৭ নভেম্বর : স্বাধীনতা সুরক্ষা দিবস:

বাংলাদেশে অনেকগুলো ঐতিহাসিক তাত্পর্যময় তারিখ আছে যথা ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় দিবস, ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ জেনারেল এরশাদের পদত্যাগ দিবস ইত্যাদি। কিছুদিন আছে দুঃখজনক স্মৃতি হিসেবে ঐতিহাসিক, যথা ১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি একদলীয় শাসন তথা বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিবস, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যা দিবস, ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের শাহাদাত দিবস, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারী করার দিবস ইত্যাদি। বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের তথা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক কিছু সম্বন্ধে অবহিত নন। যেসব বিষয়ে অবহিত নন, সেইসব বিষয়ে তাদের জানা উচিত ক্রমান্বয়ে। বিশেষ করে ১৯৭৫ এর ১২ মাসের ইতিহাস এবং তার প্রেক্ষাপট অবশ্যই জানা উচিত। ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া মর্মান্ত্মিক ঘটনার প্রেক্ষাপট অবশ্যই জানা উচিত। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সম্বন্ধে একদিকে যেমন জানার অভাব আছে, অপরদিকে নেতিবাচক প্রচারণার জোয়ার আছে। ৭ নভেম্বর এবং জিয়াউর রহমান এই দুইটি নাম এবং ইতিহাস, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি বছরের ৭ নভেম্বর এর আগে-পরে, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনের জাতীয়তাবাদী শক্তির উচ্ছসিত কর্মীগণ বন্দনায় ব্যসত্ম থাকেন কিন্তু প্রেক্ষাপটটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নহেন। অপরপক্ষে সমালোচনাকারীগণ প্রেক্ষাপটকে বিকৃত করে ৭ নভেম্বরের অর্জনকে এবং জিয়াউর রহমানের অবদানকে নেতিবাচকভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট থাকেন। আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী আজকে ২০১৩ সালে যেই অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় একদিনে আসেনি। ১৯৭৪-৭৫ সালে অবস্থা করুণ ছিল। ১৯৭৩ এর শেষ থেকে ১৯৭৪ এর শুরুর দিক পর্যন্ত্ম ৪-৫ মাস ব্যাপী সময়ে পাকিসত্মান থেকে অফিসার এবং সৈনিকগণ বাংলাদেশে প্রত্যার্পন করেছিলেন। তাদেরকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে অঙ্গীভূত করা হচ্ছিল। যথেষ্ট বাসস্থান ছিল না, কাপড়-চোপড়, গাড়ি-ঘোড়া সরঞ্জাম ইত্যাদির অভাব ছিল। মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকগণের সঙ্গে তাদের সমঝোতার অভাব ছিল। সমঝোতা সৃষ্টির জন্য কোনো উদ্যোগ রাজনৈতিকভাবে নেয়া হয়নি। পাকিসত্মানে বন্দী থাকা অবস্থায়, বাঙালি অফিসার ও সৈনিকগণ নিজেদের মধ্যে চিন্ত্মাভাবনা, গল্পগুজব, আলাপ-আলোচনার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার জন্য, নিজের নিজের চেতনায় দুঃখিত ছিলেন। অপরপক্ষে তাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাগণের সাফল্য এবং সেনাবাহিনীতে উজ্জ্বল অবস্থানকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি, ফলে অস্থিরতায় ভুগতেন। পাকিসত্মানের বন্দী শিবিরে থাকা অবস্থায়, নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব ও মতামতের আদান-প্রদানের সময় কিছু সংখ্যক অফিসার ও সৈনিক বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিজম ভিত্তিক রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়ে গিয়েছিলেন; এবং ঐ দীক্ষা নিয়েই তারা বাংলাদেশে ফেরত আসেন এবং সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত থাকেন। তাদের বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক চিন্ত্মা সম্বন্ধে ঐ আমলের কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিলেন না, যদি অবহিত থাকতেন সম্ভবত তাদেরকে চাকরি করতে দেয়া হতো না। কারণ, একটিভ বা সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক মতবাদধারী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি, সামরিক বাহিনীর শৃংখলার জন্য ক্ষতিকারক। কথাটি তখন যেমন সত্য ছিল, এখনও সত্য। যাহোক, পাকিসত্মান থেকে ফেরত এসে ঐ ধরনের সক্রিয় রাজনৈতিক চিন্ত্মাশীল ব্যক্তিগণ, চাকরিতে ব্যসত্ম থাকার পাশাপাশি, নিজেদের রাজনৈতিক চিন্ত্মাভাবনাকে আরো বেশি শাণিত করে এবং কীভাবে সেটাকে বাসত্মবায়ন করা যায় সেটার উপরে মনোযোগ দেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সেক্টর কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। তিনি পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ বা এসএসজি তথা কমান্ডো বাহিনী-তে চাকরি করতেন একজন সুনামধারী অফিসার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর যেই কয়জন বাঙালি অফিসার পশ্চিম পাকিসত্মান থেকে, ভীষণ বড় রকমের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশকে অতিক্রম করে, পলায়ন করে, দেশে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ১৯৭১ সালের মেজর আবু তাহের। শুধুমাত্র পাঠকের কৌতুহল নিবারণের জন্য ঐ রকম পলায়ন করে আসা এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী আরও দু’একটি নাম উল্লেখ করছি যথা বর্তমানে মরহুম মেজর জেনারেল (১৯৭১-এ মেজর) মোহাম্মদ আবুল মনজুর বীর উত্তম এবং বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর সুপরিচিত শিক্ষাবিদ (১৯৭১-এ মেজর) জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম। কর্নেল আবু তাহের সচেতন বয়স থেকেই বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক চিন্ত্মাধারায় বিশ্বাস করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে ব্রিগেড কমান্ডার হয়েছিলেন এবং কিছু ব্যতিক্রমী চিন্ত্মা বাসত্মবায়নের উদ্যোগ নেন। তত্কালীন সরকার উদ্যোগগুলোকে প্রকাশ্যে প্রশংসা করলেও সচেতনভাবেই তার বিস্তৃতি কামনা করে নাই। কর্নেল তাহেরকে ঢাকায় বদলী করা হয়। বছরখানেক পর তাকে অবসর দেয়া হয়। সরকারের অধীনেই তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে নিয়োজিত করা হয়। কিছুদিন পর সেই চাকরি থেকে তাকে অপসারণ করা হয়। কারণ একটাই। তিনি তার বামপন্থী তথা সমাজতান্ত্রিক চিন্ত্মা প্রসারের জন্য পরিশ্রম করছিলেন। যখন তিনি সম্পূর্ণভাবেই চাকরিমুক্ত হয়ে যান, তখন তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রবেশ করেন।
১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুসারী মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র তরুণদের মধ্যে একাধিক বিষয়ে কঠোর মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। এক পক্ষে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আসম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু ইত্যাদি নেতৃবৃন্দ। অপরপক্ষে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা শেখ মনি’র নেতৃত্বে অন্যান্যরা। ১৯৭২-এর অক্টোবরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাসদ সৃষ্টি হয়। সভাপতি হন মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং মুক্তিযুদ্ধের পর অত্যাচারিত ও নিপীড়িত অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম এ জলিল। মহাসচিব হন আসম আব্দুর রব। ১৯৭২-এর শেষ থেকে শুরু করে পুরো ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ তারা সরকারের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নামে একটি তত্ত্ব বাসত্মবায়নের জন্য এবং সরকারের দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। ঐ সময় ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত থাকতো। এক পর্যায়ে তারা মনে করেন যে, শুধুমাত্র রাজপথের আন্দোলন দিয়ে ঐ আমলের অর্থাত্ ১৯৭৩-৭৪ এর বঙ্গবন্ধুর সরকার, তাদের ভাষায়, অত্যাচারী, শোষণকারী ও দুর্নীতিযুক্ত সরকারকে অপসারণ প্রায় অসম্ভব। যদি সেনাবাহিনী বা সেনাবাহিনীর কোনো অংশের সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে কাজটা সহজ হয়। এবং সেনাবাহিনী বা তাদের কোনো অংশের সঙ্গে সঠিক সহযোগিতার জন্য তারা নিজেদের মধ্যেও একটি সুশৃংখল প্রশিক্ষিত আন্দোলনকারী বাহিনী সৃষ্টি করে যার নাম ছিল গণবাহিনী। ১৯৭৪ এর শুরুর দিকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম জাসদে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো পদ-পদবি তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি রাজনৈতিক দীক্ষা প্রদানের বিষয়টি এবং গণবাহিনীকে সক্রিয় আন্দোলনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি দেখাশুনা করতেন। প্রকাশ আছে যে, তিনি গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন।
১৯৭৩-৭৪ সালের একটা পর্যায়ে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিজম ভিত্তিক চিন্ত্মাধারার সৈনিকগণ, মূলত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রীক, একটা সংস্থা গড়ে তোলে যার নাম বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। তাদের সদস্যদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ছিল কিন্তু বেশিরভাগই পাকিসত্মান প্রত্যাগত ছিল। এক পর্যায়ে এই সংস্থা মনে করলো যে, তারা একা কোনো কিছু করতে পারবে না, কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা পেলে তাদের পক্ষে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। এইরূপ চিন্ত্মার পরিপ্রেক্ষিতে তারা মনের মিল হয় এমন রাজনৈতিক দলের সন্ধান করছিলেন। অপরপক্ষে জাসদ নামক রাজনৈতিক দলটিও সৈনিকদের মধ্যে বামপন্থী চিন্ত্মাধারা লালন করে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির সন্ধান করছিলেন। ১৯৭৪ এর মাঝামাঝি বা শেষাংশে এক পর্যায়ে দুই এর সঙ্গে দুই যোগ হয়ে চার হয়ে গেল। ফলে জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি হলো। এই ঐক্যের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন জাসদের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। জাসদ সৈনিকদের মধ্যে তাদের চিন্ত্মাধারাকে আরো প্রখর করে প্রসারিত করতে থাকে যেন ঐ সৈনিকদের মাধ্যমেই বিপ্লব ঘটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারে।
১৯৭৫ সাল ব্যাপী, জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রস্তুতি অগ্রগতি করতে থাকে। তখনকার আমলের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে এবং অস্থিতিশীল সেনাবাহিনীর কমান্ডের পরিবেশে, এই গোপন তত্পরতা সাফল্যের সঙ্গে অগ্রগতি করতে থাকে। কিন্তু সৈনিকগণকে রাজনৈতিকভাবে দীক্ষিত করা, তাদেরকে বিপ্লবের জন্য উদ্বুদ্ধ করা, বিপ্লব তথা বিদ্রোহ করার জন্য সংগঠিত করা, বাংলাদেশে প্রচলিত বা বিদ্যমান অনেকগুলো আইনের প্রেক্ষাপটেই সম্পূর্ণভাবে বেআইনী ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কর্ম ছিল।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। ঐ সময়ের আওয়ামী লীগ তাত্ক্ষণিক কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি বা করেনি। বরং তারা সদলবলে খোন্দকার মোশতাক এর নেতৃত্বাধীন সরকারকে সহযোগিতা করেন ও আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ১৫ আগস্টের বিদ্রোহী সামরিক নেতাগণ ভারত বিরোধী ছিলেন এবং সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড ভঙ্গ করেছিলেন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয়। কেউ বলে এটা সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ডকে স্থিতিশীল করার জন্য করা হয়েছিল। আবার কেউ বলে ভারত-বান্ধব একটি সরকার পুনস্থাপনের জন্য এই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছিল। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তত্কালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুই নম্বর সেক্টরের ও কিছুদিন পর ‘কে ফোর্স’ এর সুপরিচিত, সফল ও সাহসী অধিনায়ক ছিলেন। এই অভ্যুত্থানের অন্যতম উপসর্গ ছিল, তারা ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে দায়িত্ব পালনরত সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে নিজের বাড়িতে বন্দী করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে পদচ্যুত করেন। পাঠক খেয়াল করবেন যে, জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে স্বাধীনতার ঘোষক, যুদ্ধ চলাকালে সেক্টর কমান্ডার এবং কিছুদিন পর ‘জেড ফোর্স’ এর সুপরিচিত, সফল ও সাহসী অধিনায়ক। জিয়াউর রহমান সাধারণ সৈনিক ও অফিসারগণের নিকট অন্য সকল জ্যেষ্ঠ অফিসারের তুলনায়, বহুগুণ বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এর সামরিক অভ্যুত্থানকারীগণ তাকে বন্দী করায়, ঐ আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মাঝারি ও কনিষ্ঠ অফিসার এবং সৈনিকগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে মানসিক বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
পাঠক অনুগ্রহপূর্বক মানসিকভাবে ১৯৭৫ এর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফেরত যান। সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের তরঙ্গে অস্থির। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত মেঘে ঢাকা। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই, রাজনৈতিক দল জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা দারুন অস্থিরতায় নিপতিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত্ম নেয় যে, তারা সেনাবাহিনীতে বিপ্লব ঘটাবে। পাঠক খেয়াল করুন, অভ্যুত্থান নয় বরং একটি বিপ্লব ঘটাবে। তারা মূল্যায়ন করে যে, ঐ বিপ্লবের প্রধান প্রতিবন্ধক সেনাবাহিনীর অফিসারগণ। তাই তারা সিদ্ধান্ত্ম নেয় অফিসারদেরকে হত্যা করার মাধ্যমেই তাদের রাসত্মা পরিষ্কার করতে হবে। এই সকল কিছুর নেতৃত্ব দেয় জাসদ। পাঠক কষ্ট করে মিলিয়ে নিতে হবে ঐ আমলের জাসদের নেতৃত্বের কোন অংশ কতটুকু দায়িত্ব কোন আঙ্গিকে পালন করেছিলেন। জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা যেই বিপ্লবের সিদ্ধান্ত্ম নেয় এবং ৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্য রাতে তথা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এর প্রথম প্রহরেই যেই বিপ্লব শুরু করে তার লক্ষ্য ছিল অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করা, জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সমূলে ধ্বংস করা, বামপন্থী তথা সমাজতান্ত্রিক তথা কমিউনিজম ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। নিজেদের নেতৃত্বে নাও কুলাতে পারে এই মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা বন্দী দশায় নিজ গৃৃহে আবদ্ধ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের সহযোগিতা চান। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এবং জাসদের নেতৃত্বের মধ্যে, বিশেষত কর্নেল তাহের বীর উত্তমের মধ্যে কী সমঝোতা বা কী সহযোগিতামূলক সিদ্ধান্ত্ম হয়েছিল তার কোনো স্বীকৃত দলিল বা রেকর্ড আজ পর্যন্ত্ম উদঘাটিত হয়নি। জাসদ নেতৃবৃন্দ অতীতে এবং বর্তমানে প্রচার করেন যে, জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তাহলে স্বাভাবিক যেই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়, সেই প্রশ্নটি হলো, বিশ্বাসটা কী ছিল, যার বিরুদ্ধে ঘাতকতা করা হয়? এর কোনো দলিলভিত্তিক উত্তর জাসদ নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে দেন না। কারণ, দেয়ার মতো কিছু নেই। ৭ নভেম্বর প্রথম প্রহর থেকে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের গতিধারা ও লক্ষ্য সাধারণ সৈনিকগণ দুই ঘণ্টার মধ্যেই আবিষ্কার করেন। সাধারণ সৈনিকগণের মতে ঐ বিপ্লব ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্থিতিশীলতা ধ্বংসের বিপ্লব, বাংলাদেশকে রাজনৈতিক-প্রশাসনিকভাবে অরাজকতায় নিপতিত করার বিপ্লব, অরাজকতা সৃষ্টির পর প্রতিবেশীর প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পনের বিপ্লব, বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীতে বিশ্বাসহীনতা স্থাপনের বিপ্লব। ইংরেজী ভাষায় বলে আয়রনী অফ ফেইট অর্থাত্ ভাগ্যের পরিহাস যে, উভয় দিকে ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাগণ ও রাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধাগণ। ৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্য রাত্রির পর তথা ৭ নভেম্বর শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা সেনানিবাসের সাধারণ সৈনিকগণ নিজেরাই প্রতিবিপ্লব শুরু করেন। তারা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের চতুর্পাশে সংগঠিত হন, এবং তাকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করেন। তারা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে বামপন্থীদের প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখার জন্য মানসিক ও শারীরিক বলয় গড়ে তোলেন। বিপ্লবী বেআইনী গোপন সৈনিক সংস্থা এবং জাসদ এর গণবাহিনী যেই অভ্যুত্থানমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন সেটা প্রতিহত করার জন্য জনগণকে সক্রিয় করার জন্য তাত্ক্ষণিক ভূমিকা রাখেন। জাসদ তথা তার নেতৃবৃন্দ চেয়েছিলেন, জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে তত্কালীন ঢাকা মহানগরের শাহবাগ এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ বেতার বা রেডিও বাংলাদেশ এর সদর দপ্তরে নিয়ে তার মাধ্যমে বা তার মুখ থেকে নিজেদের পছন্দের ভাষনটি প্রচার করতে। কিন্তু দেশপ্রেমিক শৃংখলাপ্রিয় সৈনিকগণের প্রভাবে এবং নিজ বিবেচনায়, জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ঐ চক্রান্ত্মে পা দেননি। এতে ঐ রাতের ও ঐ দিনের জাসদ নেতৃবৃন্দ দারুণভাবে হতাশ, বিক্ষুদ্ধ ও জিয়াউর রহমানের প্রতি ক্ষিপ্ত হন।
সেনাবাহিনীর সৈনিকদেরকে বিপ্লব, অভ্যুত্থান, অরাজকতার পথে দীক্ষিত করে আহ্বান জানিয়েছিল জাসদ এবং এই কাজটি ছিল শতভাগ বেআইনী ও রাষ্ট্রদ্রোহী। সেনাবাহিনী ও দেশের সামনে ছিল মহাবিপদ। ঢাকা মহানগরীর সাধারণ জনগণ হাজারে হাজারে ও লাখে লাখে রাসত্মায় নেমে আসে এবং জিয়া অনুরক্ত সৈনিকগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিপ্লবকে ঠেকিয়ে দেয়। যদি না ঠেকাতো, তাহলে কী হতো এই কলামের সম্মানিত পাঠক নিজেই বিবেচনা করুন। ডজন ডজন বা শত শত সেনা অফিসার নিহত হতেন অথবা নিহত হওয়ার থেকে বাঁচার জন্য দায়িত্ব থেকে দূরে থাকতেন। সেনাবাহিনী কমান্ডবিহীন হতো। সংখ্যায় অনেক কম একদল ধর্মবিশ্বাসবিহীন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও সৈনিক দেশের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করতেন। দেশপ্রেমিক সৈনিকগণ তার বিরোধীতা করতেন। অতএব সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ শুরু হতো। অতএব মেহমান হিসেবে প্রতিবেশী দেশের সেনাবাহিনী যে আসতো না ঐ গ্যারান্টি কেউই তখন যেমন দিতে পারেনি, আজকেও দিতে পারছে না। দেশকে বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া ছিল ফরজ ও সময়ের দাবি। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব ছিল ক্যারিশমেটিক তথা গণমুখী। তিনি সেদিন পুনরায় সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মাত্র ৪৮ ঘণ্টা বয়সি তথা নবনিযুক্ত নতুন রাষ্ট্রপতির পাশে দাঁড়ান। প্রকারন্তরে দেশের নেতৃত্ব নেন। সামরিক বাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ নেন। দেশকে অরাজকতার হাত থেকে এবং সম্ভাব্য পরাধীনতার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করা থেকে রক্ষা করেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছিল কিন্তু ১৯৭৫ এর নভেম্বরের ৭ তারিখ পলাশীর প্রান্ত্মরের মতো সেই স্বাধীনতার সূর্য হারিয়ে যেতে বসেছিল। জিয়াউর রহমান সেই স্বাধীনতা হারাতে দেননি। সেদিনের এবং আজকের বামপন্থী এবং ভারতপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও সকল পেশাজীবীর নিকট, এটাই জিয়াউর রহমানের অপরাধ!!! সম্মানিত পাঠকগণ নিজের বিবেক দিয়ে বিচার করবেন।

পূর্ব প্রকাশিত: গুডনিউজবিডিডটকম

 

[youtube=http://www.youtube.com/watch?v=5hj0S_9po8g]

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *