স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামপন্থিরা অবশ্যই ফ্যাক্টর

শেখ হাসিনা বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানবেন না, সেটা তিনি পরিষ্কার বলে আসছেন। এর জন্য তিনি বিস্তর রক্তক্ষয় ঘটিয়েছেন। আরো ঘটলেও তিনি এই অবস্থান থেকে নড়বেন না। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে রেখেই তিনি নির্বাচন করতে পারেন, সেই ইঙ্গিত রাজনীতিতে নানাভাবে তিনি দিয়ে রেখেছেন। যদি তিনি সদয় হয়ে নিজে ক্ষমতার দণ্ড হাতে না রাখেন তাহলেও তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনের ওপর তাঁর দাপট ও মতা পুরাপুরি বহাল রয়েছে। তিনি জানেন বাংলাদেশের বর্তমান সহিংস রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং বিরোধী দল ও মতকে দমন, পীড়ন, হত্যা ও খুনোখুনির যে ইতিহাস তিনি সৃষ্টি করেছেন, এরপর যারা মতায় আসবে তাঁরা তাঁকেই আদর্শ বলে মেনে নেবে। কিন্তু এর ফল তাঁর ও তাঁর দলের জন্য ভাল হবে না। ফলে সহজে মতা ছাড়বার কোন পরিস্থিতি তিনি রাখেন নি।
এই অবস্থান থেকেই তিনি চারটি সিটি করপোরেশানের নির্বাচনে সম্মতি দিয়েছেন। কারণ এটা প্রমাণ করা তার জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নির্বাচিত সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব। অর্থাৎ তিনি যেভাবে ক্ষমতায় থাকতে চান সেইভাবে রাষ্ট্রের কলকব্জা তাঁর নিয়ন্ত্রণে রেখেও সুষ্ঠু, পরিচ্ছন্ন ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে কোনই অসুবিধা হবার কথা নয়। বলাবাহুল্য দেশের সকলে তা মানছে না। বিএনপির তো মানার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু যাদের তিনি বোঝাতে চান তারা দেশের মানুষ নয়, বিদেশের সেই সব শক্তিধর দেশ, যারা চায় নির্বাচন হোক। তারা শেখ হাসিনার ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে, যেন বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের একটা সমঝোতা হয়। বিদেশী কূটনৈতিক মহলকে বোঝাতে চান তিনি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্যই হবে। বিএনপির তত্ত্বাবধায়কের দাবি অতএব মেনে নেবার কোন দরকার নাই। চারটি করর্পোরেশানের নির্বাচন দেওয়া এবং হার মেনে নেওয়ার পেছনে এই রাজনীতিটাই কাজ করেছে। এখন কূটনৈতিক মহল তাঁকে বিশ্বাস করছে কিনা সেটা সামনের দিনগুলোতে আমরা আরো পরিষ্কার ভাবে বুঝব।
দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনা যুক্তি দিচ্ছিলেন সাংবিধানিক বৈধতার আলখাল্লা পরা একনায়কী ও ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার অধীনে সুষ্ঠ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব। তাঁর মন্ত্রীরা তাঁর এই মন্ত্র নানান ভাবে প্রচার করছিল। চারটি সিটি কর্পোরেশানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্মতি দেবার পেছনে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করবার পক্ষে ন্যায্যতা তৈরীই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। অনেকে দেখছি, দাবি করছেন, তিনি সফল হয়েছেন। কিন্তু কার কাছে? শুধু তাদের কাছে যারা মূলত চৌদ্দ দলের সমর্থক। এর বাইরে ‘নিরপেক্ষ’ কেউ যদি ক্ষমতাসীন দলের ঔদার্যে বিমোহিত হয় তাঁরা বড়জোর ভালমানুষ। ঝুটঝামেলা চান না। তবে আঠারো দলীয় জোটের কাছে এর কোন মূল্য আছে বলে মনে হয় না। এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু তারা এখনও হারায় নি যে চারটি সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচন আর জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। তবে এই নির্বাচনের অন্য কোন রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে কিনা সেটা বিচার করতে হলে আমাদের আরো একটু গভীরে যেতে হবে। যাঁরা গুরুগম্ভীর ভাবে বলছেন স্থানীয় ইস্যু নয়, মূলত জাতীয় রাজনীতিই সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচনে ছায়া ফেলেছে, তাঁদের কথা খুবই শিশুসুলভ ও হাস্যকর শোনায়। স্থানীয় হিসাবনিকাশ বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ভূমিকা রাখার পরেও স্থানীয় নির্বাচনে – বিশেষত সিটি কর্পোরেশানের ভোটাভুটির ক্ষেত্রে অবশ্যই জাতীয় রাজনীতি ছায়াপাত করে। ছায়াপাত করতে বাধ্য। বিশেষত যখন সকল পক্ষ খেয়ে না খেয়ে সচেতন ভাবে স্থানীয় নির্বাচনকে দলীয় নির্বাচনে পরিণত করবার জন্য নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করে নেমে পড়েছিল।
আজ ১৬ জুন তারিখে প্রধান কয়েকটি পত্রিকা কি শিরোনাম করেছে দেখা যাক। ‘আঠারো দলের বিপুল বিজয়’ (নয়া দিগন্ত), ‘চার সিটিতেই বিএনপির বিজয়’ (প্রথম আলো), ‘চার সিটিতেই আ’লীগের ভরাডুবি’(যুগান্তর), ‘চার সিটিতেই বিএনপি বিজয়ী’ (ইত্তেফাক), ‘বিএনপির বিশাল জয়’ (সমকাল), ‘BNP takes 4 cities by storm’ (নিউ এইজ), ‘Four-Zero: BNP-backed mayor aspirants triumph over AL-blessed rivals in four city polls’ (ডেইলি স্টার)। দেখা যাচ্ছে কোন গণমাধ্যমই একে স্থানীয় নির্বাচন গণ্য করছে না, বরং একে ধরে নিয়েছে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতা হিসাবে। আসলে সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচন চরিত্রের দিক থাকে জাতীয় নির্বাচনের চরিত্রই পরিগ্রহণ করেছিল। এটা জানার পরেও স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনই ছায়াপাত করেছে বলার কোনই অর্থ নাই। যদি তাই হয় তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে আসলে কী ঘটছে এবং তার আলাদা কোন তাৎপর্য আছে কিনা সেই দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে।
সমাজে রাজনৈতিক মেরুকরণের সহিংস ভিত্তি শেখ হাসিনা শুধু পাকাপোক্তই করেন নি, তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে বিচার বিভাগকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে হয়। কিভাবে বিরোধী চিন্তা ও মতকে দমন করতে হয়। তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার যে অগণতান্ত্রিক, গণবিরোধী ও ফ্যাসিস্ট রূপান্তর ঘটিয়েছেন তা অসামান্যই বলতে হবে। বাংলাদেশে ছাপা ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের ভিড়কে তাঁর তোয়াক্কা করতে হয় নি। ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামের আতংকে দিশেহারা তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ ও প্রগতিশীলদের তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে বিএনপি, জামায়াত এবং হেফাজত বাংলাদেশকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে যাচ্ছে। মেয়েদের তারা বোরখা পরিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেবে, শরিয়া আইন চালু হয়ে যাবে, অমুসলিম নাগরিকরা আর নিরাপদ থাকবেন না। তাঁর আমলে ‘সংখ্যালঘু’ নাগরিকদের জনপদ ও উপাসনালয়ের ওপর কারা বিভিন্ন সময় হামলা করেছে তার কোন নিরপেক্ষ তদন্ত তিনি করেন নি। সরকারি দলের লোকজনের ভূমিকা থাকার অভিযোগ ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক কারণে যেসকল নাগরিকদের অবস্থান নাজুক তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের ঔদাসীন্য ছিল প্রকট। মনে হয়েছে এই ধরণের ঘটনা সরকার ঘটতে দিয়েছে। তাঁর সমর্থক গণমাধ্যমের মিথ্যা অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন যে তিনিই এখনো সংখ্যালঘুদের একমাত্র রক্ষক। বিএনপি ও ইসলামপন্থিরাই সংখ্যালঘুদের একমাত্র শত্রু। তারাই সাম্প্রদায়িক। যেহেতু তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই তাঁর প্রতিভার গুণে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবার পরেও এই সত্য আড়াল করবার জন্য এই ইসলাম-বিরোধী প্রচার দারুন ফলদায়ক সেটা মানতেই হবে।
তাঁর অনুমান হচ্ছে কঠোর ইসলাম বিরোধী ও ইসলাম বিদ্বেষী প্রচার, সংস্কৃতি ও রাজনীতিই ক্ষমতায় থাকার জন্য তাঁর পক্ষে সহায়ক। তাঁর এই অনুমান ভুল বলা যাবে না। অবাধ দুর্নীতি ও কুশাসন সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে সুশীল সমাজসহ শহুরে মধ্যবিত্তের সমর্থন অস্বীকার করার কোনই উপায় নাই। তাঁর বিরুদ্ধে এই শ্রেণির নিরর্থক গজগজানি রাজনৈতিক দিক থেকে বিশেষ কোন মূল্য বহন করে না। এই শ্রেণীর সমর্থনই ফ্যাসিবাদকে মতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান ভিত্তি হয়ে রয়েছে। আগামি দিনেও থাকবে বলে আমরা অনায়াসে অনুমান করতে পারি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের লড়াই যে ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, বরং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এই সত্য প্রতিষ্ঠিত নয়। সেটা প্রতিষ্ঠিত হতে না পারার কারণ শুধু শেখ হাসিনা ও চৌদ্দ দলীয় জোট নয়। বেগম খালেদা জিয়া এবং আঠারো দলীয় জোটও বটে।
এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই তিনি ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। গণহত্যা সংগঠিত করতে কুন্ঠা বোধ করেন নি। হেফাজতে ইসলামকে নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে দমনের নীতির মধ্য দিয়ে নিজের রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র পরিচ্ছন্ন করেছেন। দেশে বিদেশে তাঁর রাজনীতি সম্পর্কে ধারণাও পোক্ত করতে পেরেছেন। প্রমাণ করতে পেরেছেন একমাত্র তিনিই এই দেশে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে কোন ধরণের রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠি বা প্রবণতাকে নিষ্ঠুর ও কঠোর ভাবে দমন করতে সক্ষম। এটাও তিনি কমবেশী প্রমাণ করতে পেরেছেন অধিকাংশ গণমাধ্যমই তাঁর পক্ষে। তিনি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা অবৈধ ভাবে গায়ের জোরে বন্ধ করে দিতে পারেন। মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করতে পারেন। তাঁর পক্ষে কোন সম্পাদক সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে নিঃশর্ত কোন অবস্থান নিয়ে দাঁড়াবে না। কিম্বা দাঁড়ালেও তার মধ্যে বিবিধ ভেজাল মিশ্রিত থাকবে। যেসব সম্পাদক সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশ বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে নির্যাতনের বিরোধিতা করেছেন তাঁদের অনেককে দেখছি আবার মাহমুদুর রহমানকে ইনিয়েবিনিয়ে সমালোচনা করে তাঁদের পার্থক্য ও দূরত্ব বজায় রাখার কোশেশ করছেন। মাহমুদুর রহমানের ওপর প্রথম আলো রীতিমতো তিনদিন ‘আমার দেশ’ ও মাহমুদুর রহমানের সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে লেখালিখি করছে। তাদের শত্রু ফ্যাসিবাদ বা ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়। বরং তারাই যাদের শেখ হাসিনা তাঁর প্রধান দুষমণ বলে গণ্য করেন। আর এভাবেই গণমাধ্যমগুলো তাদের ফ্যাসিস্ট চরিত্র নগ্ন করে দেখায়। শেখ হাসিনাকে প্রশংসা না করে পারা যায় না, তাঁর গোলামদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা খুবই পরিষ্কার। যে কারণে নির্ভয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে সম্প্রতি তিনি আরো মজবুত করে নিয়েছেন, এই আইন প্রয়োজনে যে কোন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে তিনি ব্যবহার করবেন। তিনি জানেন রাজনৈতিক ভাবে তাঁর বিরোধী শক্তি শুধু নয় এমনকি তার নিজের পরে গোলামরাও যদি সমালোচনা করে তিনি কঠোর হাতেই সেটা দমন করবেন। তাঁকে জোর করে ক্ষমতায় থাকতে হবে অথবা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আবার ফিরে আসতে হবে।
হয়ে যাওয়া চারটি সিটি করপোরেশান নির্বাচনে আওয়ামি লিগ অবশ্য ভাবে নি যে তারা চারটিতেই খারাপ ভাবে হারবে। কারচুপির কোন পরিকল্পনা ছিল না, সেটা দাবি করা মুশকিল। আসলে নির্বাচনের ফলাফল গোনা হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিপক্ষের কাছে চলে গিয়েছিল এবং গণমাধ্যমে তা প্রচারিত হচ্ছিল। ফলে কারচুপির জায়গা বা মুহূর্ত বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না। এর অসুবিধা টের পেয়ে রাজশাহিতে খায়রুজ্জামান আপত্তিও তুলেছিলেন। তিনি অভিযোগ করছিলেন মিডিয়া ক্যু হচ্ছে (প্রথম আলো ১৬ জুন ২০১৩)। অর্থাৎ ফলাফল আগে প্রচারিত হওয়াতেই তাঁর আপত্তি। মোসাদ্দেক হোসেনের সমর্থকরা বুদ্ধিমানের কাজ করেছে বোঝা যাচ্ছে। এতে তারা কারচুপি থেকে রাই শুধু পায় নি, সংঘাত ও সহিংসতার যে সম্ভাবনা রাজশাহীতে ছিল তাকেও মোকাবিলা করতে পেরেছেন সফল ভাবে।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুষ্ঠিত এই চার সিটি করপোরেশন (রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট) নির্বাচনে যারা মেয়র পদে জয়ী হয়েছিলেন তারা এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। গত ১৫ জুনে পরাজিত চার প্রার্থী তখন মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছিলেন। বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা তখন পরাজিত হয়েছিলেন। বিএনপি শুধু সিলেটে প্রার্থী বদলায়। তাছাড়া আগের তিন প্রার্থীই বহাল থাকে।
শেখ হাসিনার ঘোর সমর্থকদের মধ্যে হাহাকার উঠেছে। প্রথম আলোয় একজন লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায়?’ বিদায়ী চার মেয়র ‘এগিয়ে ছিলেন’। এই ধরণের ছেলেমানূষী মন্তব্যের পেছনে অনুমান হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান জানাবার সুযোগ পেলে জনগণ তা বিবেচনা করবে না, তাদের বিবেচনা করতে হবে প্রথম আলোর হাস্যকর ‘সৎ ও যোগ্য’ প্রার্থীর সুশীল ধারণা। প্রার্থীরা যেহেতু ভদ্রলোক ছিল, এলাকায় কাজ করেছে, অতএব তাদেরকে ভোট দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা হারল কেন? না তারা ঠিকই হেরেছে আওয়ামি লীগের কারণে। তো আওয়ামি লীগ খারাপ কি কাজ করল? তার ফিরিস্তি হিসাবে দশটি কারণ দেখানো হয়েছে। যথা, ১. অতিআত্মবিশ্বাস ২. ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ৩. সাংগঠনিক দুর্বলতা ৪. বিরোধী দলের শক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ৫. মিত্রদের সঙ্গে অসহযোগিতা ৬. জাতীয় পার্টির অসহযোগিতা ৭. কাজের চেয়ে কথা বেশি ৮. বিএনপিকে মৌলবাদীদের দিকে ঠেলে দেওয়া ৯. সবকিছুর দায় জামায়াতের ওপর চাপানো ১০. শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হল-মার্ক ইত্যাদি কেলেঙ্কারির জবাব না পাওয়া, ইত্যাদি। (দেখুন ‘আওয়ামি লীগের পরাজয়ের দশ কারন’ ১৬ জুন ২০১৩)।
বিস্ময়কর হলো কোথাও রাষ্ট্রের চরিত্রের গণবিরোধী রূপান্তর এবং তার কারণে জনগণের মনোভাবে কোন পরিবর্তন ঘটেছে কিনা সে সম্পর্কে ঘূণাক্ষরেও একটি বাক্য নাই। সেটা দূরে থাকুক এমনকি ক্ষমতাসীনদের নির্বিচার দমনপীড়ন, মানবাধিকার লংঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমখুন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার খোল নলচে বদলে দেওয়া, যুদ্ধাপরাধীর প্রহসনমূলক ও বিতর্কিত বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা, অন্যায় ভাবে দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশান ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ একটি ইস্যুরও উল্লেখ নাই যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দিক থেকে প্রাসঙ্গিক। যে সকল নাগরিক ও মানবিক অধিকার জন্য লড়াই করা ছাড়া গণমানুষের আর কোন গত্যন্তর নাই। যদি আওয়ামি লীগের প্রার্থীরা ভাল হবার পরেও তাদের ভোট দিয়ে জনগণ জয়ী না করে তাহলে তার প্রধান কারণ হচ্ছে চৌদ্দ দলীয় জোটের মধ্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিরোধী যে-চরিত্রের নিদর্শন এই সরকারের শাসনামলে জনগণ দেখেছে তা তারা পছন্দ করে নি। চৌদ্দ দলের সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে আবার জয়যুক্ত করবার কোন সঙ্গত যুক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খুঁজে পয়ায় নি। চৌদ্দ দল বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সর্বনাশ ঘটিয়েছে এবং গণতান্ত্রিক বিধিবিধান ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নষ্ট করে চলেছে। শুধু দুর্নীতিবাজ ও ইসলাম বিদ্বেষী হিসাবে নয়, চৌদ্দ দল বরং জনগণের নাগরিক ও মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী হিসাবে নিজের যে রূপ প্রদর্শন করেছে তার কাফফারা তাকে বহু দীর্ঘদিন গুণতে হবে। ইসলাম-বিদ্বেষ আঠারো দলীয় জোট ও হেফাজতে ইসলামের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচনে তা অবশ্যই প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু জনগণের দিক থেকে এই দুটো বিষয় ছাড়াও রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ধরণে যে নেতিবাচক ক্ষয় ঘটেছে তার উপলব্ধি অবশ্যই জনগণের বিবেচনার মধ্যে ছিল। সাধারণ মানুষ এই ক্ষয়ের উপলব্ধি কিভাবে নিজ নিজ জায়গা থেকে করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে সেটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলা ঠিক হবে না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা বলেই এই উপলব্ধির চরিত্র ও মাত্রা বোঝার দরকার আছে। তার দ্বারাই বোঝা যাবে আগামি জাতীয় নির্বাচনে, যদি আদৌ নির্বাচন হয়, আসলে কী হতে যাচ্ছে।
যাঁরা বলছেন যে সিটি করপোরেশানের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের হেরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আগামি নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের হার হওয়া, এতো দ্রুত এই সিদ্ধান্ত টানা ঠিক বলে মনে হয় না। ঠিক যে চৌদ্দ দলের ভরাডুবি হয়েছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য দমন পীড়নের পরেও ক্ষমতাসীনদের প্রার্থী কম ভোট পেয়েছে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত যে দল বা জোটের প্রার্থীকে জনগণ ভোট দিয়েছে তারাও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষের দল নয়। মনে রাখা দরকার বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছাড়া এখনও অবধি এমন কোন প্রস্তাব পেশ করেনি যাতে স্রেফ ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোন ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে চায়। সাংবিধানিক রাজনীতির অধীনে থেকে সেটা সাংবিধানিক ভাবেও ঘটানো সম্ভব। কিন্তু এই গোড়ার রূপান্তর ঘটাতে চৌদ্দ দল ইচ্ছুক এবং সম কিনা সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
তবে এটা সত্য যে সিটি নির্বাচনকে ঘিরে আঠারো দল ও হেফাজতে ইসলামের মধ্যে যে সমঝোতা আমরা দেখছি তা আকস্মিক গড়ে ওঠে নি এবং তা ক্ষণস্থায়ী কিছু নয়। হেফাজতের ছয়ই এপ্রিল ও ৫ই মের কর্মসূচির জের এখনও কাটে নি। সিটি করপোরেশান নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার কিছুটা প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। হেফাজত সিটি করপোরেশানের নির্বাচনে বুঝিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আঠারো দলীয় জোটের গণসমর্থনের ভিত্তি সম্প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার সতর্ক সমর্থন বিএনপির রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হয়েছে ও হবে সন্দেহ নাই। রাজনীতির দিক থেকে বিএনপির জন্য এটা নতুন চ্যালেঞ্জও বটে। বিএনপিকে দেখাতে হবে ইসলাম প্রশ্নের মোকাবেলা মানে একটি ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র কায়েম করা নয়, বরং রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের পরিগঠনে যাকে এতোকাল উপেক্ষা ও অস্বীকার করা হয়েছে তাকে স্বীকার ও আত্মস্থ করা। ইসলামপন্থিদের বোঝাবার দায় বিএনপি বহন করতে সক্ষম কিনা স্পষ্ট নয়। চৌদ্দ দল বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইসলামের ভূমিকা আসলে কিভাবে দেখে এবং কিভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দিক থেকে শুধু নয় ইসলামের দিক থেকেও সার্বজনীন আদর্শ হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ধারণা আত্মস্থ করতে চায় সেই প্রশ্নের মীমাংসা না হলে জামায়েতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিছকই সুবিধাবাদী ও কৌশলমূলক হয়ে থাকবে। এই রাজনীতির কোন ভবিষ্যৎ নাই। ইসলাম প্রশ্নকে উপেক্ষা করা কারো পক্ষেই বাংলাদেশে আর সম্ভব না। কিন্তু এই সম্পর্ক নিছকই কৌশলগত জায়গায় আটকিয়ে রাখা যাবে না। সেটা হবে কপটার্থে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের খারাপ উদাহরণ। চৌদ্দ দল ও তথাকথিত সুশীল সমাজের সমালোচনা এই কারণেই অনেকের কাছে যথার্থ মনে হয়।
সুশীল রাজনীতি ইসলামী আতংকে কিভাবে ভোগে তার একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। গত শুক্রবার ১৪ জুন তারিখে ডেইলি স্টার প্রথম পাতায় একটি ছবি ছেপেছে। টুপি ও পাঞ্জাবি পরা কিছু নাগরিক একটি মাইক হাতে কিছু একটা প্রচার করছেন। নীচে ডেইলি স্টারের ক্যাপশান হচ্ছে ‘alleged activists of Hefajat-e Islam campaign for the BNP-backed mayoral candidate in Khulna yesterday’। আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে হেফাজতে কর্মী হিসাবে ‘অভিযুক্ত’রা বিএনপির সমর্থিত প্রার্থীর জন্য প্রচার করছে। ‘অভিযুক্ত’ কথাটা ফৌজদারি বা আইনী শব্দ। টুপি ও পাঞ্জাবি পরার কারণে নাগরিকরা ‘অভিযুক্ত’। কী অপরাধ করেছেন তারা? তাঁরা হেফাজত করেন। যে কোন প্রার্থীকে যে কোন নাগরিক সমর্থন দিতে পারেন, সেটা প্যাণ্ট শার্ট পরেই হোক, কিম্বা হোক টুপি পাঞ্জাবি পরে। কিন্তু টুপি পাঞ্জাবি পরা সুশীল পত্রিকার চোখে অপরাধ। কোন প্রার্থীকে কোন ধর্মপ্রাণ মানুষ সমর্থন করলেই সেটা অপরাধ হয়ে যাবে।
এর নীচে খবরের হেড লাইন হচ্ছে BNP, allies count on Hefajot clout. Plot to forge partnership, exploit religion in JS। আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট হেফাজতের সমর্থনের ওপর নির্ভর করছে। তারা জোট বাঁধার ‘ষড়যন্ত্র’ করছে, যাতে ধর্মকে ব্যবহার করতে পারে। বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে এতে সুশীল সমাজ আতংকিত। কিন্তু কাছে আসাটা এখনও কৌশলগত মাত্র। অতি আতংকে দিশেহারা হয়ে সুশীল সমাজের পত্রিকাগুলো যেসব কথা বলছে তার কোন ভিত্তি নাই। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণশক্তির গঠন ও বিকাশের দিক থেকে নীতিগত ঐক্যের জায়গাগুলো কি হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনা জরুরী হয়ে পড়েছে।
সিটি করপোরেশানের নির্বাচনের ফলাফল সেই তাগিদ যদি জোরদার করে তাহলে বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়ে যেতে পারবে। আশা করি।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *