মিসরের সেনাবাহিনী সে দেশের গণতন্ত্র ও বৈধতার পক্ষে বিক্ষোভকারী প্রসিডেন্ট মুরসীর সমর্থকদের উপর গুলি চালিয়ে মিশরের কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বর্বর গণহত্যার পর বুধবার দেশটিতে এক মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি অঞ্চলে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সে দেশের অবৈধ শাসক গুষ্টি নিজ দেশের প্রত্যয়-দীপ্ত তরুণ তরুণীর ও বিভিন্ন বয়সের নারীপুরুষের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন গণতন্ত্রের ও বৈধতার, স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সাম্য-ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। মিশরে আজ যেভাবে গণতন্ত্রের ও বৈধতার বলী হল শত শত মানুষ যা দেখে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয় কাঁপার কথা কিন্তু তারা যেহেতু মুসলিম তাই আজ অনেকের কাছেই মনে হয় “মুসলিমদের রক্তের মত সস্তা জিনিস পৃথিবীতে বুঝি আর নেই। এরা স্বৈরতন্ত্রের হাতেও মরবে, গণতন্ত্রের হাতেও মরবে, আবার জঙ্গিদের হাতেও মরবে। কোথাও যেন নিস্তার নেই এদের!! হায়রে মুসলিম উম্মাহ!!!” কথাগুলা ফেইসবুকের এক বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখলাম। তবে মিশরে প্রত্যয়-দীপ্ত তরুণ তরুণীর ও নারীপুরুষ ও কিশোরের তাদের গণতন্ত্রের ও বৈধতার, সাম্য-ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন সহসাই পূরণ হবে কিনা সেটা বলার সময় হয়তো এখনো আসেনি। তবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, মিশরের বামপন্থি ও মোবারক-পন্থিরা সেনাশাসনকে স্বাগত জানিয়ে, গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে সভ্যতার সূতিকাগার এই দেশটিকে আবারো এক অন্ধকার যুগেই ঠেলে দিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে ইতিহাসের এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে কিংবা নিন্দা জানাতে মুসলিম দেশগুলার শাসকদেরকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়না বরং অবৈধ সেনাশাসকদেরকে সাহায্য করতে তারা তৎপর। কারণ আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও অন্যতম প্রভাবশালী দেশ মিশরে যদি গণতন্ত্র ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে আশেপাশের স্বৈরাচারী ও বাদশাহী শাসন ব্যবস্থার ঠিকে থাকতে পারবেনা অদূর ভবিষ্যতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জরুরি অবস্থার আড়ালে মিশরে কার্যত সামরিক শাসন বা মার্শাল ল জারি করা হয়েছে। পতিত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক তার তিন দশকের শাসনামলের পুরোটা সময়ই বহাল রেখেছিলেন জরুরি অবস্থা।
বুধবার মিশরের নামসর্বস্ব প্রেসিডেন্ট আদলি মনসুর জরুরি অবস্থা ও কারফিউ জারি এবং সেনাবাহিনীকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে যে ডিক্রি জারি করেছেন তা যে মার্শাল ল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বস্তুত গত ৬ দশক ধরে সেনাবাহিনীই মিশর শাসন করেছে। বলা হয়, মিশরের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্র। অনেকে আবার বলেন, মিশরের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তারা গাছেরও খায় তলারটাও কুড়ায়।
মিশরের সর্বময় কর্তৃত্বই শুধু তাদের হাতে নয়, টেলিযোগাযোগসহ বহু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। সেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশাল সাম্রাজ্য।
শুধু বিলাসী জীবনই উপভোগ করে না সেনাবাহিনী, ক্লাব জীবনে অভ্যস্ত সেক্যুলার শিক্ষায় দীক্ষিত এই বাহিনীর কর্তাদের জীবন অনেকটা অনিয়ন্ত্রিতও। তাদের কর্তৃত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ করুক, অবাধ সুবিধায় বাধ সাধুক তা মেনে নেয়া এই বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব।
সবারই জানা আছে, সেনা কর্তৃত্বকে খর্ব করতে মিশরীয়দের বহু রক্ত ঝরাতে হয়েছে। সমকালীন সময়ে মিশরীয়দের রক্ত দেয়ার এই পালা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের শুরুর দিকে, বিশ্বকাঁপানো তাহরির স্কয়ারে। আরব বসন্তের ছোঁয়ায় সে সময় প্রায় ৯০০ অমূল্য জীবনের বিনিময়ে ক্ষমতাচ্যুত হন লৌহমানব হোসনি মোবারক।
তবে মোবারকের পতন হলেও ক্ষমতা আবারও চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। আবারও আন্দোলন করতে হয় মিশরীয়দের। আবারো সেনাদের গুলিতে জীবন বিসর্জন। এরপর অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। এতে জয়ী হয় মিশরের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড।
এরপর ২০১২ সালের জুনে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জয়ী হয় ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু তাকে জয়ী ঘোষণা করতে টালবাহানা শুরু করে সেনাবাহিনী। তাদের পছন্দের প্রার্থী হোসনি মোবারকের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিককে জয়ী ঘোষণার পাঁয়তারা চলে। আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তাহরির স্কয়ার। এরপর চাপে পড়ে মুরসিকে জয়ী ঘোষণা করা হলেও ডিক্রি জারি করে প্রেসিডেন্টকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে দেয় সেনাবাহিনী।
মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও মূল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে মোবারকের অনুগত সেনাবাহিনী, বিচারপতি ও আমলাতন্ত্র।
এ অবস্থায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মুরসিকে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে মুরসি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন যেখানে শরীয়াকে আইনের মূল উত্স হিসেবে গ্রহণ করা হয়। গ্রহণযোগ্য গণভোটেই পাস হয় সেই সংবিধান।
কিন্তু নতুন এই সংবিধানকে গ্রহণ করতে পারেনি মিশরের সেক্যুলার মোবারকপন্থি ও বামপন্থিরা। তারা মুরসিকে উত্খাতের ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় উচ্চাভিলাসী সেনা কর্মকর্তারাও। এসব শক্তির চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে হাত মেলায় ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। এরা কেউই চায়নি মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী ইসলামী দল ব্রাদারহুড শাসন করুক মধ্যপ্রাচ্যের জনবহুল এই দেশটি।
তাদের আশঙ্কা, ব্রাদারহুড ক্ষমতায় টিকে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার স্বৈরাচারী রাজা-বাদশাহদের মসনদ টিকবে না।
এ অবস্থায় কথিত বিক্ষোভের অজুহাত দেখিয়ে গত ৩ জুলাই সেনাবাহিনী মুরসিকে উত্খাত করে। অথচ তিনি এক বছরও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুরসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো অভিযোগও নেই ।
মুরসিকে উত্খাতের পর তাকে অজ্ঞাত স্থানে বন্দি রাখা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ব্রাদারহুডের প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আদলি মনসুর যে মন্ত্রিসভা নিয়োগ করেছেন সেখানে মুসলিম প্রধান মিশরের কোনো ইসলামপন্থিই স্থান পাননি। পুরো মন্ত্রিসভা বামপন্থি, খ্রিস্টান আর নারীদের দিয়ে পরিপূর্ণ।
এ অবস্থায় মিশরের গণতন্ত্র ও ইসলামপ্রিয় মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। সংখ্যায় তারা হাজার হাজার নয়, ছিলেন লাখে লাখে। ট্যাঙ্কের সামনে টানা ৬ সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ করে তারা দুনিয়ার ইতিহাসই যেন পাল্টে দিয়েছেন। এতে প্রমাদ গুণতে বাধ্য হয়েছে সেনা সরকার।
ব্রাদারহুডের এ আন্দোলন অব্যাহত থাকলে মিশরকে কায়েমী স্বার্থবাদীদের তল্পিবাহক বানানোর স্বপ্ন যে অধরাই থেকে যাবে তা তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। তাই মুরসি সমর্থক ও ব্রাদারহুড কর্মীদের ওপর তারা একের পর গণহত্যা চালিয়েছে।
গণহত্যার সবচেয়ে লোমহর্ষক চিত্র দেখা গেছে বুধবার। এতে ঠিক কত লোক নিহত হয়েছে সেই চিত্র অদূর ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে তা যে হাজার হাজার না হলেও শত শত, তাতে খুব কম লোকেরই সন্দেহ আছে।
এই অমানিশার অন্ধকার ভেদ করে আলোর ঝলকানি দেখতে মিশরীয়দের আরো বহু রক্ত ঝরাতে হবে, হয়তো অপেক্ষা করতে হবে বহু দিন। তবে অবস্থা যেভাবে মোড় নিচ্ছে তাতে মিশরের অবস্থাও সিরিয়ার মত গৃহযুদ্ধে পতিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: এ নিবন্ধটি প্রণয়নে ফেইসবুক ও অর্ন্তজালের আমার যে সকল বন্ধুদের ইমেইল ও ব্লগ-তথ্যের কিছু সহায়তা গ্রহণ করেছি তাদেরকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
[youtube=http://www.youtube.com/watch?v=kvqXatBpZXM]