দুই ভাইয়ের গল্প

মক্কা শহরে কামালের রুজি রোজগার ভালই চলছিল। ৫বছর আগে কেটারিং কোম্পনির চাকুরী থেকে ছাটাই হওয়ার পর নিজের জমানো ও বন্ধুবান্ধবরে কাছ থেকে ধার করা অর্থ দিয়ে সৌদি কাফিলের নামে একটি দোকান খোলে এত লাভবান হতে পারবে ভাবতেও পারে নি। সৌদিতে কোন বিদেশী নিজের নামে ব্যবসা করা বেআইনি। তাই কিছু করতে হলে কোন সৌদির নামেই তা করতে হয়। তবে সৌদির নামে ব্যবসা করে অনেকে সব হারিয়েছেন এমন উদাহরণ দেখেও কামাল সাহস করে তার পরিচিত এক সৌদিকে বিশ্বাস করে ও আল্লাহর উপর ভরসা করে দোকান দিয়েছিল। অবশ্য শর্ত ছিল প্রতিমাসে কাফিলকে নির্ধারিত ফি দিতে হবে এবং ব্যবসা ভাল চললে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তা বাড়তে পারে। কামালের ভাগ্য ভালই বলতে হবে কারণ সাহস করে এত বড় ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করে সে লাভবানই হয়েছে। তবে ইদানীং কামালের মনটা খুবই খারাপ ঢাকা থেকে ফোন এসেছে তার বাবার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না প্রায়ই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। কি হয়েছে ডাক্তাররা ধরতে পারে না। বাবার চিকিৎসা সুবিধার জন্য এবং ছোট ভাই ও বোনের লেখা পড়ার কথা চিন্তা করেই ঢাকা শহরে নিয়ে এসেছিল কামাল সবাইকে বছর চারেক আগে। ইতিমধ্যে ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকত্ব লাভ করে। কিন্তু অনেক দিন থেকে কোন চাকুরী ভাগ্যে জুটছিলনা দেখে সৌদিতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিল। তবে বাবার অসম্মতির কারণে তা করতে পারে নাই। তাঁর ইচ্ছা ছোট ছেলে বিদেশে না গিয়ে দেশেই ব্যবসা করুক। তাই বাবার পরামর্শে ছোট ভাইকে ঢাকা শহরে একটি টেইলারের দোকান খোলার ব্যবস্থা করে দিতে বলায় কামাল তাই করেছিল। অবশ্য কামালের পাঠানো টাকায় আশেপাশের অন্য দোকানের চেয়ে অধিক সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ করে শুরুতেই এলাকার সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় দোকান তৈরি করতে অসুবিধা হয়নি।
গত মাসে দুসাপ্তাহের জন্য ঢাকা গিয়েছিল কামাল। তখন ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে শুনতে পায় অনেক কথা তার মাঝে একটি ঘটনার কথা ভুলতে পারছেনা অনেক চেষ্টা করেও।
একদিন হঠাৎ জামালের দোকানের সামনে একটি দামী গাড়ী এসে থামলে এক মধ্যবয়স্ক এক লোক নেমে এসে এক হাজার পায়জামা পাঞ্জাবি তৈরির ওয়ার্ডার দেয় এবং তা মে মাসের ৪ তারিখে অবশ্যই ডেলিভারি দিতে হবে বলে। সময়মত ডেলিভারি দিতে পারবে কিনা ভাবতে গিয়ে জামালের বুদ্ধি জাগলো একটু চড়া দাম হাঁকিয়ে রাজি করাতে পারলে কিছু কাজ না হয় অন্য দোকান থেকেও করাতে পারবে। আবার লোকটির চাহিদা হল মাদ্রাসার হুজুর ও ছাত্ররা যে ধরনের পাঞ্জাবী পড়েন সে ভাবেই সেলাই করতে হবে সবকয়টি। তাই জামাল যে রেইট চার্জ করল তাতেই রাজী হয়ে লোকটি অগ্রিম টাকা দিয়ে চলে গেল। জামাল ভেবেছিল এক সাথে এত কাপড় সেলাইয়ের ওয়ার্ডার দেয়ার উদ্দেশ্য কি জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু ভয়ে করে নাই। কি জানি এই প্রশ্ন করলে যদি আবার ধমক খেতে হয়। আবার ভাবল হয়ত লোকটি কোন মাদ্রাসায় দান করার জন্য এগুলা তৈরি করছেন। কিন্তু জামালের মনে বিস্ময় হল যে দিন ক্ষমতানশীনদের সাথে কড়া লাইন আছে বলে পরিচিত সে এলাকার সবচেয়ে বড় মাস্তান এসে সে ওয়ার্ডার সম্পর্কে খুঁজ নিয়ে গেল এবং কাপড়গুলা ডেলিভারি নিতেও সে আসল। পরে মতিঝিলের শাপলাচত্বরের সেই কালো রাত্রের ঘটনা বিশেষ করে বায়তুল মোক্কারাম মসজিদের পাশের দোকান পাঠ ও কোরআন পুড়ানের দৃশ্য টিভিতে দেখে সে বিস্ময় আরো বেড়ে গেল! জামালের তখন বুঝতে অসুবিধা হল না হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা যারা ইসলাম বিদ্ধেশী নাস্তিকদের ইসলাম বিরোধী অপপ্রচারের প্রতিবাদ করতে ঢাকা শহরে এসে কেন অভিযুক্ত হচ্ছে কোরআন পুড়ানের অভিযোগে? বিশেষ করে একটি মহলের পক্ষ থেকে কেন তা করা হচ্ছে? । সবার চেহারার নাকি ভিডিও ফুটেজ আছে অথচ আজ পর্যন্ত এ জঘন্য অপরাধের বিচার বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে না? তাই জামালের ধারণা তার তৈরি কাপড়গুলা শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীরাই পড়েছে তাদের কুকর্ম করার জন্য।

জামাল কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী বা ক্যাডার ছিল না তবে তার বোনের জামাই একটি গুরুত্বপূর্ণ মিনিস্ট্রিতে অনেক বড় পদের অফিসার। ফরিদপুরের আওয়ামী ঘরানার লোক হওয়ায় সরকারের সমালোচনা করে কোন কথাবার্তা দুলা ভাইয়ের সাথে তারা আলাপ করতনা। কিন্তু ইদানীং তার কাছ থেকেও শাপলা চত্বরের সে কালো রাত্রের ঘটনার জন্য ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করতে শুনা যায়। দুলাভাইয়ের তথ্যমতে সে দিনের সে অভিযানের জন্য পুলিশ অধিদপ্তর সকল মিনিস্ট্রির গাড়ী রিকুইজিশন করে। সে কারণে দুলাভাইয়ের অফিসের ড্রাইভারেরও ডিউটি পড়ে সে কালো রাত্রে । অতিরিক্ত পুলিশ ও এক ধরণের ক্যাডার বাহিনীর লোক ভর্তি গাড়ী চালানোর দায়িত্বে ছিল। তাই শাপলা চত্বরের আসলেই কি ঘটেছিল সে রাত্রে তা দেখার সুযোগ হয়েছে তার। তাই সে ড্রাইভারের কাছ থেকেই জামাল জানতে পায় সে রাত্রে কি ঘটেছিল শাপলা চত্বরে?

“সেদিন শাসকগোষ্ঠীর ঘাতক বাহিনীর কাছে কিভাবে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছেন নাস্তিকদের বিপক্ষে প্রতিবাদ করায় আসা নিরস্ত্র মানুষ। তাদের বেঁচে থাকার আকুতি নির্দয় শাসক ও হায়েনাদের কাছে এক কনাকড়ির সমান মূল্য পায়নি। সে দিন মানবতার ফরিয়াদ যেখানে বিফল হয়ে আহাজারি করতে করতে ফিরে গেছে আরশের মালিকের কাছে। জবাইকৃত জন্তু যেমন রক্তস্রোত প্রবাহিত করে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে ও কাতরাতে থাকে, সেভাবেই মেরে ফেলা হয়েছে অনেক মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে। এসব দুঃস্মৃতি তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায় প্রতিদিন, সারাদিন, সারাক্ষণ এ কথাগুলা বলে যাচ্ছিল তাকে।”

জামালের মনে আজ প্রশ্ন জাগে শাপলা চত্বরের সে রাত্রে প্রাণপ্রিয় নবী মুহাম্মাদ(সাঃ) এর অবমাননার বিচারের দাবি নিয়ে আসা অভুক্ত-হতক্লান্ত-নিরস্ত্র-ঘুমন্ত অসংখ্য মানুষগুলোর ওপর রাতের আঁধারে নির্বিচারে হাজার হাজার রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে গরুর মত পিটিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে নৃশংতম মহা গণ হত্যাযজ্ঞ চালানো হল তার দায় কে শোধ করবে ?

ডাইভার বলে যাচ্ছিল “স্যার, এখনও মনে পড়ে অন্ধকার নেমে এলে আশেপাশের গলিগুলো হয়ে ওঠেছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। মাঝে মাঝে গলি থেকে মূল সমাবেশে লীগের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল। আর জনতা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে সে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। রাত বাড়তে থাকলে ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর ক্লান্তিতে অনেকেই একটু ঝিমচ্ছিলেন বা ঘুমচ্ছিলেন, কেউ বা নামায পড়ছিলেন, অনেকেই জিকির করছিলেন। রাত তখন আনুমানিক আড়াইটা। হই হই আওয়াজ হলো। ভাবলাম গলি থেকে আবার কোন আক্রমণ বুঝি। কিন্তু না,এবার সরাসরি গুলির শব্দ। লোকজন ছুটাছুটি শুরু করেছে। দেখলাম গুলির বৃষ্টি। গুলি ছুটছিল, আর মানুষগুলো পাখির মতো টুপ টুপ করে রাস্তায় পড়ছিল……..লাশগুলা ট্রাকে তোলার পর কিছুক্ষণ পরে ভোর রাত্রে আসল দমকল বাহিনীর পানির গাড়ী যা দিয়ে রাস্তায় জমে থাকা রক্ত করা হল পরিস্কার।’’

তাই কামাল ভাবতে থাকে এ রকম একটা চরম অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্মম পদক্ষেপ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কি হুট করে তড়িৎ সিদ্ধান্তে গ্রহণ করেছে? এ প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে করায় তিনি বলেছিলেন, “না এটা হুট করে তড়িৎ সিদ্ধান্তের কিছু নয় বরং এত বড় একটা অপারেশন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হর্তাকর্তারা ও তাদের উপদেষ্টারা মিলে চিন্তা ভাবনা করেই গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু কেন?

উত্তর হচ্ছে এই পৈশাচিক আচরণ কার্য্যকর করার পিছনে দুটা উদ্দেশ্য কাজ করেছে।

১) যারা ইতিহাস পড়েছেন সবাই জানেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকা যুদ্ধে যোগদান করে এবং যুদ্ধের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পরাজিত হিটলারের মিত্র দেশ জাপান যখন আত্মসমর্পণ করতে মিত্র বাহিনীর সাথে আলাপে ব্যস্ত ঠিক সে সময়ে আমেরিকা হিরোশিমা ও নাগাসাকি নামের জাপনের দুটা বড় শহরে আণবিক বোমা ফেলে লাখো লাখো মানুষকে হত্যাকরে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য একটিই ছিল। তাহলো পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দেয়া যে আমেরিকা চাইলে যে কোন দেশকে ধূলিসাৎ করে দেবার ক্ষমতা রাখে। আর সে ভয়ে এখনও পৃথিবীতে বিরাজমান।

ঠিক তেমনি বাংলাদেশে আওয়ামীলীগও হেফাজতে ইসলামীর মত একটি দুর্বল ও অসহায় দলের কর্মীদের উপর এমন চরম পদক্ষেপ নেয়ায় অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকার বিরোধী বিএনপি ও জামাতের কর্মী সমর্থকদের মনে ভয় ভীতি সৃষ্টি করা এবং এতে তারা অনেকটা সফল কাম হয়েছে বলে দেখা যায়।

২) হেফাজতে ইসলামীর কর্মীদের বেশভূষা চালচলন ও তাদের ১৩ দফা দাবী ইত্যাদি ইসলামী মূল্যবোধের ধারক হওয়ায় বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের পরাশক্তির কাছে হচ্ছে এরা হচ্ছে পুঁজিবাদ বিরোধী, ইসলামী মৌলবাদী, ফ্যানাটিক গুষ্টি। অতএব এদের উপর যে কোন অমানুষিক চরম পদক্ষেপ নিয়ে তাদেরকে স্তব্ধ করে দিতে পারলে পশ্চিমা শক্তি খুশী হবে এবং তাদের এ পৈশাচিক পদক্ষেপ আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সুনজর অর্জন করবে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু বিএনপি জামাতের কর্মী সমর্থকদের মনে ভয় ভীতি সঞ্চার ও পশ্চিমা পরাশক্তির সুনজর অর্জন ছাড়াও যে দেশের দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ আছে তাদের মনে কি প্রতিক্রিয়া বা ক্ষোভ জন্মিতে পারে সম্ভবত সরকারের উপদেষ্টারা সে বিবেচনা করেন নাই।

তবে সাধারণ মানুষ তাদের মনের অসন্তোষ প্রকাশ করা ইতিমধ্যে শুরু করেছেন। অতএব অদূর ভবিষ্যৎ বলে দিবে বাংলাদেশের ইতিহাসে হেফাজতে ইসলামের নিরীহ মানুষের উপর সেই নৃশংতম গণ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যারা নিজেদের হাতকে রক্তে রঞ্জিত করেছেন তারা আসলেই কি সফলকাম না নিজের কবর নিজেরাই খনন করলেন?”

বি:দ্র: গল্পটি সংগৃহীত।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *