”কোরআন অনলি”- কেন সম্ভব নয়? ( ১ম পর্ব)

সংলাপব্লগ ও সদালাপের মুসলিম পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য “কোরআন অনলি” বিষয়ে ফারুক নামের জনৈক ব্লগারের একাধিক পোষ্টের বিপক্ষে প্রচুর সমালোচনা এসেছে এবং এ বিষয়ে এম আহমেদ ভাই ফারুক সাহেবের সমুচিত জবাব দিয়ে পাল্টা পোষ্ট দিয়েছেন।ফারুক সাহেবের পোষ্টের জবাবে এম আহমেদ ভাইয়ের ২য় পোষ্টার শিরোনামটাও একেবারে উপযুক্ত হয়েছে।
এই “কোরআন অনলি”রা যে আসলেই ভণ্ডামিতে লিপ্ত সে বিষয়ে গতকাল আমার বন্ধু ওয়াহিদুর রহমান সাহেবের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। সে আলাপে ওয়াহিদ সাহেবের কিছু মন্তব্য ও আমার কিছু অনুসন্ধানী তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমি এ পোষ্টটি লিখেছি।

সাধারণ মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করার এ হীন উদ্দেশ্যে ইসলামে হাদিস ছাড়া কোরআন অনলির পক্ষে থাকার বক্তব্য প্রচারে একটি বিশেষ গুষ্টি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক দিন থেকেই তৎপর কিন্তু সুবিধা করতে পারছে না। বাংলা ব্লগে যারা এ ধারনা ছড়াতে চায় এটা তাদের নতুন কোন আবিষ্কার নয়। তবে এদের থেকে মুসলিমদেরকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বের ইসলামী স্কলার শিয়া সুন্নির সবাই এবং তাদের অভিমত হল ইসলামে কোনভাবেই হাদিস ছেড়ে শুধু কোরআন অনলি মতবাদ গ্রহনযোগ্য নয়। কেননা এটি একটি ভ্রান্ত মতবাদ ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ইসলামের শত্রুদের এ এক অপ্রয়াস!
আল্ আহজার বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রখ্যাত আলেমদের মতে যারা শিয়া ফিকাহকেও ইসলামের ৫ম মাজহাব (school of Islamic thought) হিসাবে গ্রহণ করেন তাদের মতে “কোরআন অনলিরা” অমুসলিম।
ড: ইউসুফ আলবাদরি ( Member, Higher Assembly of Islamic Affairs,Egypt ) বলেন, কোরআন অনলিরা যদিও বলে কোরআনকে মানে কিন্তু তারা কোরআনের আয়াতে যে বলা হয়েছে “He who obeys the messenger obeys God?” তা মানতে চায়না! যারা নবীকে মানেনা নবীর সুন্নাহকে অস্বীকার করে শুধু কোরআন নিয়ে থাকতে চায় এরা বিপথগামী, মুরতাদ বা apostates. ড: ইউসুফ আলবাদরির শেষ কথা হল “কোরআন অনলি” বা “কোরানিষ্টরা” ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ইসলামের দুশমনদের পক্ষে মুসলিম সমাজে স্পাই তথা গুপ্তচরের ভূমিকায় লিপ্ত কিন্তু আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে ইসলামকে তিনি অবশ্যই হেফাজত রাখবেন। শেখ আল আজহার, ড: মোহাম্মদ সাইয়িদ তানতায়ী এদের জবাবে বলেন, যারা কোরআন অনলির পথে আহ্বান করে তারা মূর্খ, মিথ্যুক এবং ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে অজ্ঞ …”
Dr. Mohamed Sayed Tantawy, the Sheikh of AL-Azhar replied saying that those who call for relying only on the Quran are ignorant, lairs, and do not know religious rules because the ideas in the Sunna came from God, but it was put into words by the prophet (Peace be upon him). Moreover, Sunna explains and clarifies the rules mention as in the holy Quran.
(আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্কলারদের মন্তব্য জানতেএখানে দেখুন)
Contemporary scholars such as Gibril Haddad have commented on the apostatic nature of a wholesale denial of the probativeness of the Sunnah according to Sunni Orthodoxy, writing “it cannot be imagined that one reject the entire probativeness of the Sunna and remain a Muslim”.

The Grand Mufti of Pakistan Muhammad Rafi Usmani has also criticised Qur’anists in his lecture Munkareen Hadith (refuters of Hadith); he states:
The Qur’aan, which they claim to follow, denies the faith of the one who refuses to obey the Messenger (peace and blessings of Allaah be upon him) and does not accept his ruling: “But no, by your Lord, they can have no Faith, until they make you (O Muhammad) judge in all disputes between them, and find in themselves no resistance against your decisions, and accept (them) with full submission.” [al-Nisa’ 4:65 – interpretation of the meaning]

ইসলামে কেন সম্ভব নয়?
কোরআন অনলিদের সবচেয় বড় ডিলেমা বা উভয়-সংকট হচ্ছে যে বিষয়ে আর আসলে চিন্তা করলে দেখা যায় সেটাই হচ্ছে অন্যতম কারণ যে জন্য ইসলামকে কোন দিন পরিবর্তন বা সংস্কার করা সম্ভব নয়।
কোরআন স্পষ্টত ঘোষণা দেয় যে এটা সম্পূর্ণটা আল্লাহর কালাম আবার সে কোরআনই মুসলিমদেরকে হুকুম দেয় রাসুলের অনুসরণ করতে।
“He who obeys the Messenger, obeys Allah: But if any one turn away, We have not sent thee to watch over their (evil deeds).” Qur’an 4:80
এখন কেউ যদি জানতেই চায়না মোহাম্মদ (স:) কি হুকুম পালন করতে বলেছেন তা হলে কোরআনে আল্লাহর দেয়া উপরুক্ত হুকুম পালন করা অসম্ভব। অতএব কোরআনের নির্দেশমতো মুসলিমকে নবীর অনুসরণ করতেই হবে এবং সে উদাহরণ একমাত্র নবীর সুন্নাতের মাঝেই বিদ্যমান আর হাদিস ছাড়া সুন্নাহর তথ্য পাওয়ার কোন বিকল্প রাস্তা নাই।
সুরা আহযাবে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন:
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলিল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা (উসুওয়াতুল হাসানা) রয়েছে।
(৩৩:২১) হাদিস না জেনে রাসুলের চরিত্রের উত্তম আদর্শের কথা কিভাবে জানা যাবে?
কোরআন অনলিরা “হাদিস বুঝতে” না পারলেও (?) আজ থেকে ১৪০০ শত বছর ধরে ইসলামী জগতে বিভিন্ন যুগে হাজার হাজার স্কলাররা অসংখ্য বই পুস্তক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন যার মাধ্যমে যারা হাদিস বুঝতে চান তাদের কোন অসুবিধা হয়নি বা হবেও না ইনশাআল্লাহ। আর যে সব হাদিস নিয়ে প্রশ্ন তুলে কোরানিষ্টরা সকল হাদিসের প্রয়োজনিয়তা বিসর্জন দিতে চায় তার সমাধানও মুসলিম স্কলাররা অনেক আগেই করে গেছেন। কোরআন অনলিদের কাছ থেকে মুসলিমদের শিক্ষা নিতে হবে না।

কেন কোরআন অনলি ইসলামে সম্ভব নয় তা বিভিন্ন পর্বে ব্যখা করার চেষ্ট করব ইনশা আল্লাহ তবে তার আগে আজকের পর্বে ইসলামের কন্সেপশন ক্লিয়ার করার জন্য কিছু বেসিক বিষয় আলোচনা করতে চাই।

প্রসঙ্গবহির্ভুতভাবে অর্থাৎ out of context কোর’আন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে কোরআন অনলিরা যেভাবে বক্তব্য উপস্থাপনা করেন তা কোরআন-সূন্নাহ্র ব্যাপারে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

সুরা আন্ নিসার ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন ” হে বিশ্বাসী গন! তোমরা মাতাল বা মানসিক ভাবে অস্বচ্ছ অবস্থায় নামাজের কাছে যেও না, যতক্ষণ না তোমরা কি বলছ তা বুঝতে পার, আর ভ্রমণের সময় ছাড়া অপবিত্র অবস্থাতেও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা গোসল কর। আর যদি তোমরা অসুস্থ থাক বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ পায়খানা-প্রস্রাব কর, বা স্ত্রী সহবাস করার পর পানি না পাও, তবে তাইয়াম্মুম করবে পরিষ্কার মাটি দিয়ে ও তা মুখে হাতে বুলিয়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাপ মোচন কারী ক্ষমাশীল।”

এই আয়াতের মাধ্যমে অবশ্যই বুঝা যায় যে স্ত্রী সহবাসের পর গোসল করা ফরজ হলেও পানি না পাওয়া গেলে নামাজ পড়ার জন্য তাইয়াম্মুম করা জায়েজ করা হয়েছে। হেদায়েত প্রতিপালনের জন্য বিধি-বিধানের এই পার্থক্য কন্টাডিকশন নয় কন্ডিশন। কন্ডিশন অর্থাৎ অবস্থা বা শর্ত বিবেচনা করে হেদায়েত প্রতিপালনের জন্য এরকম ব্যতিক্রম বা ফ্লেক্সিবিলিটির ব্যবস্থা রেখেই ইসলামকে সকল যুগের সকল মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে। কোর’আন-সূন্নাহ্ মুসলমানদের জন্য সংবিধান। অন্যান্য আইনের মতো হেদায়েত প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের জন্য অনেক কিছুই স্বতঃ:সিদ্ধ রাখা হয়নি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী বিধান অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে মুসলমানদের প্রায় সকল কাজেরই হারাম-হালালের ব্যাপারে ব্যতিক্রম আছে। যেমন ভ্রমণ অবস্থায় ফরজ নামাজ চার রাকাতের স্থলে দু’রাকাত পড়তে হয়। ইসলাম সকল যুগের সকল পরিস্থিতির সাথে মানান সই একটি ধর্ম। আদেশ-নিষেধ বা হেদায়েত প্রতিপালনের ক্ষেত্রে এরকম ফ্লেক্সিবিলিটি না থাকলে ইসলামকে ইউনিভার্সাল ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হতোনা।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই ব্যতিক্রম বা ফ্লেক্সিবিলিটি বুঝার জন্য কোর’আন-সূন্নাহ্র উপর যে জ্ঞান থাকার দরকার তা এখন মুসলিমদের মাঝে খুবই কম পরিলক্ষিত হয় যার ফলে ইসলামের শত্রুরা সুযোগ পায় মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করতে তাই মুসলিম সমাজে কেউ হচ্ছে চরমপন্থি আর কেউ হচ্ছে নরমপন্থী তথা সেকুলারিষ্ট অথচ ইসলাম হচ্ছে মধ্যপন্থী একটি জীবন ব্যবস্থা। অধিকন্তু প্রায় সর্বত্রই মুসলিমরা এখন হচ্ছে কালচারাল মুসলিম। ফলে ইসলামের উপর প্রাইমারী এডুকেশন নেই এমন লোকও পিএইচডি লেভেলের বিষয় হেন্ডলিং করতে গিয়ে প্রতিদিন বিভ্রান্ত হচ্ছে। আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিবিড় তথ্য বুজার জন্য মানুষের দু’টো গুনাগুণ থাকা প্রয়োজন। (১) মানুষিক পরিপক্বতা তথা ম্যনটেল মেচিউরিটি যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়, এবং (২)জ্ঞান বৃদ্ধি বা নলেজ ডেভোলাপমেন্ট যা অর্জন করতে হয় ‘ষ্টেপ-বাই-ষ্টেপ’ অর্থাৎ ধাপে ধাপে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেহ যদি ধাপে ধাপে জ্ঞানের উন্নয়ন সাধন না করে তাহলে বয়স ২৫ বছর হলেও পিএইসডি’র পড়া বুঝা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। ইসলাম মানুষের সারা জীবনের জন্য একটি পরিপূর্ণ কোর্স। কিন্তু মুসলিমদের অনেকেই আজকাল ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ ‘বিসমিল্লাহ্’ ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক শিক্ষার উপর বিশেষ জ্ঞান রাখে না। এমতাবস্থায় ‘ক্লাস ওয়ান’ এর সমতুল্য জ্ঞান নেই এমন কেহ যদি ইসলামের ‘পিএইসডি’ ধরনের বিষয় বস্তু নিয়ে প্রশ্ন করে তাহলে এমন প্রশ্নে যে সে নিজে বিভ্রান্ত হবে অন্যান্যদেরকেও বিভ্রান্ত করবে তা সন্দেহাতীত ভাবে সত্য হতে বাধ্য।
আমার এক বন্ধু বাংলাদেশে তার এক অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছিলেন তা হল তিনি দেশে একবার তার এক বন্ধুর ছেলে ধর্ম নিয়ে তাকে একটি উঁচু ধরনের প্রশ্ন করেছিল। তিনি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তার কাছ থেকে এক ঘণ্টা সময় চেয়েছিলেন ধর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার জন্য। এক ঘণ্টা পর সে ওনাকে বলল ‘আপনি তো আমার প্রশ্নের উত্তর জানেন, তাহলে বলছেন না কেন?’ তিনি তাকে বললেন ‘তুমি যে বুঝতে পেরেছ তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা রয়েছে এই মুহূর্তে তোমার ও আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এটা একটি উঁচু স্তরের প্রশ্ন। এর উত্তর বোঝার জন্য কোর’আন-সূন্নাহ্’র উপর তোমার আরো লেখা পড়া করার দরকার। আর লেখা পড়া করলে তোমার নিজের পক্ষেই একদিন এর উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু আমি যদি এর উত্তর তোমাকে বলতে যাই, তুমি প্রশ্ন করা শুরু করবে। এবং প্রশ্ন করতে করতে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়ে যেতে পার যে পর্যায়ে গেলে তোমার ঈমান প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই তোমাকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর জন্য আমি এই মুহূর্তে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিনা।’

আসলে মানুষের পক্ষে অনেক সময় মানুষের তৈরি বিধি-বিধানই সঠিক ভাবে বুঝা সম্ভব হয় না। কোর্টে আইনের একই ধারা নিয়ে দুই উকিল দু’ভাবে যুক্তি উত্থাপন করে, কিন্তু বিচারক একটাকে গ্রহণ করে অন্যটাকে পরিত্যাগ করে থাকে। কোর’আন-সূন্নাহ্ আল্লাহ্ প্রবর্তিত বিধি-বিধান। মানুষের সসীম জ্ঞান দিয়ে আল্লাহ্র এই অসীম জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করা এত সহজ মনে না হলেও আল্লাহ্ কোর’আন-সূন্নাহ্ মানুষের বুঝার জন্য সহজ করেই প্রবর্তন করেছেন (সুরা কমর: ৫৪/১৭,২২,৩২,৪০)। তাই একটু সময় নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলে কারো পক্ষেই কোর’আন-সূন্নাহ্ বুঝা ও মনে রাখা অসম্ভব নয়। তবে এজন্য মানুষের তৈরি বিধি-বিধান বুঝার জন্য আমরা যে সময় ব্যয় করে থাকি অন্তত: তার চেয়ে কম সময় ব্যয় করা ঠিক নয়। আর এটাও ঠিক নয় যে ‘উকিল না হয়ে আমরা ধর্মীয় বিধি-বিধানের ব্যাপারে উকিলের মতো তর্ক করি। আল্লাহর আইন না মেনে মানুষের কোন গত্যান্তর নেই। তাই আসুন তর্ক না করে আমরা আল্লাহর আইন অনুশীলনের জন্য সঠিক ভাবে তা অনুধাবন করার কাজে একে অন্যকে সহায়তা করি। মনে রাখবেন ‘বিশ্বাসে মিলায় স্বর্গ তর্কে বহু দূর’ প্রবচনটি একেবারে অমূলক নয়। নিয়ত ঠিক থাকলে আল্লাহ্ কোন কাজেই মানুষকে পরাভূত হতে দেয় না। ডঃ জেফরি লেং আমেরিকার একটি স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটির মেথম্যাটিক্সের প্রফেসর। তিনি কেথলিজম ছেড়ে বিভিন্ন ধর্মচর্চা করতে গিয়ে নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলেন। দৈবাৎ তাঁর কোর’আনের সহিত পরিচয় ঘটে। সূরা বাকারার ৩০নং আয়াত পর্যন্ত পড়ে তিনি তাঁর আজন্ম লালিত অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি মেথম্যাটিক্সের মতো এনালাইস করে পুরো কোর’আন অধ্যায়ন করেন। তিনি বলেছেন ‘কোর’আনের প্রতিটি আয়াত পূর্বের আয়াতে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দেয় এবং নূতন প্রশ্ন উপস্থাপন করে। এই ভাবে আয়াতের পর আয়াতে উত্থাপিত প্রশ্ন-উত্তর সমাধান করে যখন তিনি কোর’আনের সর্বশেষ আয়াতে পৌঁছালেন তখন তার সকল প্রশ্নের সমাধান হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন ঘাত-সংঘাতময় এই পৃথিবীতে মনুষ্য জন্মের উদ্দেশ্য। তাঁর লেখা ‘ষ্ট্রাগলিং টু সারেন্ডার’, ‘ইভেন এঞ্জেল নিউ’, ‘লুজিং মাই রিলিজিয়ন’ ইত্যাদি বই গুলো পড়লে অনেকেই কোর’আন-সূন্নাহ্ সঠিক ভাবে অধ্যয়নের অনুপ্রেরণা পাবেন এবং খুঁজে পাবেন আপনার মনুষ্য জন্মের মর্ম কথা।
তবে হাদিসের ব্যাপারে যে অনেক সমস্যা রয়েছে তা একেবারে অসত্য নয়। হজরত আলীর পর ইসলাম উমাইয়্যা-আব্বাসিয়দের হাতে পড়ে গিয়েছিল এবং বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল শিয়া-সুন্নি দু’ভাগে। তখন সবাই সবার কাজকে জাষ্টিপাই করার জন্য যে বেঠিক হাদিস তৈরি করেনি তা কেহ হলফ করে বলতে পারবে না। হাদিসের প্রেক্ষাপট, সঙ্কলন, ভাষান্তর ইত্যাদি সংরক্ষণের মধ্যেও রয়েছে অনেক লিমিটেশন। কিন্তু যত লিমিটেশনই থাকুক মনে রাখবেন, জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকার দায়িত্ব আল্লাহ্ আমাদের উপরই ছেড়ে দিয়েছেন (সুরা তাহ্ রীম : ৬৬/৬)। কোর’আন মুসলমানদের হেদায়েতের মৌলিক গ্রন্থ। সূন্নাহ্ হেদায়েত কিভাবে প্রতিপালন করতে হবে তার উপর রাসুল (সাঃ) এর প্রত্যক্ষ ডেমোনেষ্ট্রেশন। এজন্যই মোহাম্মদ (সঃ) কে জীবন্ত কোর’আন বলে অভিহিত করা হতো। কালের বিবর্তনে এই ডেমোনেষ্ট্রেশনের বিষয়টি নিয়ে কিছু কিছু মতভেদ সৃষ্টি হলেও সম্পূর্ণ ভাবে তা হারিয়ে যায়নি। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য কোর’আন এখনো আমাদের সামনে অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। ফলে কোন হাদিস যদি কোর’আনের সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে তাহলে তা পরিহার করে চলার সুযোগ অবশ্যই আমাদের রয়েছে। অপরদিকে হেদায়েত নিয়ে যত প্রকার মতপার্থক্য তার বেশীর ভাগই হেদায়েতের প্রয়োগ ‘কিভাবে’ হবে তা নিয়ে। কিন্তু হেদায়েত ‘কি’ এবং ‘কেন’ আমরা হেদায়েত পালন করি তা নিয়ে খুব বেশী মতপার্থক্য নেই। আর এই ‘কি’ এবং ‘কেন’র বিষয়টি কোর’আনই আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাই কোর’আন জানা থাকলে হেদায়েত প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ‘কিভাবে’ ইস্যু নিয়ে যে ছোটখাটো পার্থক্য আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে গুরুত্বহীন হয়ে যেতো। মনে রাখবেন, ইসলাম রীতি সর্বস্ব কোন ধর্ম নয়। মুসলমানদেরকে জীবনের প্রতিটি কাজ আল্লাহর আইন অনুযায়ী সম্পাদন করে বেহেস্ত লাভের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। একাজে, কোর’আন ও সূন্নাহ্ একটাকে বাদ দিয়ে আর একটা হয় না বলেই মোহাম্মদ (সাঃ) বিদায় হজ্জ্বে আমাদেরকে কোর’আন-সূন্নাহ্ মেনে চলতে বলেছেন। সূন্নাহ্ সমূহের সঙ্কলনকে আমরা হাদীস বলে অভিহিত করে থাকি। হাদিস সঙ্কলনের মধ্যে যদি কোন ভুল ভ্রান্তি থাকে তা সংশোধন করার দায়িত্ব আমাদেরই। কিন্তু সংকলন যদি সঠিক থাকে এবং আমার তা বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে বিশ্বাসী হিসাবে হাদিস অস্বীকার করার অধিকার কোন মুসলমানের নেই। ক্লাসের অনেক পড়া-লেখিতও আমাদের বোধগম্য হয় না। তাই বলে শিক্ষক বা শিক্ষার কোন উপাদানকে আমরা ভুল বলে অভিহিত করি না। একই ভাবে কোর’আন-সূন্নাহ্র ব্যাপারে আমাদের অসহিষ্ণু হওয়া উচিত নয়। আগেই বলা হয়েছে যে ইসলাম সর্বকালের সকল পরিবেশের সহিত মানানসই একটি ধর্ম। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একই হেদায়েতের প্রয়োগ বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন রকম হতে পারে। তাই আমাদের উচিত এরকম পার্থক্যের মধ্যে অসংগতি না খুঁজে অসঙ্গতির কারণ খুঁজে বের করে যথাযথ ভাবে হেদায়েত প্রতিপালন করা। আল্লাহ বলেন
يُرِيدُونَ لِيُطْفِؤُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
তিনি তাঁর রসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্য-ধর্ম নিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে একে সবধর্মের উপর প্রবল করে দেন যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
(সুরা ৬১: ৮-৯)
ইসলামকে আল্লাহ অবশ্যই হেফাজত করবেন এতে কোন সন্দেহ নাই তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে আমরা নিজেরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে কতটুকু সচেষ্ট হচ্ছি?
(চলবে)

Loading


Comments

”কোরআন অনলি”- কেন সম্ভব নয়? ( ১ম পর্ব) — 3 Comments

  1. আমি শুনলাম যে শিয়াদের আকিদার মধ্যে সমস্যা আছে। কারন তারা বলে যে নাবী করিম(সাঃ) এর ইন্তেকালের পর ৩ জন সাহাবী ছাড়া বাকী সবাই মরতাদ হয়ে গিয়ে ছিল। তাহলে তাদের আকিদা কি ভাবে সঠিক হল…? যেখানে আল্লাহ্‌ তালা পবিত্র কুরআনে সাহাবিদের প্রতি রাজী খুশি হয়েছেন আর নবী করিম(সাঃ) ও বলেছেন যে , যারা আমাকে ও আমার সাহাবীকে অনুসরণ করবে তারাই সঠিক পথে থাকবে, সেখানে শিয়ারা সাহাবিদের প্রতি খুশি না, তাহলে তারা কি ভাবে মুসলমান হল…?

  2. অশেষ ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
    কোরআন অনলিরা হাদিস ছেড়ে শুধু কোরআন মানার কথা বলে কিন্তু কোরআনকেই যে অস্বীকার করছে তা জেনেও তারা এসব প্রচার করে ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে।

  3. ১। অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে এই কাজের সওয়াব দান করুন এবং এই দানের মাত্রা ৭০ গুন বাড়িয়ে দিন

    ২। ‘উকিল না হয়ে ধর্মীয় বিধি-বিধানে উকালতি …’ একান্ত নির্লজ্জ না হলে এমনটা কে করতে পারে? আরব জগতে এই চক্রান্তের পিছনে কিছু অভিশপ্ত লোক টাকা ঢালছে। যখন দেখা যায় যে কোন মূর্খ কোরান অনলি গান গাইতে গিয়ে চরম মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে, তারপর চড়-থাপ্পড় খাচ্ছে, তবুও নির্লজ্জভাবে সেই মুর্খামি চালিয়ে যায়, তখন আশ্চর্য হতে হয় তখন এটাও মনে হয় যে হয়ত এতেই তার রুটি-রুজি।

    ৩। এই কোরান অনলিরা মুরতাদ হওয়ার বিজ্ঞ অভিমত (ফতোয়া) পাওয়া গেল। যাদের কাছে রাসূলের প্রয়োজন নেই, যারা সুন্নাহকে অস্বীকার করে, কোরানকে পরিবর্তিত ভাবে, সাহাবিদেরকে (রা), মুহাদ্দিসদেরে, ফকিহদের বিষোদগার করে, এরা তো মুরতাদই। মুরতাদ হওয়ার পর স্ত্রী তালাক হয়ে যায়, মুরতাদের জানাযা করা যাবে না, মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন/কাফন করা যাবেনা। মুসলমানের মুখোশধারিদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না। তারা তো আল্লাহর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং রসূলের প্রতিও। বস্তুত: তারা না ফরমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে।’

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *