তুরস্কের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পার্টির নিরঙ্কুশ বিজয়।

সাম্প্রতিক তুরস্কের সংসদ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েব এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন জাস্টিস অ্যান্ড ভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে। গত রোববার ১লা নবেম্বর রাতে এ ফল ঘোষণা করা হয়। সংসদের ৫৫০টি আসনের মধ্যে একেপি পেয়েছে ৩১৬টি আসন। এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ২৭৬টি আসন।
রোববার তুরস্কের ২৬তম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশটির ৮১টি প্রদেশে স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ১৬টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।
দেশটিতে গত পাঁচ মাসের মধ্যে এটি দ্বিতীয় নির্বাচন। গত জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একেপি পেয়েছিল ২৫৮টি আসন। এককভাবে সরকার গঠনের মতো আসন না পাওয়ায় জোট সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে কোনো শরীক না পাওয়ায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ নির্বাচনে ১৬টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ৮১.৩৭ শতাংশ ভোট গণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে একেপি ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩১০টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মধ্য বামপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি)। দলটি ২৫.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৩৩টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনালিস্ট অ্যাকশন পার্টি (এমএইচপি) ৪২টি আসন পেয়েছে।
কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এইচডিপি) ৫৯টি আসন পেয়েছে। তবে তাদের ভোট অনেক কমে গেছে।একে পার্টির প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী আহমদ ডাভুটুগ্লু এটাকে গণতন্ত্রের জয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি সংবিধান সংশোধন করবেন বলেও জানিয়েছেন। এতে প্রেসিডেন্টকে আরো বেশি ক্ষমতা দেয়া হবে। তবে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েব এরদোয়ানের এ দূরদৃষ্টি পূর্ণ সঠিক নেতৃত্বের সুফল।
তুর্কি কোস্টগার্ডের কর্মরত এক পিতার পুত্র রিসেপ তায়েব এরদোয়ান এক সময় তুরস্কের রাস্তায় লেবু বিক্রি করতেন। তিনি এখন তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যারিশম্যাটিক নেতা। ৬১ বছর বয়সী এই মানুষটি এবার তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তার দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) নির্বাচনে আবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ায় ১৩ বছরের শাসনকে আরো বাড়ানোর সুযোগ পেলেন। এবার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মার্কিন স্টাইলের সর্ব ক্ষমতাসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তিনি। এভাবে গণতান্ত্রিক উপায়েই তিনি তুরস্ককে তার ভিশনে গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তুরস্কের কাসিমপাশা থেকে ইস্তাম্বুলে আসেন। সেখানে রাস্তায় বিক্রি করতেন লেবু, তিল ও ঝুটি। পরবর্তী সময়য পড়ালেখা করেছেন ব্যবসায় প্রশাসনে। জড়িয়ে পড়েন ইসলামী আন্দোলনে। ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। দেড় কোটি মানুষের শহর ইস্তাম্বুলে তখন তিনি যানজট ও বায়ুদূষণ রোধ করে নগরের চেহারা পাল্টে দেন। ২০১২ সালে তুরস্কে গিয়েছিলাম ইস্তাম্বুল শহরের রাস্তাঘাটের পরিছন্নতা ও বাড়ী ঘর দেখে আমার কাছে কানাডা থেকেও সুন্দর লেগেছে।
তুরস্কে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে তিনি বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে একটি ধর্মীয় কবিতা আবৃত্তির কারণে চার বছরের জেল হয় তার। কবিতাটি ছিল- মসজিদ আমাদের ক্যান্টনমেন্ট, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাসীরা আমাদের সৈনিক। এরদোগানের দীর্ঘদিনের মিত্র আবদুল্লাহ গুল ও অন্যদের সঙ্গে মিলে ২০০১ সালে একেপি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সাল থেকে এ দলটি প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভ করে আসছে। জেল খাটার অতীত থাকায় প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি তিনি। পার্লামেন্টে নতুন আইন পাসের মাধ্যমে ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। গত বছর প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে তুরস্কের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন। লম্বা স্লিম চেহারার মধ্যবয়স্ক এরদোগান রাজনীতিতে এক ভিন্নধর্মী ইমেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিন বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন কোনো মুসলিম দেশে প্রেসিডেনসিয়াল সফরে গেলেন, তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম পাঁচ মিত্র দেশের অন্যতম বলে উল্লেখ করলেন। এরদোগানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ঘোষণা দিলেন, একজন নেতা কীভাবে একইসঙ্গে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরদোগান। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রকে সমন্বিত করে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি রোল মডেল সৃষ্টি করেছেন।

কট্টর সেকুলার কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের জনগণের ধর্ম পালনের অধিকার কেড়ে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামী ঐতিহ্য ও চেতনা মুছে ফেলেছিলেন। এরদোগান সেই ক্ষত সারিয়ে বলেছেন, ধর্ম পালনে কাউকে বাধ্য যেমন করবেন না, তেমনি ধর্ম পালনে কেউ যেন বাধা না দিতে পারে সে ব্যবস্থা তিনি করবেন। তার বিরোধীরা তাকে কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতালিপ্সার অভিযুগ দিলেও এবারের নির্বাচন দেখিয়ে দিল যে জনগণ এরদোগানের কর্তৃত্ববাদী শাসনই অনুমোদন করে এবং ভাল পায়।

আসলে তুরস্কের অবস্থা বিশেষ করে সে দেশের সেকুল্যারদের শক্তির মোকাবিলায় এরদোগান যে ভাবে কৌশল করে চলছেন তাকে আমি সাধুবাদ দেই। বাংলাদেশের সেকুলার আর তুরস্কের সেকুলারা সমান নয়। কামাল আতা-তুর্ক যে অবস্থায় সে দেশের মানুষের বিশেষ করে এলিটদের মাঝে ইসলাম বিমুখী মানসিকতায় গড়ে তুলেছে সেখানে ইসলামের পক্ষে রাজনীতি করা এত সহজ নয়।

এরদোগান একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান যে কিনা মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সারায়ে সিসির সামরিক শাসনের বিপক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন এবং যতটুকু সম্ভব ব্রাদারহুডের লোকদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। এরদোগান একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান যে কিনা ইসরাইলের প্রকাশ্য সমালোচনা করার উদাহরণ রেখেছেন এবং হামাসের সাহায্য করেন। এরদোগান একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান যে কিনা রোহিঙ্গার নির্যাতিত মানুষের পাশে সশরীরে গিয়ে হাজির হয়েছেন তাদের সাহায্য করতে। এরদোগান একমাত্র মুসলিম নেতা যিনি মুসলিম বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের ব্যাপারে ভাবেন ও কাজ করতে চান। বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদেরকে হত্যা করা বন্ধ করতে বার্তা পাঠিয়েছেন সরকারকে। কি দরকার ছিল তাঁর এসব করার। তুরস্কের অধিকাংশ মানুষ তাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটোতে থাকতে চায়। সাদ্দাম যে ভুল করেছে সে জন্য এরদোগানকে দুষ দিয়ে কি হবে? তুরস্ককে ভাঙ্গার জন্য পিকেকে নামে কুর্দিস সন্ত্রাসী যাদেরকে যায়োনিস্ট ও পশ্চিমা শক্তি সমর্থন করে যাচ্ছে এরদোগানকে সে সমস্যারও মুকাবিলা করতে হচ্ছে। তুরস্কে একমাত্র রাষ্ট্র যে দেশ প্রায় ২ মিলিয়নের অধিক সংখ্যক সিরিয়ার রিফিউজিকে তাদের মাটিতে আশ্রয় দিয়েছে।

একে পার্টিকে কেন আবারো আস্থায় নিয়ে ভোট দিল মানুষজন? এর কারণগুলো কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে একে পার্টির এমপি রাভজা কাভাকচি বলেছেন, তুরস্ক বদলে গেছে।
রাভজা কাভাকচি এখানে বলছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান-এর সময়ে তুরস্ক এমনই পাল্টে গেছে যে, আমরা এখন এমন সব ইস্যু যেমন- ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি যা কখনোই সম্ভব হতো না।
গত বেশ কিছুদিন ধরেই তুরস্কে চলছে সহিংসতা, হামলা, পাল্টা হামলা।সহিংসতা ও বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে মানুষ আবার একে পি’র উপরেই আস্থা রেখেছে।

সুত্র: বিবিসি, নয়া দিগন্ত, যুগান্তর

Loading

Comments are closed.