ইসলাম শান্তির ধর্ম, আর মুসলিমরা শান্তির দূত-

মুসলিম হিসেবে দ্বীন ইসলাম পালন এবং তার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য জিহাদ অর্থাৎ চেষ্টা সাধনা করার বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারেনা। এই চেষ্টা সাধনার পদ্ধতি ও পর্যায় সবার ক্ষেত্রে সব সময় একই রকম নাও হতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রেই কিছু মৌল নীতি অবশ্যই মেনে চলার প্রয়োজন রয়েছে। মুসলিম মাত্রই মহান আল্লাহতায়ালা প্রেরিত কিতাব আল-কোরআনের বাণী অনুধানের জন্য অবশ্যই সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। যেহেতু এই জিহাদ ব্যক্তি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়, তাই মানবতার স্বার্থে ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সময় উপযোগী পদক্ষেপে নিতে হবে।

কোন অহংকারী ইমানহীন জ্ঞানপাপী কিংবা দাম্ভিক ধর্মান্ধ মুর্খ নয়, বরং প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ও বোধসম্পন্ন মুসলিমদের পক্ষেই ইসলামি জিহাদের প্রকৃত মর্ম অনুধাবন করা সম্ভব। শুধুমাত্র পার্থিব লাভ লোকসানের হিসেব কষে জিহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। যারা সত্যিকার অর্থে ইসলামের পথে চেষ্টা-সাধনা করতে চান, তাদেরকে অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। তাড়াহুড়া করা কিংবা অধৈর্য হয়ে কথায় ও কর্মে আবেগপ্রসূত অসহনশীল আচরণ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কারণ রুঢ় কথা ও অসহিষ্ণু আচরণ সাধারণ জনগণের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে। ইসলাম শান্তির ধর্ম, আর মুসলিমরা হলো শান্তির দূত স্বরূপ। তাই তাদেরকে মার্জিত ও সৎ স্বভাবের অধিকারী হবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কারণ মহান স্রষ্টা বিনয়ী, সহিষ্ণু ও সৎকর্মশীল ভাল মানুষদের ভালবাসেন এবং সাথে থাকেন। তাছাড়া সাধারন মানুষই শুধু নয়, চরম শত্রুরাও ভাল মানুষের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়, বিশ্বাস ও আস্থা পায় এবং বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। সব সময় মনে রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে শান্তি ও সত্যাশ্রয়ী কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠার ম্যান্ডেট দিয়েই এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল পথেই এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু তাই বলে সহনশীলতার অর্থ এই নয় যে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেও মুসলিমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। ক্ষমতা দখলের মোহে তথাকথিত সন্ত্রাস নয়, বরং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের স্বার্থে শক্তি প্রদর্শন এবং মুসলিমদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে তার সদ্ব্যবহার করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

সাধ্যমত ইসলামের দাওয়াত দেয়াও ‘জিহাদের’ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভাল কথা, সৎকর্ম, সারগর্ভ বক্তৃতা ও লেখালেখি ইত্যাদি সকল সুস্থ পন্থায় দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতে হবে এবং যুগোপযোগী আধুনিক গণমাধ্যম সমূহের সুষ্ঠু ব্যবহার করার বিষয়েও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, প্রকৌশল বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আইন শাস্ত্র, মহাকাশ বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ ইত্যাদি যত ধরনের পার্থিব বিশেষ জ্ঞানই মানুষ অর্জন করুক না কেন, ইসলামের দাওয়াত কর্মে নিবেদিতদেরকে আল-কোরআনের জ্ঞান অর্জন ও অনুধাবন করার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে যে কোন মুহূর্তে পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। এই দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষ কটুকথা কইতে পারে এবং নানা রকমের পীড়নমূলক আচরণ করতে পারে। অনুকুল বা প্রতিকুল অর্থাৎ পরিবেশ ও পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, সকল অবস্থায় মহান আল্লাহতায়ালার পথনির্দেশনা মেনে চলাই হলো মুসলিমদের জন্য সর্বোত্তম পন্থা।

ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে আল-কোরআনে প্রদত্ত মৌল দিকনির্দেশনা-

সূরা ক্বাফ (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৩৪)
(৫০:৪৫) অর্থ- তারা যা বলে, তা আমি সম্যক অবগত আছি। তুমি তো তাদের উপর জোরজবরদস্তিকারী নও। অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান কর।
সূরা আল-ফুরকান (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৪২)
(২৫:৫২) অর্থ- অতঃপর তুমি আনুগত্য করো না অবিশ্বাসীদের এবং তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এর (কুরআন) সাহায্যে এক মহা প্রচেষ্টা চালাও।
সূরা আল আনকাবুত (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৮৫)
(২৯:৬৯) অর্থ- আর যারা আমার (আমাদের/আল্লাহ- সম্মানসূচক) জন্য চেষ্টা-সাধনা/সংগ্রাম করে, আমি (আমরা/আল্লাহ- সম্মানসূচক) অবশ্যই তাদেরকে আমার (আমাদের/আল্লাহ- সম্মানসূচক) পথে পরিচালিত করবই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন।
সূরা নাহল (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৭০)
(১৬:৮২) অর্থ- অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার কর্তব্য তো কেবল সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেয়া মাত্র।
(১৬:১২৫) অর্থ- তোমার পালনকর্তার পথের দিকে আহবান কর প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও ভাল উপদেশ শুনিয়ে এবং তাদের সাথে আলোচনা কর উত্তম পন্থায়। নিশ্চয় তোমার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে।
(১৬:১২৬) অর্থ- আর যদি তোমরা প্রতিশোধ নাও, তবে প্রতিশোধ নিও ঠিক তেমনিভাবে, যতটা ক্লেশ তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, অবশ্যই তা ধৈর্যশীলদের জন্য অতি উত্তম।
(১৬:১২৭) অর্থ- ধৈর্য ধারণ কর। তোমার সহিষ্ণুতা তো আল্লাহ ব্যতীত নয়, তাদের আচরণে দুঃখ করো না এবং তাদের চক্রান্তের কারণে মনঃক্ষুণ্ন হইও না।
(১৬:১২৮) অর্থ- নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন যারা সাবধান হয় এবং যারা সৎকর্মশীল।
সূরা আশ-শুরা (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৬২)
(৪২:৩৯) অর্থ- আর যারা পীড়নমূলক আচরণের স্বীকার হলে আত্মরক্ষা করে।
(৪২:৪০) অর্থ- আর মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। যে ক্ষমা করে ও পুনর্মিত্রতা/ মিমাংসা করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে; নিঃসন্দেহে তিনি অত্যাচারীদের পছন্দ করেন না।
(৪২:৪১) অর্থ- আর নিশ্চয় যে কেউ আত্মরক্ষা করে অত্যাচারিত হওয়ার পর – তখন তারাই, যাদের বিরুদ্ধে কোন (অভিযোগের) পথ নেই।
(৪২:৪২) অর্থ- (অভিযোগের) পথটি কেবল তাদেরই বিরুদ্ধে, যারা মানুষের উপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(৪২:৪৩) অর্থ- আর যে ধৈর্যশীল থাকে এবং ক্ষমা করে, নিশ্চয় এটা সাহসিক কাজগুলোর অন্যতম।
(৪২:৪৮) অর্থ- যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আমরা তো তোমাকে তাদের রক্ষক করে পাঠাইনি। তোমার উপর কোন দায়িত্ব নেই তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া ছাড়া। আমি যখন মানুষকে আমার রহমত আস্বাদন করাই, তখন সে উল্লসিত হয়, আর যখন তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদের কোন অনিষ্ট ঘটে, তখন মানুষ অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়।
সূরা হা-মীম সেজদাহ (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৬১)
(৪১:৩৩) অর্থ- আর কথাবার্তায় তার চাইতে উত্তম কে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, “নিশ্চয় আমি তো তাদেরই মধ্যকার- যারা মুসলিম”?
(৪১:৩৪) অর্থ- আর সমান নয় যা ভাল এবং যা মন্দ। প্রতিহত কর তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, তখন দেখো! তোমার মধ্যে ও তার মধ্যে শত্রুতা থাকলেও, সে যেন ছিল অন্তরঙ্গ বন্ধু।
(৪১:৩৫) অর্থ- আর কেউ এটির (এই গুণের) অধিকারী হয় না ধৈর্যশীলরা ব্যতীত, আর কেউ এটির (এই গুণের) অধিকারী হয় না মহা সৌভাগ্যবান ব্যতীত।
(৪১:৩৬) অর্থ- আর যদি শয়তানের কাছ থেকে তুমি কোনরূপ কানাঘুষা ও কুমন্ত্রণা পেয়ে থাক, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হও। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
সূরা মায়েদাহ (মদীনায় অবতীর্ণক্রম-১১২)
(০৫:১০৫) অর্থ- ওহে! যারা তোমরা আস্থা রাখ নিজেরাই নিজেদের উপরে, তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না যারা পথভ্রষ্ট, যখন তোমরা পথনির্দেশ মেনে চলো। আল্লাহর কাছেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন, তখন তিনিই তোমাদের জানাবেন, কি কি তোমরা করতে।
সূরা আল ইমরান (মদীনায় অবতীর্ণক্রম-৮৯)
(০৩:১০৪) অর্থ- আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।
(০৩:১৮৬) অর্থ- নিশ্চয় তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হবে তোমাদের ধন-সম্পদে এবং তোমাদের জীবন সম্পর্কে এবং নিঃসন্দেহে তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের কাছে এবং অংশীবাদিদের কাছে অনেক কষ্টদায়ক উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর এবং সাবধান হও, তবে তা হবে দৃঢ়সংকল্পের ব্যাপার। 
সূরা আল মু’মিনূন (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৭৪)
(২৩:৭২) অর্থ- তুমি কি তাদের কাছে কোন প্রতিদান চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই উত্তম এবং তিনিই উত্তম জীবিকাদাতা।
সূরা নাহল (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৭০)
(১৬:৮২) অর্থ- অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার কর্তব্য তো কেবল সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেয়া মাত্র।

মানুষের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা ছাড়া মনের ভাব অন্যের কাছে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই আল-কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে কথায় ও কর্মে যে আচরণবিধি মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছন, মুসলিম মাত্রই তা জানার ও মানার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পাহাড়সম প্রতিকূলতা সত্বেও এই আচরণবিধির বাস্তব প্রতিফলনই ইসলামী জাগরণের মূলমন্ত্র। মহান আল্লাহতায়ালা যেন তাঁর বাণী অনুধাবন করার এবং সেই অনুসারে রাসূলের (সাঃ) আদর্শ সঠিকভাবে জেনে, বুঝে ও অনুসরণ কোরে সরল পথে চলার মত ধৈর্য ও শক্তি দান করেন- আমীন।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *