প্রান্থিকতা বর্জিত সমাজিক লক্ষ্য

-এক-

সমাজের মানুষ নানান বিশ্বাসে বিভক্ত: কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু, কেউ ইয়াহুদী, অথবা কেউ হয়ত নাস্তিক। এসব নিয়ে রেষারেষি কোন ভাল কাজ নয়।  যার যার স্থানে থেকে গেলেই বিবাদ থাকে না।

যুক্তি দর্শানো ছাড়া কি সত্যানুভূতি নেই?

মানুষের ধর্ম-কর্ম প্রধানত প্রায়োগিক (functional)। এটা জীবন পদ্ধতি-সদৃশ বা জীবন পদ্ধতি। যেমন কোন পরিবেশে মানুষ চাষবাস করে। এখানে একজন দা, কুড়ল, খুন্তি, লাঙল, জোয়াল, মই ইত্যাদির ব্যবহার শিখে। কোন্‌ মাসে কী কাজ করতে হয় তা শিখে। ফসলের রোপণ, পরিচর্যা থেকে ফসল তোলার জ্ঞান লাভ করে, এতেই তার জীবন। কিন্তু এসব বিষয়ের ঐতিহাসিকতা কী, কোন্‌ হাতিয়ার কালের আবর্তনে কীভাবে পরিবর্তিত/পরিবর্ধিত হয়েছে, অথবা জাতীয় জীবনে তার পরিবারের অবস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় তারা কোন্‌ স্থানে আছেন অথবা কোন্‌ ধরণের ভূমিকা (role) পালন করেন; অথবা তাদের শ্রেণির জীবন যাপনের দার্শনিক দিক কী অথবা অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থার সাথে তাদের তুলনীয় রূপ কী –এসব বিষয় সে সুন্দর করে, যৌক্তিক ভাষায় বুঝিয়ে দেবার জ্ঞান হয়ত রাখবে না। বিষয়টি এভাবেই। কেননা এসব বিদ্যায় সে বছরের পর বছর কাটিয়ে সেই “ভাষা” আত্মস্থ করেনি। কিন্তু আপনার ‘ভাষায়’ ও আপনার ‘যুক্তিতে’ তার কথা সাজিয়ে ‘পটর-পটর’ করতে পারে নি বলে তার আক্কেল বুদ্ধির কোন কমতি আছে –এমনটা কি ভাবা যাবে?

কোন ব্যক্তি যে কাজ করে, দর্শন, যুক্তিতে তার কাজের ব্যাখ্যা কীভাবে হবে তা নিয়ে এক ভিন্ন ধরণের “লটর-পটর” করার সংস্কৃতি প্রায় আড়াই শো বছরের মত লক্ষ্য করা যায়। এই সংস্কৃতিতে সব কিছু ভাষিক (rationalising) ব্যাখ্যায় তোলে ধরতে পারাটাই একটা বড় বিষয় হয়ে গিয়েছে। কোন এক মহিলা কেন বিবাহ ছাড়াই ১০ পুরুষের সাথে দৈহিক সম্পর্ক রাখছেন অথবা একজন পুরুষ বিবাহিত হয়েও পরকীয়া সম্পর্কে জড়িত তা তারা সুন্দরভাবে সাইকো-সস্যিয়েল যুক্তিতে ও ভাষায় নৈপুণ্যের সাথে ব্যক্ত করতে পারাতে তাদের কথা শ্রবণ, বিবেচনা ও সভ্যতায় গ্রহণের শ্রেণী ও সংস্কৃতি সমাজে রূপলাভ করেছে। এখানে ইংরেজি প্রবচন gift of the gab  বা ‘মুখের জোর’ অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু হয়েছে।

-দুই-

সাধারণ মানুষের ধর্ম নির্মূল করে কার মূল্যবোধ ও বিশ্বাস চাপানো হবে?

ধর্মের বিষয়টি হচ্ছে আমল-কেন্দ্রিক। এখানে যুক্তি, দর্শনে ধর্ম-ব্যাখ্যায় পারদর্শী হওয়া জরুরি নয়। একজন আল্লাহতে বিশ্বাস করবে, পরকালে বিশ্বাস করবে, তার ভাল-মন্দ কাজের হিসাব নেয়া হবে –এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে সে জীবন সাজাবে। এটাই হচ্ছে ধর্ম জীবনের মূল বস্তু। যৌক্তিকতায় কী দেখাতে পারল বা কী পারল না, তাতে কিছুই যায় আসে না। প্রায়োগিক মূল্যই বড় মূল্য। এমনটাই বিশ্ব-মানবে স্থান কালের পরিক্রমায় পাওয়া যাবে –এটাই নানান ধর্ম ও সংস্কৃতিতে গড়ে-ওঠা এই মানবের এক বড় ঐতিহ্য।

ইসলাম ধর্মের বর্ধিতরূপ আসে এভাবে: এক ব্যক্তি নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, জাকাত দেবে, হজ্জ করবে, হালাল রুজি করবে, দান-খয়রাত করবে, প্রয়োজনে অপরের সাহায্যে এগিয়ে যাবে, অপরের দোষ-ত্রুটি মার্জনার চোখে দেখবে, ছেলে-মেয়ে বড় হলে বিয়ে-শাদী দেবে, কেউ মারা গেলে দাফন কাফন করবে। এসব কাজের আরও বিবরণ/বিস্তৃতি আছে। এসবের মধ্যে সে, তার পরিবার, তার সমাজ সবই পারস্পারিকতায় সংযুক্ত। এখানে উল্লেখিত ধর্ম-কর্মে বিশেষ জ্ঞান, বিশেষ জিজ্ঞাসা, বিশেষ নিয়ম-কানুনের সন্নিবেশও রয়েছে। কিন্তু সকলকে সেই জ্ঞান অর্জনের দরকার হয় না। ‘কিছু লোক’ সেই জ্ঞান অধ্যয়ন করলেই বাকিদের জন্য সেই প্রায়োগিক প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়। এভাবেই কালীন প্রবাহে অনেক উত্তম প্রথা প্রবাহিত হয়।

-তিন-

মুসলিম সমাজে মাদ্রাসার ঐতিহ্যগত প্রথা আসলে কি শিখায়?

বাংলাদেশের সাধারণ মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রম মূলত এই প্রায়োগিক বা functional বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাস কী; আমল আখলাকের বিবরণ কী; বাচ্চাদেরকে কী কী পড়ানো দরকার; পবিত্রতা কী; ইবাদত বন্দেগী কী এবং এতে কীরূপ পবিত্রতার প্রয়োজন, নামাজ কীভাবে পড়তে হয়; অজু কীভাবে করতে হয়; মসজিদে ইমামতি কীভাবে করতে হয়; বিয়ে কীভাবে পড়াতে হয় এবং কীভাবে তা কার্যকর হয়; বিয়ে যদি সমস্যাবহুল হয় তবে তালাকের নিয়মকানুন কীভাবে কার্যকর হয়, এই ধারায় দৈনন্দিন জীবনে এবং যাবতীয় ক্ষেত্রে সকল হুকুম আহকাম পালনের প্রায়োগিক কাজ সমাধা করার উপযোগী লোক তৈরি করাই হয় এই ব্যবস্থার প্রধান কাজ। এখানে কাউকে তর্কবাগীশ বানানো হয় না। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ইত্যাদি পাঠ করে কোন আলোচনা যেসব শব্দ ও পরিভাষায় করা হয় তারা সেই ভাষা আত্মস্থ করে সেই ভঙ্গিতে বক্তব্য উপস্থাপনের স্কীল শিখে বের হন না। কারণ তাদের ধর্মীয় দৈনন্দিন জীবনের প্রায়োগিক উদ্দেশ্য ভিন্ন। কিন্তু এই ব্যবস্থা মানুষকে সৎলোক করে। সামাজিক ও পরকালমুখি করে। মানব উদ্দেশ্যকে ধারণ করে।

দায়িত্বশীল সামাজিক ব্যবস্থা মানুষকে দায়িত্বশীল ক্রে গড়ে তুলে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেটা দেখা যাচ্ছে না। যা দেখা যাচ্ছে তা হল বড় বড় চুরি, ডাকাতি, গুম-রাহাজানি, হত্যা-চাঁদাবাজি, জাতীয় সম্পদের হরিলুট: ব্যাঙ্কলুট, ভূমিদস্যিপনা, নারী-ব্যবসা। এসব থেকে উত্তরণের জন্য নৈতিক সমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজন যেখানে মানুষকে মূল্যায়ন করা হবে, মানুষ তার অধিকার বঞ্চিত হবে না। মানুষ স্বাধীন হবে। ইউরোপ এই গুণগুলো লালন করতে পারছে বলেই সেখানে তুলনামূলক শান্তি বিরাজ করছে।

পারস্পারিক সম্মানবোধ ছাড়া সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। সবাইকে এই সম্মান দেখাতে হবে -ব্যক্তির বিশ্বাস আস্তিকতা হোক অথবা নাস্তিকতা। কেউ যখন একে অন্যের বিশ্বাসের সমালোচনা করবেন, তখন ভদ্র ভাষাই তা করবেন। সমালোচার নাম বিদ্বেষ নয়।  মূলকথা প্রান্থিকতা বর্জনের মাধ্যমেই সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারে।

 

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

Comments are closed.