তারা চোর বটেন। তবে ‘যাহা তাহা’ মার্কা অর্ডিনারি নন। কেউ কেউ রীতিমত উচ্চশিক্ষিত। পদস্থ কর্মকর্তাও কেউ কেউ। গাড়ি চোরচক্রের সদস্য এরা। সম্প্রতি ‘ধরা খাওয়ার’ পর তাদের সম্পর্কে জানা গেছে। তথ্যাদি চাঞ্চল্যকর। বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। রঙটা নির্ঘাত কালো। বাংলার মাটিতে কালো বিড়াল বলে সুখ্যাত(!) ছোঁচা রাজনীতিকের নামটা সক্কলেরই জানা। উল্লেখ নাহয় নাই-বা করলাম।
এনাদের টার্গেট নতুন মডেলের দামি গাড়ি। নতুন নতুন কৌশল খাটিয়ে কাজ হাসিল করে নিচ্ছে তারা। মহাজোটীয় সরকারের আমলে মহাউৎসাহে দিনবদল ঘটে চলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছিনতাইকারীরা বদলাচ্ছে কলাকৌশল। কর্মপদ্ধতিই শুধু না, চোরা বাবাজিদের রুচি-পছন্দেরও পরিবর্তন ঘটছে। পুরান-ধুরান ওল্ড ফ্যাশনড গাড়ি তারা পোঁছে না। নজর বড়ই উঁচু উনাদের। তা তো হবেই ‘টিম ছিনতাই’ লেখাপড়া করনেওয়ালা লোকের সংমিশ্রণ হয়েছে। গুণগত পরিবর্তন তাই আসতে বাধ্য। এই চক্রে ইদানীং জড়িত হচ্ছেন বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নামি-দামি ব্যাংক কর্মকর্তা, বি আরটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। গাড়ি মেরামতকারী সংস্থার শ্রমিক, পেশাদার দালালরা তো আছেই। আজকাল যেসব গাড়ি চুরি/ছিনতাই হচ্ছে অথবা পুলিশ উদ্ধার করছে—সেগুলোর বেশিরভাগই নতুন মডেলের দামি গাড়ি। ডিবি পুলিশের অভিযানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ তিনজনকে আটক করা হয় সম্প্রতি। তাদের কব্জায় থাকা ১৫টি চোরাই গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
গাড়ি চুরি করা অনেক ‘মেহনতের’ কাজ। একটু দেখাই যাক সেই মেহনতের আকার প্রকার, কারিশমা টেকনিক। এই চক্রের যারা সদস্য, তারা কয়েকটি ধাপে তাদের সুকর্ম(!)টি সম্পাদন করে থাকে। যে গাড়িকে টার্গেট করা হয়, কয়েকদিন ধরে সেটার গতিবিধি সতর্ক নজরদারিতে থাকে। তারপর? ঝোপ বুঝে কোপ মারা হয়। এই চক্রের সদস্যদের কাছে দরকারি মাল-সামান মজুত থাকে সবসময়। লক খুলে গাড়ি ড্রাইভ করে পালানোর জন্যে দরকারি সব যন্ত্রপাতি হচ্ছে এই মাল-সামান। বড়সড় শপিংমল, হাসপাতাল ও বিনোদন কেন্দ্রের গাড়ি পার্কিং এলাকায় চোররা ঘোরাফেরা করে। গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভাররা অন্যত্র গেলে তারা ঝটপট করে নেমে পড়ে অপারেশনে। কোনো কোনো সময় গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভাররা ঘুমোয়। তখন চালককে অজ্ঞান করে গাড়ি নিয়ে দে চম্পট।
অন্য কিসিমের তরিকাও আছে। সেটা হলো ডাইরেক্ট অ্যাকশন। সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা গাড়ির গতিরোধ করে স্ট্রেইট। চালক বা মালিকের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখে কাজ সমাধা। আজকাল এই পদ্ধতিই বেশি চলছে। চুরি করনেওয়ালাদের যুক্তি হয়তো এরকম : অত হাংকি পাংকির দরকারটা কী বাপু! ধরো তক্তা মারো পেরেক। ছাক্কা অ্যাকশন। আজাইড়া সময় ক্ষেপণের কোনো কায়-কারবার নাই। এই সিস্টেমের ছিনতাই আবার দিনের যে কোনো টাইমে করা চলে না। বিশেষ সুবিধাজনক টাইম রয়েছে। সেটা হলো গিয়ে সকাল ছয় ঘটিকা থেকে আট ঘটিকা। অথবা রাতের বেলা। বেলা বেড়ে গেলে এই প্যাটার্নের ছিনতাই করতে গেলে হাজারটা ঝামেলা। নানারকম ঝঞ্ঝাট, বিভ্রাট। বেলা বাড়লে রাজধানীতে যানজটের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন ছিনতাই করা এত্ত বড় ‘মাল’ নিয়ে নিরাপদে সটকে পড়া মুশকিল। প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে তাতে।
আরেকটি প্রক্রিয়ার কথা জানা গেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় থেকে এই প্রক্রিয়ার সূচনা। ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশ থাকে এই কৌশলে। তারাও ‘টু পাইস’ পান কি না! সে কারণেই হাত মেলানো। কাজের বিনিময়ে খাদ্য আর কি! ছিনতাই চক্রের সদস্যরা গাড়ির ক্রেতাকে ফলো করতে থাকে। যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয় এবং যে শোরুম থেকে গাড়ি কেনা হয়, তারা ‘সহায়তার’ হাত বাড়িয়ে দেন। ড্রাইভার নিয়োগে তারা সাহায্য করেন। এই ড্রাইভারও চোরাচক্রের একজন। সময় সুযোগ বুঝে এই ড্রাইভারই গাড়ি নিয়ে ‘হাওয়া’ হয়ে যান। অর্থাৎ কিনা, শর্ষের মধ্যেই ভূতের বসতি। সম্মানিত পাঠক, এ বিষয়ক ‘জ্ঞান’ অর্জন এখনও বাকি আছে কিছুটা। ছিনতাই বা চুরির আগে থেকেই ক্রেতা ঠিক করা থাকে। কোন্ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে গাড়িটি বেচা হবে, সেইটে। এই ‘ঠিক করে রাখা’র গূঢ় কারণও আছে। ছিনতাই করা গাড়ি বোমার মতো বিপজ্জনক। যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিপদ ঘটতে পারে। অত্রএব যত দ্রুত সম্ভব ডিসপোজাল করে ফেলতে পারলেই মঙ্গল। ধরুন, একখান গড়ি চুরি বা ছিনতাই করা হলো। প্রথমে গাড়িটি নিয়ে যাওয়া হয় যে ওয়ার্কশপের মালিক বা কর্মচারীদের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ আছে, তাদের কাছে।
পাল্টে ফেলা হয় দুর্ভাগা গাড়িটির ইঞ্জিন, চেসিস, রেজিস্ট্রেশন নম্বর এবং রঙ। ভোল পাল্টে ফেলা এই গাড়ি চিনে শনাক্ত করে সাধ্য কার। গাড়ির তো আর ডিএনএ নাই। আগাপাস্তলা পাল্টে ফেলা তো হলো। এখন বাকি রইল কাগজপত্তর। বি আরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় পুনর্বার কৌশলের প্রয়োগ। প্রকৃত মালিকের ছবিসমেত কাগজপত্রাদি সংগ্রহ করা হয় এ পর্যায়ে। নতুন নকল কাগজপত্র তৈরি করা হয় আসল মালিকের ছবি দিয়েই। তারপর কী কাজ? আছে, সামান্য। চক্রের দালাল সদস্যদের মাধ্যমে বাজার মূল্যে তা বিক্রি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসিবত যে হয় না তা নয়। তবে তারও দাওয়াই আছে। সেটা হলো, বিকেন্দ্রীকরণ পলিসি। কাগজপত্র নকল করতে না পারলে গাড়িটি ঢাকার বাইরে কোনো মফস্বল শহরে বেচে দেয়া হয়। ইদানীং উদ্ধার করা দামি গাড়ির মধ্যে রয়েছে লেটেস্ট মডেলের টয়োটা এফ, প্রিমিও, এলিয়ন, এক্সিও, জি করোলা, এক্র করোলা, এক্স নোয়া, এসিস্টা, ভক্সি, নিসান, মিৎসুবিশি ইত্যাদি।
চোর আরও আছে। ডাকাত বলাই ভালো। তাদের ডাকাতির বিষয়বস্তু লেটেস্ট গাড়ির চাইতেও মূল্যবান। আছে নদীদস্যু। গত ছয় মাসে বুড়িগঙ্গা নদীর মাত্র তিন কিলোমিটার অংশে গড়ে উঠেছে ২২৫টি অবৈধ স্থাপনা। আছে বিশ্বাসহন্তারক। ভোটচোর। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার যারা লুণ্ঠন করে, রক্তে যাদের হাত রাঙানো, তাদের আটকাবে কোন্ ডিবি পুলিশ? লেখক : কবি ও সাংবাদিক