ধর্ম: ছুঁৎমার্গ, প্রতীক ও সমাজ -১ম পর্ব

ছুঁৎমার্গ ও প্রতীক

হরিজন বা নীচ জাতের কাউকে স্পর্শ করলে ধর্ম অশুদ্ধ হয় এমন ধারণা হিন্দু ধর্মে আছে, যদিও হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশ এই প্রথাকে দূর করতে সচেষ্ট আছেন এবং তাদের এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। আমার কথা কিন্তু হিন্দু ধর্ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নয়, শুধু ছুঁৎমার্গের একটা ‘অর্থ’ সামনে আনা মাত্র। বাংলায় ছুঁৎমার্গ শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখলেই এমন ধারণা ঠিক হবে না যে এখন হিন্দু ধর্ম আলোচিত হচ্ছে। কোনো শব্দ একটি বিশেষ ধর্মে উৎসারিত হলেও অপরাপর ব্যবহারিক অঙ্গনে সেই শব্দ অন্য অর্থ পরিগ্রহ করতে পারে। ভাষা-শাস্ত্রে এই স্থানটি তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ছুঁৎমার্গ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে একটি অর্থ স্পর্শকাতরও হয়। আবার কোনো কিছুর সামাজিক প্রতিক্রিয়াকে হাল্কা করতেও ব্যবহৃত হতে পারে। উপমার এমন অনেক স্থান রয়েছে।

আমাদের এলাকায় একটি তরু-ঘাস আছে যাকে ‘ছুঁতে-মরা’ বলা হয়। স্পর্শ করলেই তার বিস্তারিত পাতা কুঞ্চিত করে মরার-মতো হয়ে পড়ে। এখান থেকে আমরা কারো ব্যাপারে বলে থাকি ‘ছুঁতে-মরা’। কাউকে প্রতিক্রিয়া না দেখাবার জন্য বলে থাকি ‘ছুঁতে-মরা হয়ো না’। ইসলাম ধর্মে হিন্দু ধারণার সেই ছুঁৎমার্গ না থাকলেও সমাজে অনেক অনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকতে পারে যেগুলো সংঘটিত হলে সমাজে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কোনো সুস্থ প্রতিক্রিয়া কখনো ছুঁৎমার্গ হয় পড়ে না। বরং প্রতিক্রিয়াহীন সমাজ নৈতিকভাবে অসুস্থ হতে পারে।

আমাদের সামাজিক ও নৈতিক জীবনের বাস্তবতায় এখনো কিছু বিষয় এমন রয়েছে যে কোথাও ধর্মীয় ও নৈতিকতার তীব্র স্খলন ঘটলে সেখানে সামাজিক প্রতিক্রিয়া তীব্রভাবে আসে। যে প্রতিক্রিয়া যেখানে দেখানো জরুরি সেখানে যদি সেই প্রতিক্রিয়া দেখানো না হয় তাহলে ভাল-মন্দের পার্থক্য নিশ্চিহ্ন হবে। আমার পাড়ায় বা মহল্লায় যদি একজন লোক বিবাহ-ছাড়াই একটি মেয়ে নিয়ে বসবাস করতে শুরু করে দেয় তবে আমার সমাজ এটাকে ছিঃ ছিঃ করবে। এটা নৈতিকতার স্বাভাবিক ও জীবন্ত রূপ। এটা ঈমানের সর্বনিম্ন দিকও। সমাজ থেকে এই বাস্তবতা তিরোহিত হলে বুঝতে হবে বিশ্বাসের সমাজ আধুনিকতাবাদের নৈতিকতায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। যা অশ্লীল, যা অরুচিকর, যা নিষিদ্ধ যেগুলো ছিঃ ছিঃ পাওয়ার যোগ্য সেগুলো ছিঃ ছিঃ পেতে হবে। মন্দ কাজে ‘জাত’ যাক কী না যাক তাতে কিছুই আসে যায় না, কিন্তু তাতে ধর্ম যায় বটে, মন্দ প্রসারিত হয় এবং দ্বীনি অস্তিত্ব বিলোপ হয়। ইউরোপ আমেরিকার বর্তমান ধর্মীয় ও নৈতিকরূপ এর চাক্ষুষ প্রমাণ। আমাদের চেষ্টা করতে যে যে স্থানটি ছুঁৎমার্গের নয় সেই স্থানটি ছুঁৎমার্গে না-আনতে। আজ আমাদের সমাজ অমনিতেই নানান অবক্ষয়ে ভূগছে। ছুঁৎমার্গ নিয়ে আরও কিছু কথা পরে আসছে।

ইসলামে প্রতীক ও প্রতীকী অর্থ

আমাদের ভাষা প্রতীকী –শব্দ থেকে বাক্য এবং বাক্য থেকে গোটা ভাষার বিস্তৃত পরিধি। ‘শব্দ’ দিয়ে একটি উদাহরণ আনি। ‘বিড়াল’ একটি শব্দ। শব্দটি লোমবিশিষ্ট চতুষ্পদ  একটি প্রাণীর অর্থ বহন করে। আমরা যখন কাগজের উপর ‘বিড়াল’ লিখি তখন ওখানে, ঐ অক্ষরের সমষ্টিতে, (বি-ড়া-ল) যে ‘বিড়াল’ হয়, সেটি বাস্তবের লোমবিশিষ্ট প্রাণী হয় না। ঐ শব্দটি প্রতীকীতে (symbolically) বাস্তবের প্রাণীকে ইঙ্গিত করে। ভাষাতত্ত্ববিদ ফারডিনেন্ড ডি সসিয়র (১৮৫৭-১৯১৩) এই প্রতীকে দুটি উপাদান আবিষ্কার করেন। যদিও তা শুনতে মামুলি কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক ও অর্থ-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটি এক দিগন্ত উন্মোচন করে। এই প্রতীকের এক অংশকে তিনি ‘অর্থ-নির্দেশ প্রতীক’ (signifier) এবং এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দ্বিতীয় অংশকে ‘অর্থ-নির্দেশিত’ (signified) উপাদান বলে উল্লেখ করে উভয়ের মিলিত বস্তুকে সাইন (sign) বা প্রতীক বলেন। কাগজের বিড়ালটি যেমন একটি লিখিত প্রতীক হয় তেমনি অন্য লেভেলে উচ্চারিত ‘বিড়াল’ ধ্বনিও আরেকটি প্রতীক (ফনেটিক সাইন/সিম্বল)। আবার বিড়ালের ‘ছবিও’ আরেকটি প্রতীক (আইকনিক সাইন/প্রতীক)। আমরা কোনো লেভেলের প্রতীকেই লোমবিশিষ্ট চতুষ্পদ জন্তুটি উপস্থিত পাইনা, কেননা সেগুলোতে জন্তুটি নিহিত নয়, বরং ভাষাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে আমরা ‘সম্পৃক্ততা’ (association, অর্থাৎ এক শ্রেণীর প্রতীক চিহ্নসমূহতে সম্পৃক্ত। উদাহরণ, বিড়াল শ্রেণীর এবং গৃহপালিত অপরাপর জন্তু-প্রতীক-চিহ্ন) এবং ‘পৃথকীকরণ’ (differentiation অর্থাৎ যে চিহ্নটি উল্লেখ হবে সেটি অপরাপর কোনো চিহ্ন নয়) এর মাধ্যমে অর্থের সমঝ পাই। আমাদের সমাজ ‘প্রতীক’ ও জন্তুর মধ্যে ‘অমনি অমনি’ (arbitrarily) যে অর্থের সমন্বয় ঘটিয়েছে সেই উপলব্ধিতে যাই এবং এভাবে আমাদের ধ্যান-ধারণায় নানান প্রতীক প্রতীকী অর্থবহ হয়ে ওঠে। ভাষা আপনাতেই একটি প্রতীকী সিস্টেম (a symbolic system), তাই সব সমাজে, সব ধর্মে, সব গ্রন্থে, হোক তা সাধারণ বই অথবা ধর্মগ্রন্থ সবখানেই প্রতীকী অর্থের ছড়াছড়ি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমি এখন যে ধারায় কথা বলছি তা আপাতত বন্ধ করে দিয়ে যদি বলি যে আমাদের কোরানে, আমাদের হাদিসে, আমাদের ধর্মে প্রতীকের ব্যবহার আছে তাহলে বাড়তি কথা বলার দরকার হবে না। আমাদের ধর্মকে, আমাদের অনেক প্রথাকে, অনেক ধারণাকে নিছক একটি দুটি নয় বরং অসংখ্য প্রতীক প্রতিনিধিত্ব (represent, but arbitrarily) করে যায়।

ধরুন আপনি ইউরোপের কোথাও ট্রেনে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করছেন। অনেক চার্চ দেখেছেন। এখন সামনে একটি মসজিদ। তার মিনার, তার গুম্বজ, তার বিশেষ আকৃতি –এই বস্তুটি কোন্‌ ধর্মের ইঙ্গিত বহন করে? নিশ্চয় ইসলামের। এখানে এই স্থাপত্য ইসলামের প্রতীক হয়ে আছে। কাগজে কয়েকটি ধর্মের ইবাদতখানার ছবি (আইকনিক প্রতীক) দেখিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করুন কোন্‌টি ইসলামের প্রতীক। ওখানে মসজিদের ছবি থাকলে ‘ইসলাম’ সহজেই বলা হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতীকও মেটোনিমিক (metonymic) এবং মেটাফোরিক (metaphoric) হতে পারে। মেটোনিমিতে গোটা বস্তুর একটি ক্ষুদ্র অংশ গোটা বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে আর মেটাফর কেবল একটি বস্তু অপর একটি বস্তু অথবা গোটা বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যে কোনো একটি ক্ষুদ্র প্রতীক স্থানভেদে গোটা ধর্ম বা জাতিকে প্রতীকীতে আনতে পারে। এক টুকরো কাগজে কৃষ্ণ, জরাস্ট্রা (জরদস্ত), গুরুনানক, মুহাম্মাদ, ঈসা লিখে কাউকে ধর্ম নির্দেশ করতে বললে তারা সহজেই সেই ধর্মগুলো উল্লেখ করে যাবেন। এখানে লিখিত আকারে নামগুলো প্রতীকীতে গোটা ধর্মকে নির্দেশ করছে। এভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ও শ্রেণীতে বিভিন্ন প্রতীকে মূল বস্তুকে পাওয়া যেতে পারে এবং কোথাও এই প্রতীকী অর্থ পাওয়া গেল বলে শিরকের চিৎকার তোলা যাবে না, কেননা মুসলমানগণ কোনো প্রতীকের পূজা করেন না। এখানে উল্লেখিত মসজিদ, তার গুম্বজ, তার বিশেষ আকৃতি, মুহাম্মদের (সা.) নাম, শারিয়াহ শব্দ এবং সার্বিকভাবে যেকোনো ধরণের প্রতীক, ফনেটিকসহ (যেমন আযান-ধ্বনি), ধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে গেলেও শিরক আসে না। আরেকটি শ্রেণীর কথা আনা যাক। অপরাপর কিছু ধর্ম গ্রন্থের পাশে ‘কোরান’ লিখিত হলেই ‘ইসলাম’ এসে যাবে। চার্চের বেল ও আযানের ধ্বনিতেও পেয়ে যাবেন। কিন্তু এখানে এমন প্রশ্ন তোলা অর্থহীন যে এই প্রতীকগুলো যে ইসলামকে প্রতিনিধিত্ব করছে –এমনটি কী কোরানে হাদিসে আছে?

আজকাল অনেক গ্রুপের মধ্যে একটা ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে যে কোনো কিছু সামনে রেখেই বলবেন –এটা কী কোরানে আছে, হাদিসে আছে যেমনটি আমাদের আহলুল হাদিস ভাইদের মধ্যে একটু বেশি অনুভূত হয়। (আহলুল হাদিসের কেউ এই লেখাটি পড়লে কিছু মনে করবেন না, ঘটনা হয়ত এমনও হতে পারে যে আমি যেসব আহলুল হাদিস ভাইদের সাথে পরিচিত তাদের অভিজ্ঞতাকে জেনরেলাইজ করে ফেলছি)। মনে রাখতে হবে, লাখ লাখ প্রতীকে লাখ লাখ অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে এগুলো কোরান হাদিসে তল্লাস করার বিষয় নয়। মক্কা, মদিনা, জামারাত, মিনা, ঢাকা, সিলেট এইসব শব্দতে মূল বস্তু নিহিত নয়। ‘অর্থ’ প্রতীকীতে, কেননা বাস্তবের বস্তুগুলো সেই শব্দগুলোর মধ্যে নয়। এই বিশ্বে আমাদের প্রাপ্তব্য ও অনাগত শব্দসমূহ কিভাবে অর্থ প্রকাশ করে যাবে এবং কেন করে যাবে এসব কোরানে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

চাঁদ তারা

আমার এক বন্ধু, শাহজালাল ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র বলেন যে তার এক কালের শিক্ষক জাফর ইকবাল চাঁদ তারা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতেন। ইউনিভার্সিটির কেন্দ্রীয় মসজিদের শীর্ষে খচিত চাঁদ তারার প্রতি ইঙ্গিত করে বলতেন, দেখ, নব-চন্দ্রের আকৃতির মধ্যেই তারকা চিহ্ন, বিষয়টি কত অবৈজ্ঞানিক! একজন বিদেশি লোক এই ইউনিভার্সিটি পরিদর্শন করতে এলে, এটা দেখে কী বলবে? নবচন্দ্রের (হেলালের) মধ্যে কী তারকা ধারিত হয়?

কিন্তু একটি প্রতীকী চিহ্ন এবং বাস্তবে এর সম্পর্ক যে কীরূপ হতে পারে এই ব্যাখ্যায় উল্লেখিত ‘বৈজ্ঞানিক মন্তব্যটি’ যে কত ‘মূর্খ’ সেটিই প্রমাণ পায়। বরং বলি মূর্খতা বিস্ময়কর।

গত কয় বছর আগে আমি একটি ব্লগ-সাইটে যখন লেখালেখি করতাম তখন সেখানে জাফর ইকবালের নাম করে কিছু লোক চাঁদ-তারা প্রতীকের সমালোচনা করতে দেখি। পরে অনেক চর্বিত চর্বণও দেখি। এই গ্রুপটির কাছে পাকিস্তানের কোনো ভাল বা ইতিবাচক দিক ছিল খাটি ছুঁৎমার্গের বিষয়। এই পাকিস্তানীরাই নাকি মুসলিম জাতীয়তাবাদের নামে বাঙালীদেরকে দুই দশক শোষণ করেছিল এবং এই শোষক দেশের পতাকায় ছিল চাঁদ তারা খচিত! (মার চালাইয়া!)। চাঁদ তারা -শোষণের প্রতীক!

প্রায় ১০/১২টি সংখ্যাধিক্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশের পতাকায় চাঁদ তারা খচিত। পতাকা শ্রেণীতে, অথবা বাইরেও, কোথাও চাঁদ-তারার প্রতীকীতে ইসলাম নির্দেশিত হলে তা কি শিরক হয়ে যাবে? না, মোটেই না। শিরক অন্য বস্তু।

তুর্কীর পতাকাতেও চাঁদ তারা খচিত! এই চিহ্নটি ওসমান সাম্রাজ্যের পতাকায় সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে চলে আসছে। তখন ইউরোপে নৌশক্তির উত্থান ঘটেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ওসমান সাম্রাজ্যের পতন টানতে ইউরোপে নানান পরিকল্পনা চলছিল। ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো ওসমান সাম্রাজ্যে বসবাসরত খৃষ্ঠীয়ানদের স্বার্থ সমৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন এলাকা নিয়ে নাক গলাত। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই তারা খৃষ্টীয়ান অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকা স্বাধীন করিয়ে নেয়। (যেমন ১৮০৮ সালে সার্বিয়ায়, বর্তমান ইউগোস্লাভিয়ায়, বিপ্লব ঘটায় এবং ১৮৩০ সালে স্বাধীন করিয়ে নেয়)। বিংশ শতাব্দীতে এসে তারা ওসমান সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। যারা এই কাজ করেছিল তারা যে শুধু ইসলামের ভূখণ্ড খণ্ড খণ্ড করতে চেয়েছিল তা নয় বরং ইসলামের সাথে যাকিছু সংশ্লিষ্ট তা হোক ধারণা বা প্রতীক সবগুলোতে আক্রমণ এনেছিল। মুসলমান কোনো জাতি নয়, ইসলামে কোনো ভূখণ্ডের দরকার নেই, ‘আঙুলে-গুণা’ কয়েকটি কাজেই যখন ইসলাম ধর্ম ‘শান্তির সুশীতল ছায়া’ হয়ে পড়ে, তখন ভূখণ্ডের কি প্রয়োজন? তাদের এই ধারণা মুসলমানদের একাংশে সাফল্যজনকভাবে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে এবং তাদের আদর্শে ও জীবন দর্শনে মুসলমানদের এক বিরাট অংশকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে।

সকল জাতির মত মুসলিম জাতিতে শিক্ষা-দীক্ষার বিকাশ ঘটেছে, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে, সাহিত্য রচিত হয়েছে, স্থাপত্য-শিল্প গড়ে ওঠেছে এবং সর্বত্রই আধ্যাত্মিকতার বিকাশ তাদের কর্মকাণ্ড ও ব্যবহারিক বস্তুতে প্রতিফলিত হয়েছে। মুসলমানরা মূর্তি তৈরি করেনি কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টিরাজির নৈপুণ্য ও প্রকৃতির সৌন্দর্য বিভিন্নভাবে ধারণ করেছে, দেখেছে এবং তাদের নিজেদের স্থাপত্য-শিল্পে ও সৃষ্টিতে সেই সৌন্দর্যকে স্থান দিয়েছে, কিন্তু কখনো আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করেনি। মুক্ত ময়দানে দাঁড়িয়ে মহাকাশকে গম্বুজের মত দেখেছে, রাতের তারকা-খচিত দিগন্ত-দৃষ্টে খোদার সৃষ্টি-নৈপুণ্য অন্তরাত্মা বিহ্বল করেছে। অনন্ত মহাকাশের বিরাজিত মহিমাময় দৃশ্যকে তারা ক্ষুদ্র ক্ষণিকায় নিজেদের স্থাপত্যে ও শিল্পে স্থান দিতে চেয়েছে, মহাসিন্ধুকে ক্ষুদ্র বিন্দুতে ধারণের মত। কোনো এক সময়ে ‘গুম্বজ ও চাঁদ তারা’ প্রতীকীতে অনন্য (unique) হয়ে গিয়ে বিশ্ব মানবতায় পরিচিতির ইঙ্গিতবাহী হয়েছে। এমনিভাবে কোনো কোনো মেটোনিমিক প্রতীক (metonymic sign) পরিচিতিতে মেটাফোরিক (metaphoric) হয়ে যেতে পারে এবং হয়েছে।

কোরান হাদিসে প্রতীকী অর্থ

মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেহেতু এমন যে এর সবকিছুতেই প্রতীক ও প্রতীকী ধারণা কাজ করে যাচ্ছে তাই কোরান হাদিসে এই ভাষিক উপাদানটির ব্যবহার বিস্তর আকারে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই বিষয়টি এতই স্বাভাবিক যে তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। ঈমান থেকে শুরু করে ইসলামের শাখা প্রশাখা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। কলিমা তৈয়্যিবাহকে খেজুর গাছের ইঙ্গিতে ‘শাজারাহ তৈয়্যিবাহ’ (شجرة طيبة /পবিত্র গাছ) বলা হয়েছে (১৪:২৪)। এখানে কালিমাহ হচ্ছে ঈমান (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) এবং পবিত্র বৃক্ষ হচ্ছেন ‘মুমিন’ (ইবন আব্বাস রা.)। মুজাহিদ ও ইকরিমা (রা.) বলেছেন খেজুর বৃক্ষকে ঈমানের উপমায় বলা হয়েছে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের উদাহরণ হচ্ছে এক বলিষ্ঠ বৃক্ষ। এতে (এই উপমায়) ঈমান হবে তার জড় বা শিকড়, নামাজ হবে তার কাণ্ড, যাকাত হবে শাখা-প্রশাখা, রোজা হবে ডালপালা, আল্লাহর পথে দুঃখ-কষ্ট তার সবজিজাত গাছ/তরুলতা, উত্তম চরিত্র তার পত্রপল্লব এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকা হবে তার ফল-ফসল।’ কুফরকে শাজারাহ খাবিছাহ (খবিছ বৃক্ষ) বলা হয়েছে (১৪:২৬)। এই বৃক্ষটি ‘হানযালাহ’ যার কোনো উপকার নেই এবং এর জড় মাটির গভীরে নয় এবং এটা কাঁটাযুক্ত এবং দুর্গন্ধময়। কোরবানির উট (২২:৩৬), সাফা মারওয়া (২:১৫৮), মসজিদ ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতীক (شعائر/symbols/নিদর্শন) বলে উল্লেখ এসেছে –এসব ফিরিস্তি অতি দীর্ঘ করা যেতে পারে। এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধান ও কর্মকাণ্ড তা’জীমের সাথে পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তা’জীমের অর্থ হচ্ছে আদব আখলাকের সাথে এবং সম্মানের সাথে সেই নিদর্শনপূর্ণ স্থানে দ্বীনি নির্দেশনা পালন করা, যেমন মসজিদে ঢুকার পর মসজিদের আদব রক্ষা করা এবং সাফা-মারওয়া, কাবা গৃহ ইত্যাদিতেও তা’ই।

পতাকাও একটি প্রতীক। যুদ্ধের সময় মুসলমানদের পতাকা থাকত এবং তাদের একজন সেই পতাকা বহন করতেন। কাফির দলেও পতাকা থাকত এবং তাদের দেবমূর্তিও থাকত। কিন্তু মুসলমানদের পতাকার অর্থ কি হত? মুসলমানদের হাতে যখন পতাকা থাকত, তখন ওঠা কীসের প্রতীক হত? উত্তর হচ্ছে এই পতাকা মুসলিম পক্ষের প্রতিনিধিত্বের ভাব প্রকাশ করত। এখানে পরিচিতির ও প্রতিনিধিত্বের একটা অর্থ নিহিত থাকত। এই পতাকা মানি ‘এই পক্ষ’, মুসলিম পক্ষ। অপরের পতাকা অপরের পক্ষের। বলেছি এসেছি, ইসলামী আর্ট ও স্থাপত্য শিল্পে প্রতীকীর ছড়াছড়ি রয়েছে। ওগুলো নানান প্রতীকী অর্থ, বিশেষ ধারণাকে, প্রতিনিধিত্ব করত এবং এখনো করে। পতাকা যে কেবল যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত হত তা নয়, দুই বা ততোধিক দলের সন্ধিক্ষণেও ব্যবহৃত হত। আমার পঠিত স্মৃতি থেকে বলছি হযরত আলীর (রা.) এবং আরো রেওয়ায়েত আছে যে তাঁরা বলছেন অমুক সন্ধিতে আমি পতাকা ধারণ করেছি। ইসলামে প্রতীকের পূজা নেই, কিন্তু অর্থের ব্যবহার আছে। ইসলামের আলিম-উলামা এসব বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত।

নব-চাঁদের (বা হিলালের/crescent) উল্লেখ কোরানে এসেছে। আল্লাহ বলেন এটা হচ্ছে সময় নির্দেশক/নির্ধারক (২:১৮৯)। মুফাসসিরগণ এর অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। বলেছেন, এতে হজ্জের সময় ও বিধান, রোজার সময় ও বিধান, নারীর ইদ্দত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সন্ধির কাল এবং কৃষিকার্যসহ অনেক বিষয়ের কাল নির্ধারিত ও বিবেচিত হয়। আল্লাহ সূর্যকে বলেছেন উজ্জ্বল আলো (দানকারী) এবং চাঁদকে আলো, ব্যাখ্যায় তা স্নিগ্ধ আলো ((প্রাপ্ত) (১০:৫))। সুফি তফসীরে এর তুলনা রূহ এবং ক্বালবের মত আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ রূহকে নূরানী করে সৃষ্টি করেছেন, সূর্যের মত বা এর তুলনায় এবং ক্বালবকে করেছেন শ্বেত, আলোর গ্রাহক হিসেবে, চাঁদের তুলনায় ((তাফসীর/ইমাম আহমদ বিন ওমর (র.))। আল্লাহ তাঁর নবীকে ‘সিরাজুন মুনির’ (উজ্জ্বল প্রদীপ)আখ্যায়িত করেছেন (৩৩:৪৬)। কোরানে গ্রহ-নক্ষত্রের আলোচনা হেদায়াত বুঝার নিদর্শন হিসেবে বিস্তরভাবে এসেছে। তফসীরেও বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। ইমাম আহমদ বিন ওমর (র.) আলাদাভাবে সুফি ইশারাবাহী একখানা তফসীর প্রণয়ন করেছেন যার নাম হয় ‘গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক ব্যাখ্যার তফসীর’ (التأويلات النجمية في التفسير الإشاري الصوفي)। আল্লাহ আসমান জমিনকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা (তাফাক্কুর) করতে বলেছেন, তিনি তার সৃষ্টিরাজির কথা কোরানে বর্ণনা করেছেন। মুসলিম সমাজে এইসব বিষয় চিন্তা-ভাবনায় এসেছে, আলোচিত হয়েছে, তাদের শিক্ষা সংস্কৃতিতে এবং তাদের স্থাপত্যেও রূপায়িত হয়েছে। চাঁদ তারাতে সমস্যা কী হয়েছে? কেউ কি চাঁদ তারার উপাসনা করে? এটা কী উলটা বলা যাবে না যে এক শ্রেণীর লোকজন মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এলার্জি অনুভব করে থাকেন, যেমন একটি গ্রুপের কথা উল্লেখ করেছি।

প্রতীকের ব্যাপারে আরেকটি কথা। প্রতীক কিন্তু সব সময় ‘একক’ অর্থ (singularity of meaning) বহন করে না। প্রতীকীতে একাধিক অর্থ নিহিত থাকতে পারে, আবার কিছু অনিশ্চয়তাও (uncertainty) থাকতে পারে –এটাই প্রতীকীর প্রকৃতি। ‘বিড়াল’-এর অর্থ স্পষ্ট হলেও স্থানভেদে অন্য ভাব বহন করতে পারে। কোনো বিশেষ ব্যবহারে ‘বিড়াল’ শ্লেষাত্মক হয়ে কোনো ব্যক্তিকেও নির্দেশ করতে পারে, যেমন ‘ছুঁতে-মরা’ এবং ‘ছুঁৎমার্গ’ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রতীকী ব্যবস্থায় ‘অর্থ’ বহু (plural) হতে পারে। বাক্য, প্যারাগ্রাফ, অধ্যায়, গোটা বই, একটি প্রতীক, প্রতীকের সমষ্টি বহুবাচক (plural) অর্থ বহন করতে পারে। এ জন্যই আমাদের কথা, লিখা, আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অনেক অর্থ বার বার ব্যাখ্যা করার অবকাশ আসে। ভাষা, কাল ও আমাদের অবস্থান এবং নিত্য নতুন পরিপ্রেক্ষিত একই ট্যাক্সট নতুন আলোকে অনুধাবন করতে বাধ্য করে কিন্তু পূর্বের অর্থ বিসর্জন (discard) দিয়ে নয়।

কোরানের ও হাদিসের বাণীতেও অনেক বহুবাচক অর্থ (plurality of meaning) রয়েছে। এই সত্য না বুঝার কারণে সমাজে অনেক বিতর্ক দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু অনেক সময় বিতর্কীরা জানেনই না যে তাদের বিতর্কের স্থান মূল টেক্সটের বহুবাচক (plural) অর্থে নিহিত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে এই সব বিষয় আমাদের ক্লাসিক্যাল অনেক আলিম-ওলামা বুঝতেন কিন্তু এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেকে সেই বুঝ হারিয়ে বসেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এটা ধ্যান থেকে হারিয়ে গিয়েছে যে মূল বিষয় ভাষা-দর্শনের সাথে সংযুক্ত কিন্তু আলোচনা হচ্ছে ভাষা-দর্শনকে বাইরে রেখে। আমাদের একটি অস্তিত্ব ভাষিক। আমাদের এই বিশ্ব, এই চতুঃপার্শ্বের যাবতীয় বিষয় আমরা ভাষার ‘মাধ্যমেই’ জ্ঞাত হই কিন্তু এই মাধ্যমের প্রকৃতি হচ্ছে প্রতীকী (metaphoric)। একেক ভাষা একেক ধরণের জাগতিক অনুভূতির নির্দেশ করে, আমরা নানান প্রতীকের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করি, তাই এই বিবেচনাটি সাথে রাখা জরুরি হয়, যদিও আমরা অনেক সময় ভুল করে থাকি।

 

 

Loading

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *