বিবাহ অনুষ্ঠানের ভোজ বা ওলীমার বাস্তবতা

বিবাহ মহান রাব্বুল আলামীনের দেয়া চিরায়িত বিধি সম্বলিত একটা নেয়ামত। আল্লাহ নির্ধারিত বিবাহের মাধ্যমে পুরুষ ও নারী পরস্পরে মিলিত হয়ে পরিবার গঠন করে। এ ঘর বাঁধার মাধ্যমে গড়ে ওঠে সংসার, সমাজ, দেশ এবং সৃষ্টি হয় অনাবিল প্রশান্তির পরিবেশ। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘ইয়া আইয়্যুহান্না ছূত্তাকু রাব্বাকুল্লা খালাক্বাকুম মিন নাফসিউ ওয়াহিদা তুউ ওয়া খালাক্বা মিনহা যাওজাহা ও বাচ্ছা মিনহুমা বিজালান কাছিরাও ওয়ানিসাআ ওয়াত্তাক্বুলাহাল্লাজী তাসাআলুনা বিহিওয়াল আরহামা, ইন্নাল্লাহা কানা আলাইকুম রাক্বিবা। অর্থাৎ হে মানবগোষ্ঠী! তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ হতে, উহা হতেই উহার জুড়ি তৈরি করেছেন এবং এই উভয় হতে বহু সংখ্যক পুরুষ ও স্ত্রীলোক (পৃথিবীতে) ছড়িয়েছেন। সেই আল্লাহকে ভয় কর যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের নিকট নিজের নিজের হক দাবি কর। আত্মীয় সূত্র ও নিকটত্বের সম্পর্ক বিনষ্ট করা হতে বিরত থাক। নিশ্চিত জেনো যে, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া দৃষ্টি রাখছেন (সূরা নিসা, আয়াত-১)। এ আয়াতের মর্মার্থ এ কথারই দিক নির্দেশনা দেয় যে, নারী-পুরুষের সম্মিলিত সহঅবস্থান তথা কর্মপদ্ধতির দ্বারা বিশ্বে যে মহাসমারোহের বন্যা বইছে তা মহান রাব্বুল আলামীনের অতুলনীয় সৃষ্টি কৌশলের মহাবারতা ভিন্ন আর কি হতে পারে? নারী-পুরুষের বৈধ মিলন বিধান জারি করে আল্লাহ সুবহানুহু তায়ালা মানুষের মধ্যে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন তার কৃতিত্ব একচ্ছত্রভাবে মহান স্রষ্টারই প্রাপ্য। এ বিষয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এবং তিনি সে সত্তা যিনি পানি দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি এর থেকে নিজ বংশ এবং শ্বশুরালয়ের দু’টি আলাদা ধারা চালু করেছেন, তোমাদের রব খুবই কুদরতময় (আল কুরআন)।

মানুষের মধ্যে এ আত্মীয়তা সম্পর্ক যেমন গড়ে ওঠে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে ঘর-সংসার, পুত্র, কন্যা পরিজনসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সমন্বয়ে তেমনি বিবাহ অনুষ্ঠানের আপ্যায়নের মাধ্যমে সবার সাথে পারস্পরিক পরিচিতি ও ওঠাবসার সুযোগে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। যার ফলে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়।

আমাদের দেশে বিবাহ উপলক্ষ্যে যে, ভোজ দেয়া হয় এটা অতিবিলাস বহুল তথা ব্যয়বহুল যাকে মাত্রাতিরিক্ত জনভোজ বলা যেতে পারে। যে ভোজ অনুষ্ঠানে সচ্ছল শ্রেণীর ধনী বা বড়লোকেরাই নিমন্ত্রণ পেয়ে থাকে। গরিব, দুঃস্থ, নিরন্ন তথা অসহায় জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি খুবই বিরল। এ ধরনের অনুষ্ঠান স্বার্থান্বেষী মহলের পরোক্ষভাবে স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে যে বিবেচিত হয় তাতে আর সন্দেহের কি থাকতে পারে? বিবাহ অনুষ্ঠানে যে খাদ্য পরিবেশন করা হয় তাতে গরিব দুঃস্থদের উপেক্ষা করে নিছক ধনী ও প্রভাবশালীদের দাওয়াত খাওয়ানোর ব্যাপারে ইসলামে শুধু নিরুৎসাহিতই করা হয়নি এ সমস্ত কার্যক্রম যারা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) এর একটা হাদীস এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘আন্নাহু কানা ইযাকুল শাররু ও তয়ামিত তয়ামুল ওলীমা ইউদ লাহাল আগনিয়াউ ওয়া ইউতরাকুল ফুক্বারাউ, অর্থাৎ আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, যে ওলীমায় (অর্থাৎ বিবাহভোজে) শুধুমাত্র ধনী, আমীরদের দাওয়াত দেয়া হয় এবং গরিব ফকীরদের দাওয়াত দেয়া হয় না, সে খাবার সবচেয়ে নিকৃষ্ট … (সহিহ আল বুখারী, হাদিস নং-৪৭৯৬)। ওলীমা বা বিবাহ ভোজের বাড়াবাড়ি মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা ও অপচয় সম্পর্কে পরে আলোচনা করছি। এখন আমি ওলীমাটা কার করা উচিত সে সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই।

ইসলামের সঠিক ইতিহাস ও শরীয়ার দিক নির্দেশনা থেকে যতটুকু জানা যায়, তাহলো বিবাহোত্তর আপ্যায়ন যাকে ওলীমা বলা হয়েছে বিবাহ অনুষ্ঠান যেহেতু একটি নর ও নারীর পরম আত্মীক বন্ধনের শুভ ঘোষণা, এটাও একটা আনন্দঘন মুহূর্ত উপস্থিত সকলের জন্য। এতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায়ের সাথে সাথে সবাই খুশির আমেজে সম্মিলিতভাবে কিছু পানাহার করবে এটাই স্বাভাবিক। এর পানাহার বা দাওয়াতে ওলীমার ব্যবস্থাপনা পাত্র পক্ষের করাটাই প্রয়োজন মর্মে মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) দের জীবনী থেকে জানা যায়। বিবাহের ওলীমা যে মাত্রারিক্ত হওয়া জরুরি নয় সে সম্পর্কেও বহু হাদিস দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায়। এ মর্মে একটি হাদিসের বর্ণনা এ রকমÑ আন সাফিয়া বিনতে শাইবা (রা.) ক্বয়ালাত আওয়লামান্নাবীঊ (সা.) আ’লা বা আদিনিছায়্যিহী বিমুদ্দায়নি মিন শায়্যিরিন অর্থাৎ শাফিয়া বিনতে শাইবা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) তাঁর কোনো স্ত্রীর বিয়েতে চার সের পরিমাণ খব বা বার্লির দ্বারাই ওলীমার ব্যবস্থা করেন (সহিহ আল বুখারী, হাদিস নং-৪৭৯১)। এ হাদিস দ্বারা এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানা গেল যে, বিবাহের ওলীমার ব্যবস্থা সাধারণত পাত্র পক্ষই করে থাকে এবং সেটা কখনও মাত্রাতিরিক্ত নয়। এ মর্মে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করা যায়Ñ যেমন : আন আনাস (রা.) ইয়াক্বুলু বানান্নাবী (সা.) বিইসরাতিন ফার আর সালানী ফাদাওয়াতু রিজালান ইলতি তয়াসিÑ অর্থাৎ আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) তাঁর এক স্ত্রী (যয়নব) এর সাথে বিবাহ মিলনের ব্যবস্থা করলেন এবং লোকদেরকে (বিবাহ) আপ্যায়নের দাওয়াত দেয়ার জন্য আমাকে পাঠালেন (সহীহ আল বুখারী, হাদিস নং-৪৭৮৯)। এ হাদিসেও ঐ একই কথা আসছে যে, নবী তাঁর বিয়েতে বর হিসেবে নিজে ওলীমার ব্যবস্থা করেছিলেন। কনে পক্ষকে খাদ্য খাওয়ানোর ব্যাপারে কোনো ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল কিনা তা উল্লেখ নেই। এ সম্পর্কিত আরেকটি হাদিস হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে যেভাবে বর্ণিত আছে, তাতে ওলীমার ব্যবস্থাপনা পাত্রকেই করতে হবে মর্মে বলা হয়েছে। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেছেন, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) রাসূল (সা.) এর নিকট এমন অবস্থায় আসলেন যে, তার অঙ্গে সুফরার (সুগন্ধি) চিহ্ন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে এ চিহ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ এর উত্তরে নবী (সা.)-কে বললেন যে, সে জনৈকা আনসারী মহিলাকে বিবাহ করেছে। নবী (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে কি পরিমাণ মোহরানা দিয়েছ? সে বলল, আমি তাকে খেজুরের আঁটির সমপরিমাণ ওজনের স্বর্ণ দিয়েছি। নবী (সা.) বললেন, তাদের ওলীমার ব্যবস্থা কর, যদিও তা একটি মাত্র বকরি দিয়েই হোক (সহিহ আল বুখারী, হাদীস নং-৪৭৭৩)।

যেখানে নারীদের বিবাহের ক্ষেত্রে মোহরানা প্রধান শর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এ শর্ত পালনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেখানে ওলীমার ব্যবস্থাপনা যে পাত্রকেই করতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিবাহের যেসব শর্ত আছে তা পালনের জন্য পাত্রদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দান করা হয়েছে। হজরত ওকবা (রা.) এ সম্পর্কিত নবী (সা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। নবী (সা.) বলেন, সব শর্তের চেয়ে বিবাহের শর্ত পালন করা তোমাদের জন্য অধিক কর্তব্য। (সহী আল-বুখারী, হাদিস নং-৪৭৭১)

উসাইদ আস-সায়েদী (রা.) তাঁর বিবাহোত্তর পর্বে নবী (সা.)সহ অনেক সাহাবী (রা.)-কে দাওয়াত করেছিলেন এবং ঐ ওলীমা অনুষ্ঠানে তাঁর নব বিবাহিতা স্ত্রী মেহমানদের খাদ্য পরিবেশন করেছিলেন (আল হাদিস)।

এভাবে মহানবী (সা pharmaciepourhomme.fr.) ও তাঁর বহু সংখ্যক সাহাবী (রা.)গণ নিজেদের বিয়ের ওলীমা নিজেরাই সম্পন্ন করেছিলেন, শ্বশুরের ওপর বা পাত্রী পক্ষের ওপর চাপিয়ে দেননি। বর্তমান সমাজে যেটা চালু হয়েছে তা হলো যৌতুকসহ ওলীমার বাধ্যবাধকতা পাত্রী পক্ষের ওপর চাপিয়ে দেয়া যা মহানবী (সা.)-এর সুন্নত তথা শরীয়া বিধানের পরিপন্থী।

শ্বশুর বাড়ির আদর-আপ্যায়নের অভাবে আত্মীয় সম্পর্কের অবনতি এমনকি বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হবার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে যা ইসলামী শরীয়া সম্মত আইন নয়। এছাড়া ঘটা করে সম্পদশালীরা বিবাহ অনুষ্ঠানে যে ভোজ উৎসব পালন করে তা এক রকম অপচয়ের পর্যায়ে পড়ে যায়। অথচ যারা এগুলো করে তারা অনেকেই আল্লাহর দেয়া বিধান জাকাত ও ওশর আদায়ের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। শরীয়ার বিধান না মেনে এবং গরিব দুস্থদের উপেক্ষা করে উপহার-উপঢৌকনের লোভে যারা এগুলো করে থাকে তারা এক ধরনের ব্যবসা মনোবৃত্তি নিয়ে করে আর তা না হলেও এটা যে অপচয় তা বলাই বাহুল্য। আর মহান রাব্বুল আলামিন অপচয়কারীদের সম্পর্কে বলেছেন, নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই (আল কুরআন)।

প্রত্যেকটি সমাজেই বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। মুসলিম সমাজে এ বিবাহ পর্বটি হালাল পদ্ধতিতে বিশ্বনবী (সা.)-এর নির্দেশিত পন্থা সর্বোপরি মহান রাব্বুল আলামীনের বিধান অনুযায়ী হওয়া জরুরি।
লেখক : প্রভাষক।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *