অনুঘটক হতে হবে।

বিশ্ব নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন লা ইলাহা ইল্লালাহ বলে ইসলামের বাণী প্রকাশ করলেন তখন জাহেলী যুগের কোরেশ প্রধানরা এবং অপরাপর গোত্র প্রধানরা বুঝতে পেরেছিল এই “লা ইলাহার” তাৎপর্য কী এবং এর মূলমন্ত্রে যদি একটি সমাজ গড়ে উঠে তখন কী হতে পারে। আর জাহেলী সমাজ সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিল যে এই , মুহাম্মদই (সা.) যদি হয়ে পড়েন অনুসরণের মূল ক্বিবলাহ তাহলে সমাজে তাদের যে কতৃত্ব আছে তা থাকবেনা। বস্তুত তারা যদি ইসলামকে প্রচলিত কায়েমি স্বার্থবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে তার আপন স্থানে প্রতিষ্ঠিত রেখে কেবল জিকির আযকার ও তসবিহ তাহলিলে সীমিত এক ধর্ম মনে করত তাহলে তারা কোন দিন ইসলামের বিপক্ষে অস্ত্র ধরত না। তারা যখন দেখল এই বাণী বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছিল তখনই মাক্কী মুশরিকরা মুহাম্মদের (সা.) সাথে বার বার সমঝোতা বা আপস-মীমাংসা করতে চেয়েছিল যাতে মুহাম্মদ (সা.) তাদের সমাজ ব্যবস্থার প্রতীকী মূর্তিদের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করেন, তাঁর ধর্ম-কর্ম যেন কেবল সালাহ আর আল্লাহ আল্লাহ করাতে সীমিত রাখেন, এতে তাদের আপত্তি থাকবেনা। বিনিময়ে তিনি যা চান তা দিতে তারা তা দিতে প্রস্তুত ছিল কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) তাঁর একহাতে চন্দ্র আর অপর হাতে সূর্য পেলেও তাঁর মূল বাণীতে আপস করতে রাজি হতে চান নি। কারণ মহান আল্লাহ তাকে সেজন্য নবী নিযুক্ত করেন নাই। এ ব্যাপারে এম আহমেদ ভাই তার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রতিবন্ধক যুক্তি ব্লগে (লিংক এখানে) কয়েকটি কথা বলেছেন যা এখান উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি।

তিনি লিখেছেন, “আল্লাহ যদি তাঁর নবীকে এই সমঝোতার নির্দেশ দিতেন তাহলে মুহাম্মদ (সা.) সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু কলেমা, সালাহ ও তাওহীদী দাওয়াতে সীমিত থাকতেন। দাওয়াত দিতে দিতে একদিন আরববাসী মুসলমান হয়ে গেলে কিল্লাহ ফতেহ হত। বিজয় নিশ্চিত হত – আল্লাহর দ্বীন অমনিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। কিন্তু এমন সমঝোতায় দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয় না। কখনও হয়নি। নবীর (সা.) যুগেও তাওহীদবাদী হানাফিরা ছিল। এরা যুগ যুগ ধরে অস্তিত্বে ছিল। কিন্তু তারা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে, সেই ব্যবস্থার নিয়ম-নীতি ও প্রথার সাথে মিলে-মিশে এবং বিশেষ করে তাগুতকে তার আপন স্থানে রেখে এমন কাজ হয় না। এগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে হয়; এগুলোর বিকল্প তৈরির জন্য কাজ করতে হয়; এর জন্য মানুষ তৈরি করতে হয়; মানুষের মধ্যে যোগ্যতা তৈরি করতে হয়; এই কাজ করতে গিয়েই সেই যোগ্যতা হাসিল হয়; তাগুতি শক্তি যখন মার-ঢালতে আসবে তখন তার মোকাবেলা করার মানসিকতা, সাহস ও যোগ্যতা তৈরি হতে হয়। এই সবগুলো চলতে হয় পাশাপাশি (hand in hand)।”
তবে তাগুতি শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার আগে ভাবতে হবে মুহাম্মদ (সা:) মক্কায় থাকা কালিন কেন যুদ্ধে জড়িত হলেন না কাফিরদের সাথে? কেন মুসলিমদেরকে হাবাসায় হিজরত করতে নির্দেশ দিলেন? আল্লার উপর ভরষা করে কেন তারা যুদ্ধ শুরু করলেননা? আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে প্রথমে মদীনায় হিজরাত করায়ে সেখানে লা ইলাহার কলেমার স্বীকৃতিতে একটি জনপদে সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর মুহাম্মদের (সা.) কাফেরদের আক্রমনের মোকাবেলায় তাঁর অনুসারীদেরকে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। যারা ইসলামের ইতিহাস পড়েছেন তারা জানেন মদীনার জনগুষ্টি তাদের সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব মুহাম্মদ (স:) হাতে অর্পণ করে ছিল তাদের সদিচ্ছায় এবং সে জন্য মদিনা বাসীর উপর অস্ত্র হাতে চড়াও হতে হয়নি। অবশ্য বৃহত্তর জনগুষ্ঠির একাত্মা ঘোষণার পর ছোটখাট দু এক গোত্র আপত্তি করলেও নবীর প্রতি বৃহত্তর জনগুষ্টির আসক্তির জোয়ার কেউ বন্ধ করতে পারেনি কেউ। আজ বিশ্ব জুড়ে যেভাবে মুসলিম নারী পুরুষ ও শিশু সন্তানের রক্ত ঝরছে সে প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র কৌশলগত পদক্ষেপের নিমিত্তে অবশ্য এখানে এ কথাটি উল্লেখ করেছি। পরহেজগারের বেশে শত্রুর ভয়ে গর্তে ঢুকে আল্লাহ আল্লাহ করার জন্য নয়।
আহমেদ ভাই অরো কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছেন যা চিন্তার খোরাক জাগায়। তিনি লিখেছেন, “আজকে কী নামাজীদের অভাব আছে? যে সংখ্যার মানুষ নামাজ পড়ে কেবল ওরাই সৎ, ভাল লোক হলে দেশের অবস্থা অন্যরূপ হত। পাঁচ ওয়াক্তের বাইরে নফল নামাজীদেরও অভাব নেই। তারপর জুমার দিনে মসজিদগুলোতে স্থান সংকুলান হয় না। কিন্তু দেশের নৈতিক বাস্তবতার অবস্থা কী? এই দেশেই চলছে ঘোষ, চুরি, ধর্ষণ, বদমাশি, হত্যা।”
এই প্রতিষ্ঠিত প্রথার লোকজনই আবার জাতিকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে একে অন্যকে হত্যা করে কলঙ্কমুক্ত করার কথা বলে!
একজন সাধারণ মুসলিম এবং ইসলামী জ্ঞানে ও ইসলামী দা’য়ী হিসাবে নিজেকে অনেক-অনেক পিছনের কাতারের এক নগণ্য ব্যক্তি হিসাবে আমার এ ক্ষুদ্র জ্ঞানে দুটি কথা পাঠকদের উদ্দেশ্য রাখতে চাই:
আমরা জানি গ্লুকোজ / সুগার মানব দেহের জন্য ভাল এবং একটি প্রয়োজনীয় উপাদান কিন্তু একজন ডায়াবেটিক রোগের মানুষ গ্লুকোজ বেশি সেবন করলে বয়ে আনে মৃত্যু। আজ বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর যে অবস্থা তা অনেকটা ডায়াবেটিক রোগের মত। অতএব আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে সীমিত পরিধির ধর্মীয় কাজ ভাল মনে হলেও একে যথেষ্ট ভাবা মুসলিম উম্মাহর জন্য ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত রুগীর সুগার সেবনের মত বয়ে আনবে ভয়াবহ পরিণতি! তখন দেখা যাবে মুসলিম উম্মাহ যাতে পিপিলিকারমত এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে সে জন্য সবচেয়ে খুশী হবে ইসলাম বিদ্বেষী মহল এবং সে জন্য তারা সকল ধরণের সহযোগীতা দিতে প্রস্তুত হবে।
আমি স্বীকার করি ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে যদি কেউ অন্য ধর্মের সাধারণ নিরীহ মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায় বা যারা ইসলাম বুঝে না তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করেন তাহলে বুঝতে হবে কাজ সঠিক পথে হচ্ছে না। অন্যদিকে আবার চুর বদমাইশ ও স্বৈরাচারী, অত্যাচারীরা যে ইসলামী প্রচারকে সমর্থন করে পৃষ্টপোষকতা করে, সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগীতা করে তখনও বুঝতে হবে সে কাজ যে কোন সমাজ প্রভাব ফেলছে না।
বস্তুত বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন দীর্ঘদিনের এবং এই প্রতিষ্ঠিত প্রথার লোকজনই আবার জাতিকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে একে অন্যকে হত্যা করে কলঙ্কমুক্ত করার কথা বলে! সত্যি বলতে কি বাংলাদেশে আজ যে পলারাইজেশন হয়েছে সমাজের সর্বস্তরে এগুলোর প্রতিকার করতে দরকার হচ্ছে নৈতিক শিক্ষায়, নৈতিক নেতৃত্ব গঠনে, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনে, নৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠতায়, নৈতিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন আইন ব্যবস্থার।
ইসলামকে শুধুমাত্র ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার চতুর্দেয়ালে বন্দি করে ফেললেই কী প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা আপনাতেই সংস্কার হয়ে যাবে? ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার শুধু সমালোচনা করলেই যথেষ্ট নয় আজ আমাদেরকে সঠিকভাবে আন্তরিকতার সহিত এর প্রতিকারে এগিয়ে আসতে হবে। ঈমান ঠিক হলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে পাশ কেটে চলে গেলে চলবে না। নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করলে আজ আমাদেরকে অবশ্যই অনুঘটক (Catalyst) হতে হবে। হযরত ইব্রাহিম (আ:) একাই এক মিল্লাত ছিলেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও তাদের মূর্তিপূজার বিপক্ষে তিনি একাই আওয়াজ তুলে ছিলেন এবং মহান আল্লাহ তাকে কি মর্যাদা দিয়েছেন আমরা জানি। মোহাম্মদ (স:) একাই আবু জাহেলের দরজায় গিয়ে তাকে ডেকে বেদুইনের টাকা ফিরত দিতে বললেন তখন কাফেরা তামাশা দেখার জন্য দাড়িয়ে ছিল কিন্তু সে দিন কি হয়েছিল আমরা অনেকেই জানি।
আসলে বান্দা যখন এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে একমাত্র আল্লাহই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সবকিছুর উপর চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখেন। আর সফলতা একমাত্র আসতে পারে তারই কাছ থেকে যখন যে সময় তিনি দিতে চাইবেন। তখন কোন দু:খ কষ্টের মুহূর্তে সে বিচলিত হয়না বরং এ দৃঢ় বিশ্বাস তাকে সামনে চলার সকল বাধা অতিক্রমে সাহায্য, সাহস ও শক্তি সঞ্চার করে।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *