বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন

ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন যে, অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের দ্বারা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল। সেই থেকে যদি আমরা বাংলায় ইসলামের সূচনা ধরি তাহলে অন্তত ১২০০ বছর ধরে বাঙালি সমাজের কোনো না কোনো অংশে যেভাবেই হোক একটি সক্রিয় জীবনাদর্শরূপে ইসলাম অস্তিত্বশীল আছে। তা সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাসকে এত দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস বলে গণ্য করা চলে না। কারণ ইতিহাসে এটাও নির্দেশিত হয়েছে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে বাংলাভাষী সমাজে ইসলামের প্রসার এত অল্প হয়েছিল যে, তা নিতান্তই উল্লেখের দাবি রাখে মাত্র। তার বেশি নয়। বাংলায় ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল প্রধানত উত্তর ভারত থেকে আসা সুফিদের দ্বারা। বাংলার বৌদ্ধ জনসাধারণ ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। শক্তি, শৈব, বৈষ্ণব (চেতনাপূর্ব) প্রভৃতি ধর্ম থেকেও মুসলমান হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে ইতিহাসের সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত নয়, অনুসন্ধান চালালে নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে এবং তাতে ধারণা বদলাতেও পারে। ইখতিয়ার উদ্দীনের লক্ষণাবতী দখল থেকে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ধরলেও বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস অন্তত ৭০০ বছরের। তাও কম সময় নয়। বাঙালি মুসলমানদের এ দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসের পাতার ওপর দিয়ে শুধু চোখ বুলিয়ে গেলেই বিশ্বাসের ও আচরণের বিস্তর পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ওহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত যে আন্দোলন উনিশ শতকের অর্ধেককালব্যাপী ব্যাপকভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজে পরিচালিত হয়েছিল, সেই আন্দোলনের নেতাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল, মুসলমান বাঙালিরা তখনো যথেষ্ট পরিমাণে মুসলিম হয়ে ওঠেনি তাদের মধ্যে তাদের হিন্দু-বৌদ্ধ পূর্ব-পুরুষদের আচার-আচরণ, সংস্কার, বিশ্বাস_ এমনকি পূজা-পার্বণ পর্যন্ত রয়ে গেছে। এ উপলব্ধি নিয়ে ওহাবি কর্মীরা তাদের মতে, ‘ভারতের তথাকথিত মুসলমানদের’ ‘মুসলমানিকরণে’ মন দেয়। কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন : ওহাবি প্রচারকদের মতে_ ‘বাংলার অধিকাংশ মুসলমান ছিল অদ্ভুত কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীব, তারাই তাদের মুসলমানি আচার-ব্যবহার নতুন করে শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের দাবি মিথ্যা নয়। এক আচারের পরিবর্তে অন্য আচার তারা বাংলার মুসলমানকে শেখাতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু যেভাবে শিক্ষা নিলে কোরআনের-ইসলামের মর্যাদা রক্ষা হতো, সেভাবে দেয়া হয়েছে কিনা তাও বিচার্য। … ওহাবি অথবা ওহাবি প্রভাবান্বিত প্রচারকদের প্রচারের ফলে বাংলার মুসলমানদের অনেকে নামাজ পড়তে শিখেছেন, কিন্তু কিছুই না বুঝে।’ ওহাবি আন্দোলনের রূপ আরব দেশে, অন্যান্য মুসলমান দেশে এবং বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে এক রকম ছিল না। বাংলাভাষী ভূখ-ে এ আন্দোলন সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ওহাবি প্রচারকদের সম্পর্কে ঙঁৎ ওহফরধহ গঁংধষসধহং গ্রন্থে হান্টারের এ উক্তিও রোমাঞ্চকর। ‘পূর্ববঙ্গের প্রায় প্রত্যেক জেলা থেকে ওহাবি প্রচারকরা সাধারণত ২০ বছরের কম বয়সের শত শত সরলমতি যুবককে অনেক সময়ে পিতামাতার অজ্ঞতাতে, নিশ্চিত প্রায় মৃত্যুর পথে সঁপে দিয়েছে। শত সহস্র কৃষক-পরিবারে তারা দারিদ্র্য ও শোক প্রবিষ্ট করছে, আর আশা-ভরসাস্থল যুবকদের সম্পর্কে পরিজনের অন্তরে একটা স্থায়ী দুর্ভাবনা এনে দিয়েছে। যে ওহাবি পিতার বিশেষ গুণবান অথবা বিশেষ ধর্মপ্রাণ পুত্র বিদ্যমান। তিনি জানেন না কোন সময়ে তার পুত্র গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যাবে। এভাবে যেসব যুবকদের উধাও করা হয়েছে তাদের অনেকেই ব্যাধি, অনাহার অথবা তরবারির আঘাতে বিনষ্ট হয়েছে।’ ওহাবি আন্দোলনের এ সশস্ত্র রূপ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের বিপ্লববাদী আন্দোলন-ইংরেজ সরকার যার নাম দিয়েছিল সন্ত্রাসবাদ ১৯৬০-এর দশকের সশস্ত্র নকশালপন্থী আন্দোলন এবং পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র কর্মকা-ের কথা। এসব আন্দোলনের কর্মীরাও সংগৃহীত হয়েছিল প্রধানত ২০ বছরের কম বয়সের তরুণদের থেকেই। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশে ইসলামের নামে আবার দেখা দিয়েছে গোপন সশস্ত্র কর্মকা-। বাংলাভাষী ভূখ-ে সশস্ত্র সংগ্রামের ও সশস্ত্র কর্মকা-ের ঐতিহ্য দীর্ঘকালের; কত দীর্ঘকালের তা অনুসন্ধান করলে বাংলাভাষী জনসমষ্টির মানসপ্রবণতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহাসিকভাবে অর্জিত শক্তি ও দুর্বলতার কারণ বোঝা সহজসাধ্য হবে। ওহাবি আন্দোলন আরবে ছিল মুখ্যত প্রচারমূলক ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী বিশুদ্ধতাবাদী আন্দোলন। কিন্তু ভারতে বা বাংলায় এ আন্দোলনের রাজনৈতিক রূপ প্রচ্ছন্ন ছিল না। তবু আদর্শগত পরিচয়ে ভারতে এবং বাংলায়ও ওহাবি আন্দোলন ছিল ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদী শুদ্ধি আন্দোলন_ ইংরেজিতে ওংষধসরপ চঁৎরঃধহ জধারাধষরংঃ গড়াবসবহঃ. ইসলামের আদি রূপকে পুনরুজ্জীবিত করে মুসলমান বাঙালিদের জীবনকে তারা পূর্ব সংস্কারমুক্ত ও বিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং তার জন্য তারা অস্ত্র ধরেছিলেন। আজকের অবস্থা বিচার করতে গেলেও হয়তো একই প্রশ্ন উঠবে : ৭০০ বছরে বা তার চেয়েও দীর্ঘতর সময়ে মুসলমান বাঙালিরা কতটা মুসলমান হয়ে উঠেছে বা হতে পেরেছে? আরো প্রশ্ন উঠবে, মুসলমান বাঙালিদের জীবনে অদূর এবং সুদূর ভবিষ্যতে ইসলামি মতাদর্শ জোরদার হওয়ার এবং বাংলার পরিবেশে তার আদি রূপের পুনরুজ্জীবনের ও শুদ্ধিকরণের সম্ভাবনা কতখানি? বাংলাদেশে গত তিন দশক ধরে যেভাবে দ্রুতগতিতে নতুন নতুন মাদ্রাসা, মসজিদ, মাজার নির্মিত হয়ে চলছে, মাদ্রাসা শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়ছে, গ্রামাঞ্চলে ওয়াজ-নসিহতের অনুষ্ঠান এবং শহরাঞ্চলে মিলাদ মাহফিল, ইফতার পার্টি, ঈদ পুনর্মিলনী ইত্যাদি যেভাবে জাঁকজমকপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করেছে, রেডিও-টেলিভিশনে আজান ও অধিক সংখ্যায় ইসলামী অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা হয়েছে, রমজানের পবিত্রতা রক্ষা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইজতেমা, পীর-ফকির, গণক-জ্যোতিষ, তাবিজ-কবচ, ঝাড়-ফুঁক ও তার পানির প্রতিপত্তি বাড়ছে এবং রাজনীতিতে ইসলামের অপব্যবহার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে, ঠিক সেই অনুপাতে কি মর্মগত দিক দিয়ে ইসলামী মতাদর্শ কার্যকারিতা পাচ্ছে? সামাজিক অগ্রগতিতে ইসলাম আজ কি ভূমিকা পালন করছে? বাংলার সমাজে ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা অতীতে কী ছিল, বর্তমানে কী আছে এবং ভবিষ্যতে কী হবে? গত ৭০০ বছরে মুসলমান বাঙালিদের অবস্থা এবং ইসলাম সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি যেমন বিবর্তিত হয়েছে, তেমনি ইসলামের প্রভাবে অমুসলিম বাঙালিদের অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। মুসলমানদের মধ্যে জাতিভেদ নেই, হিন্দুদের মধ্যেও জাতিভেদের কঠোরতা হ্রাস পেয়েছে, শ্রী চৈতন্যের নেতৃত্বে বৈষ্ণব মতবাদ বিকশিত হয়েছে, ধর্মীয় প্রভাবের পারস্পরিকতার ফলে মিলনের ও সংশ্লেষণের কিছু ধারা বিকশিত হয়েছে, দীর্ঘকাল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে, দাঙ্গার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভক্ত হয়েছে, পাকিস্তানের বিভক্তিতে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া কাজ করেছে এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধে হত্যাকা-ের সময়ে ইসলামের নাম ব্যবহৃত হয়েছে। আজো এ সমাজে ইসলামের নামে হত্যাকা- থেকে শুরু করে কত ধরনের গর্হিত ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হয় এবং রাজনীতির ক্ষেত্রেও দরিদ্র জনসাধারণকে ভাঁওতা দিয়ে হীনস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে ইসলামের নাম কাজে লাগানো হয়। ইসলাম যেমন বিদেশ থেকে এ দেশে প্রচারিত হয়েছে তেমনি বিদেশ থেকে এসেছে খ্রিস্টধর্ম, পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শ। ধর্মের নামে যেমন তেমনি এসব আদর্শের নামেও গর্হিত ক্রিয়াকলাপ চলে। বর্তমানে বিভিন্ন মতাদর্শের পারস্পরিক সংঘাতও এ সমাজে চলছে। তবে এ কথাও সত্য যে উপস্থিতকালে বাংলাদেশের সমাজে কোনো আদর্শেরই উপলব্ধি ও অনুশীলন গভীরতা পায়নি_ মানবীয় বিচার-বুদ্ধির পর্যাপ্ত পরিচালনা পায়নি_ নানারকম বিকার-বিকৃতি ও অস্থিরতা এ দেশে মানুষের উপলব্ধিকে ও মনোজীবনকে করে রেখেছে বিকারগ্রস্ত, অসুস্থ, অস্বাভাবিক, উত্তেজিত, অবিমৃষ্যকারী, অপরিণামদর্শী, আত্মঘাতী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে প্রিয় হয়েছে গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী। বিশ্বনবীর জনপ্রিয়তার কারণ হয়তো এই যে, এ বইতে মোস্তফা চরিত্রের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এক সম্মোহিত দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে, যে দৃষ্টিভঙ্গি একই সঙ্গে সম্মোহনকারীও বটে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস ও ভক্তি যতটা প্রবল তার চেয়ে প্রবল বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত আবেগ-উচ্ছ্বাস; এতে বিবেক, যুক্তি, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধিৎসা, বিচার-বিবেচনার প্রবণতা ইত্যাদি একেবারেই ভেসে যায় অন্ধ আবেগের প্রবল স্রোতে। এ বইয়ের প্রভাবের কথা ভাবতে গেলে আমাদের স্মরণ হয় কাজী আবদুল ওদুদের। সম্মোহিত মুসলমান (জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩) প্রবন্ধের কথা। ওই প্রবন্ধে মুসলমান বাঙালিদের তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: ‘জীবনের অর্থই যেন আধুনিক মুসলমান বোঝে না। বুদ্ধি, বিচার, আত্মা, আনন্দ_ এসবের গভীরতার যে আস্বাদ, তা থেকে তাকে বঞ্চিত ভিন্ন আর কিছু বলা যায় না। জগতের পানে সে তাকায় শুধু সদিগ্ধ আর অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে, এর ফলে যেন সে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, একে যেন সে চেনে না। কেমন এক অস্বস্তিকর অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সারাজীবন সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চলেছে।’ মুসলমান বিশেষ করে আধুনিক মুসলমানের এ অবস্থা লক্ষ্য করেই বলতে চাই_ সে সম্মোহিত। সে শুধু পৌত্তলিক নয়, সে এখন যে অবস্থায় উপনীত তাকে পৌত্তলিকতার চরম বলা যেতে পারে; তার মানবসুলভ সব বিচার-বুদ্ধি, সব মানস-উৎকর্ষ আশ্চর্যভাবে স্তম্ভিত। বর্তমান তার কুয়াশাচ্ছন্ন, দিগদেশহীন, অতীত ভবিষ্যৎ তার নেই। সময় সময় দেখা যায় বটে সে তার অতীতকালের বীরদের, রাজাদের, ত্যাগীদের, মনীষীদের কথা বলছে। কিন্তু এ শেখানো বুলি আওড়ানোর চেয়ে এক তিলও বেশি কিছু নয়।… প্রকৃত সম্মোহিতের মতো তার জন্য একমাত্র সত্য প্রভুর হুকুম- স্থূলবুদ্ধি শাস্ত্র ব্যবসায়ী প্রভুর হুকুম। সেই প্রভুর হুকুমে কখনো কখনো ভবিষ্যতের অসংলগ্ন স্বপ্ন সে দেখে- কখনো ‘প্যান ইসলাম’-এর স্বপ্ন, কখনো এই ১৩০০ বছরের পুরো ইতিহাস, পুরো বর্তমান পরিবেষ্টন, যেন জাদুমন্ত্রে উড়িয়ে দিয়ে সেই ১৩০০ বছরের আগেকার ‘শরীয়ত’-এর হুবহু প্রবর্তনার স্বপ্ন। কত নিদারুণ তার জীবনের পক্ষে এ প্রভুর হুকুম তার প্রমাণ এখানে যে, এর সামনে তার সব বুদ্ধি-বিচার-স্নেহ-প্রেম-শুভেচ্ছা সব স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব আশ্চর্যভাবে অন্তর্হিত হয়ে যায়। সে যে চিরদাস, চির অসহায়, অত্যন্ত অপূর্ণাঙ্গ মানুষ_ এই পরম বেদনাদায়ক সত্য ভিন্ন আর কিছুই তার ভেতরে দেখার থাকে না।’ এ বর্ণনায় যে অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে তুলনায় আজকের অবস্থা ভিন্ন; তবু জনসংখ্যা বৃদ্ধির এবং শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির সমানতালে কি বিশ্বনবীর পাঠক সংখ্যা বেড়ে চলছে না? এই পাঠকদের মনে কি কোনো জিজ্ঞাসা জাগে? যুক্তির উদয় হয়? ধর্মপ্রবর্তকের প্রতি মুসলমান বাঙালিদের মনোভাব লক্ষ্য করে ‘সম্মোহিত মুসলমান_ এই কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন : ‘মহাপুরুষ সর্বজ্ঞ নন, মানুষের সর্বময় প্রভু নন, মানুষের জীবন সংগ্রামে তিনি একজন বড় বন্ধু মাত্র, ‘তার কথা ও চিন্তার ধারা চিরকালের জন্য মানুষের পথকে নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছে_ এ কথা বিশ্বাস করলে মানুষরূপে তার সাধনাকে চরম অপমানে অপমানিত করা হয়’, মহামানব মুহম্মদের অনবর্তীরা ‘অন্যান্য ছোটখাটো প্রতিমার সামনে নতজানু হওয়ার দায় থেকে কিছু নিষ্কৃতি পেলেও ‘প্রেরিতত্ব’ রূপ এক প্রকা- প্রতিমার সামনে নতদৃষ্টি হয়ে জীবনপাত করছেন।’ ‘মোস্তফা-চরিত’ ও ‘বিশ্বনবী’ দুটো গ্রন্থই ‘সম্মোহিত মুসলমান’-এর অন্তত এক দশককাল পরে লেখা। ‘রিসালাত’; ‘ওহি’, ‘মিরাজ’, ‘সিনা সাফ’ ইত্যাদি সম্পর্কে মওলানা আকরম খাঁ ও গোলাম মোস্তফার দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পার্থক্য, তা কি কোনো মুসলমান বাঙালির মনে সংশয় জাগায়? প্রশ্ন হলো, মুসলমান বাঙালিদের মনে এসব সম্পর্কে কোনো জিজ্ঞাসা জাগে কি? ‘লড়কে লেঙ্গা পাকিস্তান’, ‘পাকিস্তানের উৎস কি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা-বিশ্বনবী মোস্তফা’ ইত্যাদি সস্নোগানে উন্মত্ত হয়ে যারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করেছেন, লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ ঘটিয়েছেন, লাখ লাখ পরিবারকে বাস্তুহারা করেছেন, এ ভূখ-ে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার পথ রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছেন, বিবেক ও যুক্তির ধারাকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছেন, সুদীর্ঘকাল ধরে এ ভূখ-ে জাতি গঠনের ও সামাজিক প্রগতির সম্ভাবনাকে বারবার বিপর্যস্ত করেছেন, তারা কী কখনো ভেবে দেখেছেন, মানবজাতির কি ক্ষতি তারা করেছেন? যদি বলি বাঙালি-সমাজে ইসলামের ইতিহাস কেবল ‘বহুল পরিমাণে ব্যর্থতার ইতিহাস’ নয়, ‘বহু দুর্যোগ ও দুর্দশা সৃষ্টিরও ইতিহাস’ তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? ইসলামকে দায়ী করার জন্য আমরা এসব কথা বলছি না; বলছি ইসলামের অনুসারীদের কোনো কোনো অংশের আচরণ সম্পর্কে কল্যাণকর সচেতনতা জাগানোর উদ্দেশে। মুসলমান বাঙালিদের বেলায় সবচেয়ে করুণ ব্যাপার হলো তাদের জিজ্ঞাসাহীনতা, যুক্তিবিমুখতা, ঔৎসুক্যহীনতা এবং বিশ্বাসের অন্ধত্ব ও উচ্ছ্বাসপ্রবণতা। দর্শনের জীবন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের মন আলোড়িত হয় না। ঈশ্বরবিষয়ক সমস্যা দর্শনের শাশ্বত জীবন্ত সমস্যাগুলোর একটি। বাংলার কোনো মুসলমান চিন্তাবিদ কি অন্তরের তাগিদে দার্শনিক দিক থেকে সমস্যাটির মুখোমুখি হতে চেয়েছেন কখনো? ‘কোরআনের আল্লাহ’ (১৩৪৫) প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদ আল্লাহকে যেভাবে উপলব্ধি করার কথা বলেছেন, তা কি কখনো কোনো মুসলমান বাঙালির মনে সংশয় কিংবা প্রশ্ন জাগিয়েছে? ওই ক্ষুদ্র প্রবন্ধটিতে তিনি প্রত্যেক মুসলমানকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার চেষ্টা করতে বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর নিরানব্বই নামের প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো গুণ ব্যক্ত করছে, যেসব গুণ মানুষের মধ্যেই কমবেশি দৃষ্ট হয়। কেন, কী অভিপ্রায়ে, তিনি মানুষকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রস্তাব করেছেন? তার প্রস্তাব কি ইসলামসম্মত হয়েছে? তার মন কি অন্ধবিশ্বাসের প্রতি সংশয় ও অনাস্থা প্রকাশ করতে চেয়েছে? আল্লাহর স্বরূপ সম্পর্কে এরূপ ব্যাখ্যা আরবে,্ ইরানে, সিরিয়ায়, মিসরে, স্পেনে কিংবা অন্য কোনো মুসলমান দেশে কোনো চিন্তাবিদ কি কখনো করেছেন? গত আড়াইশ বছর ধরে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ_ এ তিনটি আদর্শ ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়েছে। এগুলোর প্রসার ও প্রতিষ্ঠার পেছনেও রয়েছে বিপুল সংগ্রাম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কী দেখা যাচ্ছে? আফগানিস্তানে ও ইরাকে যেভাবে গণতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে তা কি গণতন্ত্রসম্মত? সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা এখনো সক্রিয় অবস্থান নিয়ে আছে। আর সমাজতন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রকে সাধারণ মানুষের কাছে আবেদনহীন করে ফেলেছে। ধর্মর্, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কোনোটাই আদর্শরূপে আর আগের মতো আবেদনশীল নেই। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের স্থলাভিষিক্ত করা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়নকে। এ বিশ্বায়নের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি মানব জাতিকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে চলছে। এ ব্যাপারে মানব জাতির মধ্যে সক্রিয় সচেতনতা দরকার। দরকার বিজ্ঞানসম্মত নৈতিক চেতনা ও আদর্শ। নৈতিক চেতনার বিশ্বাস ঘটলে এবং উষ্ণতর আদর্শে উত্তীর্ণ হলেই মানব জাতি শান্তি, সমৃদ্ধি, সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতির উপায় বের করতে পারবে। সভ্যতার বিকাশে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তারপর মানুষ অর্জন করেছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের অভিজ্ঞতা, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের অভিজ্ঞতা। গত প্রায় দুই দশক ধরে চলছে বিশ্বায়নবাদের অভিজ্ঞতা। নতুন আদর্শে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ সবকিছুর সংশ্লেষণ বা সিনথেসিস ঘটাতে হবে। প্রজ্ঞা ও চারিত্র্য শক্তি দুই-ই লাগবে।  

পূর্ব প্রকাশিত যায়যায় দিন 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *