অপারেশন ফ্লাশআউট

নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন ফ্লাশআউট’; অর্থাৎ হেফাজতিদের শহর থেকে টিয়ারগ্যাস ছুড়ে গুলি মেরে বোমা ফাটিয়ে যেভাবেই হোক তাড়িয়ে দিতে হবে। শহর সাফ করতে হবে। শহর ধনী ও বড়লোকদের জায়গা। ভদ্রলোকদের নগর। সুশীলদের রাজধানী। যাদের পাহারা ও রক্ষা করবার দায়িত্ব র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও মজুত। পুলিশের পক্ষ থেকে ওই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’; অন্যদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) একই অপারেশনের নাম দেয় ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’। চরিত্রের দিক থেকে এটা ছিল মূলত একটি সামরিক অভিযান। নিজ দেশের নিরস্ত্র নাগরিকদের বিরুদ্ধে সাঁজোয়া যান ও মারণাস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়া। অপারেশন ফ্লাশআউট – টিয়ারগ্যাস ছুড়ে, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে, ভীতিকর সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত করে গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোকে মেরে-কেটে তাড়িয়ে দাও। শহর নিরাপদ কর সেই গুটিকয়েকের জন্য, যাদের কাছে ষোলো কোটি মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকা জিম্মি না রেখে বেঁচে থাকতে পারে না।

শহরে কি তাহলে গ্রামের মানুষের কোনো স্থান নেই আছে। শহরেও মাদরাসা আছে; কিন্তু তার উপস্থিতি অদৃশ্য। তাকে থাকতে হবে, না থাকার মতো শহুরে; ভদ্রলোকদের নজর থেকে দূরে। তবে শহর সীমিত ক্ষেত্রে গরিব ও গা-গতরে খাটা মানুষদের সহ্য করতে বাধ্য হয়। সহ্য করে কারণ তাদের নোংরা ও নীচু প্রকৃতির কাজগুলো করার জন্য সস্তা শ্রমের দরকার হয়। বাড়ির বুয়া, চাকর-বাকর, দারোয়ান, গাড়ির ড্রাইভার, হেলপার, মিউনিসিপ্যালিটির আবর্জনা সরাবার জন্য লোকজন, ইত্যাদি। এদের ছাড়া আবার ভদ্রলোকদের জীবন মসৃণ রাখা কঠিন। এদের ছাড়াও শহরে সহ্য করা হয় পোশাক কারখানার জন্য কিশোর ও কিশোরী সস্তা শ্রমিকদের। কিন্তু তাদের থাকতে হয় বদ্ধ বস্তিতে এক ঘরে দশ-পনেরো জন। যে মজুরি পায় তা ঘরভাড়া দিতেই চলে যায়। খাবার ঠিকমত খায় কিনা সন্দেহ। কিন্তু তারাও যখন কারখানায় কাজ করে, তখন তাদের তালা মেরে রাখা হয় জেলখানার বন্দির মতো। কারখানায় আগুন লাগলে যে কোনো দুর্ঘটনায় তারা পুড়ে মরে, হুড়োহুড়ি করে বেরুতে গিয়ে পায়ের চাপায় পিষ্ট হয়ে লাশ হয়ে যায়। ভবন ধসে পড়ে প্রায়ই। তখন তাদের জ্যান্ত কবর হয়। রানা প্লাজা ধসে গিয়ে চাপা পড়ে মরেছে হাজারেরও বেশি মানুষ।

