সাম্প্রতিক ভাবনা

আজ একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় আমরা এমন এক সময়ে এ পৃথিবীতে বসবাস করছি অর্থাৎ মানব সভ্যতা এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্য ও মিথ্যার তফাৎ বুঝা দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হতে যাচ্ছে। অদ্ভুত ও আজব এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে সারা বিশ্বে বিশেষ করে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রে। আর এ সব চলছে মুলত মুসলিম সমাজের শাসন ব্যবস্থা ও কতৃত্ব কাদের হাতে থাকবে অর্থাৎ ক্ষমতার আসনে কে বসবে তা নিয়ে। শাসন ব্যবস্থায় গনতন্ত্রের কথা বললেও বিশ্ব মোড়ল তাদের আজ্ঞাবাহী কেউ মুসলিম সমাজের ক্ষমতায় না বসলে সে গনতন্ত্র তাদের কাছে বাসি বা পানসে হয়ে যায়। যার তাজা উদাহরণ হল সাম্প্রতিক মিশরের উদাহরণ। একদিকে ইসলামী অনুপ্রেরণায় মানবাধিকার ও মানবতা প্রতিষ্ঠার সাথে ইসলামী মুল্যবোধের আলোকে শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ও সসম্মানে বেঁচে থাকার লড়াই চলছে প্রতিটি মুসলিম দেশে। অন্যদিকে মানবতার কল্যাণে সমাজ পরিবর্তনের এ সুমহান প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে চলছে কায়েমী স্বার্থপর গোষ্ঠির বিরামহীন চক্রান্ত এবং এ যুদ্ধে তাদের সহযোদ্ধা হচ্ছে পুঁজিপতি, ধর্মবিদ্ধেষী নাস্তিক, এক শ্রেণীর মুসলিম নামধারী মুনাফিক ও কমিউনিস্ট  তথা বামপন্থী তথাকথিত সাম্যবাদীরা এবং মুসলিম দেশের রাজা বাদশা ও স্বৈরাচারী শাসক গুষ্টি। আর যেহেতু তাদের আছে অফুরন্ত সুযোগ সুবিধা, মিডিয়া, আর্থিক সামর্থ্য  ও সামরিক শক্তি যা মুমিনদের জন্য  হয়ে গিয়েছে পাহাড় সমান প্রতিরোধ! তাই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে এ অসম বৈরী অবস্থা অতিক্রম করে আদৌ কি আসতে পারবে কোন সাফল্য?

বস্তুত এমনি এ যুগ সন্ধিক্ষণে বিশ্বের ১,৬ বিলিয়ন মুসলিমদের কাছে ফিরে এসেছে  পবিত্র রমজান মাস। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এ রমজান মাসেই এসেছে মুসলিম উষ্মার জীবনে অনেক সাফল্য, অনেক বিজয়। অতএব এ রমজান মাসের গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করার মাঝেই আসতে পারে একজন মুসলিমের জীবনে তার ইসলামী চেতনার নবজাগরণ। এ মাসে সঠিকভাবে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ নিতে পারলে একজন মুসলিম তার বাকি জীবনকে অর্থবহ (meaningfull) করতে সক্ষম হবে এতে কোন সন্দেহ নাই ইনশাল্লাহ। আর এ বিষয়ে আরো গভীর চিন্তা করলে এ কথা বুঝা সম্ভব হবে যে এই পবিত্র মাস প্রচলিত বস্তুতান্ত্রিক জীবন ধারার বিপরীত অভ্যাসের দাবী করে। যার সমন্বয়ে গড়ে  উঠে বিশ্বাসের স্তম্ভ। তাই বিবেক ও বিবেকবান নারী পুরুষের দায়িত্ব হল রমজানের এ ভিন্ন মাত্রা (dimension) অনুভব ও তার গুরুত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। পবিত্র এ মাসে একজন মুসলিম তার “নিজের মাঝে ফিরে আসার” এ গুরুত্ব যে কত বেশী তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

রমজান একজন মুসলিমের জীবনে নিয়ে আসে এক আকস্মিক পরিবর্তন বিশেষ করে বর্তমান এই ভৌগ্যবাদী সামাজিক জিবন ধারায়। ভোগ্যবস্তুর প্রাচর্য্যে ভরা এবং “বাজার অর্থনীতি” পরিচালিত এ সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে ভোগকারী ও ব্যক্তি স্বার্থ হচ্ছে সবার ঊর্ধ্বে! যার বিপরীতে এ  মাস আমাদেরকে শিক্ষা দেয় আমরা যেন ফিরে আসি জীবনের মূল কেন্দ্রস্থলে এবং জীবনের মুল উদ্দেশ্যে। আর সেই কেন্দ্রস্থলে হচ্ছেন আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন এবং তাঁর সাথে আমাদের হৃদয়ের সর্ম্পক। আর এ সম্পর্ক যত গাড় হতে থাকবে একজন মানুষের জিবন তত বেশী পরিছন্ন ও সুন্দর হবে এবং এতেই আসবে চুড়ান্ত সাফল্য। মুমিনদের জন্য আল্লাহ কেন রমজানের বিধান অবতির্ন করেছেন তার জবাব পবিত্র কোরআনে অল্লাহ বলে দিয়েছেন, “…লা আল্ লাকুম তাত্তাকুন” অর্থাৎ তাকওয়া অর্জন তথা আল্লাহর চেতনা (God consciousness) জাগ্রত হওয়া। ইসলামের সেই প্রথম যুগের এক গল্প প্রায়ই মুসলিম স্কলারদেরকে বলতে শুনা যায় তা হল:

অনেক দিন আগে এক শিক্ষক তার কিছু ছাত্রের প্রত্যককে একটি করে আপেল ফল দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন একাকী সেটি এমন এক জায়গায় আহার করে যেখানে অন্য কেউ দেখতে না পায়। পরের দিন ওস্তাদ সবাইকে জিজ্ঞস করায় সবাই জানালো যে তারা একাকী অবস্থায় তা খেতে সক্ষম হয়েছে শুধু একজন ছাড়া যাকে কিনা শিক্ষক সবচেয়ে বেশী পছন্দ করতেন। সে বলল “হজুর আপনি বলেছেন যেখানে কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু আমি এমন কোন জায়গায় পায়নি বাহ্যত নিজেকে একা পেয়েও কেননা যেথায় অন্য কেউ না থাকলেও  আল্লাহর উপস্থিতির অনুভূতি না করা সম্ভব হয়নি এবং নিজেকে একা ভাবাও বিশ্বাস  হয়নি তাই আপনার নির্দেশ পালন করতে পারি নাই।”
আসলে আমাদেরকে এই লেভেলে পৌছানোই হচ্ছে তাকওয়ার দাবী আর তখন একজন মানুষের পক্ষে অবিচার করা অন্যায় করা সম্ভব হবে না এবং একমাত্র তখনই সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো দেখা সম্ভব। তখন দলীয় চশমা দিয়ে কোন অন্যায়কে ন্যয় হিসাবে দেখার হীন মান্যতা থাকে না।

তবে রমজানের শিক্ষা হচ্ছে আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করা। আধুনিক বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক তরিক রামদান বলেন, “ to achieve the ultimate goal of the fast, our faith requires a demanding, lucid, sincere and honest mind capable of self critism. Everyone should be able to do that for oneself, before God, within one’s solitude as well as within one’s commitment among one’s fellow human beings…………Instead of blaming “those who dominate”, “the other”  “the West” etc., it is necessary to learn from the teaching of Ramadhan: You are indeed what you do of yourself. What we are doing of ourselves today? What our contributions within the field of education, social justice and liberty? What are we doing to promote the dignity of women, children or to protect the rights of the poor or marginalised people in our societies? What have we done with our universal message of justice and peace? What have  we done with our universal message of individual responsibility of human brotherhood and love?

All these questions are in our hearts and minds and there is only one  response inspired by the quran and natured by the Ramadhan: God will chnage nothing for the good if we change nothing.”

অর্থাৎ “রমজানের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের ঈমানের দাবী হল একটি নির্মল আন্তরিক এবং সৎ মনের প্রয়োজন যা আমাদের আত্মসমালোচনা করতে সক্ষম। প্রত্যেকেরই উচিত আল্লার কাছে একান্ত নির্জনতায় নিজের জন্য তা করতে সক্ষম হওয়া । ………… যারা আমাদেরকে  অধীনস্থ করেত চায় “ওরা”, ” পশ্চিমা শক্তি”  ইত্যাদির দুষ দেখার আগে  রমজানের শিক্ষা  থেকে শিখতে হবে:

(নিজেকে কি সত্যিই জানতে পেরেছি ?)  আপনি তা  যা আসলেই আপনি, আজ আমরা নিজেদের প্রতি কি করছি?  শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আমারা সমাজে কি অবদান রাখছি?  আমরা নারী, শিশু মর্যাদা উন্নীত করা বা দরিদ্রের অধিকার রক্ষায় কি করছি বা সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য কি করছি? আমাদের সর্বজনীন আদর্শ, যেমন ন্যায় বিচার ও শান্তি, মানুষের ভ্রাতৃত্ব এবং ভালোবাসার  ব্যাপারে আপনি কি কাজ করেছেন? এই সব প্রশ্ন আমাদের হৃদয় ও মনে আসে যা   কুরআন ও রমজানের শিক্ষা  দ্বারা অনুপ্রাণিত শুধুমাত্র একটি জবাবই আসে: আল্লাহ আমাদের কল্যাণের জন্য কিছুই পরিবর্তন করবেন না যতক্ষণ আমরা নিজেরা (নিজেদের) পরিবর্তন না করব (বা পরিবর্তনে সচেষ্ট না হব)”.

পরিশুদ্ধি দরকার আগে মুসলিম দেশে::

আরব বসন্তের ফলে গত এক বছর ধরে আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ মিশরে মোহাম্মদ মুরসি যখন আধুনিক গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের ভোটে ক্ষমতায় ছিলেন তখন সৌদি ও গালফ অঞ্চলের শাসকেরা তেমন অর্থ সাহায্য দিতে চাননি আর যখনই তাঁকে সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করল সঙ্গে সঙ্গে সৌদি সরকার তা স্বীকৃতি দিল। খবরে প্রকাশ সৌদি সরকার ৫ বিলিয়ন ডলার মিশরের সেনা সরকারকে সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে! আর অমিরাতও এগিয়ে এসেছে ২ বিলিয়ন ডলার নিয়ে! এদিকে খবরে প্রকাশ মার্কিন সহায়তায় ও অর্থে নাকি মুরসিকে উৎখাতের  নীলনকশা করা হয়েছে । যুক্তরাষ্ট্রের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ভিত্তিক অনুষ্ঠান ইউসি বারকেলের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের উন্নয়নে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেমোক্রেসি অ্যাসিস্ট্যান্ট তহবিলের অধীনে এই অর্থ-সহায়তা দেওয়া হয়। সূত্র এখানে দেখুন। তবে অনেকে বলছেন সে অর্থ আসলে এসেছে মুসলিম শাসকদের কাছ থেকেই কেননা আরব বসন্তের হাওয়া মুক্তিকামী মানুষের মনে আশার সঞ্চার হলেও  পুঁজিপতি সহ মুসলিম দেশের রাজা বাদশাহ ও স্বৈরাচারী শাসক গুষ্টির কাছে তা লেগেছে  বালু ঝড় (sand storm) ও নিজেদের ধ্বংসের তুফানের পূর্বাভাস।

সুত্র:: Ramadhan Month of fasting, month of meaning by Dr.Tariq Ramadhan (Canadian Muslim Journal, July 1,2013)
খবর আল- জাজিরা
CBS News

[youtube]http://www.youtube.com/watch?v=0qZA9rfJ2-4[/youtube]

Loading


Comments

সাম্প্রতিক ভাবনা — 1 Comment

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *