একাত্তরের হাতিয়ার

শাহবাগে জনসমাবেশ খুবই উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে এই সমাবেশে দাবি ছিল কেবল, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই’। কিন্তু পরে দাবি উঠল ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আর একবার’। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই হাতিয়ার আসবে কোথা থেকে? আর কারাই বা ব্যবহার করবেন এই হাতিয়ার? কারণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা এখন আর অনেকেই বেঁচে নেই। তারা ইন্তেকাল করেছেন স্বাভাবিকভাবেই। যেসব মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন, তারা সবাই হয়ে পড়েছেন প্রায় বৃদ্ধ। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার সামর্থ্য তাদের আর অবশিষ্ট নেই। অস্ত্র ধারণ করতে হলে নতুন প্রজন্মকে নিতে হবে বিশেষ প্রশিক্ষণ। কিন্তু দেশে বসে সে রকম প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ ঘটবে কি? ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতে যেয়ে। এবারো কি ভারত আসবে তরুণ প্রজন্মকে ১৯৭১-এর মতো প্রশিক্ষণ প্রদান করতে? ১৯৭১-এর যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারত ও পাক বাহিনীর যুদ্ধ। সেটা ঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়ে থাকেনি। বাংলাদেশে এখন আর পাক বাহিনী নেই। বাংলাদেশ এখন একটা পৃথক স্বাধীন দেশ। তার আছে নিজস্ব বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ার ১৯৭১ সালে গর্জে উঠেছিল পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে। এবার নিশ্চয় গর্জে উঠতে চাইবে না বাংলাদেশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রশ্নটা তাই সঙ্গতভাবেই উঠছে মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার গর্জে উঠতে চাইলে বাংলাদেশ বাহিনী সে ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাাখবে।   ১৯৭১-এর অবস্থা আর আজকের পরিস্থিতি এক হয়ে নেই। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ বলে কোনো পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু এখন আছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার কাদের বিরুদ্ধে, কিভাবে গর্জে উঠবে সেটা নিয়ে থাকছে প্রশ্ন। শাহবাগে সমবেত তরুণ প্রজন্ম কি এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে কিছু ভাবতে চাচ্ছে না! আমরা ১৯৭১ সালের বিশ্বে এখন আর বাস করছি না। নানা দিক থেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক আলাদা হয়ে পড়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা চলে, উলফাদের কথা। ১৯৭১-এ উলফা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এখন আছে। ভারত ইচ্ছা করলেই আগের মতো উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাতে পারবে না। যে সাহায্য সে পাঠাবে, তার একটা অংশ পাচার হয়ে যেতে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতে। আর উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামীরা করতে পারেন সেটার ব্যবহার। ভারতকে তাই ভাবতে হবে অনেক ভিন্নভাবে। ভারত ১৯৭১-এ আগরতলা থেকে সৈন্য পাঠিয়েছিল ঢাকার পথে। কিন্তু ত্রিপুরার পরিস্থিতি এখন হয়ে উঠেছে বেশ কিছুটা ভিন্ন। ত্রিপুরীরা চাচ্ছেন স্বাধীন হয়ে যেতে। এই যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, এটাকে বিবেচনায় নিয়ে ভারতকে করতে হবে তার নীতি নির্ধারণ।   বিশুদ্ধ সমরনীতির দিক থেকে বিচার করলেও বলতে হবে ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে গুণগতভাবেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হাতে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। পাকিস্তান এখন একটি পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশ। ভারত যদি বাংলাদেশে অভিযান চালাতে চায়, তবে পাকিস্তান কী করবে সেটা এখন খুব নিশ্চিত নয়। ভারত একটা খুবই জনবহুল দেশ। পারমাণবিক যুদ্ধে সে দেশের যত ক্ষতি হবে, পাকিস্তানের তা হবে না। তা ছাড়া ভারতের অর্থনীতি যতটা শিল্পপ্রধান, পাকিস্তানের অর্থনীতি এখনো ততটা শিল্পপ্রধান নয়। যেকোনো পারমাণবিক যুদ্ধে ভারতের কলকারখানার অর্থনীতি যতটা বিপদগ্রস্ত হবে, পাকিস্তানের অর্থনীতি তা হবে না। পারমাণবিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের তাই থাকবে বেশ কিছু সুবিধা। খবরে প্রকাশ, পাকিস্তান তার গোয়ান্দার বন্দর পরিচালনার ভার প্রদান করতে যাচ্ছে চীনকে। চীন এখানে গড়তে চাচ্ছে এক বিরাট নৌ-ঘাঁটি, যা ভারতের জন্য হয়ে উঠছে খুবই উদ্বেগের কারণ। ভারতের সমুদ্রসৈকত প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি। এই দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত রক্ষা করার মতো যুদ্ধজাহাজ এখনো ভারতের নেই। ভারত তাই পাকিস্তানে চীনের নৌ-ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনায় হয়ে উঠেছে খুবই উদ্বিগ্ন। ভারত চীনের মতো সমরাস্ত্রে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি। ভারতের তাই সমরাস্ত্র কিনতে হচ্ছে বিদেশের কাছ থেকে। এই সমরাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ঘটছে অনেক দুর্নীতি। যার ফলে সেনাবাহিনীতে ঘটতে পারছে মনমালিন্য। সেনাবাহিনী উঠতে চাচ্ছে বিশৃঙ্খল হয়ে। এ রকম সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করা ভারতের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়তেই পারে।   ১৯৭১ সালে ভারতের সেনাবাহিনী যতটা সুশৃঙ্খল ছিল, এখন তা আছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে না। ভারতের পত্রিকার খবরে প্রকাশ, নকশালরা ব্যবহার করছে স্থল মাইন। এই স্থল মাইন তারা কিনেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। ভারতের সেনাবাহিনী অস্ত্র বিক্রি করছে নকশালদের কাছে। যেটা ১৯৭১ সালে শোনা যায়নি। ‘৭১-এর হাতিয়ার গর্জে উঠার ক্ষেত্রে তাই এখন অনেক বাধার সৃষ্টি হতে পারে। ভারত সেসব বাধাকে সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই নতুন প্রজন্ম ইচ্ছা করলেই ১৯৭১ সালের মতো কোনো হাতিয়ার গর্জে ওঠার সম্ভাবনা এখন আর বিদ্যমান নেই।   এবার ২১ ফেব্র“য়ারিতে প্রধানমন্ত্রী বললেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন ছিল আমাদের স্বাধীন হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান আমলেই সাফল্য পেতে পেরেছিল। এর সাথে পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহকে এক করে দেখা যায় না। ১৯৭১ সালে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হবে কি হবে না, সেটা নিয়ে। ভাষার বিরোধ এখানে কোনো বিষয় ছিল না। তাই বলা যায় না, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছার প্রকাশ। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের ইতিহাসকে নানাভাবে বিকৃত করে উত্থাপন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রথম শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। এ সময় শেখ মুজিব এতে কোনো অংশগ্রহণ করেননি। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিব ছিলেন জেলে। ইচ্ছা থাকলেও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কোনো অংশ নেয়া। কিন্তু যে কথাটা আজ ভুলে যাওয়া হচ্ছে, তা হলো আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিল না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ শহরে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বলেন, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে উর্দুই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তাই আজ যখন শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রভাষার অংশী, তখন সেটাকে ইতিহাসভিত্তিক বলা চলে না। আর তিনি যখন বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্ব, সেটাও সমর্থন করা চলে না ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই। ১৯৫২ সালে আমরা বলেছিলাম উর্দু-বাংলা ভাই ভাই, উর্দুর পাশে বাংলা চাই। এর বেশি আমাদের কোনো দাবি ছিল না সেদিন। আজ বামপন্থীরা দাবি করছেন যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল তাদের দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ইতিহাস কিছু ভিন্ন কথাই বলে। কারণ, পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ছিলেন সাজ্জাদ জাহির। তিনি ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের লোক। তিনি উত্তর প্রদেশ থেকে হিজরত করেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি বলেন, উর্দুই হওয়া উচিত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। অবশ্য তার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু কমিউনিস্ট নেতা পোষণ করেছিলেন ভিন্নমত। তবে এই উপমহাদেশে কমিউনিস্টরা তখন সাধারণভাবে বলছিলেন-   ইয়ে আজাদী ঝুট্টা হ্যায়   লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।   অর্থাৎ ইংরেজ চলে যাওয়ায় এই উপমহাদেশ স্বাধীন হয়নি। কারণ লাখ লাখ মানুষ এখনো থাকছে অভুক্ত হয়ে।   পূর্ব পাকিস্তানে যখন হচ্ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, তখন কিছু বামপন্থীকে বলতে শোনা গিয়েছিল- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হচ্ছে একটা বুর্জুয়া ব্যাপার। এর সাথে মানুষের ভাত কাপড়ের সমস্যার সংযোগ নেই। আমাদের আন্দোলন করতে হবে জনগণের ভাত কাপড়ের দাবি নিয়ে; ভাষা নিয়ে নয়। ভাষা নিয়ে আন্দোলন কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশ হতে পারে না। কিন্তু আজ বামপন্থীরা দাবি করছেন, তাদের পূর্বসূরিরা করেছিলেন ভাষা আন্দোলন। কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদী নন। তারা হলেন, শ্রেণী সংগ্রামবাদী। জাতীয়তাবাদ আর শ্রেণী সংগ্রামবাদ পৃথিবীর নানা দেশেই এক হতে পারেনি। গোটা মার্কসবাদে স্থান পেতে পারেনি জাতি সমস্যা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের অনেক কথাই এখন চেপে যাওয়া হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেছিল তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল প্রধানত ইসলামপন্থী ছাত্রদের নিয়ে। কিন্তু এখন তাদের কথা বলা হচ্ছে না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এদের কথা চেপে যাওয়া হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তখন জিন্নাহ সাহেব বেঁচে ছিলেন। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনতার উদ্দেশে উর্দুকে কেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা উচিত, সে সম্পর্কে বক্তৃতা দেন, ইংরেজি ভাষায়। কারণ উর্দু ভাষা তিনি ভালো করে বলতে পারতেন না। এর পর তিনি ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা উচিত বলে যে ভাষণ দেন, তা-ও তিনি দিয়েছিলেন উর্দুতে নয়, ইংরেজি ভাষায়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তার বক্তৃতার মধ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন। যেসব ছাত্র প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের মধ্যে গোলাম আযম ছিলেন একজন। তিনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিএস হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে প্রদান করেন বিশেষ ‘মেমোরেনডাম’। যাতে বলা হয়- কেবল উর্দুকে নয়, বাংলাকেও দিতে হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি। গোলাম আযম এ সময় জামায়াত-ই ইসলামীর সাথে যুক্ত ছিলেন না। ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা ছাত্রনেতা। পরে তিনি চাকরি নিয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজে যান। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কথা বলার কারণে হারান তার চাকরি। বর্তমানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তার অবদানকেও এখন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাকে প্রচার করা হচ্ছে কেবলই একজন রাজাকার হিসেবে।   ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, তার বিখ্যাত লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে গ্রহণ করে। এই দাবি উত্থাপন করেছিলেন, তখনকার বাংলার বিখ্যাত নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ১৯৪১ সালে জনাব সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী গঠন করেন জামায়াত-ই-ইসলামী দল। মওদুদী পাকিস্তান প্রস্তাবকে সমর্থন করেন না। তিনি বলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে উপমহাদেশের মুসলমানেরা দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়বে। বিরাট সংখ্যক মুসলমানকে থেকে যেতে হবে ভারতে। তারা যেতে পারবেন না পাকিস্তানে। ভারতীয় মুসলিমদের পড়তে হবে ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে। পক্ষান্তরে পাকিস্তান না হলে এই উপমহাদেশের মুসলমানেরা এক হয়ে তাদের দাবিদাবা অনেক সহজেই পূরণ করতে পারবেন। পাকিস্তানের দাবি তাই এই উপমহাদেশের মুসলিম স্বার্থের সমর্থনীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর মওদুদী চলে আসেন পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭১-এ জামায়াত মনে করে, ভারত চাচ্ছে, পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে, যা হবে মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর। জামায়াত তাই গ্রহণ করে সাবেক পাকিস্তানকে অখ- রাখার নীতি। গোলাম আযম সমর্থন করেন তার দলের এই নীতিকে। যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করতেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যথেষ্ট সুবিচার করছে না। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারছে, তা দূর করা প্রয়োজন।   আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাষাসৈনিক ছিলাম না। তবে এই আন্দোলনকে দেখেছি অনেক কাছে থেকে। আর পাঁচজন সাধারণ ছাত্রের মতো বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দিয়েছি সমর্থন। কিন্তু এই আন্দোলন ঘটেছিল আমার চোখের সম্মুখে। আজ যেভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে, সেটাকে আমার কাছে মনে হয় যথার্থ নয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে পৃথক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন ছিল না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে। তার বাইরে নয়। বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদের শতকরা ৬০ ভাগ বাস করেন বর্তমান বাংলাদেশে। আর বাদবাকি ৪০ ভাগ বাস করেন ভারতে। ভারতের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে ঘটেনি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কোনো আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমিত। আজ পশ্চিম বাংলা থেকে কবীর সুমন এসে শাহবাগ চত্বরে গিটার বাজিয়ে গান করছেন। বলছেন, কোনো দেশের সীমানা তিনি মানেন না। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোক। পশ্চিমবঙ্গ একটি স্বাধীন দেশ নয়। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি প্রদেশ মাত্র। বাংলাদেশ যদি পশ্চিম বাংলার সাথে যোগ দেয় তবে বাংলাদেশও হয়ে পড়বে ভারতেরই অঙ্গরাজ্য। তার কোনো স্বাধীন সত্তা বজায় থাকবে না। সুমনের গানের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝার জন্য খুব বড় রকমের বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন করে না। সুমনের গান করা উচিত পশ্চিমবঙ্গকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। তারপরে ভেবে দেখা যেতে পারে, দুই বাংলার যৌথ স্বার্থের কথা; তার আগে নয়।   শাহবাগ চত্বর থেকে অনেক কথায় বলা হচ্ছে। যার অর্থ আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন নয়। বলা হচ্ছে, জামায়াতই ইসলামীকে বে আইনি করার কথা। কিন্তু কোনো দলের জনসমর্থন থাকলে তাকে বে আইনি করে খুব একটা ফায়দা হয় না। ভারতে হিন্দু মহাসভাকে বে আইনি করার কথা উঠেছিল। হিন্দু মহাসভা রাতরাতি পরিণত হয় জনসঙ্ঘ নামে একটি দলে। পরে জনসঙ্ঘ আবার পরিণত হয় ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি)। বিজেপি এখন হয়ে উঠেছে কংগ্রেসের প্রকৃত প্রতিপক্ষ। আগামী নির্বাচনে জিতে সে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতেও পারে। এ যাবত ভারতে যারা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাদের মধ্যে বিজেপির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী হয়ে আছেন বিশেষভাবে খ্যাত। জামায়াতকে বে আইনি করতে গেলে সে-ও নাম বদলে নতুন দলে পরিণত হতে পারে; যেমন হয়েছে ভারতে হিন্দু মহাসভা দল।   ধর্ম নানা দেশের ইতিহাসকেই প্রভাবিত করেছে এবং করছে। আমাদের বাড়ির কাছে মালয়েশিয়া একটি গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হলো ইসলাম। অনেক দেশেরই রাষ্ট্রধর্ম আছে। রাষ্ট্রধর্ম আছে ইংল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্কের মতো গণতান্ত্রিক দেশে। এসব দেশের মানুষ ধর্মান্ধ নয়। কিন্তু এদের মধ্যে কাজ করে চলেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। রাষ্ট্রিক আইন গড়ে ওঠে মূল্যবোধের ভিত্তিতে। আর ধর্মবিশ্বাস হলো এখনো মানুষের মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান উৎস। শাহবাগে আন্দোলন বিশেষভাবে ধাক্কা খেল ব্লগার রাজিবের কারণে। শাহবাগের আন্দোলন এখন মুসলিম জনসমাজের কাছে মনে হতে পারে একটি ইসলামবিরোধী আন্দোলন হিসেবে। সব গণতান্ত্রিক দেশেই সংখ্যাগুরু জনসমাজের থাকে একটা বিশেষ ভূমিকা। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এখানে ইসলামকে খাটো করে আন্দোলন করতে গেলে, তা মানুষকে সাধারণভাবেই ক্ষুব্ধ করে তুলতেই পারে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কী চাচ্ছে, সেটা আমাদের কাছে পরিচ্ছন্ন নয়। তারা বলছে, আলবদর, রাজাকারদের ঠাঁই হবে না বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশে কাদের ঠাঁই হবে, আর কাদের ঠাঁই হবে না, সেটা কি কেবল ঘাদানিকেরাই ঠিক করে দিতে পারবে? তাদের প্রতিপক্ষরা সংখ্যায় খুব কম নয়। তারা বেঁচে নেই ঘাদানিকদের দয়ার ওপর। এটাও উপলদ্ধি করা প্রয়োজন। শাহবাগ চত্বরে প্রচুর শিশুর সমাগম ঘটছে। তারা অনেক কিছুই বলছে। জেনেভা কনভেন অনুসারে শিশুদের যুদ্ধে ব্যবহার যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য। শাহবাগ চত্বরে তাই শিশুদের ডেকে এনে তাদের দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা যথাযথ বলে মনে হচ্ছে না। অনেকে বলছেন, শাহবাগের গণজাগরণ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করছে। কিন্তু, আমার কাছে মনে হচ্ছে, শাহবাগে যা ঘটছে, তা জাতিকে গুরুতর বিভক্তির দিকেই ঠেলে দিতে পারে। মারদাঙ্গার রাজনীতি আমাদের কাম্য হতে পারে না। কেননা তা হয়ে উঠবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিশেষ প্রতিবন্ধক।   লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *