অরক্ষিত সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য মানেই পরাধীনতা

স্বাধীনতা মানে কেবলমাত্র একটি ভৌগলিক সীমারেখার সার্বভৌমত্বের অধিকার পাওয়া নয়। স্বাধীণতার অর্থ আরো স্থুল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি স্বাধীন ভু-খণ্ড ও লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি- ব্যাপারটা এমন সরলও নয়। পাশাপাশি পেয়েছি আমাদের স্বতন্ত্র কৃষ্টি, দর্শন বা মূল্যবোধের স্বীকৃতি। জাতি হিসেবে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছি আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের কথা। যা ছাড়া একটি দেশের স্বাধীনতা মূল্যহীন, স্বাদহীন। অনেক কষ্টে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। তা রক্ষা করা স্বভাবতই আরো কষ্টের। কাজেই কষ্টার্জিত সে স্বাধীনতা রক্ষার মানে হলো ভূ-খণ্ড ও পতাকার সম্মান রক্ষার সাথে সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো সাধের সে স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে আমরা অনেকটা হিমশিম খাচ্ছি। আমাদের স্বাতন্ত্রতা হারিয়ে ফেলছি। ক্রমেই আমরা জড়িয়ে পড়ছি অপসংস্কৃতির জালে।

আকাশ-নৌ ও স্থলবাহিনীর যৌথ আক্রমণের মাধ্যমে ভিন্ন রাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে পরাস্ত করে ভূ-খণ্ড দখল করার রীতিতে এসেছে পরিবর্তন। নতুন ধারনায় একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস বা দখল করতে পারলে এমনিতেই সেদেশের মানুষ তার স্বকীয়তা হারিয়ে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়। এমনিভাবে ভৌগলিক সীমারেখা ও পতাকা অক্ষুণ্ন রেখেও একটি দেশের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া সম্ভব। কাজেই বলা যায়, অরক্ষিত স্বীয়-সংস্কৃতির অপর নাম পরাধীনতা। উল্লেখ্য, মূলত সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামের পৃথক দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। ভিত্তি ছিল প্রধানত ধর্মবিশ্বাস। পরবর্তীতে, ভৌগলিকভাবে সংস্কৃতির ভিন্নতা অনেকটাই প্রভাবান্বিত করেছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে।

তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে ১১তম সুখী দেশ। এমন সুখকর খবরের পেছনের কারণ যতটা না অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। দেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংস্কৃতির শুরু বেশি দিনের নয়। তারপরও সিংহভাগ ক্ষেত্রে এখনও বাবা-মায়ের শেষ বয়সে প্রয়োজনীয় সেবা করাকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করা হয়। বয়স্করা পরিবারের সাথে আনন্দে জীবনের শেষ সময় পার করেন। দাদা-দাদী আর নাতি-নাতনিদের দুষ্টুমীতে এক স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অভিজ্ঞতার বিনিময় হয় বৃদ্ধ থেকে যুবাতে। কাঙ্ক্ষিত এমন মূল্যবোধের রয়েছে পারিবারিক, ঐতিহ্যগত ও ধর্মীয় শিক্ষার মজবুত ভিত। যা আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই সাংস্কৃতিক মৌলবাদিতাকে সুখের চাবিকাঠি বললে অত্যুক্তি হবে না। পরিতাপের বিষয়, ইদানিং উল্লেখিত তিন ধরনের শিক্ষার প্রতিক্ষেত্রেই ক্রমাগতভাবে ভেজাল ঢুকছে। পরিণামে নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয় পৌঁছেছে চরমে। প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে পারিবারিক কলহ, বিবাদ, রেশারেশি। ভাঙছে পরিবার। সমাজে একে অপরের প্রতি বিদ্যমান শ্রদ্ধা-স্নেহ-মায়া-মমতা কমছে আশংকাজনক হারে। ধর্ম, বিধর্ম বা অধর্ম বিভিন্নভাবে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িক দন্দ্ব।

জীবনের জন্য সুস্থ বিনোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষনীয় গল্পসমৃদ্ধ টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যদি গঠনমূলক কোনো বার্তা দেওয়া যায় তাহলে তার দ্বারা সমাজ উপকৃত হয়। কিন্তু পরিবার বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর বিষয় যদি হয় বিনোদনের মুল প্রতিপাদ্য বিষয় তাহলে তা কোন অবস্থায় সুফল বয়ে আনতে পারে না। সম্প্রতি মাননীয় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ বিমানের লয়্যালটি কার্ড উদ্ভোধন অনুষ্ঠানে র্যা ম্প মডেলদের অর্ধনগ্ন উপস্থিতি ও অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি, ক্যাটওয়াক দেখতে অনেকের কাছে সুখকর হলেও তা আমাদের সংস্কৃতির সাথে কোনভাবেই মানায় না। সময়ের বিবর্তনে নিজস্ব সংস্কৃতিরও উন্নয়ন হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যদি হয় স্বকীয় মূল্যবোধ বা স্বাতন্ত্রকে ধুলিসাৎ করার মাধ্যমে তাহলে তা কিছুতেই কাম্য নয়।

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে পশ্চিমা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য বিষয় লিভ টুগেদারের মত ঘটনা কল্পনা করা যেত না। পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে দেশে বিদ্যমান লিভ টুগেদারের ভয়াবহতা উঠে এসেছে। সাথে ডিজে পার্টি, রাতজেগে মাদক গ্রহণ ইত্যাদি তো আছেই। অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরা ইতিমধ্যেই ভয়ংকরভাবে পতিত হয়েছি এগুলো তারই প্রমাণ বহন করে।

কোন ঘটনা বা দৃশ্য মনের মধ্যে তীব্রভাবে গেঁথে গেলে শরীরের জৈবিক প্রক্রিয়ায় (বায়োলজিকাল সিস্টেম) তার প্রভাব পড়ে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে আচার-আচরণে। ঘটনাটি খারাপ-ভালো দুই-ই হতে পারে। শরীরের প্রতিটি কোষ পরিবর্তীত আচরণের বহিঃপ্রকাশে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখে। এভাবে চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা দ্বারা আমরা প্রভাবিত হই। ঘটনাটি যদি হয় বাস্তবতাবিবর্জিত অভিনয় তাহলে পরিণতি হয় ভয়াবহ। ভারতীয় মেগা সিরিয়ালগুলো অনেকটা সেরকম কাজ করছে। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রেম করার কৌশল, পরকীয়া আর সম্পত্তি দখলের মত মারাত্মক বিষয় নিয়েই সিরিয়ালগুলো আবর্তিত হয়। অনৈতিক এসব কর্মকাণ্ডে অনুঘটকের মত কাজ করছে সিরিয়ালগুলো। কোন যুক্তিতেই একে সুস্থ সংস্কৃতি বলা যায় না। অন্তঃসার শূন্য হওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর এগুলোতে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে। বিশেষ করে দেশের নারী সমাজের একাংশের মধ্যে সংগোপনে কূটকৌশল ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অদৃশ্য দরজা দিয়ে ঢুকে সেসব কূটবুদ্ধি মনমস্তিস্কে প্রোগ্রাম আকারে স্থায়ী প্রভাব ফেলছে এবং অজান্তে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। কম্পিউটার ভাইরাসের সাথে মিল রেখে একে ‘সাংস্কৃতিক-ভাইরাস’ বলা যেতে পারে। পরিনামে আমরা খারাপকে খারাপ হিসাবে বিবেচনা করার শক্তি বা বিবেক হারিয়ে ফেলছি। আমাদের ব্যর্থতা থাকলেও ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সাফল্য শতভাগ বলা যায়।

আমার এক পরিচিতাকে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালে আসক্ত না হওয়ার পরামর্শ দিলে উত্তরে আমাকে বলেছিল- ‘ডোন্ট ওরি, মনের মধ্যে কূটকৌশল না ঢুকালেই তো হলো’। আমি বলেছিলাম- ‘ইচ্ছা না থাকলেও অজান্তেই মন-মস্তিস্কে কিভাবে ঢুকবে বুঝতেও পারবে না’। সর্বশেষ জেনেছি হয়তো সিরিয়ালের প্রভাব তার জীবনে পড়েছে। অথচ আমার জানা মতে, পারিবারিকভাবে যথেষ্ট নৈতিকতার শিক্ষা ছিল তার। এভাবেই সিরিয়ালরুপী ঘুঁনপোকা আমাদের সমাজের ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্ত খুঁটিগুলোকে ধ্বংস করছে। ভেঙে পড়ছে পারিবারিক শিক্ষা বা মূল্যবোধ।

সংসারের অনেক জরুরি কাজ বন্ধ রেখে হলেও সিরিয়াল দেখতেই হবে। সিরিয়াল শেষ হলে তার বিভিন্ন কৌশল, পোশাকের স্টাইল, মেকআপ, গেটআপ প্রভৃতি সম্পর্কে ঝড় ওঠে গল্পে, চায়ের টেবিলে, মোবাইলে, ফোনে। বাস্তবের সাথে অনেকটাই অমিল বা গল্প শূন্য হলেও কেবলমাত্র চাকচিক্য আর পোশাকের বাহারিতে সিরিয়ালগুলোকে হাজার পর্বে টেনে নেওয়া হচ্ছে। ফলে বছরের পর বছর চলছে একই চর্চা। ঘটে যাচ্ছে এক নিরব বিপ্লব। যে বিপ্লব সমাজের জন্য কখনই কাম্য নয়। এখানেই শেষ নয়। মগজ ধোলাই এর পাশাপাশি বাজারে আনা হচ্ছে চলমান সিরিয়ালের নামে বাহারি ভারতীয় পোশাক। যার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে উঠতি বয়সের তরুণী ও গৃহিনীরা। মার খাচ্ছে দেশীয় পোশাক। ধ্বংস হচ্ছে সম্ভাবনাময়ী দেশীয় পোশাক শিল্প। সুতরাং আমাদের লোকসান বহুমাত্রিক।

ভারত আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোকে সেদেশে ঢুকতে দেয় না। কাজেই আমাদের উদার হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিষয়টা প্রতিশোধের নয় বরং শিক্ষা নেবার। ভারত যেমন তার স্বকীয়তার ব্যাপারে দারুণভাবে সচেতন আমাদেরকেও সঙ্গতকারণেই সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশের সিরিয়ালগুলোর মান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে, লালন করতে হবে। সার্বিকভাবে, প্রধানত দুই উপায়ে আমাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা সম্ভব। প্রথমত- মনে-প্রাণে দেশের মূল্যবোধকে ধারণ করা, ভালোবাসা, চর্চা করা। চর্চা না করলে দেশীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত- অপসংস্কৃতিকে কোনোভাবেই দেশে ঢুকতে না দেওয়া। উল্লেখ্য যে, একই সাথে দুই সংস্কৃতি চলার মত অবস্থা বর্তমানে নেই।

সামরিক বিবেচনায় বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। বিজিবির প্রধান কাজ সীমান্ত পাহারা দেওয়া। তেমনিভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যকে পাহারা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব রয়েছে সবার উপর। উদ্বেগের বিষয় স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ এ সাম্রাজ্যের সীমানা পাহারার ব্যাপারে আমরা অনেকটাই বে-খবর। আরো ভয়ংকর যে, সীমানাকে শুধু অরক্ষিত রেখেই ক্ষান্ত হচ্ছি না অনেক ক্ষেত্রে অপসংস্কৃতিকে দাওয়াত করে নিয়ে আসছি। বিষয়টা নিতান্তই দুঃখজনক। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। সবদিক দিয়ে বানের মত ঢুকছে অপসংস্কৃতির স্রোত। স্বভাবতই ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে আমাদের নিজস্বতা। একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সাধের স্বাধীনতা।

আধিপত্যবাদীরা তো চাইবেই। কারণ তাতে আগ্রাসী দেশের রয়েছে বহুমুখী লাভ। কিন্তু সাম্রাজ্যকে অরক্ষিত রাখতে ভিনদেশী সেসব সংস্কৃতির কতটুকু আমরা আমাদের দেশে ঢুকতে দেব বা আদৌ দেব কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। পুরোপুরিভাবে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হওয়ার আগে সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব তথা দেশের স্বাধীণতাকে সমুন্নত রাখতে যত দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে ততই মঙ্গল। বিষয়টা যতটা না সামরিক তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। যাই হোক, রাজনৈতিক সে সিদ্ধান্ত অবশ্যই হতে হবে জনগণ বা দেশীয় সংস্কৃতির মূল্যবোধের আলোকে।

পূর্ব প্রকাশিত: RTNN

 

Loading

ড. কে এইচ এম নাজমুল হুসাইন নাজির

About ড. কে এইচ এম নাজমুল হুসাইন নাজির

সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। বর্তমান: গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *