রদত্ত অনেক রায়ের মতো বিভক্ত রায় ছিল। ২০০৯ সালের রায় এবং ২০১৪ সালের রায় দুটি দুই মেরুর। মোদির সংগ্রাম থেকে নেওয়ার মতো বার্তাওপরের অনুচ্ছেদে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কথা এসেছে, ২০০৭ সালে সাংবিধানিকভাবে প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনটি বাতিলের কথা এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নির্বাচন এবং সেখান থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা নেওয়ার অথবা কোনো ধরনের উপসংহার টানার আছে কি না, সেটা এই কলামের আলোচনায় আসবে। ভারতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রায় সাত সপ্তাহ ধরে। ফলাফল ঘোষিত হয়েছে মে মাসের ১৬ তারিখে। ১৬ মে দুপুর ১২টার আগেই পৃথিবী জেনে গিয়েছিল আগামী দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কে হচ্ছেন। এই কলাম যখন পাঠক পড়বেন, ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আর কারা মন্ত্রী হচ্ছেন, এ রকম একটি ধারণাও পেয়ে যাবেন। নরেন্দ্রনাথ দামোদর দাস মোদি নামক ব্যক্তি প্রথম রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দায়িত্ব পেয়েছিলেন অক্টোবর ২০০১-এ। তাঁর দল তাঁকে গুজরাট প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করেছিল। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন এই মর্মে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি কোনো না কোনো একটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসবেন। একই কথা দিল্লির লোকসভার জন্যও প্রযোজ্য। নরেন্দ্র মোদি যেমন দল কর্তৃক মনোনীত হয়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং পরে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েছেন, তেমনই ড. মনমোহন সিংও প্রথমে কংগ্রেস কর্তৃক মনোনীত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং পরে দিল্লি থেকে বহুদূরের একটি আসন থেকে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ভারত ভীষণ বড় আকৃতির একটি দেশ। আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে তার অনেক দোষ আছে, আবার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তার অনেক গুণও পাওয়া যাবে। এই যে প্রথমে মনোনীত হওয়া এবং পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত হওয়া- এই ধারণাটি যদি আমরা ২০১৩ সালের শেষ ভাগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনুধাবন ও আত্মস্থ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ভিন্ন রকম হতো। শুধু উদাহরণস্বরূপ আলোচনার খাতিরে বলছি। ২০১৩ সালের জুলাই বা আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ এ রকম কোনো একটা সময়ে যদি আওয়ামী লীগ দলীয় অথবা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলীয় ১০ জন বা ১১ জন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তে সংসদ থেকে পদত্যাগ করতেন, তাহলে ১০টি বা ১১টি সংসদীয় আসন শূন্য হতো। ওই শূন্য আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলে ১০ জন বা ১১ জন পছন্দনীয় ব্যক্তিকে নির্বাচনের জন্য মনোনীত করলে এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অন্য কেউ সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি না করতেন, তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিরা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসতেন। ওই ১০ জন বা ১১ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতেন। ওই ১০ জন বা ১১ জন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেত। ওই ব্যক্তিরা আসলেই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতেন, কিন্তু সংবিধানের শর্ত পূরণের জন্যই মাত্র নির্বাচিত সংসদ সদস্য হতেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল বড় রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বড় রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুকূলে কোনো রকম শুভ মন্তব্য করতে পারছি না এবং পারবও না। এর কারণ জানুয়ারি ২০১৪-তে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ছিল না। এটা ছিল ভারতের কংগ্রেস সরকারের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে রচিত, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহারের ভিত্তিতে রচিত এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, যেকোনো নিয়মে বাস্তবায়নের নিমিত্তে পরিচালিত একটি নির্বাচন। এত দীর্ঘ ব্যাখ্যা এ জন্য দিলাম যে এপ্রিল-মে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে যে রকম সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, তার পেছনে যে স্বচ্ছ আনন্দ ও ভারতীয় জনগণের আশীর্বাদ আছে, সে রকম কোনো স্বচ্ছ আনন্দ ও বাংলাদেশের জনগণের আশীর্বাদ আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার জন্য জানুয়ারি ২০১৪-তে ছিল না, এখনো নেই এবং প্রযোজ্যও নয়। কংগ্রেস সরকারের উত্তরসূরি, এনডিএ বা বিজেপি সরকার, নিজেরা স্বচ্ছতার আয়নায় উদ্ভাসিত থাকবে এবং ঢাকায় তাদের (তথা বিজেপির নয় কিন্তু দিল্লির) প্রতিবিম্ব-সরকার অস্বচ্ছতার অন্ধকারে আচ্ছাদিত থাকবে, এ রকম কামনা হয়তো জনাব মোদি করবেন না; এটা আমার এবং অনেক লোকের আশা। একটু হালকা মেজাজে এ রকম বলা যায় যে নিজেরা স্বচ্ছ ভেজালহীন দুধ খাবেন এবং ঢাকার প্রতিবিম্বকে দুধের নামে ঘোল খাওয়াবেন, সেটা মোদি কামনা নাও করতে পারেন।

২০০২-০৩ সালের কথা। মোদির মুখ্যমন্ত্রিত্বের বয়স যখন মাত্র চার কিংবা পাঁচ মাস, তখন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মার্চ ২০০৩-তে গুজরাট রক্তাক্ত ছিল। ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনায় সেখানে হিন্দু-মুসলিম রায়ট হয়েছিল। আরো প্রত্যক্ষভাবে বললে, মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছিল হিন্দুদের দ্বারা। তখন অন্তত ৭৯০ জন মুসলমান ও ২৫৪ জন হিন্দু নিহত হয়েছিল আর ২২৩ জন নিখোঁজ হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০০৫ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের জন্য ভিসা দিতে অস্বীকার করে। অর্থাৎ একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্র ঢুকতেই অনুমতি দেয়নি। কেন্দ্রীয় ভারত সরকার এই ঘটনায় নামকাওয়াস্তে আপত্তি জানিয়েছিল। সেই অক্টোবর ২০০১-এ মোদি যে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, এর পরে তিনি আরো দুইবার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। শেষবার ডিসেম্বর ২০১২-তে গুজরাট রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে। এখন ২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় তথা লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। মোদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের জন্য এরই মধ্যে মার্কিন সরকার দাওয়াত দিয়েছে। এই গল্পটি বললাম অন্য একটি ঘটনা বলার জন্য। ২০১৩ সালের শেষাংশে ভারতে বিজেপির সম্মেলন ছিল। ওই সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য মেহমান হিসেবে বিএনপির প্রতিনিধিকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি ঢাকা থেকে প্রতিনিধি মনোনীত না করে লন্ডন থেকে করে। বিএনপি কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেন এবং যথাসময়ে হাইকমিশনের নির্দেশ অরুযায়ী ভিসা-সংবলিত পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। বিএনপি প্রতিনিধি তথা পাসপোর্টধারীর কাছে ভিসা-সংবলিত পাসপোর্টটি হস্তান্তরের ঠিক পূর্বমুহূর্তে হাইকমিশন তাদের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিল। তারা ভিসা বাতিল করে দেয়। বাতিল করে দেওয়া ভিসা ও পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বিএনপি প্রতিনিধি ফেরত যান। বিএনপি প্রতিনিধি লন্ডন মহানগরে বিজেপি অফিসে বিষয়টি জানান। লন্ডন বিজেপি অফিস বিষয়টি ভারতে জানায় এবং বিষয়টি নরেন্দ্র মোদির গোচরে আনা হয়। তিনি হাইকমিশনের আচরণে মর্মাহত হয়েছিলেন এবং বিএনপি প্রতিনিধির যেতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই যে নরেন্দ্র মোদি সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিএনপি ধৈর্য ধরেছে। তখন অনেকেই গবেষণা করেছিলেন, কী কারণে লন্ডনের ভারতীয় হাইকমিশন বিএনপির ভিসা আবেদনকারীর প্রতি এ রকম অপ্রিয় কঠোর আচরণ করেছিল। গবেষণা শেষে কেউ অকাট্য প্রমাণ দিতে পারেননি যে আওয়ামী লীগ এই কাজটি করিয়েছে, কিন্তু সবাই মনে করেছেন যে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ এই কাজটি করাবে না।

মোদির জন্ম ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫০, ভারতের গুজরাট রাজ্যের বর্তমান রাজধানী গান্ধীনগরে অবস্থিত মুখ্যমন্ত্রীর আবাসিক বাংলো থেকে, প্রত্যক্ষভাবে দিকনির্দেশক কম্পাস ধরলে সোজা উত্তরে ১১০ কিলোমিটার দূরে ‘ভাদানগর’ নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে। মোদির জন্মের দেড়-দুই বছর পর, ভারতের জন্য নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে মোট ৪৮৯টি লোকসভা আসনের মধ্যে ওই আমলের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামক দলটি ৩৬৪টি আসন পেয়েছিল। মনে রাখতে হবে যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বা ইংরেজি ভাষায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দলটিই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা ছিল। ওই রাজনৈতিক দল তথা কংগ্রেস আরো দুইবার এ ধরনের বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ সালের মে মাস- ভারতের বয়স ৬৬ বছর ৯ মাস। স্বাধীনতা আনয়নকারী রাজনৈতিক দলটি লোকসভা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনয়নকারী দল মুসলিম লীগ (১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮) ১১ বছরের মাথায়ই প্রায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনয়নকারী দল তিন বছরের মাথায় (জানুয়ারি ১৯৭৫) নিজেকে নিজে ‘বাকশাল’-এর গহ্বরে বিলুপ্ত করেছিল। অন্যরা পরবর্তী বছরগুলোতে সেই বিলুপ্তির ওপর প্রলেপ দিয়েছিল। বিলুপ্তির চার বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনয়নকারী রাজনৈতিক দল তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার জীবিত হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের রাজনৈতিক সৌজন্যে। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে সব ধরনের ছল, বল ও কৌশল খাটিয়েই আওয়ামী লীগকে নিজের অস্তিত্ব বহাল রাখতে হয়েছে। ভারতে কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দলটিকে রাজনৈতিক ধাক্কা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি নামক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির আদলের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা কে হবেন, যিনি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক ধাক্কা দেবেন, সেটা এই মুহূর্তে নিশ্চিত নয়। নরেন্দ্রনাথ দামোদর দাস মোদি এক দিনে দিল্লির রাজনৈতিক আসনে পৌঁছেননি। দীর্ঘদিন পরিশ্রম করতে হয়েছে, একনিষ্ঠতার সঙ্গে এবং লক্ষ্যবস্তু থেকে বিচ্যুত না হয়ে। নরেন্দ্রনাথ মোদির বিশ্বাসের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি, বক্তব্যের অংশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি, বাংলাদেশের প্রতি তাঁর মনোভাব কেমন হবে সে প্রসঙ্গে আমি উদ্বেগ পোষণ করি, কিন্তু ভারত নামক মাতৃভূমির প্রতি নরেন্দ্র মোদির দেশপ্রেমকে আমি সম্মান প্রদর্শন করি, তাঁর সংগ্রামী জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি। নরেন্দ্র মোদি, ভারতীয় ভাষায়, ‘ঘাঞ্চি’ বা ‘ঘাঁচি’ সম্প্রদায়ের ব্যক্তি। ঘাঁচিরা ভারতীয় ধর্মীয়-সমাজ ব্যবস্থায় নিম্ন সম্প্রদায়ের বা ভারতীয় সংবিধানের ভাষায় ‘অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত’। ঘাঁচিদের সামাজিক পেশা সবজি থেকে তেল (ভেজিটেবল ওয়েল) উৎপাদন করা। যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন কুড়াল দিয়ে কাঠ কাটতেন এবং ভাঙাচোরা কাঠের দেয়ালের বাড়িতে থাকতেন। তাই বলা হয়, ফ্রম লগ-কেবিন টু হোয়াইট হাউস। মানে হলো, ভাঙাচোরা তক্তার কুঁড়েঘর থেকে ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস পর্যন্ত অভিযাত্রা। মোদির পরিবার তেল উৎপাদন করত, আমাদের দেশের সামাজিক ভাষায় তারা ছিল ‘কলু’। নরেন্দ্র মোদি নিজে তাঁদের গ্রামের ভাদানগর রেলস্টেশনে, তাঁদের পারিবারিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চায়ের দোকানে গ্রাহকদের চা খাওয়াতেন। মোদির জন্য অভিযাত্রা হচ্ছে চায়ের দোকান থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসা।

নরেন্দ্র মোদি স্বামী বিবেকানন্দের দারুণ ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন। গুজরাটের রাজকোটে অবস্থিত আশ্রমে জনৈক স্বামী আটমাস্থানন্দজি মহারাজ এসেছিলেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৯ সালে এখানেই স্বামী আটমাস্থানন্দজি মহারাজ মোদিকে চূড়ান্তভাবে জানিয়েছিলেন যে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমের জীবন মোদির জন্য নয়। মোদির জীবন অন্যত্র। সেই অন্যত্র মানে হচ্ছে ২০১৪ সালের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। মোদির জীবনের আদর্শ তাঁর দুটি কথা থেকে বোঝা যায়। সে কথাগুলোর শব্দের মাঝে মাঝে তথা লাইনের ফাঁকে ফাঁকে (ইংরেজি ভাষায় ইন বিটুইন দ্য লাইনস) কী মর্ম বা অর্থ আছে, সেটি বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকদের অনুধাবনের জন্য বিনীত আবেদন করছি। এই উক্তির কথাগুলো দিয়ে কলাম শেষ করছি। উক্তিটি, ২০১৩ সালে নয়াদিল্লির ‘ট্রানকোয়েবার প্রেস’ কর্তৃক প্রকাশিত জনৈক নিলঞ্জন মুখোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত ‘নরেন্দ্র মোদি : দ্য ম্যান, দ্য টাইমস’ নামক বইয়ের ১১২ পৃষ্ঠায় আছে। একই কথা জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক ও লেখক-সাংবাদিক এন ডি মারিনো কর্তৃক লিখিত বই ‘নরেন্দ্র মোদি : এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’র (যেটা ভারতে হারপার কলিন্স পাবলিশারস ইন্ডিয়া কর্তৃক ২০০৪ সালেই প্রকাশিত) ৩৭ পৃষ্ঠায়ও উল্লেখ আছে। স্মৃতিচারণামূলক ভাষায় নরেন্দ্র মোদির কথাটি নিম্নরূপ :

“If I was the person that cleans the car, I made sure to clean the car, I made sure to clean the car very nicely, so that even my boss thought : ‘This is a good boy, teach him to drive, he will be useful for our driving.’ Then I become a driver. So basically, whichever assignment is given to me, at that point of time, I am totally involved in it. I never think about my past, I never think about my future.”

ভাবানুবাদ : “মনে করুন, আমাকে একটা কার পরিষ্কার করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে, আমি এমনভাবে গাড়িটি পরিষ্কার করতাম, যেন আমার বস বা ওপরওয়ালা কাজ দেখে অনেক খুশি হন এবং আমার ওপর তাঁর আস্থা বৃদ্ধি পায়। আস্থা যেন এতটুকু বৃদ্ধি পায় যে তিনি খুশি হয়ে বলেন, ‘মোদি ছেলেটা ভালো, ওকে গাড়ি চালানো শেখালে সে ভালো গাড়ি চালাতে পারবে এবং আমাদের গাড়ি চালনার কাজে খুব উপকার হবে।’ অতঃপর স্বাভাবিকভাবেই আমি একজন ড্রাইভার হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে আমার ওপর প্রদত্ত দায়িত্বের সম্পর্ক হলো এ রকম- যেকোনো একটা সময়ে যখন আমাকে একটা কাজ দেওয়া হয়, আমি তখন ওই কাজটির মধ্যে ডুবে যাই, পুরোপুরিভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাই। তখন আমি আমার অতীত নিয়ে চিন্তা করি না, আমার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করি না।”

 পূর্ব প্রকাশিত: কালের কন্ঠ

Loading

Comments are closed.