দেশ ও জনগণের পুরাতন শত্রুদের শাসনই মিসরে ফিরে এসেছে

১৪ আগস্টের গণহত্যার পর থেকে প্রত্যেক দিনই মিসরে সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণে সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত কায়রোয় একশ’র কাছাকাছি লোক নিহত হচ্ছেন। এরা সবাই সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা দখলের বিরোধী প্রতিরোধকারী ও নিরীহ জনগণের বিভিন্ন অংশ। এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে হাজারের অনেক বেশি এবং আহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি, বলা চলে অসংখ্য। আপাতদৃষ্টিতে মিসরের এই সামরিক অভ্যুত্থানকে শুধু মিসরের সামরিক বাহিনীর কাজ মনে হলেও সম্ভবত এটা এমন এক চক্রান্তের পরিণতি যে চক্রান্তের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোও গভীরভাবে জড়িত।

দুনিয়াজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীকে দিয়ে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ যে খেলা চালিয়ে এসেছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে মিসরের সামরিক অভ্যুত্থানও সে রকম এক প্রচেষ্টা। কাজেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, অভ্যুত্থানের দিনই মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি জন কেরি এ বিষয়ে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, সেই ‘অভ্যুত্থানের দ্বারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ হচ্ছে! মিসরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে সেনাবাহিনী অপহরণ ও আটক করে তার সরকার উৎখাত ও সে সঙ্গে সংবিধান স্থগিত করার ব্যাপারটি কীভাবে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ হলো এটা সাম্রাজ্যবাদী এবং তাদের গোলামরা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে বলা অথবা বোঝা সম্ভব নয়। তাছাড়া মিসরে যেখানে মুহাম্মদ মুরসির সরকারের আগে কোনো নির্বাচিত সরকারই ছিল না, গণতন্ত্রের চিহ্নমাত্র শাসন ব্যবস্থার কোথাও ছিল না, সেখানে গণতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধারে’র কথা কীভাবে বলা সম্ভব এটা বোঝারও কোনো উপায় নেই।

মিসরে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ সামরিক বাহিনীর দ্বারা হয়েছিল। কাজেই স্বাভাবিকভাবে সেই অবস্থায় রাজতন্ত্রের স্থানে কোনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নাগিব, নাসের, সাদাত ও মোবারকের সামরিক শাসনই সেখানে একটানাভাবে বজায় থেকেছে। গত বছরই প্রথম একটি সংবিধানের অধীনে, একটি নির্বাচনের মাধ্যমে মিসরে প্রথম একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এই সরকারের দেশ রক্ষামন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন সংবিধান মান্য ও রক্ষা করে চলার, আনুগত্যের সঙ্গে সরকারের সেবা করার।

নিজের এই শপথ ভঙ্গ করে তিনি সংবিধান স্থগিত এবং প্রতিষ্ঠিত নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে বড় রকম এক বেইমানির উদাহরণ স্থাপন করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর প্রধান সিসির নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকার কথা বললেও তারা মিসরের সামরিক বাহিনীকে বার্ষিক ১৩০ কোটি ডলার সাহায্য বন্ধ না করার এবং তাদের সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এর থেকেই প্রমাণিত হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিসরের এই সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এ বিষয়টি এতই স্পর্শ যে, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য অনেক দেশ তাদের সাম্রাজ্যবাদী জোটের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছে মিসরকে অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করতে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যেসব ষড়যন্ত্র করে তার সঙ্গে জড়িত থাকে সৌদি আরবসহ তাদের বিভিন্ন মক্কেল দেশ। মিসরের বর্তমান পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা যাচ্ছে। সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলো মিসরীয় সেনাবাহিনীকে তাদের অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য বিশাল পরিমাণ অর্থ আগেই প্রদান করেছে এবং প্রকাশ্যে এই সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মক্কেল দেশগুলোর এই অবস্থান মিসরের সামরিক অভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাই প্রমাণ করে। এ কাজ মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলো এর আগেও ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে করেছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে তারা গত দু’বছর ধরে এটা করে আসছে এবং ঠিক এখন আবার মিসরের ক্ষেত্রে তারা এই একই ভূমিকা ও কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছে।

প্যালেস্টাইনের সঙ্গে বেইমানি করে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে এক শান্তি চুক্তি করেন। সেই থেকে মোবারকের শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে মিসর ইসরায়েলের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে এবং কার্যত প্যালেস্টাইনের শত্রু হিসেবে কাজ করেছে।  মোবারকের সরকার উচ্ছেদ হওয়ার পর প্রথম এই সম্পর্ক হুমকির সম্মুখীন হয় এবং মুরসির সরকার ক্ষমতায় আসায় মিসর-ইসরায়েল সম্পর্ক একেবারে শেষ হওয়ার শর্ত তৈরি হয়। মিসরে প্রথম নির্বাচিত সরকারের শাসন এক বছরের মধ্যেই সামরিক বাহিনীকে দিয়ে উৎখাত করার এটাই বলা চলে অন্যতম প্রধান কারণ। প্রকাশ্যে প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন সত্ত্বেও মার্কিনের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর যে কার্যত প্যালেস্টাইনের বিরোধী এটা তাদের বহু কার্যকলাপের মাধ্যমে ইতিপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে এবং এখন মুরসির সরকার উচ্ছেদের সঙ্গে তাদের প্রায় সরাসরি সম্পর্কের মাধ্যমে এটা নতুনভাবে প্রমাণিত হলো।

মুহাম্মদ মুরসি মিসরের ইসলামী সংগঠন ইসলামিক ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি। এই দলটি যে প্রতিক্রিয়াশীল এতে সন্দেহ নেই। মুরসি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মিসরের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধানের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে না পারলেও নিজের সরকারে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে বিরোধীদের দাবি-দাওয়া উপেক্ষা করেন।

এসব কারণে তার সরকারের বিরুদ্ধে তার প্রতিপক্ষদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ক্ষোভকে প্রজ্বলিত করার ক্ষেত্রে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাও কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এর ফলে মুরসির বিরোধিতা করতে গিয়ে জনগণের একটা অংশ সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে। বর্তমানে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, মুরসি ক্ষমতায় থাকার সময় যারা সামরিক বাহিনীর পেছনে ছিল ও তাকে সমর্থন জানিয়েছিল, এখন তারা আর আগের মতো অবস্থানে নেই। বেপরোয়াভাবে সামরিক বাহিনী যেভাবে দেশের জনগণকে হত্যা করছে তার প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। কাজেই মুরসির সরকার উৎখাতের সময় সামরিক বাহিনীর যে জনসমর্থন ছিল এখন তাতে ব্যাপক আকারে ভাটা পড়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা জনগণের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে এবং তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা নতুন করে সামরিক একনায়কতন্ত্র ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী খেলায় তারা ইসরায়েলের শক্তিকেই বৃদ্ধি করেছেন।

মিসরে যেভাবে এখন গণহত্যা চলছে এটা এভাবে চলতে থাকলে সেখানকার পরিস্থিতি মোবারকের আমলের থেকে খারাপ হবে। এই সম্ভাবনাই এখন দেখা যাচ্ছে। মুরসির সরকার মিসরের মৌলিক সমস্যাবলি সমাধানের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও সে সরকার হচ্ছে একটি নির্বাচিত সরকার। বিরোধীদের সঙ্গে সমঝোতায় আসার জন্য তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা এবং মুরসিকে তার কর্তব্য নির্ধারণের জন্য সময় দেওয়ার পরিবর্তে সেনাবাহিনী কর্তৃক সে সরকার উৎখাত করা হলে মিসরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে পুরাতন ফ্যাসিস্ট সামরিক শাসনকেই আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। এই চেষ্টা যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে মিসরে শুধু যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ব্যাপক ও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়, মোবারকের আমলের থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে দেখা দেবে। গৃহযুদ্ধ এবং এমন নৈরাজ্য যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত মিসরের ইতিহাসে নেই।

সভাপতি  জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *