অস্ত্র মামলার রায় এবং ফরজ ও নফলের গল্প

 

অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা নিয়ে কিছু না বললেই নয়। শনিবার ১ ফেব্র“য়ারি ২০১৪ দিবা শেষে, রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত টেলিভিশন চ্যানেল ৭১ টিভিতে লাইভ টকশোতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। মূল স্টুডিওতে পূর্ণ দুই ঘণ্টা সময় নিজে উপস্থিত ছিলাম; পূর্ণ এক ঘণ্টা মাত্র উপস্থিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী; এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী। মোয়াজ্জেম আলী চলে যাওয়ার পর মূল স্টুডিওতে যোগদান করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহিদুজ্জামান; মোহাম্মদ আলী বিদায়ের পর স্টুডিওতে যোগদান করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ। মূল স্টুডিওর বাইরে অন্যত্র তথা লিঙ্ক-স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন পূর্ণ দুই ঘণ্টা মেয়াদে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের সিনিয়র সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক এবং এক ঘণ্টা পরে যোগদান করেছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর আব্দুর রব খান। আলোচনাটি পুনঃপ্রচার হয়েছিল কয়েক ঘণ্টা পরই অর্থাৎ ২ ফেব্র“য়ারি রোববার ভোর রাত ১:২৫ মিনিট থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার জন্য। আবার প্রচার হওয়ার কথা ছিল রোববার সকাল ৯:৩০ থেকে। কিন্তু টঙ্গী ইজতেমা মাঠ থেকে মুনাজাতপূর্ব এবং মুনাজাতের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করার কারণে দ্বিতীয়বারের মতো পুনঃপ্রচার হয়নি। মোয়াজ্জেম আলী, মোহাম্মদ আলী, আব্দুর রশিদ, সাহিদুজ্জামান, আব্দুর রব খান বা জুলফিকার আলী মানিকের মতামত বা বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারছি না স্থান অভাবের কারণে। কিন্তু মতামতগুলোর প্রতি আমার সম্মান পুনর্ব্যক্ত করছি। ওই টকশোতে যা বলেছিলাম তার কিছু অংশকে মাত্র, গুছিয়ে এখানে আবার উপস্থাপন করছি। কারণ টকশোর কথা যদি ইউটিউব-জাতীয় কোনো কিছুতে স্থান পায় তা হলে সাময়িকভাবে কিছু দিনের জন্য এর আয়ু বৃদ্ধি পায়; অন্যথায় সেটি বাতাসেই থাকে। কলাম সংরণ করা বা একাধিকবার পড়া সম্ভব।
আলোচনার মূল বিষয় ছিল, ১০ বছর পূর্বেকার দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং সদ্য প্রদত্ত তার রায়। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (সিইউএফএল) জেটি ঘাটের পাশেই অবস্থিত বন্দর ঘাট এলাকায় খালাস করার সময় দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। দু’জন পুলিশের সার্জেন্ট ঘটনাটি আবিষ্কার এবং তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপকে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। ওই স্থান থেকে কর্ণফুলী নদীর মোহনা এক মাইলের বেশি দূরে নয়। মোহনা দিয়ে প্রতিদিন সমুদ্রগামী জাহাজ প্রবেশ করে, সমুদ্রে মাছ ধরে এমন জাহাজ প্রবেশ করে, সমুদ্র তীরের কাছাকাছি থাকে এমন নৌকাও চলাচল করে। অস্ত্রগুলো ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকায় এসেছিল এবং অস্ত্রের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, সেগুলোকে ধারণ বা বহন করার জন্য দশটি ট্রাক প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। যদি পুলিশের দু’জন সার্জেন্টের হাতে বিষয়টি ধরা না পড়ত, তা হলে অস্ত্রগুলো ওই স্থান থেকে বাংলাদেশেরই অভ্যন্তরে অন্য কোথাও যেত, নাকি বাংলাদেশের মাটির ওপর দিয়ে বাহিত হয়ে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রে যেত, নাকি পৃথিবীর অন্য কোথাও যেত, সেটি বলা দুষ্কর ও মুশকিল। যাহোক, যেহেতু ঘটনাটি আবিষ্কার হয়েই গিয়েছিল, সেটিকে আমলে নেয়া ছাড়া আর কোনো পথ কারো সামনে খোলা ছিল না। সুকঠিন প্রশ্ন (১) অস্ত্রগুলো কোন দেশে বানানো হয়েছিল; (২) অস্ত্রগুলো কোন দেশের কোন বন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল; (৩) অস্ত্রগুলো কোন মালিকের কোন জাহাজে করে সমুদ্রপথে বাংলাদেশের জলসীমা পর্যন্ত এসেছিল; (৪) কোন মালিকের কোন ুদ্রাকৃতির নৌকায় জাহাজ থেকে নামানো হলো; (৫) সিইউএফএল জেটিতে ভেড়ার আগে এই ঘটনা সম্পর্কে অন্য কেউ জানতেন কি না; (৬) যে দু’জন পুলিশ সার্জেন্ট ঘটনাটি আবিষ্কার করেন, তাদের অন্য কেউ গোপনে পূর্ব থেকে সংবাদ দিয়েছিলেন কি না; (৭) এত বড় একটি ঘটনা সিইউএফএল জেটিতে ঘটবে, তার কোনো পূর্বাভাস স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পেয়েছিল কি না, নাকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পেয়ে থাকলেও চুপ ছিল; (৮) এ ঘটনার সাথে বিদেশী কোনো নাগরিক জড়িত ছিল কি না; (৯) এসব অস্ত্রের মূল্য কে কোথায় কিভাবে পরিশোধ করেছিল, নাকি বিনামূল্যেই কেউ কারো জন্য উপহারস্বরূপ এই অস্ত্র পাঠিয়েছিল; (১০) এ ঘটনার তদন্ত যথাযথ নিয়মে স্বাভাবিক গতিতে চলেছিল কি না অথবা কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল কি না?
যত প্রশ্ন ওপরে উপস্থাপন করলাম, সেসব প্রসঙ্গে আলোচনা একটি কলামে সম্ভব নয়। আবার সব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য সম্মানিত পাঠকেরা আগ্রহী নাও হতে পারেন। ১০ বছর ধরে, অর্থাৎ রায় প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, যে কথাটি মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়েছে সেটি হলো যে, এসব অস্ত্র বেআইনিভাবে সার্বভৌম বাংলাদেশের জলসীমায় বা স্থলসীমায় প্রবেশ করেছে এবং এ কর্মটিকে চোরাচালান বলা যায়। আরো যে কথাটি ছড়িয়েছে, সে কথাটি হলো যে, এসব অস্ত্র সম্ভবত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বাহিত হয়ে অন্যত্র কোথাও যেত এবং এবং সেই অন্যত্র মানে যথাসম্ভব উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো-না-কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে যেত। বিষয়টি তদন্ত করার সময় বাংলাদেশ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম উঠে আসে। ওই সব ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের আওতায় জবানবন্দী দিয়েছেন (হয় স্বেচ্ছায় স্বাভাবিক মানসিকতায় অথবা চাপের মুখে অস্বাভাবিক মানসিকতায়)। ওই সব জবানবন্দীতে বাংলাদেশ সরকারের একাধিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকাণ্ডের আংশিক চিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। যে আংশিক চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তা শোভনীয় বা উপভোগ্য নয়।
ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল। মামলা দায়েরের প্রায় পৌনে ১০ বছর পর চট্টগ্রাম মহানগরের একটি আদালত কর্তৃক রায় ঘোষণা করা হয়েছে। মামলাটি অস্ত্র চোরাচালান সংক্রান্ত। বাংলাদেশ সরকারের (২০০১-০৬) তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান নিজামী, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন প্রতিরা গোয়েন্দা পরিদফতরের অন্যতম উপমহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার যিনি পরে মেজর জেনারেল র‌্যাংকে প্রমোশন পেয়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বা এনএসআইয়ের প্রধান হয়েছিলেন, তৎকালীন (এপ্রিল ২০০৪) জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বা এনএসআইয়ের মহাপরিচালক তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আসাম প্রদেশের বিদ্রোহী সংগঠন ‘উলফা’-এর একজন শীর্ষ নেতাসহ মোট ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আরো ১৪ জনকে অন্যান্য ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। যারা মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব জনাব নূরুল আমিন, এনএসআইয়ের তৎকালীন অন্যতম পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবউদ্দিন আহমদ, এনএসআইয়ের তৎকালীন অন্যতম পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, তৎকালীন এনএনএস-আইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসীন উদ্দিন তালুকদার, সিইউএফএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক প্রশাসন জনাব কে এম এনামুল হক। উল্লেখ্য, সিইউএফএল নামে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন বা বিসিআইসির অধীনস্থ একটি সংস্থা। বিসিআইসির একজন চেয়ারম্যান আছেন। বিসিআইসির ওপরের কর্তৃপ হচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা দেখলে, অনেকেই মনে করতে পারেন যে, তৎকালীন শিল্প মন্ত্রণালয়, বিসিআইসি, সিইউএফএল কর্তৃপ, প্রতিরা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বা এনএসআই বাংলাদেশ সরকারের এই অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানগুলো এক হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এরূপ একটি চোরাচালানি কারবার ঘটিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য কি না, সেই বিচার সম্মানিত পাঠক সমাজের ওপর ছেড়ে দিলাম। কারণ এত বড় বড় সংগঠন, এত বড় বড় কর্মকর্তা চাইলেন কিন্তু পারলেন না, এই কথাও অনেকের কাছেই অন্তত বিশ্বাসযোগ্য নয়। আদালত বা বিচার বিভাগের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে, অনেকেই মনে মনে প্রশ্ন করছেন যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ নিজেদেরকে বা আত্মপ সমর্থনের জন্য উপযুক্ত ও যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন কি না।
১০ বছর ধরে আকাশে-বাতাসে তোলপাড় করা কয়েকটি বিষয়, রায়ের পর আবার আলোচনায় স্থান পায়। অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত সাবেক শিল্পমন্ত্রী রায় ঘোষণার পরপরই এজলাসে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘রায় কী হবে, আগে থেকে সবার জানা আছে। যে রায় দেয়া হয়েছে, তা অন্যায়ভাবে দেয়া হয়েছে।’ অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘কাউকে খুশি করার জন্য এ রায় দেয়া হয়েছে’। এসব বিষয় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে প-বিপ নিয়ে আলোচিত হয়েছে। ১ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যা রাতে ৭১ টিভির সেই টকশোতেও আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কলামে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে বা হচ্ছে এবং আমার মনে হয় হতেই থাকবে বেশ কিছুদিন।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে ভারতের সাতটি প্রদেশ আছে। প্রদেশগুলোর নাম মেঘালয়, আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মনিপুর ও ত্রিপুরা। এখন যদিও সাতটি প্রদেশ, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন এখানে প্রদেশ ছিল মাত্র একটি, যার নাম ছিল আসাম এবং মহারাজা শাসিত ও দিল্লি সরকারের প্রতি অনুগত রাজ্য ছিল একটি যার নাম ত্রিপুরা। ভারত স্বাধীনতা লাভের পরপরই ত্রিপুরা, ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য সম্মতি দেয়। ১৯৪৭-৪৮ এ আসাম প্রদেশের বিভিন্ন অংশে, পরবর্তী দশকগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বা স্বাধীনতাকামী আন্দোলন সংঘটিত হয়। প্রথমটি ছিল নাগাল্যান্ডের আন্দোলন, যার শুরু ১৯৫২ সালে এবং যেটি টিমটিম করে জ্বলে থাকা প্রদীপের মতো এখনো চলছে। বেশির ভাগ বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বা স্বাধীনতাকামী আন্দোলন কোনো-না-কোনো পর্যায়ে ভারত সরকারের সাথে সমঝোতা বা আপসে আসে, এটা যেমন সত্য আবার এটাও সত্য যে, ওই রূপ আন্দোলন বা গোষ্ঠীগুলোর কোনো-না-কোনো অংশ সাথে সাথেই নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। এটা নাগাল্যান্ডের েেত্র হয়েছে, ত্রিপুরার েেত্র হয়েছে, মনিপুর মিজোরামের েেত্র হয়েছে। এটাও সত্য যে, এ মুহূর্তে ওই আন্দোলনগুলো সার্বিকভাবে ম্রিয়মাণ অবস্থায় আছে। এসব সত্য হলো, ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি প্রদেশ সম্পর্কে। বাংলাদেশের পশ্চিমে এবং বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের উত্তরে অবস্থিত ভারতীয় প্রদেশের নাম পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিমবাংলা, যার রাজধানী কলকাতা। এই রাজ্যের একটি বিখ্যাত জেলা ও শহরের নাম দার্জিলিং। দার্জিলিং পর্যটন-বান্ধব শহর। এখন থেকে পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা একটি রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে এই দার্জিলিংয়েই সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পরে সরকার দার্জিলিংয়ে অটোনোমাস বা স্বায়ত্তশাসিত হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল গঠন করে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল। এখানে এই বর্ণনার মূল কারণ হচ্ছে, এ পরিস্থিতির সাথে আমাদের বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার সম্পর্কটি হালকাভাবে উপস্থাপন করার জন্য।
উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে, ১৯৭৫ সাল থেকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা যুদ্ধ পরিচালনা শুরু করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো যেমন সম্ভবত বিদেশ থেকে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে, তেমনই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীও বিদেশ থেকে সাহায্য সহযোগিতা সম্ভবত পেয়েছে। তবে সম্ভবত শব্দটিকে বাদ দিয়ে এখন বলছি, নিশ্চিতভাবে পেয়েছে। তবে কিভাবে পেয়েছে, কখন পেয়েছে ইত্যাদি বর্ণনা দেয়ার উপযুক্ত স্থান এ কলাম নয়। অনেক লেখকের প্রচুর বইয়ে বা প্রচুর কলামে এ সম্পর্কে বক্তব্য আছে। আমার নিজের লেখা (আমার লেখা বইগুলোর মধ্যে ১১তম) বই যার নাম ‘মিশ্র কথন’ এর ৮ নম্বর অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের স্বীকারোক্তিমূলক দীর্ঘ বক্তব্য হুবহু উদ্বৃত করা আছে। ‘অনন্যা’ নামক বিখ্যাত প্রকাশকের স্টল থেকে পুস্তকটি কেউ সংগ্রহ করলে তিনি নিজে আশ্বস্ত হতে পারবেন যে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী (বিচ্ছিন্নতাবাদী হোক বা না হোক) যারা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে, তারা ভারত সরকার থেকে সাহায্য-সহযোগিতা ও অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি পেত। ভারতের প থেকে এসব কাজ ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী করত। ভারতের প থেকে অভিযোগ ছিল যে, বাংলাদেশও নাকি উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা দিত, যদিও বাংলাদেশ সর্বদাই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বাংলাদেশ আমলের পূর্বে, পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য দিত বলে অভিযোগ ভারত বরাবরই করেছে। পাকিস্তান বহু বছর ধরে বলে আসছে যে, ১৯৭১ এর পূর্বে, বাংলাদেশে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন সৃষ্টির পে ভারতের ভূমিকা ছিল এবং ১৯৭১ এর সময় এবং এর পরে পাকিস্তান বরাবর বলে আসছে যে, পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ভারতের প্রত্য ও বিস্তৃত সাহায্য ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাগণের ভূমিকাকে যেকোনো প্রকারে মার্জিনালাইজড বা প্রান্তিকরণ করার চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু এটা সত্য, বাংলাদেশের নিজের প্রয়োজনে এবং ভারতের প্রয়োজনে ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দিয়েছে। এসব বিষয় এক দিকে যেমন সত্য, অপর দিকে বিষয়গুলোর বিস্তৃত বিবরণ কোথাও যে আলোচিত নয় বা সমালোচিতও নয়, সেটাও সত্য। কিন্তু দুঃখজনক কথা হলো, চট্টগ্রামের ঘটনাটির কারণে, প্রকাশ্যে আদালতে বিচারপ্রক্রিয়ার কারণে, মিডিয়া কাভারেজের কারণে, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড, সাফল্য বা ব্যর্থতা, কর্মকর্তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বহুবিধ বিষয় জনসমে উপস্থাপিত হলো। এটি কোনো দিনই কাম্য ছিল না।
যেকোনো দেশের সরকার একটি রাজনৈতিক সরকার। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকার পরিচালিত হয়। সরকারের নির্বাহী বিভাগ রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই কাজ করে। যাবতীয় দায়-দায়িত্ব রাজনৈতিক সরকারকে নিতে হয়। নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা আদেশ পালন করে থাকেন। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকাণ্ড হুবহু নির্বাহী বিভাগের মতো নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের জন্য এ কথাটি বাস্তব ও সত্য। বাংলাদেশের স্বার্থ রার জন্য বা বাংলাদেশের স্বার্থকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য গোয়েন্দা বিভাগগুলো কাজ করে। বাংলাদেশের প্রধান গোয়েন্দা বিভাগগুলোর দু’টি নাম হচ্ছে এনএসআই ও ডিজিএফআই। এই দুই প্রতিষ্ঠানের ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। কিন্তু একটি ভুলের বিপরীতে তাদের ১০টি সাফল্য বা ভালো কাজ আছে এটাই আমরা বিশ্বাস করি এবং প্রকাশ করতে পিছপা হবো না। এই উভয় সংস্থাতেই উচ্চ পদে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাগণ দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যেও আবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাগণ অধিক সংখ্যায় পালন করেছেন। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি থেকে আমি একজন সেনাসদস্য বা সৈনিক। ১৯৭১ এর রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা। অতঃপর আরো ২৭ বছর সৈনিক ছিলাম। ১৯৯৭ এর জুলাই থেকে পরবর্তী ১০ বছর সুশীলসমাজের সুপরিচিত নিরপে মুখ ছিলাম। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর থেকে একজন রাজনীতিবিদ। এরূপ ত্রিমুখী বা তিন আঙ্গিকের অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে চাই যে, আমার সৈনিক পরিচয় গর্বের পরিচয়, বাংলাদেশের সৈনিকগণের আপাদমস্তক সম্মান রার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট ছিলাম এবং ভবিষ্যতেও থাকব। সৈনিকগণ অনেক ধরনের আদেশ পান; মিষ্টি, টক অথবা ঝাল। জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ওই দায়িত্বগুলো পালন করেন। যেমন আমি নিজেও পার্বত্য চট্টগ্রামে, আমার সহকর্মীদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করে আধা-রাজনৈতিক এবং পূর্ণ সামরিক দায়িত্ব পালন করেছি। তাই আমরা কর্মকর্তা বা চাকরিজীবী ছিলাম; প্রশংসা ও কৃতিত্ব সরকারের। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, বাংলাদেশ প্রতিরা বাহিনী বা বাংলাদেশের গোয়েন্দা বাহিনীগুলো বা যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা প্রকাশ্যে অসম্মানিত হোক, আমি সেটা চাইও না সমর্থনও করি না।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত জ্যেষ্ঠ বাঙালি কর্মকর্তাগণকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের খেদমতে নিয়োগ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা সাজানো হয়েছিল। তখন আমরা বলেছিলাম, এটা মিথ্যা এবং তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতিকে এবং বঙ্গবন্ধুকে হয়রান ও অপমান করার জন্য এ মামলা সাজিয়েছে। স্বাধীনতার পর আমরা স্বীকার করছি যে, আসলেই আগরতলা যাওয়া হয়েছিল, স্বাধীনতার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল, ভারতের সাহায্য চাওয়া হয়েছিল এবং আসলেই পরিকল্পনাটি বা কর্মকাণ্ডগুলো পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে ১৯৬০ এর দশকের শেষাংশে তৎকালীন ভারতের আগরতলায় কর্মরত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কোনো ব্যক্তি বা তাদের কোনো ঊর্ধ্বতন  ব্যক্তি কোনো দিন কোনো প্রকার শাস্তি পেয়েছেন বলে আমরা শুনিনি। শাস্তি না পাওয়াটাই উচিত। কারণ তারাও একটি রাজনৈতিক সরকারের নির্দেশ পালন করেছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আওতায়। আরো একটি যুক্তি আছে, তা হলোÑ আমাদের স্বাধীনতার জন্য অন্য কেউ শাস্তি পাক, বাঙালি ও বাংলাদেশী হিসেবে আমি সেটা চাই না।
বাংলাদেশের মাটি অন্য কোনো দেশের অশান্তির জন্য ব্যবহৃত হোক, সেটা বাংলাদেশের প্রকাশ্য পররাষ্ট্রনীতির অংশ হতেই পারে না। অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালিত হোক সেটাও কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। বাংলাদেশের তিন দিকে স্থল সীমান্ত। এর সাত ভাগের ছয় ভাগ হলো ভারত এবং সাত ভাগের এক ভাগ হলো বার্মা বা মিয়ানমার। নেপাল বা ভুটান একটু দূরে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান অনেক দূরে অবস্থিত। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কথা না-ই বা বললাম। তাই বাংলাদেশের সুখের জন্য এবং দুঃখের জন্য, বাংলাদেশের সুবিধা ও অসুবিধার জন্য, বাংলাদেশের সম্মান বা অসম্মানের জন্য নিকটতম প্রতিবেশী হলো ভারত। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মান রা করবে। কিন্তু বিগত পাঁচ-সাত বছরের অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অথবা বিগত পাঁচ সাত বছর যাবৎ বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম ‘ফরজ’ কাজ ভারতের স্বার্থ রা বা ভারতকে খুশি করা। বাংলাদেশের স্বার্থ রা বা বাংলাদেশকে খুশি করা ভারতের জন্য নফল কাজ হিসেবেও গণ্য হচ্ছে না বলে আমার মতো অনেকের মনে হয়। অপরিহার্য, পালনীয় ও আবশ্যকীয় হচ্ছে ফরজ। অন্য দিকে করলে ভালো, না করলে দোষ নেইÑ এমন কিছু অতিরিক্ত কাজের নাম হচ্ছে নফল। চট্টগ্রামের অস্ত্র মামলার রায় এবং রায়ের মাধ্যমে প্রদত্ত শাস্তি অভূতপূর্ব ও অশ্র“তপূর্ব। বিষয়টি গভীর মনোযোগ, গভীর সামরিক বিশ্লেষণ, গভীর গোয়েন্দা বিশ্লেষণ এবং গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

পূর্ব প্রকাশিত নয়া দিগন্ত

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *