গভীর চিন্তার সময় এখন

প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস এলেই বিশেষভাবে মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা, সহ-মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এবং অনিবার্যভাবেই প্রসঙ্গ এসে যায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কী পাওয়ার কথা ছিল, কী পেয়েছি, কী পাইনি সেসব কথা। এবার ফেব্র“য়ারি মাসের শুরু থেকেই এ কথাগুলো বেশি বেশি মনে আসছে। স্মৃতিশক্তি থেকে এবং ব্যক্তিগত ফাইল থেকে এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ১৯৯৯ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে ঢাকা মহানগরের তোপখানা রোডের পশ্চিম দিকে অবস্থিত সিরডাপ মিলনায়তনে একটি গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’। ওই আলোচনা সভায় আমি মূল প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেছিলাম এবং কিছুসংখ্যক বিদগ্ধ ব্যক্তি আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।   পরেরদিন অর্থাৎ ১১ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে, প্রধান পত্রিকাসমূহে এর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সাতটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম আমি উল্লেখ করছি। দৈনিক সংবাদ : ‘সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের জন্য দায়ী রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা’। ভোরের কাগজ : ‘২৭ বছরে সবচেয়ে মারাত্মক অবনতি ঘটেছে শাসন ব্যবস্থায়’। মানবজমিন : ‘মানুষের স্বার্থে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ’। যায়যায়দিন : ‘বড় বিষয়গুলোতে সমঝোতা হলে এই দুর্ভাগ্য হতো না’। ইনকিলাব : ‘স্বাধীনতার ফল ভোগ করছে জনবিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী, জনগণ রয়েছে বঞ্চিত’। দৈনিক সংগ্রাম : ‘২৮ বছরে জাতির প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার জন্য রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাই দায়ী। এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের’।   প্রথম আলো : ‘স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অনৈক্য’। সুধী পাঠক, শিরোনাম থেকেই বুঝতে পারছেন যে, আলোচনা কোন ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। ১২-১৩ বছর আগে ওই আলোচনা সভায় আমি যেই প্রবন্ধটি পড়েছিলাম সেই প্রবন্ধের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ দুই-তিনটি পত্রিকায় হুবহু উদ্ধৃত করেছিল। আমি ওই ক্ষুদ্র অংশটি এখানে আজকের কলাম পাঠকদের জন্য পুনরায় উদ্ধৃত করছি। ‘ৃ এখন সময়ের ডাক হচ্ছে জাতীয় সমঝোতার। সব ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর অংশ, যার যার ভুলগুলো স্বীকার করুক। প্রয়োজনে এই ভুলের জন্য ক্ষমা চাক। এরপর আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে আগামী শতাব্দীতে প্রবেশ করব। কারণ মানুষই ভুল করে। ভুলের জন্য অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনায় কোনো লজ্জা নেইৃ’। আলোচনা সভায় যে নতুন শতাব্দীর প্রসঙ্গ এসেছিল, সেই নতুন শতাব্দীর প্রায় তেরটি বছর শেষ হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই, ক্ষমা চাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই অতএব ক্ষমা করারও কোনো অবকাশ নেই। ক্ষমা ও সমঝোতা পারস্পরিকভাবে সম্পৃৃক্ত।   সমঝোতার কয়েকটি আঙ্গিক বস্তুগত বা অভ্যাসগত নয়। এগুলো বিশ্বাস ও অনুভূতি সম্পর্কিত। কোনো একজন ব্যক্তিকে নিয়ে, এই বিশ্বাস ও অনুভূতিগুলোকে একটি গুচ্ছ আকারে প্রকাশ করা যায় যথা : একের ভেতর চা   প্রশ্ন হচ্ছে সেই এক কী জিনিস, সেই চার কী জিনিস। উত্তর হচ্ছে—সেই এক হচ্ছে আমি আর চার হচ্ছে আমার পরিচয়। সেই চার পরিচয় কী? আমি বাঙালি, আমি বাংলাদেশী, আমি মুসলমান এবং আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমার কোনো একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধু হলে বলতেন : আমি হিন্দু, আমি বাঙালি, আমি বাংলাদেশী, আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমার প্রজন্মের অনেকেই এবং পরবর্তী প্রজন্মের সবাই মুক্তিযোদ্ধা নয়। তাদের জন্য প্রযোজ্য তিন পরিচয়। যথা—হিন্দু অথবা মুসলমান, অবশ্যই বাঙালি এবং বাংলাদেশী। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান প্রজন্মের কোনো উপজাতীয় ভাই হলে তিনি বলবেন, আমি চাকমা, আমি বৌদ্ধ এবং আমি বাংলাদেশী। আমাদের জাতীয় জীবনে সমঝোতার অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে বাঙালি না বাংলাদেশী এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিতর্ক এবং হিন্দু এবং মুসলমান বলা যাবে কী যাবে না এই নিয়ে বিবাদ।   আমার জন্ম চট্টগ্রামের এক গ্রামে। তখন ছিল নিভৃত অনগ্রসর পল্লী, বর্তমানে বর্ধিষ্ণু জনপদ। আমি যখন জন্মগ্রহণ করি তখন রেওয়াজ মোতাবেক বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আজান দেয়া হয়েছিল এবং আমার কানের মধ্যে ফুঁ দিয়ে আজানের বাণী ও কলেমা পড়া হয়েছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজকে এবং আমাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আমি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। জন্মে আমার কোনো হাত ছিল না। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর হুকুমেই আমার পিতা-মাতার ঘরে আমি জন্মেছি এবং আনন্দের সঙ্গে দ্বীন ইসলামের সঙ্গে এ পর্যন্ত ওই বিশ্বাস নিয়ে আছি।   বুদ্ধি হওয়ার পর, লেখাপড়া করার পর বিশ্বাসের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আমাদেরই গ্রামের দক্ষিণাংশে ছিল বড় হিন্দুপাড়া। ওই পাড়ায় জন্মগ্রহণ যারা করত তাদের জন্মের সময় উলুধ্বনি দিয়ে কাঁসা বাজিয়ে মন্ত্র জপে তাদের হিন্দুধর্মে বরণ করা হতো এবং তারা খুশি মনেই সেই বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছেন, বেঁচে আছেন, যাবতীয় জাগতিক কর্মে অংশগ্রহণ করছেন। হিন্দু হই বা মুসলমান হই, সৃষ্টিকর্তা কিন্তু কাউকেই আলো-বাতাস এবং প্রকৃতির মায়া-মমতা দিতে কার্পণ্য করেননি বা করছেন না।  জন্মের পর এক-দেড় বছর পর্যন্ত দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতাম। তার পরে প্রথম যে কোন শব্দগুলো উচ্চারণ করা শিখেছিলাম সেটা মনে নেই। তবে নিজের সন্তানদের এবং শত শিশুকে দেখে অনুমান করি যে, প্রথম শব্দটি হয়তো ‘মা’ ছিল বা ‘আম্মা’ ছিল। তর পরের শব্দ হয়তো বা ‘পানি’, ‘আব্বু’, ‘বসা’, ‘খাওয়া’, ব্যথা পেলে উহু করা ইত্যাদি সম্পর্কীয় ছিল।   ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা রপ্ত করলাম এবং শিশু বয়সে মাতৃভাষা রপ্ত করাটা এত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া যে, এটা পর্যবেক্ষণ করা খুবই কঠিন। যদিও এই পরিণত বয়সেও আমি বলতে পারব না যে, আমি আমার মাতৃভাষা পুরোপুরি রপ্ত করতে পেরেছি। মাতৃভাষার কারণে আমি বাঙালি। আমি জন্মগতভাবে বাঙালি এবং বাঙালি হওয়ার জন্য আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি। সৃষ্টিকর্তাই আমাকে বাঙালি বানিয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, যেটাকে আমরা ধর্মীয় বিশ্বাস বলি সেটা (মুসলমানদের পরিভাষায় ঈমান) এবং মাতৃভাষা এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা—এই দুটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছু ছিল না এবং এ দু’টির উপর আমার জন্মগত অধিকার আছে। অতএব এই দুটি নিয়ে কোনো বিবাদের অবকাশ নেই।   হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এসব বাঙালি এবং কিছু অবাঙালি মিলে একদা ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত পাকিস্তানি হিসেবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে আমরা সুবিচার পাইনি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা দ্বীন ইসলামের অনুসারী হলেও, তারা ইসলামের মূল নীতি লংঘন করেছেন তথা অন্যায়, অসাম্য, নির্যাতন বাস্তবায়ন করেছেন আমাদের উপর। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ভেতরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বেদনা এবং প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ ক্রমশ ঘটতে ঘটতে ২৩ বছর পেরিয়ে যায়।   আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষি জনগণ সংঘবদ্ধ হতে থাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে এবং অধিকার আদায় করতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আহ্বান এবং তৎকালীন মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করাটা কারও জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। পাকিস্তানিদের প্রতি ক্ষোভ ও প্রতিবাদের অংশ হিসেবে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। স্বজন হারানোর প্রেক্ষাপটে প্রতিশোধের সংকল্প নিয়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। দেশের মানুষের ও মাটির টানে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন বেশিরভাগই। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক প্রকারের যথা-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্র প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্র গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনিক মুক্তিযোদ্ধা এবং সমর্থক ও সহায়ক মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। লাখ লাখ লোক যেমন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, সেরূপ বহু লোক মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অবকাশ থাকা সত্ত্বেও তাতে যোগ দেয়নি (তাদের মধ্যে অনেকেই এখন ভীষণ সোচ্চার)।   আমি জয়দেবপুরে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (সংক্ষেপে সেকেন্ড বেঙ্গল)-এর কনিষ্ঠতম অফিসার ছিলাম এবং আমাদের পুরো ব্যাটালিয়ন একসঙ্গে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-জয়দেবপুর-গাজীপুর এলাকা থেকে যুগপৎ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। আমাদের অন্যতম নেতা ছিলেন তৎকালীন মেজর সফিউল্লাহ ও তৎকালীন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। আমি মুক্তিযোদ্ধা সেটা আমার জন্য আনন্দের এবং গৌরবের বিষয়। কিন্তু আমার আনন্দ এবং গৌরব অন্যের জন্য বিষাদ বা নির্যাতনের কারণ যেন না হয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যারা মুক্তিযোদ্ধা নন তার কারণে তারা হিন্দু বা মুসলমান হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। তারা বাঙালি হওয়ার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন না। মুক্তিযুদ্ধ আমরা কেন করেছিলাম? এই প্রশ্নের তত্ত্বীয় দার্শনিকভিত্তিক উত্তর দেয়া যাবে। অর্থনৈতিক কারণের ভিত্তির ওপর দীর্ঘ উত্তর দেয়া যাবে।   এসব উত্তর পাঠক সমাজের কাছে অতি পরিচিত। মোদ্দা কথা হলো, আমরা নতুন দেশ করতে চেয়েছিলাম। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হতে চেয়েছিলাম। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিয়ে, নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন করতে চেয়েছিলাম। সব মত ও বিশ্বাসের মানুষ একই সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতে চেয়েছিলাম। আমাদের নতুন দেশের নাম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই স্থির করা হয়েছিল। সেই দেশের নাম বাংলাদেশ। আমরা যদি এতদঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালি বা অবাঙালি না হতাম তাহলে কখনই বাংলাদেশের মানুষ হতাম না। বাঙালি হয়েছিলাম বলেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অন্যায় এবং অবিচারের শিকার হয়েছিলাম। সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। আর সেজন্যই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ কারণেই বাংলাদেশী। যে বাংলাদেশের জন্য আমরা লড়াই করলাম, লাখ লাখ লোক প্রাণ দিল, সেই বাংলাদেশের পরিচয়ে বাংলাদেশী হওয়ার প্রসঙ্গটিকে বহুদিন ধরে বিতর্কিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল।   কিছুদিন আগে উচ্চতর আদালতের একটি রায়ে এই বিতর্কের অবসানের ইশারা আছে। বাঙালি এবং বাংলাদেশী এই দুই পরিচয় একে অপরের পরিপূরক। স্ববিরোধী নয়। যারা এই দুয়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে তারা অকল্যাণের কাজ করে। তারা ধ্বংসাত্মক কাজ করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই গর্বিত যে, আমি একজন বাঙালি মুসলমান। আমি খুবই গর্বিত যে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার মতোই আমি একজন বাংলাদেশী। আমি আনন্দিত এবং গর্বিত যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।  ৩০ বা ৩৩ বছরকে একটি প্রজন্মের মেয়াদ ধরা হয়। যেসব তরুণ যুদ্ধ করেছিল তারা প্রথম প্রজন্ম হলে, দ্বিতীয় প্রজন্ম তারুণ্যের চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছে এবং ২০১৩ সালে তৃতীয় প্রজন্মের ব্যক্তিগণ কিশোর বা তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ করে নাই তাদের মধ্যকার মতপার্থক্যের কারণে কি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে?   আরও কঠিন প্রশ্ন, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এবং যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে কি বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে? এই পার্থক্যের ইতিবাচক সমাপ্তি প্রয়োজন (ইংরেজি ভাষায় অনেকটা এরকম : ‘ডিসিসিভ অ্যান্ড কনক্লুসিভ ফিনিশিং’ প্রয়োজন)। গত ফেব্র“য়ারি মাসের ৫ তারিখ থেকে চলমান শাহবাগ কেন্দ্রিক ঘটনাবলী চিন্তাশীল ব্যক্তিগণকে চিন্তার খোরাক দিয়েছে। শাহবাগ-এর ঘটনাবলীর উদ্যোক্তা তরুণ প্রজন্ম থাকলেও ক্রমান্বয়ে মধ্যবয়সী ও প্রবীণগণ এতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। প্রথমদিকে নির্দলীয় ব্যক্তিরা জড়িত থাকলেও, ক্রমান্বয়ে দলীয় ব্যক্তিগণ জড়িত হয়েছেন। ঢাকা মহানগর বাংলাদেশের রাজধানী, রাজধানীতে যা ঘটে সেটা সারা বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু জনসংখ্যায় ঢাকা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের বা দলগুলোর তরুণরা, ভিন্ন বিশ্বাসের তরুণরা শাহবাগের মূল চেতনার সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করলেও, পারিপার্শ্বিক চেতনা ও দাবি-দাওয়ার শাখা-প্রশাখার সঙ্গে একমত পোষণ করতে নাও পারেন।   যা-ই কিছু অর্জন হোক না কেন শাহবাগের মাধ্যমে, সেটার পরিপকস্ফতা আসে পার্লামেন্টের মাধ্যমে। অতএব পার্লামেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতেও পার্লামেন্ট গুরুত্বপূর্ণ থাকবে। সেই আগামীর পার্লামেন্টে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা আছে ব্যক্তি পর্যায়ে ও দলীয় পর্যায়ে। আগামীর পার্লামেন্ট নির্ধারণ করবে আগামী বাংলাদেশের গতিপথ। অতএব পার্লামেন্টে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটি যেন অবারিত থাকে, চাপমুক্ত থাকে সেটা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। একটি লক্ষ্যবস্তু অর্জন করতে গিয়ে আরেকটি লক্ষ্যবস্তুকে বিসর্জন দেয়া যাবে না। এমন যেন না হয় তারুণ্যের আন্দোলনের মাধ্যমে কিছু সমস্যা সমাধান করা গেল, অপরপক্ষে নতুন কিছু সমস্যর জন্ম দেয়া হলো। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতি বাস্তবায়নের আন্দোলন যেন হাইজ্যাক হয়ে না যায় বা সাইড-ট্র্যাক বা মার্জিনালাইজড (প্রান্তিকরণ) হয়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখা অতীব প্রয়োজন।   আমাদের বেঁচে থাকতে হবে সম্মানের সঙ্গে। এখন সংগ্রাম করতে হবে কীভাবে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ না হয়ে মধ্য আয়ের দেশ হওয়া যায়, কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ না হয়েও উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করা যায়, কীভাবে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, কীভাবে প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকা যায় ইত্যাদি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের অবস্থানকে জোরদার করা যায়। এখন সময় এসেছে নিজেদের গত ৪১ বছরের অকর্মণ্যতা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির জন্য অনুশোচনা করা।   নিজেদের গত ৪১ বছরের যা-ই কিছু অর্জন আছে (এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্জন অবশ্যই আছে) সেগুলোকে সুসংহত করা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কারণে বাংলাদেশ যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার থেকেও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আমেরিকার কারণে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, জাপানের কারণে কোরিয়া ইত্যাদি। সেই কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম এখন কোথায়? অন্যকে দোষ দেয়ার প্রবণতা বন্ধ করে সময়ের আয়নায় নিজেদের চেহারা একবার দেখা উচিত। আমার মনে হয় এতে উপকার হবে। নতুন শতাব্দিতে এমনিতেই মানুষ ভবিষ্যত্মুখী। যুবসমাজের একটা অংশের মধ্যে উন্নতির আগ্রহ দর্শনীয়। বেঁচে থাকার জন্য তারা সংগ্রাম করতে আগ্রহী। যারা বয়স্ক তাদের উচিত কনিষ্ঠদের সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়া। ইলেকট্রনিক ও ভার্চুয়াল জগত আমাদের উন্নয়নের রাজপথ হতে পারে; যারা এই দুটিকে লজ্জা পায়, তাদের লজ্জা ভেঙে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

(পুর্ব প্রকাশিত: বাংলাদেশ নিউজ২৪ : ২৬/০২/২০১৩)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *