বাংলাদেশি পত্রিকায় শেখ মুজিবের অমর কীর্তি (৭২-৭৫)

অপরাধী তার অপরাধ কর্মগুলো লুকানোর যত চেষ্টাই করুক না কেন, সম্পূর্ণ লুকাতে পারে না। সাক্ষী রেখে যায়। শেখ মুজিবও তার সহচরগণও অসংখ্য সাক্ষী রেখে গেছে। আর সেগুলি হল, সে সময়ের দেশী ও বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মুজিব আমলের বিবরণ। আগামী দিনের ইতিহাস রচনায় এ বিবরণগুলোই গণ্য হবে গুরুত্বপূর্ণ দলীল রূপে। শেখ মুজিব ও তার দল বাংলাদেশকে যে কতটা বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছিল সে পরিচয় পাওয়া যাবে সে আমলের ঢাকার পত্রিকাগুলো পড়লে। নিজ ঘরে নিরাপত্তা না পেয়ে বহু মানুষ তখন বনেজঙ্গলে লুকিয়েছে। ১৯৭৩ সালের ১৭ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল,“নিরাপত্তার আকুতি গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘর”। মূল খবরটি ছিল এরূপ: “সমগ্র দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির ফলে এবং মানুষের জান-মাল ও ইজ্জতের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে গ্রাম-গঞ্জ ও শহরবাসীর মনে হতাশার মাত্রা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে এবং আইন রক্ষাকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা লোপ পাইতেছে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে,চুরি-ডাকাতি, লুঠ-তরাজ তো আছেই, রাজনৈতিক, সামাজিক ও বৈষয়িক কারণে শত্রুতামূলক হত্যাকাণ্ডের ভয়ে মানুষ বাড়ীঘর ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লইতেছে। যাহারা বিত্তশালী তাহারা শহরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে এমনকি শহরের আবাসিক হোটেলগুলিতে পর্যন্ত আসিয়া উঠিতেছেন। যাঁহাদের শহরে বাস করিবার সঙ্গতি নাই,তাহার বনে-জঙ্গলে অথবা এখানে-ওখানে রাত্রি কাটাইতেছেন”।

১৯৭৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের কিছু খবরের শিরোনাম ছিল: “ঝিনাইদহে এক সপ্তাহে আটটি গুপ্তহত্যা”(০১/০৭/৭৩); “ঢাকা-আরিচা সড়ক: সূর্য ডুবিলেই ডাকাতের ভয়” (০২/০৭/৭৩) “বরিশালে থানা অস্ত্রশালা লুট: ৪ ব্যক্তি নিহত” (৪/০৭/৭৩); “পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্ত: সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র লুট” (১২/০৭/৭৩); “লৌহজং থানা ও ব্যাঙ্ক লুট”(২৮/০৭/৭৩); “দুর্বৃত্তের ফ্রি স্টাইল” (০১/০৮/৭৩); “পুলিশ ফাঁড়ি ও বাজার লুট: লঞ্চ ও ট্রেনে ডাকাতি”(৩/০৮/৭৩); “এবার পাইকারীহারে ছিনতাই: সন্ধ্যা হইলেই শ্মশান”(১১/০৮/৭৩);“চট্টগ্রামে ব্যাংক ডাকাতি,লালদীঘিতে গ্রেনেড চার্জে ১৮ জন আহত, পাথরঘাটায় রেঞ্জার অফিসের অস্ত্র লুট” (১৫/০৮/৭৩); “খুন ডাকাতি রাহাজানি: নোয়াখালীর নিত্যকার ঘটনা,জনমনে ভীতি” (১৬/০৮/৭৩); “২০ মাসে জামালপুরে ১৬১৮টি ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড” (১৭/১১/৭৩); “আরও একটি পুলিশক্যাম্প লুট: সুবেদারসহ ৩ জন পুলিশ অপহৃত” (১৩/০৭/৭৩);“যশোরে বাজার লুট: দুর্বৃত্তের গুলীতে ২০ জন আহত” (১৮/০৪/৭৪); “রাজশাহীতে ব্যাংক লুট” (২১/৪/৭৪) মুজিব আমলের পত্রিকাগুলো পড়লে চোখে পড়বে এরূপ হাজার হাজার ঘটনা ও বহু হাজার বিয়োগান্ত খবর। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে দুর্বৃত্তির যত না ঘটনা ঘটেছে মুজিবের ৪ বছরে তার চেয়ে বহু গুণ বেশী ঘটেছে। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে “ভিক্ষার ঝুলি”-এ খেতাব জুটেনি, কিন্তু মুজিব সেটি অর্জন করেছে। অথচ কিছু কাল আগেও গ্রামবাংলার অধিকাংশ মানুষের গৃহে কাঠের দরজা-জানালা ছিল না। ঘরের দরজায় চট বা চাটাই টানিয়ে অধিকাংশ মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে রাত কাটাতো। কিন্তু মুজিব শুধু খাদ্যই নয়,সে নিরাপত্তাটুকুও কেড়ে নেয়। নিরাপত্তার খোঁজে তাদেরকে ঘর ছেড়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় খুঁজতে হয়। থানা পুলিশ কি নিরাপত্তা দিবে? তারা নিজেরাই সেদিন ভুগেছিল চরম নিরাপত্তাহীনতায়। দুর্বৃত্তদের হাতে তখন বহু থানা লুট হয়েছিল। বহু পুলিশ অপহৃত এবং নিহতও হয়েছিল। মুজিবের নিজের দলীয় কর্মীদের সাথে তার নিজের পুত্রও নেমেছিল দুর্বৃত্তিতে। সে সময় দৈনিক পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল: “স্পেশাল পুলিশের সাথে গুলী বিনিময়: প্রধানমন্ত্রীর তনয়সহ ৫ জন আহত”। মূল খবরটির ছাপা হয়েছিল এভাবে: “গত শনিবার রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকার কমলাপুর স্পেশাল পুলিশের সাথে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রধানমন্ত্রী তনয় শেখ কামাল,তার ৫ জন সাঙ্গপাঙ্গ ও একজন পুলিশ সার্জেন্ট গুলিবিদ্ধ হয়েছে। শেখ কামাল ও তার সঙ্গীদেরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নয়,দশ ও তেত্রিশ-নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে। আহত পুলিশ সার্জেন্ট জনাব শামীম কিবরিয়াকে ভর্তি করা হয় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে।” -(গণকন্ঠ ১৯/১২/৭৩)।

ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ প্রকাশ্য মানুষ খুন করত -সে বিবরণ বহু পত্রিকায় বহু ভাবে এসেছে। যাদেরকে আওয়ামী লীগ বাঙালীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে তুলে ধরছে এ ছিল তাদের আসল চরিত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর এসেছে তিনবার। এর মধ্যে দুই বার এসেছে ব্রিটিশ আমলে। এবং তা ১৭৬১ সালে এবং ১৯৪৩ সালে। তৃতীয়বার এসেছে মুজিব আমলে। পাকিস্তানী আমলে একবারও আসেনি। অথচ এ পাকিস্তান আমলটিকেই আওয়ামী-বাকশালী বুদ্ধিজীবী ও নেতা-কর্মীগণ চিত্রিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপনিবেশিক শোষণের আমল রূপে। অথচ ১৯৪৭-এ পাকিস্তান আমলের শুরুটি হয়েছিল অনেকটা শূন্য থেকে। তখন অফিস আদালত ছিল না,কলকারখানা ছিল না। সহযোগী প্রতিবেশীও ছিল না। বরং ছিল ভারত থেকে তাড়া খাওয়া লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের ভিড়। মুজিবামলের ন্যায় সেসময় বিদেশ বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকার সাহায্যও আসেনি। কিন্তু সে দিন কোন দুর্ভিক্ষ আসেনি।অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশী সাহায্য সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ এসেছিল মুজিবামলে। দুর্ভিক্ষ এসেছিল শেখ মুজিবের দুর্নীতি পরায়ণ প্রশাসন এবং দলীয় ও ভারতীয় লুটপাটের কারণে। সে সময়ে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবরের দিকে নজর দেওয়া যাক। বাংলাদেশের ৭০ জন বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে দেশের পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন: বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যাভাব ও অর্থনৈতিক সঙ্কট অতীতের সর্বাপেক্ষা জরুরী সঙ্কটকেও দ্রুতগতিতে ছাড়াইয়া যাইতেছে এবং ১৯৪৩ সনের সর্বগ্রাসী মন্বন্তর পর্যায়ে পৌঁছাইয়া গিয়াছে।তাঁহারা সরকারের লঙ্গরখানার পরিবেশকে নির্যাতন কেন্দ্রের পরিবেশের শামিল বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেন: “দুর্ভিক্ষ মানুষ দ্বারা সৃষ্ট এবং একটি বিশেষ শ্রেণীর অবাধ লুণ্ঠন ও সম্পদ-পাচারের পরিণতি”। তাঁরা বলেন: “খাদ্য ঘাটতি কখনও দুর্ভিক্ষের মূল কারণ হইতে পারে না। সামান্যতম খাদ্য ঘাটতির ক্ষেত্রেও শুধু বণ্টন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা যায়। যদি দেশের উৎপাদন ও বণ্টন-ব্যবস্থা নিম্নতম ন্যায়নীতি উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিত,দেশের প্রশাসন,ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিচারকে নিশ্চিত করার সামান্যতম আন্তরিক চেষ্টাও থাকিত তাহা হইলে যুদ্ধের তিন বছর পর এবং দুই হাজার কোটি টাকারও বেশী বৈদেশিক সাহায্যের পর ১৯৭৪ সনের শেষার্ধে আজ বাংলাদেশে অন্তত: অনাহারে মৃত্যুর পরিস্থিতি সৃষ্টি হইত না।” (ইত্তেফাক,অক্টোবর ১,১৯৭৪) সে সময়ের পত্রিকার কিছু শিরোনাম ছিল: “চালের অভাব: পেটের জ্বালায় ছেলেমেয়ে বিক্রি”-(গণকন্ঠ আগস্ট ২৩,১৯৭২) “লাইসেন্স-পারমিটের জমজমাট ব্যবসা; যাঁতাকলে পড়ে মানুষ খাবি খাচ্ছে; সিরাজগঞ্জ, ফেণী, ভৈরব, ঈশ্বরগঞ্জ ও নাচোলে তীব্র খাদ্যাভাব,অনাহারী মানুষের আহাজারী: শুধু একটি কথা, খাবার দাও”- (গণকন্ঠ আগস্ট ২৯,১৯৭২) “গরীব মানুষ খাদ্য পায় না: টাউটরা মজা লুটছে; গুণবতীতে চাল আটা নিয়ে হরিলুটের কারবার”-(গণকন্ঠ সেপ্টেম্বর ১৯,১৯৭২) “একদিকে মানুষ অনাহারে দিন যাপন করিতেছে: অপরদিকে সরকারি গুদামের গম কালোবাজারে বিক্রয় হইতেছে”-(ইত্তেফাক এপ্রিল ৭,১৯৭৩); “এখানে ওখানে ডোবায় পুকুরে লাশ।”(সোনার বাংলা এপ্রিল ১৫,১৯৭৩); “চালের অভাব: পেটের জ্বালায় ছেলেমেয়ে বিক্রি; হবিগঞ্জে হাহাকার: অনাহারে এ পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ মে ৩,১৯৭৩); “কোন এলাকায় মানুষ আটা গুলিয়া ও শাক-পাতা সিদ্ধ করিয়া জঠর জ্বালা নিবারণ করিতেছে”-(ইত্তেফাক মে ৩,১৯৭৩); “অনাহারে দশজনের মৃত্যু: বিভিন্নস্থানে আর্ত মানবতার হাহাকার; শুধু একটি ধ্বনি: ভাত দাও”-(গণকন্ঠ মে ১০,১৯৭৩); “লতাপাতা, গাছের শিকড়, বাঁশ ও বেতের কচি ডগা, শামুক, ব্যাঙের ছাতা, কচু-ঘেচু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যে পরিণত: গ্রামাঞ্চলে লেংটা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি”-(ইত্তেফাক মে ১০,১৯৭৩); “পটুয়াখালীর চিঠি: অনাহারে একজনের মৃত্যু;সংসার চালাতে না পেরে আত্মহত্যা”-(গণকন্ঠ মে ১০, ১৯৭৩); “ওরা খাদ্যাভাবে জর্জরিত: বস্ত্রাভাবে বাহির হইতে পারে না”-(ইত্তেফাক মে ৩০,১৯৭৩) “আত্মহত্যা ও ইজ্জত বিক্রির করুণ কাহিনী”-(গণকন্ঠ জুন ১,১৯৭৩) “স্বাধীন বাংলার আরেক রূপ: জামাই বেড়াতে এলে অর্ধ-উলঙ্গ শাশুড়ি দরজা বন্ধ করে দেয়”- (সোনার বাংলা জুলাই ১৫,১৯৭৩) “গ্রামবাংলায় হাহাকার, কচু-ঘেচুই বর্তমানে প্রধান খাদ্য”-(ইত্তেফাক এপ্রিল,১৯৭৪); “দুঃখিনী বাংলাকে বাঁচাও”-(ইত্তেফাক আগস্ট ৪,১৯৭৪); “জামালপুরে অনাহারে ১৫০ জনের মৃত্যুর খবর”-(ইত্তেফাক আগস্ট ১৩,১৯৭৪) “১০দিনে জামালপুর ও ঈশ্বরদীতে অনাহার ও অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে ৭১ জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ আগস্ট ২৭, ১৯৭৪)

১৯৭২ সনের ২১ অক্টোবর তারিখে দৈনিক গণকন্ঠে একটি খবর ছিল: “পেটের দায়ে কন্যা বিক্রি”। ভিতরে সংবাদটি ছিল এরকম: “কিছুদিন পূর্বে কুড়িগ্রাম পৌরসভার সন্নিকটস্থ মণ্ডলের হাট-নিবাসী রোস্তম উল্লাহর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন তার আদরের দুলালী ফাতেমা খাতুনকে (৭ বছর) পৌরসভার জনৈক পিয়ন জমির উদ্দীনের কাছে মাত্র ছয় টাকায় বিক্রি করে দেয়”।১৯৭৩ সালে ৮ই জুলাই সোনার বাংলা “ফেন চুরি” শিরোনামায় এ খবরটি ছাপে: “বাঁচার তাগিদে এক মালসা ফেন। দু’দিন না খেয়ে থাকার পর এক বাড়ীর রান্না ঘর থেকে ফেন চুরি করলো সে। চুরি করে ধরা পড়লো। শুকনো মুখো হাড্ডিসার ছেলেটির গালে ঠাশ ঠাশ পড়লো সজোরে থাপ্পড়। চোখে অন্ধকার দেখল সে এবং মাথা ঘুরে পড়ে গেল। গ্রামের নাম দরগাপুর,থানা আশাশুনি,জেলা খুলনা। গাজী বাড়ির বাচ্চা। বয়স সাত-আট বছর। গুটি বসন্তে পিতা মারা গেছে। মা কাজ করে যা পায় তাতে কোলের ভাই-বোন দুটোর হলেও বাকী দুই বোন আর বাচ্চার হয় না। বাচ্চা তাই প্রতিদিন একটা ভাড়া নিয়ে বের হয়। দ্বারে দ্বারে ফেন মাগে, এই ভাবেই তিন ভাই বোন চলে”। ১৯৭৪ সনের ২৩শে মার্চ ইত্তেফাক খবর ছাপে,“মরা গরুর গোশত খাইয়া ভোলা মহকুমার বোরহানু্‌দ্দিন থানার ১০ ব্যক্তি মারা গিয়াছে এবং ৬০ জন অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে, -এই খবরে বিস্মিত হইবার না ইহাতে বিশ্বাস স্থাপন না করিবার কিছু নাই। স্বয়ং সরকারদলীয় স্থানীয় এম. পি.সাংবাদিকদের এই খবর দিয়াছেন। জান বাঁচানোর জন্য মানুষ মরা গরু খাইতে আরম্ভ করিয়াছে,তবু বাঁচিতে পারিতেছে না, বরং মরা গরুর গোশত খাইয়া আরও আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িতেছে। এ খবর বড় মর্মান্তিক, বড় সাংঘাতিক”। ১৯৭৪ সালের ৪ আগস্ট সোনার বাংলায় ছাপা হয়, “ঢোল পিটিয়ে মানুষ বিক্রি: মানবশিশু আজ নিত্য দিনের কেনা-বেচার পণ্য”। মূল খবরটা ছিল এরূপ: “হাটের নাম মাদারীগঞ্জ। মহকুমার নাম গাইবান্ধা। সেই মাদারীগঞ্জ হাটে ঘটেছে একটা ঘটনা। একদিন নয়, দু’দিন। ১০ই এবং ১৩ই জুলাই। ১০ই জুলাই এক হাটে এক ব্যক্তি মাত্র একশ টাকার বিনিময়ে তার ৬/৭ বছরের শিশু পুত্রকে বিক্রি করে। দ্বিতীয় দিনে ১৩ জুলাই একই হাটে ৫-৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৮ টাকায়। প্রথমে বাজারে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয় মেয়ে বিক্রি করার ঘোষণা। ঢোল পিটানোর মেয়ে কিনতে ও দেখতে অনেক লোক জমা হয়। অবশেষে আটাশ টাকা দামে মেয়েটি বিক্রি হয়”।

সে সময়ে প্রকাশিত বহু খবরের মধ্যে এ খবরগুলিও ছাপা হয়: ঈশ্বরদীতে ৬ কোটি টাকার তামার তার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দু’চার জন যারা ধরা পড়েছে, এবং তারা সবাই মুজিব বাহিনীর লোক। তারা পুলিশ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ( পূর্বদেশ: ১১ মে, ১৯৭২) পটুয়াখালী থানার বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির হিড়িক পড়ে গেছে। কোন গ্রাম-বন্দরে দিনের বেলা ডাকাতি হয়। পুলিশকে খবর দিলে শেষ করে দেব বলে ভয় দেখায়। ফলে থানায় খবর কমই এজাহার হয়। ডাকাতদের দু’একজন এলএমজি হাতে থানার গেটে মোতায়েন থাকে যাতে দারগা-পুলিশ ডাকাতদের জারিকৃত কারফিউ লঙ্ঘন করতে না পারে। -(পূর্বদেশ : ৩১ মে ‘১৯৭২) সম্প্রতি পাবনার সুজানগর থানাধীন ছয়টি গ্রামের ১১৮টি বাড়িতে ডাকাতি সংঘটিত হয়। পাবনার পল্লীর লোকগুলো বাড়ি-ঘর ছেড়ে জঙ্গলে রাত কাটায়। (দৈনিক বাংলা : ৩০ আগস্ট ১৯৭২) দিনমজুর ছাবেদ আলীর স্ত্রী মাত্র ৫ টাকা দামে পেটের দায়ে তার সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। (সাপ্তাহিক বিচিত্রা: ২০ জুলাই ‘১৯৭৩) শেষ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলের হেদায়েত উল্লাহকে কাফন ছাড়াই কলাপাতার কাফনে কবরখানায় যেতে হল (বঙ্গবার্তা: ৪ অক্টোবর ১৯৭৩) দেশের ঘরে ঘরে যখন বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার তখন বৈদেশিক মুদ্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের তাস আমদানি করা হয়েছে। (বঙ্গবার্তা: ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭৩) স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই ১৪ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভারতে পাচার হয়ে গেছে। -(জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানের বক্তৃতা: ২৭ জানুয়ারি ‘১৯৭৪) কয়েকদিন আগে জয়পুরহাটের মাংলীপাড়া গ্রামের আব্দুল কাদেরের কবর থেকে কাফন চুরি হয়ে গেছে। -(সাপ্তাহিক অভিমত : ২৭ মে ১৯৭৪) আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের সচিব বলেছেন, ১৯৭৩ সালের জুন থেকে ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ঢাকা শহরে তারা ১৪০০ বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। আর ১৯৭৪ এর জুলাই হতে১৯৭৫ এর জুলাই পর্যন্ত দাফন করেছে ৬২৮১টি বেওয়ারিশ লাশ। -(ইত্তেফাক: ২১ অক্টোবর ১৯৭৫) সারা দেশে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় একজনের আত্মহত্যা। -(হক কথা : ১৯ মে ১৯৭৪) গাইবান্ধায় ওয়াগন ভর্তি ৬শ’ মণ চাল লুট। রংপুরে ভুখা মিছিল।-(আমাদের কথা : ১৯ এপ্রিল ১৯৭৪) ক্ষুধার্ত মানুষের ঢলে ঢাকার রাজপথ নরকতুল্য। -(হলিডে: ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

১৯৭৪ সালে ৮ই সেপ্টেম্বর সোনার বাংলা আরেকটি ভয়ানক খবর ছাপে। খবরের শিরোনাম ছিল:“রেকর্ড সৃষ্টিকারী খবর: “জঠর জ্বালায় বমি ভক্ষণ”। খবরে বলা হয়,একজন অসুস্থ ব্যক্তি গাইবান্ধার রেলওয়ে প্রচুর পরিমাণে বমি করে। বমির মধ্যে ছিল ভাত ও গোশত। দু’জন ক্ষুধার্ত মানুষ জঠর জ্বালা সংবরণ করতে না পেয়ে সেগুলো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলেছে। ১৯৭৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম ছিল: “রাজধানীর পথে পথে জীবিত কংকাল।” উক্ত শিরোনামে ভিতরের বর্ণনা ছিল: “শীর্ণকায় কঙ্কালসার আদম সন্তান। মৃত না জীবিত বুঝিয়া ওঠা দুষ্কর। পড়িয়া আছে রাজধানী ঢাকা নগরীর গলি হইতে রাজপথের এখানে সেখানে। হাড় জিরজিরে বক্ষে হাত রাখিয়াই কেবল অনুভব করা যায় ইহারা জীবিত না মৃত।”১৯৭৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক খবরের শিরোনাম দেয়,“ক্ষুধার্ত মানুষের আর্ত-চীৎকারে ঘুম ভাঙ্গে”।খবরটি ছিল,“নিরন্ন, অভুক্ত,অর্ধভুক্ত,অর্ধনগ্ন ও কঙ্কালসার অসহায় মানুষের আহাজারি ও ক্ষুধার্ত শিশুর আর্ত-চীৎকারে এখন রাজধানীর সমস্যা পীড়িত মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। অতি প্রত্যুষে হইতে গভীর রাত্রি পর্যন্ত দ্বারে দ্বারে করুণ আর্তি: “আম্মা! একখানা রুটি দ্যান। গৃহিণীর কখনো বিরক্ত হন,আবার কখনও আদম সন্তানের এহেন দুর্দশা দেখিয়া অশ্রুসজল হইয়া ওঠেন”। এ এক হৃদয়বিদারক চিত্র!বাংলাদেশের হাজারো বছরের ইতিহাসে বহু শাসক,বহু রাজা-বাদশাহ ক্ষমতায় বসেছে। সুলতানী আমল এসেছে,মোঘল আমল এসেছে,এসেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল। কিন্তু কোন আমলেও কি মানুষকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এতটা নীচে নামতে হয়েছে যা হয়েছে মুজিব আমলে? বাংলা এক কালে সোনার বাংলা রূপে পরিচিত ছিল। দেশটিতে এক সময় প্রচুর প্রাচুর্য ছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলে প্রশ্ন তুলেছেন, “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?”পাকিস্তানী শাসকবর্গ সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে -এ অভিযোগ এনে লাখো লাখো পোস্টার ছেপে ১৯৭০-এর নির্বাচন কালে দেশ জুড়ে বিতর করা হয়েছিল।আর এভাবে পরিকল্পিত ভাবে মানুষকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপানো হয়েছিল। প্রশ্ন হল,পাকিস্তান আমলে অভাবের তাড়নায় কোন মহিলাকে কি মাছধরা ঝাল পড়তে হয়েছে? কাউকে কি ক্ষুধার তাড়নায় বমি খেতে হয়েছে? কাউকে কি নিজ সন্তান বিক্রি করতে হয়েছে? এরূপ কোন ঘটনা পাকিস্তান আমলে হয়নি। সে সময় দেশ শ্মশান ছিল না,বরং সে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে খোদ মুজিবের শাসনামলে।এজন্যই মুজিবের মৃত্যুতে ঢাকায় শোক মিছিল হয়নি।সেদিন কেউ কোন কালো ব্যাজও ধারণ করেনি।বরং তার নিজের দলের লোকেরা পর্যন্ত মুজিবের লাশ সিঁড়ির নীচে ফেলে মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছেন।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *