ইতিহাসের প্রতি অবিচার!

আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম দুর্ভাগ্য হল এখানে ইতিহাস লেখা নিরপেক্ষ হয় না, অনেক সময় দেখা যায় লেখক অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের লেখার মধ্যে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনায় তাদের নিজস্ব মতের ব্যাখ্যা জাহির করেন যার ফলে তাদের মতামত যেমন জাতিগত, জাতীয়তা, শিক্ষা, বিশ্বাস, রাজনৈতিক ওরিয়েন্টেশন, আগ্রহ ও পেশাগত স্বার্থ সিদ্ধি লাভের প্রভাব থাকে তেমনি থাকে অতিরঞ্জিতের ও অসত্যের প্রলেপ। তাছাড়া সরকারি কর্তৃপক্ষ বা অন্যান্য সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠান দ্বারা হতে পারে ইতিহাস বিকৃতি। তাই দেখা যাবে অনেকেই কেইস স্টাডি করতে গিয়ে ‘নিজের লাইফ স্টাইলের বহি:প্রকাশ বা জীবন আদর্শের চিন্তাধারার প্রসঙ্গ টেনে ঘোলা পানিতে মাছ ধরার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন। তখন কাহিনী একটি থাকে বটে কিন্তু সিদ্ধান্ত অন্যটি হতে হয়।

প্রচলিত ইতিহাস বলে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন। স্কুল পাঠ্যপুস্তকেও শিক্ষা দেয়া হয় সে ইতিহাস, আমেরিকায় কলম্বাস দিবস জাতীয় ছুটি পালন হয় কিন্তু আসলেই কি তা সত্য? এখন ইতিহাসবেত্তারাই এ প্রশ্ন করছেন এবং আজ অনেকেই জানতে পারছেন সে ইতিহাস ভুল। তাই খোলা মনে নির্মোহভাবে ইতিহাস বিচার করতে না শিখতে পারলে ইতিহাসের প্রতিই অবিচার হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আলোচনা করা যায় তখন দেখা যাবে যেহেতু ১৯৭১ সনে ইতিহাসের একটি জঘন্য গণহত্যা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা ও তাদের সহযোগী ছিল টাউট বাটপার কিছু কোলাবেটর। কিন্তু দেখা যাবে তখনকার সে কালো অধ্যায়ের বর্ণনায় অনেকে অনেক কিছু হাসিল করার চেষ্টায় থাকেন। আসলে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন সুসভ্য সমাজের লক্ষ্য থাকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে অতীতের তিক্ততা হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, হত্যাযজ্ঞ ও নিষ্ঠুর বর্বরতার পুনরাবৃত্তি পরিহার করে একটি শান্তিপূর্ণ, ক্ষমা ও মহানুভবতার আদর্শের প্রগতিশীল সুখী সমাজ গড়া যায় সে প্রচেষ্টা করা। কিন্তু আজ বাংলাদেশে সে অবস্থার বড়ই অভাব!

একজন মুসলিমের জীবন দর্শনে খোলা মনে নির্মোহভাবে ইতিহাস বিচার না করার কোন বিকল্প নাই। কেননা শয়তান মানুষকে বিপথে ফেলতে সদা ব্যস্ত তাই সতর্ক না হলে ইতিহাস চর্চায় অনেককে বিপথে নিয়ে যেতে পারে এবং আবেগ দিয়ে ভুল সিদ্ধান্তের ফাঁদে ফেলবে। ইসলামী শিক্ষা হল যেমন হাকিম লোকমানের সেই কথা যা তিনি তার পুত্রদেরকে বলেছিলেন, “যদি কোন ব্যক্তি তোমার সামনে এসে কেউ তার এক চোখ উপড়ে ফেলেছে বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তখন তুমি কোন রায় দেয়ার পূর্বে অপর পক্ষের খোজ নিবে। হয়তবা দেখবে সে যার বিরুদ্ধে আভিযোগ করছে সে তার দু চক্ষুই উপড়ে ফেলেছে আর সে যার কথা বলছে সে আদৌই তা করে নাই করেছে সে অপরাধ অন্য কেউ।
কথা হল ১৯৭১ গণহত্যা হয়েছিল, এই বর্ণনা নিয়ে শত শত বই ও লাখ লাখ পাতা লিপিবদ্ধ হয়েছে। একেক বর্ণনা একেক ধরনের অডিয়েন্সকে কেপচার করছে। এই বর্ণনার “উদ্ধৃতি” দিয়ে কাউকে নতুনভাবে convince করানোর কিছু নেই, প্রয়োজনও নেই। তবে যারা এইসব বিষয়ে মোটেই জানেন না, তাদের ব্যাপার ভিন্ন। বিদেশিরা যা লিখেছেন তাদের অনেক প্রাথমিক তথ্য বিদেশি অডিয়েন্সের জন্য, বিভিন্ন বর্ণনা তাদের অবগতির জন্য। সেই বর্ণনাও নতুন কিছু দেখায় না। তারপর এক ধরণের বর্ণনার উল্লেখ করে অন্য ধরণের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কিছু লোকের ইতিহাস চর্চায় সে প্রচেষ্টই পরিলক্ষিত হয়।

তবে ১৯৭১ বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী/বিহারীদের উপর যে গণহত্যা হয়েছিল , সেই মৃতদের সংখ্যার ব্যাপারটিও সরকারী বা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠান দ্বারা কেউই জরিপ করেছেন বলে কোন তথ্য নাই । তাই যারা ইতিহাস লিখেছেন তারা কীভাবে এবং কোন কোন পদ্ধতি অবলম্বনে তা করেছেন, সেই সব তথ্য নাই। বরং বিদেশিরা ‘প্রচলিত’ সংখ্যা এবং ‘বিবরণ’ নিজেদের লেখায় ব্যবহার করেছেন এবং অপরাপর স্থানের হত্যাযজ্ঞের সাথে সেসবের তুলনা করেছেন। বিদেশী লেখক রোমেল বা কেউ মৃতসংখ্যা নির্ণয়ের জন্য কোন জরিপ বাংলাদেশ হয়েছে বলে জানেন না বরং প্রাপ্তব্য সংখ্যা ব্যবহার করেছেন। তাই রোমেলও লিখেছেন, ‘অনেকের মতে প্রাক্কলিত সর্বমোট সংখ্যাটি হবে ৩০,০০,০০০ (আর জে রোমেল, ডেথ বাই গভর্নমেন্ট)।’ অর্থাৎ তিনি এব্যাপারে নিজে কোনো জরিপ করেননি। ‘অনেকের মত’ গ্রহণ করেছেন।
তারপর ইয়াহিয়া, টিক্কা, পীরজাদা, উমর খান, আকবর খান এসব নামও উঠে আসলে দেখা যায় পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীরাই সার্বিক দায়-দায়িত্বে ছিল। অথচ পাকিস্তানীরা ছাড়া পেল কিন্তু কেন? কারা ছেড়ে দিল?
তবে হাঁ আমরা এটাও জোর দিয়ে বলতে চাই কেউ অক্সিলারি-ফোর্স থেকে অপরাধ করে থাকলে, সঠিক বিচারিক ব্যবস্থায় সেই বিচার অবশ্যই হোক। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে তা হল বিরুধী দল নির্মূল এটাই এখন open secret.

 

সেজন্য যারাই সরকারের অন্যায় ও অবিচারের বিপক্ষে কথা বলছেন বা সমালোচনা করছেন তাদেরকে যুদ্ধাপরাধীর সমর্থক বলে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলে! রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে দেশে এক দলীয় স্বৈরাচারী কুশাসন ঠিকিয়ে রাখতেই এ প্রচেষ্টা চলছে। আজ জামাতকে “ভিলেন” বানিয়ে দেশ থেকে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধ চিরতরে বিলুপ্তি করতে কোন আদর্শের মানুষেরা বিরোধী মতামতকে স্তব্ধ করতে চাচ্ছে গায়ের জোরে তা সচেতন মানুষেরা দেখতে পাচ্ছে। আর এসব হচ্ছে আধিপত্যবাদী প্রভুদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন যা এখন মানুষ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। বলেন তো আধুনিক এ বিশ্বে গণতন্ত্রের ছদ্মনামে এত নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসক কোথায় পাবেন? যেখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী , গোয়েন্দা বাহিনী, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে করা হয়েছে চরম দলীয়করণ। তাই আজ গোয়েন্দা বাহিনীর কাজ বিদেশী শত্রুর মোকাবিলা করা নয় বরং ক্ষমতাসীনদের দু:শাসনের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলবে বা সমালোচনা করবে, মিছিল মিটিং করতে চাইবে তাদেরকে হত্যা, গুম, হামলা, মামলা ও বন্ধী করা। তবে শেষ পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। ইতিহাস তার স্বাক্ষী।

আজ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থা সহ বিভিন্ন মহলের অভিযোগ হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বত্র বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েই যাচ্ছে! খবরে দেখলাম বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড.আসাদুজ্জামান রিপন অভিযোগ করেন যে সরকার পরিচালিত যৌথবাহিনী বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের আটক করার কিছুক্ষণ পরেই তাদের লাশ রাস্তায়, ডোবায় ও পুকুরে পাওয়া যায়! দেশের ১৯-দলীয় বিরোধী জোটের নেতৃত্বে থাকা দলটি থেকে যখন এরকম অভিযোগ করা হচ্ছে তা অবশ্যই অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

টাকা দিয়ে একটা সেনাবাহিনী কিনা যায় যেমন হয়েছে মিশরে, কেনা যায় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ যেমন হচ্ছে বাংলাদেশে কিন্তু সত্যিকার দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামী আত্মবিশ্বাসীদেরকে ক্রয় করা যায় না। অর্থ ও ক্ষমতার লোভে যারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে চায় ইতিহাস তাদেরকে ক্ষমা করবে না।

সুভাস বসুর আত্মীয় ও হার্বাট বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএচডি সনদ প্রাপ্ত গবেষক শর্মিলা বসু রচিত “ডেড রেকনিং: ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি (Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War) , বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক গবেষণালব্ধ একটি বইটি, বলা যায় মাস্টার পিস। এ বইটি ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে।

 যুদ্ধকালে মানবিক বিপর্যয়ের দিকটি তিনি উপস্থাপন তুলেছেন।

বইটিতে তিনি দাবি করেছেন যে, পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যে ব্যাপক হত্যাকান্ড ও ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়ে থাকে তা অনেকাংশে অতিরঞ্জিত। বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থেই এই অতিরঞ্জন বলে তিনি দাবি করেছেন। পাকিস্তানীদের মধ্যে যারা ১৯৭১-এর পাকিস্তানীদের চালানো গনহত্যার সমালোচনা করে বই লিখেছেন, তাদের বর্ননাকে বসু ‘সীমাবদ্ধ’ আখ্যা দিয়েছেন। যেসব বিদেশী সংবাদ প্রতিবেদনে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তাদের ব্যপারে বসু বলেছেন, “বিদেশী সংবাদ প্রতিবেদন সবসময় সুষমভাবে নির্ভরযোগ্য নয়”।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে অনেক স্থানে বিহারিদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছিল বলে তিনি লিখেছেন। বিশেষ করে ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ খুলনায় নিউ টাউন কলোনিতে ব্যাপক বিহারি হত্যা করা হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
তবে তার মতে, পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক যে হত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে তাকে জাতিসংঘ প্রদত্ত সংজ্ঞানুসারে ‘গণহত্যা’ বা genocide বলা যাবে না। এ ব্যাপারে তিনি তার যুক্তিগুলো বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে তার প্রধান যুক্তি ছিল যে, পাক সেনারা বেছে বেছে শুধুমাত্র যথাসম্ভব ‘যুদ্ধমান শত্রু’দেরকেই হত্যা করেছিল; শুধুমাত্র বাঙালী হবার কারনে কাউকে হত্যা করা হয়নি। তবে বিহারিদের বিরুদ্ধে যে হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে সেটাকে গণহত্যা বলা যায়; কারন নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, যুদ্ধমান, অযুদ্ধমান নির্বিশেষে জাতিগত কারনেই এদেরকে হত্যা করা হয়েছিল এবং তা সংঘটিত হয়েছিল তার ভাষায় উগ্র জাতীয়তাবাদী বাঙালীদের দ্বারাই। তিনি আরো লিখেছেন, একাত্তুরে পাক বাহিনী কর্তৃক হিন্দু হত্যাগুলোকেও গণহত্যার সংজ্ঞায় ফেলা যায়, কারন এতে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারনেই তাদেরকে ‘যুদ্ধমান শত্রু’ বলে গণ্য করা হয়েছিল।

যুদ্ধের ফলাফল স্বরূপ অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির বিকাশ
বইটিতে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও রাজনৈতিক হানাহানির ফলে যে জাতিগত ও রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো বহাল আছে এবং এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে এখনো প্রবল রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা বিরাজ করছে। বইটির ১৮২ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এক সাগর সহিংসতার স্মৃতি রেখে গেছে; যেখানে দেখা গেছে ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভীতি প্রদর্শন, পাশবিকতা ও ‘নির্মূল করার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা’ করার উদগ্র সংস্কৃতি।

যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা
বইটিতে লেখক যুক্তি ও বিশ্লেষণ প্রদর্শন পূর্বক মতামত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাকুল্যে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারে; এবং এই সংখ্যা বাঙালী, বিহারী ও পাকিস্তানী সব মিলিয়ে। ত্রিশ লাখ বাঙালী নিহত হয়েছেন বলে যে মত বাংলাদেশে প্রচলিত ও প্রচারিত হয়ে আসছে তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করেছেন।
তিনি উল্লেখ করেন, নিহতের সংখ্যার অতিরঞ্জন নিতান্তই ‘অপ্রয়োজনীয়’ এবং তা প্রকৃত নিহতদের প্রতি ‘বিদ্রুপ’ করার শামিল।

বি:দ্র: বইটির বিস্তারিত বিষয়ে রিভিউ পড়তে পারেন বাংলা ইউকপিডিয়াতে সেখান থেকেই আমি কিছু উদ্ধৃতি পাঠকদের খেদমতে উল্লেখ করেছি।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *