কিউপিড
‘বিশ্ব যখন নিদ্রা মগন’ তখনও কেউ কেউ জেগে থাকে বৈকি! “আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইলো না কেহ” বলে যখন কেউ আক্ষেপ করে, তখন কেউ না কেউ হয়তো এগিয়ে আসে সে ব্যাকুলতা মিটাবার ইচ্ছা নিয়ে। তেমন কোন নিদ্রা বা ব্যাকুলতা নিয়ে নয়, হৃদয় নিয়ে হোক না কিছু কথা! তবে এ হৃদয় হচ্ছে হার্ট (Heart) বা হৃদপিণ্ড। হার্টের যথার্থ বাংলা যদিও হৃদয় নয়, তবু প্রায়ই এমন ভাবেই তা বলা হয়ে থাকে। কিউপিডের তীর যে হৃদয়কে বিদীর্ণ করে সব কিছু এলোমেলো করে দেয়, সে হৃদয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। অমাবশ্যার রাতে বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে যেতে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে, মনের মানুষটিকে একান্ত করে পাবার জন্য হৃদয় আকুল হয়, অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখে মুগ্ধতায় মোহিত হই। এ সবের প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্কে নয়, আমরা টের পাই আমাদের বুকের মাঝে। আর এ থেকেই ধারণা করা হয় যে, হৃদয়ের বসবাস বুকের ভিতরে। হৃদয় নয়, বুকের খাঁচার ভিতরে যেটা আছে তা হচ্ছে একটা জটিল যন্ত্র হৃদপিণ্ড বা হার্ট। আমাদের অনেকেরই ধারণা, হৃদয়ই হচ্ছে সকল অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু তা আদৌ ঠিক নয়। এ ধরণের সব কিছুর অনুভূতি বিশ্লেষিত হয় মস্তিষ্ক নামক অঙ্গে। আর তার প্রতিক্রিয়া বুকের মাঝে অনুভূত হয় বলে এমন ভুল ধারণা যুগের পর যুগ মানুষ পোষণ করে চলেছে।
মানব ভ্রূণের বয়স যেদিন মাত্র আঠারো দিন, সেদিন তা দেখতে হয় কিছু সংখ্যক কোষ সমন্বয়ে গঠিত ছোট্ট একটা মোটরদানার মত। বড়ই আজব ব্যাপার এই যে, সেদিন থেকেই হৃদপিণ্ড নিয়মিত স্পন্দিত হতে শুরু করে, আর তা কোন বিরতি ছাড়াই চলতে থাকে জীবনাবসান না হওয়া পর্যন্ত। হৃদযন্ত্রই সম্ভবত একমাত্র অঙ্গ যা অতি দায়িত্বশীলতার সাথে বিরতিহী ভাবে দায়িত্ব সুসম্পন্ন করে থাকে। মাত্র তিন সপ্তাহের মানব ভ্রূণে প্রকৃতপক্ষে কোন রক্ত সৃষ্টি না হলেও প্রতি সেকেন্ডে একবার করে হৃদযন্ত্রের স্পন্দন চলতে থাকে। শিশু জন্মের পর স্পন্দন দ্রুততর হয়, যা মিনিটে ১৪০ বার পর্যন্ত হতে পারে। এর পর বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্পন্দনের এ হার কমতে থাকে এবং বিশ্রামে বা অবসরে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন হয় প্রতি মিনিটে ৭৬ বার। কঠোর পরিশ্রম করার সময় হৃদযন্ত্র দ্রুত কাজ করে এবং স্পন্দিত হতে পারে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে শতকরা ১০০-১৫০ ভাগ দ্রুততার সাথে। একজন মানুষ ১০০ বছর বেঁচে থাকলে সারা জীবনে তার হৃদপিন্ড স্পন্দিত হয় প্রায় পঞ্চাশ হাজার লক্ষ বার!
মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এতবার স্পন্দিত হতে হতে এই যন্ত্রটি কী কখনও ক্লান্ত হয়ে পড়ে না? এক সেকেন্ডের জন্যও না থেমে সুচারু ভাবে দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে অঙ্গটি ক্লান্তিতে কেন ভেঙে পড়েনা? এ প্রশ্নের উত্তর জানবার আগে আরো কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
প্রাণীদের আকৃতি যত ছোট, তাদের হৃদস্পন্দন হয় তত বেশী! একশত পঞ্চাশ টন ওজনের তিমির হৃদযন্ত্র মিনিটে মাত্র সাত বার এবং তিন টন ওজনের হাতীর মাত্র ছেচল্লিশ বার স্পন্দিত হয়ে থাকে। অপরদিকে, এক থেকে দেড় কেজি ওজনের বিড়ালের মিনিটে ২৪০ বার এবং মাত্র ৮ গ্রাম ওজনের ছোট্ট পাখী ব্লু টিটের হৃদস্পন্দন হয় মিনিটে ১,২০০ বার! উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীদের বিপাক ক্রিয়ার সাথে হৃদস্পন্দনের নিবিড় সম্পর্কের জন্যই স্পন্দনের এই হেরফের। সহজ করে বললে বলা যায় যে, কোন প্রাণী যত ক্ষুদ্র আকৃতিবিশিষ্ট, তার দেহের সর্বত্র রক্ত পৌঁছাতে সময় লাগে তত কম। আবার সে রক্ত ফিরেও আসে অতি দ্রুত। তাই সংক্ষিপ্ত বিরতিতে রক্ত সরবরাহের প্রয়োজন হয়। বৃহদাকৃতির প্রাণীদের বেলায় ঘটে ঠিক এর উল্টোটা। দ্রুত রক্ত সঞ্চালনের ফলে বিপাক ক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। ফলে বৃহদাকৃতির প্রাণীর তুলনায় ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণীদের দেহের তাপমাত্রা থাকে সব সময়েই অধিক। যা হোক, সে আর এক ভিন্ন প্রসঙ্গ।
প্রশ্ন জেগেছিল মনে, হৃদপিণ্ড কোন বিরতি ছাড়াই এত দীর্ঘ সময় কোন রকম ক্লান্তি অনুভব না করে একটানা চালু থাকে কেমন করে? এই ‘বিরতিহীন’ বা ‘একটানা’ কথা দুটোর কোনটাই আসলে সঠিক নয়। হৃদযন্ত্রের পেশীসমূহ একেবারে নিরলস ভাবে কাজ করে না। প্রতিবারের স্পন্দনের পরে ও পরেরবারের স্পন্দনের আগে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এদের কিছুটা বিশ্রাম জোটে। বিশ্রামরত একজন মানুষের হৃদপিণ্ডের একেকটি স্পন্দনের মেয়াদ ০.৪৯ সেকেন্ড, পরের বার স্পন্দনের আগে ০.৩১ সেকেন্ড সময় থাকে বিরতি। এ ছাড়া হৃদযন্ত্রের সকল অংশ একই সাথে ব্যাস্ত সময় কাটায় না, কাজেই এই বিশ্রামকাল আসলে আরো বেশি।
ধরা যাক, হৃদযন্ত্রের কাজ শুরু হয় এর অরিকল বা অলিন্দের সঙ্কোচনের মাধ্যমে, এ সময়ে নিলয় বিশ্রামে থাকে। আবার নিলয় যখন সঙ্কুচিত হয়, তখন অলিন্দ থাকে গা ছাড়া ভাবে। অলিন্দ সঙ্কুচিত হতে সময় লাগে ০.১১-০.১৪ সেকেন্ড, এর পরে তার বিশ্রামের জন্য থাকে ০.৬৬ সেকেন্ড। হিসাব কষে দেখা যায় যে, দিনে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টার বেশী সময় অলিন্দের কাজ থাকে না – অবশিষ্ট ২০ ঘন্টা কাটে তার বিশ্রামে! ভেন্ট্রিকল বা নিলয় সঙ্কোচনে একটু বেশী সময় ব্যয় করে। ০.২৭ – ০.৩৫ সেকেন্ডে সঙ্কুচিত হয় এবং বিশ্রাম পায় অলিন্দের তুলনায় কম। এর পরেও নিলয় কিন্তু দিনে কাজ করে ৮.৫ -১০.৫ ঘন্টা এবং ১৩.৫ – ১৫.৫ ঘন্টা বিশ্রাম পেয়ে থাকে।
হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং তা দীর্ঘায়িত করা কী সম্ভব? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব ইতিবাচক। সুদীর্ঘ গবেষণার ফলাফলে জানা যায় যে, বিশ্রামরত অবস্থায় একজন দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদের হৃদযন্ত্রের সঙ্কোচনের হার অন্যান্যদের চেয়ে অনেক কম থাকে। এদের নাড়ির গতির হার (হৃদস্পন্দন) থাকে প্রতি মিনিটে মাত্র চল্লিশ, একে আরো কমিয়ে মিনিটে মাত্র আটাশেও নামানো সম্ভব!
হৃদযন্ত্রের এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য তো শুধু মাত্র বিশ্রাম যথেষ্ট হতে পারে না। এই অসাধারণ কর্ম সুচারুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি, প্রয়োজন পরিমিত অক্সিজেন। মানুষসহ সকল উঁচু স্তরের প্রাণীদের সমগ্র দেহে রক্ত সরবরাহের নিমিত্তে উন্নত ও শক্তিশালী রক্ত সংবহনতন্ত্র সচল রাখতে হৃদযন্ত্রের জন্য এই পুষ্টি ও অক্সিজেন কিভাবে পাওয়া যায়?
… চলবে …।
[যে গ্রন্থ থেকে অকাতরে তথ্য গৃহীত হয়েছে, সেটা হচ্ছে Physiology for Everyone by Boris Sergeev, Translated from the Russian by Oleg Meshkov. Mir Publishers, Moscow. First published 1973. ছবির জন্য নির্ভর করতে হয়েছে ইন্টারনেটের উপরে। উইকিপিডিয়া এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় সহায়ক।]
হার্ট প্রসঙ্গে কথাগুলা পড়ে ভাল লাগল।
সত্যিই আমাদের হার্ট এর ব্যপারে চিন্তা করলে অবাক লাগে। আমাদের দেহের ভিতরের মানুষের মুষ্টির সমান এই যন্ত্রটা (পাম্প মেসিন)দিন রাত অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে আর যখনই সে এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হবে তখনই জিবন প্রদীপ নিভে যাবে।
• প্রতিদিন আমাদের হৃতপিন্ড অবিরাম ১ লক্ষ বার বিট করে অর্থাৎ বছরে ৩৫ মিলিয়ন বার এবং একজন মানুষের জীবনে এই যন্ত্রটি গড়ে ২.৫ বিলিয়ন বার বিট্ করে!
• মানব দেহে সধারনত ৫.৬ লিটার রক্ত থাকে যা প্রতি মিনিটে পুরা শরীরে তিনবার ঘুরে আসে আর এই ভ্রমন দুরত্ব হিসাব করলে সারা দিনে দেহের সকল রক্ত নালী/ধমনী নেটওর্য়াক ঘোরে এসে মোট ৬০ হাজার মাইল রক্ত ভ্রমন হয়।
চমৎকার! চমৎকার প্রসঙ্গ নিয়ে ব্লগ লিখেছেন স্যার! অনেক কিছু জানতে পারলাম যা আমার জানা ছিলনা। আমি লেখাটি ফেসবুকে ফরওয়ার্ড করে দিলাম। ধন্যবাদ।