যে জালিম ব্যবস্থা গরিবকে নিরন্তর গরিব করে রাখে, যে ব্যবস্থায় পুঁজির কাছে নিজেকে বেচে দিয়ে নগণ্য মজুরির ওপর জন্তু-জানোয়ারের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আল্লাহর দুনিয়ায় মজলুমের প্রাণধারণের কোনো উপায় আর অবশিষ্ট থাকে না, সেই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছিল হেফাজত। কেন এসেছিল কারণ তার জীবন থেকে এই ব্যবস্থা যা কেড়ে নিতে পারেনি তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নিজের ঈমান-আকিদার প্রতি অঙ্গীকার এবং নবী করিম (সা.)-এর প্রতি অগাধ প্রেম। কুিসত ও কদর্য ভাষায় বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে তার জীবনের শেষ এই সম্বলটুকুরও অবমাননা, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেছে শহরের মানুষ। হেফাজত তার ঈমান-আকিদার জায়গা থেকেই প্রতিবাদ করেছে। যে ভাষা তার জানা, সেই ভাষাতেই। কিন্তু তার দাবি ও ভাষা শহরের মানুষের কাছে মনে হয়েছে পশ্চাৎপদ। যে ভাষায় শহরের মানুষ ঔপনিবেশিক মনিবের গোলামি করতে করতে ‘আধুনিক’ হয়েছে এবং এখন যে ভাষা সে দৈনন্দিন সাম্রাজ্যবাদের দাসবৃত্তিতে নিয়োজিত থাকতে থাকতে রপ্ত করে চলেছে, সেই ভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষা শহরের মানুষ বুঝতে অক্ষম। গোলামির ভাষা নিরন্তর যে বদ্ধ চিন্তাকাঠামোর জন্ম দেয়, তার প্রথম অন্ধবিশ্বাস হচ্ছে ধর্ম মাত্রই পশ্চাৎপদতা, মধ্যযুগীয়। ধর্ম মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল। ফলে ধর্মের ভাষায় যারা কথা বলে, তারা পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল। হেফাজতিরা ধর্মের ভাষায় কথা বলে। নিজের পক্ষে যুক্তি খাড়া করে কোরআন হাদিস থেকে। ফলে তারা প্রতিক্রিয়াশীল ও সভ্যতার শত্রু। এদের ঢাকায় সমাবেশের অনুমতিই বা দেয়া হলো কেন এদের ক্ষেত্রে দরকার অপারেশন ফ্লাশআউট।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই কালপর্বে ইসলামের জায়গা থেকে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার কথা বলা আরও বড় অপরাধ। যারা বলে তারা সভ্যতার শত্রু, সাম্প্রদায়িক, বর্বর ও সন্ত্রাসী ইত্যাদি। শহরের মানুষ ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষগুলোর আত্মমর্যাদা বোধের গভীরে যে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে, তা অনুধাবন করতেও এই কালে অক্ষম। অতএব তাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারা কঠিন কিছু নয়। এটা তাদের কাছে বিবেক, রাষ্ট্রচিন্তা বা মানবাধিকারের কোনো মামলা নয়। বর্বরের দলকে স্রেফ গুলি করে শিক্ষা দেয়ার ব্যাপার। বর্বরের দলকে আগে ঢুকতে দাও শহরে, তারা শহরে ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছে সেই খবর নিজেদের নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনে দেখাও। শহরের ধনী ও মধ্যবিত্তকে আতঙ্কিত হতে দাও। দোকানপাট ভবন পুড়ে দাও। কোরআন শরিফও পুড়িয়ে দিয়ে দাবি কর হেফাজতিরাই এই কাণ্ড করেছে। একসময় আলো বন্ধ করে দাও। ব্ল্যাকআউট কর। তারপর শাপলা চত্বরে যে জায়গায় এসব প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাৎপদ দাড়িওয়ালা টুপিওয়ালা লোকগুলো একত্রিত হয়েছে, তাদের ওপর হামলা কর। চালাও হত্যাযজ্ঞ। মারণাস্ত্রের ভয়ঙ্কর আওয়াজে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠলেও কিচ্ছু আসে যায় না। রক্তাক্ত বুলেটই হেফাজতিদের প্রাপ্য।

পুলিশের একজন বড়কর্তা দাবি করেছেন তারা বিভিন্ন ধরনের ‘নন-লেথাল অস্ত্র’ ব্যবহার করেছেন। এসব নাকি ‘প্রাণঘাতী’ নয়। ‘নন-লেথাল’ ধারণাটি ব্যবহারের পেছনে নির্মানবিক বা ডিহিউম্যানাইজড চিন্তা কাজ করে। যেমন আজকাল পরিবেশসচেতন দেশে কোথাও একপাল গরু-ছাগল বা হরিণ বা কোনো বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রে লেথাল অস্ত্র ব্যবহার করলে পরিবেশবাদীদের কাছে ‘কৈফিয়ত’ দিতে হয়, তেমনি যেন এখানে বন্য জন্তু-জানোয়ার নিয়ে কথা হচ্ছে। যাদের ওপর অস্ত্র প্রয়োগ হচ্ছে তারা মানুষ এবং এই সমাজের অন্তর্গত, তাদের আত্মীয়-স্বজন ছেলেমেয়ে রয়েছে, সেই দিকগুলো বিবেচনার বাইরে থেকে গেছে। তেমনি থেকে গেছে এই মানুষগুলো পঙ্গু হয়ে গেলে বাকি জীবন কীভাবে কাটাবে, সেই গুরুতর মানবিক প্রশ্ন। শহীদ হয়ে যাওয়া এক কথা আর চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকা আরও ভয়ঙ্কর। অথচ যাদের ওপর এসব মারণাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, তারা এদেশেরই নাগরিক। নাগরিকতার কথা দূরে থাকুক, মানুষ হিসেবেই তাদের বিবেচনা করা হয়নি।

তবে ‘নন-লেথাল অস্ত্র’ ব্যবহারের ব্যাপারে অবশ্য ছবি, ভিডিও ফুটেজ ও আহতদের দেয়া তথ্য ভিন্নকথা বলে। সাংবাদিকদের তোলা ছবি দেখে অভিযোগ উঠেছে অপারেশনে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে রয়েছে একে-৪৭ রাইফেল ও চাইনিজ রাইফেল (বিজিবি ও র‌্যাব), একে-৪৭-এর ইউএস ভার্সন এম-১৬, মেশিনগান, সাবমেশিন কারবাইন, চাইনিজ রাইফেল, শটগান (র‌্যাব-পুলিশ) ইত্যাদি।

সঙ্গত কারণেই এ সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। কতজন মানুষ হত্যা করা হয়েছে, গণমাধ্যমগুলো বিতর্ক করছে। কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বীভৎস ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে, লুকাবার কোনো উপায় নেই। লাশ কীভাবে ময়লা-আবর্জনা সরাবার গাড়িতে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, সে বিষয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা চলছে। এখন লড়াই চলছে একপক্ষের তথ্য প্রকাশ আর অন্যপক্ষের তথ্য লুকানোর প্রাণান্ত প্রয়াসের মধ্যে। অভিযোগ উঠেছিল সেই রাতেই লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সরকার ক্রমাগত তা অস্বীকার করেছে। তবে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করা হয়েছে। তারা একটি নতুন ভিডিও ফুটেজ পেয়েছে, যাতে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, শেষরাতে গাড়িতে লাশ তোলা হচ্ছে। জুরাইন কবরস্থানের কবর খননকারী আবদুল জলিল জানিয়েছেন, সেই রাতে তিনি ১৪ জন দাড়িওয়ালা লোককে কবর দিয়েছেন। তাদের মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে আবদুল জলিল বাকপ্রতিবন্ধী; তাই তিনি ইশারায় পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। নিহতের সংখ্যা হাতের আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেন তিনি। তাদের কোথায় দাফন করা হয়, তা-ও দেখিয়ে দেন আবদুল জলিল।

একটি দেশের সরকার আলো নিভিয়ে অন্ধকারে তিনটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দশ হাজারেরও বেশি সদস্য নিয়ে নিজেরই নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে-এই সত্য আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। রীতিমত অবিশ্বাস্য হলেও এই নির্মম ও অবিশ্বাস্য ঘটনাই বাংলাদেশে ঘটেছে।

কিন্তু তারপরেও এই সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি করবার লোকের অভাব হবে না। এই তর্ক চলবে। যার যার শ্রেণীস্বার্থের বিষয়! সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তি তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়ে নানাভাবে হাজির হতে থাকবে। হেফাজতে ইসলাম একদিনে ঢাকায় কী ‘তাণ্ডবই’ না করেছে, তার সচিত্র কাহিনী প্রচারিত হতে থাকবে টেলিভিশনে। হঠাৎ করে দেখা গেল গাছ-প্রেমিকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। হেফাজতিরা শহরের গাছ কেটে ফেলে তা রাস্তায় ফেলে রেখেছে, আর কিছু গাছ জ্বালিয়েছে। সাঁজোয়া যান ও জলকামান ব্যবহার করে মিছিলগুলোর ওপর পুলিশ ও সরকারের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর হামলা ঠেকাতে এই গাছগুলো ব্যবহার হয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। রোড ডিভাইডারগুলো উঠিয়ে এনেছে ব্যারিকেড দেয়ার জন্য। নিরস্ত্র মানুষদের অক্ষম হলেও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাগজ, টায়ার, ডালপালা ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ জ্বালাতে হয়েছে কারণ পুলিশ বৃষ্টির মতো কাঁদুনে গ্যাস ছুড়েছে। আগুন কাঁদুনে গ্যাসের জ্বালা কমায়। সন্দেহ নেই হেফাজত যেখানে পেরেছে তাদের ওপর সরকারের চালানো হামলা প্রতিরোধ করেছে। কিন্তু সেটা করেছে নিরস্ত্র জনগণ যেভাবে হাতের কাছে যা পায়, তা-ই দিয়ে। হেফাজত মোমের পুতুল ছিল না। রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ ছিল, যাকে আঘাত করলে সে খালি হাত হলেও প্রতিরোধ করে।

এটা ঠিক, হেফাজতকে ঢাকা শহর থেকে ‘ফ্লাশআউট’ করা হয়েছে। এটা ছিল নিষ্ঠুর ও নির্মানবিক কিন্তু সবচেয়ে সহজ কাজ। সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নের মোকাবিলা করা। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের কেন্দ্রে হেফাজতে ইসলাম শুধু নিজের জন্য একটি জায়গা করে নেয়নি, বরং এটা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে ইসলাম বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রীয়, গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ধারক প্রশ্ন। এই প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি বারবারই পাঁচ ও ছয় তারিখের হত্যাযজ্ঞকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকবে, ইতিহাসও লেখা হবে এই রক্তাক্ত অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে। রাজনৈতিক চেতনার পরিগঠন কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব মুখস্থ করে দানা বাঁধে না, বাস্তব ঘটনা থেকেই নতুন বয়ান তৈরি হয়। তার রূপ কী দাঁড়াবে তা এখনই বলার সময় আসেনি; কিন্তু জনগণের সংগ্রাম এগিয়ে যাবে, পিছিয়ে যাবে না। এই হত্যাযজ্ঞ থেকে কী শিক্ষা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে, তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনের লড়াই-সংগ্রামের চরিত্র। পুরো ঘটনার মূল্যায়ন বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তির ভূমিকা বিচারের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে এবং উঠতে বাধ্য যে, এ লড়াই নিছকই ইসলামপন্থী বনাম ইসলামবিদ্বেষী বা বিরোধীর নয়, লড়াইয়ের এই প্রকাশ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বাইরের দিক মাত্র। ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণার গোড়ায় নিছকই বিশ্বাসশূন্যতা বা ধর্মহীনতা কাজ করে না, প্রবল শ্রেণীঘৃণাও কাজ করে। হেফাজতে ইসলাম নিজেও তার নিজের জায়গা থেকে এই সত্য জানে ও বোঝে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে হেফাজতে ইসলাম তার একটি ওয়েবসাইটে লিখেছে, ‘আজ মানুষ থেকে মনুষ্যত্ববোধ বিদায় নিয়েছে। মানুষ হিংস্র দানবে রূপান্তরিত হয়েছে। নিজের প্রতিপালকের পবিত্র বাণী ও নির্দেশনা প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত। আজ মানবতা ও নৈতিকতার আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু মজলুম নিষ্পেষিত শোষিতদের চিৎকার, শাসকদের শোষণ, জালেমদের জুলুম, বিত্তশালীদের অত্যাচারে যেন জমিন ফেটে যাবে। এই শোষণ এবং নিষ্পেষণের জাঁতাকল থেকে ‘বিপন্ন মানবতাকে মুক্তি’ দেয়ার জন্যই হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে।

যদি তা-ই হয় বাংলাদেশের গরিব, নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণ ও খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির নতুন বয়ান তৈরির ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। ধনী ও উচ্চবিত্তরা ইসলাম ততটুকুই বরদাশত করে, যতক্ষণ তা গরিবের হক ও ইনসাফের ব্যাপারে কোনো কথা বলে না, নিশ্চুপ থাকে। জালিমের কাছে ইসলাম ততক্ষণই ধর্ম, যতক্ষণ তা মসজিদের চারদেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। ধর্ম যতক্ষণ ব্যক্তিগত ও পারলৌকিক স্বার্থোদ্ধারের উপায়মাত্র, ততক্ষণই তা ধর্ম বলে বিবেচিত। কিন্তু ধর্ম যখন ব্যক্তির বদ্ধ গণ্ডি অতিক্রম করে সমাজে, সংস্কৃতির পরিসরে ও রাজনীতির পরিমণ্ডলে এসে দাবি করে গণমানুষের অধিকার আদায় ও ইনসাফ কায়েমও তার সংকল্পের অন্তর্গত তখন তার বিরুদ্ধে হেন কোনো মারণাস্ত্র নেই যা নিয়ে জালিম ঝাঁপিয়ে পড়ে না।

অপারেশন ফ্লাশআউট সেই সত্যই নতুন করে প্রমাণ করল মাত্র।

নোট: পূর্ব প্রকাশিত দৈনিক আমার দেশ

Loading


Comments

অপারেশন ফ্লাশআউট — 2 Comments

  1. ক্ষমতার মোহে উম্মাদ হয়ে জনগণ-বিরোধীদল সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে বেআইনি অস্ত্রসম্ভার ধরিয়ে দিয়ে প্রশাসনের সাথে বি-টিম হিসেবে গভীর রাতে ঘুমন্ত-নিরস্ত্র জনগণের ওপর নামিয়ে দিয়ে রাতের আঁধারে বাংলাদেশের ইতিহাসের বীভৎসতম গণহত্যা চালালেন, মিডিয়া ও জনগণের মধ্যখানে এসে দুর্বৃত্তের মত সমস্ত মিডিয়াকে কুক্ষিগত করে, মিডিয়ার গলা টিপে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন। নিজের সমস্ত অপকর্মকে জায়েজ করার জন্য রাষ্ট্রের উচ্চতম দায়িত্ববান পদে থেকেও অজস্র মিথ্যের ফুলঝুরি ছোটাতে শুরু করলেন, ছুটিয়ে সেগুলোকে কলঙ্কিত-কলুষিত করলেন, অধীনস্থ প্রশাসনকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করে তাদের দিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলিয়ে জনসম্মুখে তাদের ভাবমূর্তিরও ১২ টা বাজালেন। দলীয় প্রতিনিধিগণ, উচ্ছিষ্টভোগী ভাড়াটে বুদ্ধিজীবিদের দিয়ে ‘যেমন খুশি বলো’ জাতীয় মিথ্যে বলার মহাযজ্ঞের আয়োজন করলেন, সংবাদপত্রগুলোকে চরম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রায় পাঠকশূন্য করে ফেললেন _ এখন জনগণ সত্য জানার জন্য কার দ্বারস্থ হবে ? কোথায় যাবে ?

    একটি কর্তৃপক্ষের স্বার্থে আঘাত হানবে সেজন্যে জনগণকে জম্বির মতো নিশ্চুপ বসে থাকতে হবে ? বিকল্প জনগণ খুঁজে নেবে না নিজের উদ্যোগে ? সংবাদপত্রগুলো সঙের কৌতুকে পরিণত হয়েছে, টিভি ও অন্যান্য মিডিয়াতেও সঠিক সংবাদ নেই, রাজনৈতিক নেতারাও মিথ্যে ছাড়া প্রায় বলেনই না _ মানুষ যাবে কই ?

    “বাঁশের কেল্লা” জামাত-শিবিরের হোক, বিএনপির হোক যে দলেরই হোক _ কিছু ভুল সংবাদ থাকলেও এমন সময় সঠিক সংবাদগুলোও পরিবেশন করেছে যখন মানুষ হাজার চেষ্টাতেও কোন সংবাদ জানতে পারছিল না। ১০০% সঠিক সুত্র কোনটাই না। “বাঁশের কেল্লা” দলীয় এজেন্ডা কিছু কিছু প্রচারিত হলে হোক, সেটা কেই বা না করছে ? ঐতিহাসিক গণহত্যার খবর তো এদের মাধ্যমেই দেশবাসী, বিশ্ববাসী জানতে পারলো। সরকারের হোমরা চোমরারা কিছুতেই জানতে দিচ্ছেন না, পাইকারি হারে মিথ্যে বলতে বলতে জিভে ফেনা তুলে ফেলছেন সেই পরিস্থিতিতে “বাঁশের কেল্লা” কিংবা এমনকি কোন গজিয়ে ওঠা “ঘাসের কেল্লা” ও যদি মোটামুটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দিতে পারে সেটাকেই মানুষ খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরবে এটাই স্বাভাবিক।

    পরিশেষে আরো একটি ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। সরকারে পরম পৃষ্ঠপোষকতায় ৩ মাস শখের ব্যর্থ বিরিয়ানি বিপ্লব ঘটানোর সুযোগ পেয়েছে শাহবাগিরা। এতে তাদের অপদার্থতা ও ঔদ্ধত্য বেড়েছে শতগুণ। অথচ স্বয়ং রাসূল(সাঃ) এর অবমাননার বিচারের প্রাণের দাবি নিয়ে সারা বাংলাদেশ থেকে আসা সাধারণ মানুষদের ১ টি রাতও সহ্য হয় নি তাদের। ১ টি মাত্র রাত ঢাকায় অভুক্ত, হতক্লান্ত, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত সাধারণ জনগণ নির্বিঘ্নে কাটাতে পারেনি। শাহবাগি বা ভন্ড সুশীল সমাজ যেখানে এই গণমুসলিম হত্যার ঘটনার সত্যতাকে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে, অসৎভাবে, ব্যক্তিত্বহীন চাটুকারের মেরুদন্ডহীনতায়, অমানবিকভাবে পুরোপুরিই ‘অস্বীকার’ করতে পারছে _ বরং এই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি মুসলিমের রক্তাক্ত লাশের ওপর দাঁড়িয়ে অশ্লীল দম্ভের সাথে দলবেঁধে বিদ্রুপের পৈশাচিক অট্টহাসি হাসতে পারছে ;

    সেখানে “বাঁশের কেল্লা” র একাধিক টিমে নির্মমভাবে নিহত নিরস্ত্র মুসলিমদের নিজের ভ্রাতৃসম সমব্যাথী হয়ে আত্মজের বিচার চাইতে সারা দুনিয়ায় জনমত সৃষ্টিতে বিনিদ্র রজনী যাপন করছে, হত্যাকারীদের এই জঘন্যতম অবিচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করছে, খুঁজে খুঁজে সঠিক সংবাদ বিভিন্ন সুত্র থেকে জোগাড় করার চেষ্টা করছে _ সেখানে একমাত্র সুবিধাভোগী অমানুষ ছাড়া বিবেকের কিয়দংশও অবশিষ্ট থাকলে কোন যুক্তিতে বাংলার মুসলিম জনগণ “বাঁশের কেল্লা” য় অবস্থান গ্রহণ না করে সরকার-ভন্ড সুশীলসমাজের পরিবেশিত ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যেগুলো গলধঃকরণ করার জন্য বসে থাকবে ?

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *