সামনে বদরের যুদ্ধ

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের মধ্যে অনেক প্রকারের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান যথা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। একটি দ্বন্দ্ব সুপ্ত অবস্থায় ক্রমান্বয়ে বিকশিত হচ্ছিল, যার নাম আদর্শগত দ্বন্দ্ব বা বিশ্বাসগত দ্বন্দ্ব। বিশ্ববিখ্যাত লেখক ও ভাষ্যকার প্রফেসর হান্টিংটন যেই তত্ত্ব প্রকাশ ও প্রচার করে অধিকতর খ্যাতি অর্জন করেছেন তার নাম হলো ক্যাশ অব সিভিলাইজেশন। আমি বাংলাদেশে ক্যাশ অব ফেইথ বা বিশ্বাসগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছি। এখন থেকে ১০-১৫ দিন আগে বাংলা ভাষার বিখ্যাত কলাম লেখক এবং অমর একুশের সেই অমর গানের (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো … পারি) লেখক জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরী ভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখেছিলেন। ওই কলামে তিনি গাজীপুরের সিটি করপোরেশের নির্বাচনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ান সেনাবাহিনী ও জার্মান সেনাবাহিনীর মধ্যে অনুষ্ঠিত ব্যাটেল অব স্টালিনগ্রাদের সাথে তুলনা করেছিলেন। দীর্ঘ একনাগাড়ে পরাজয়ের পর রাশিয়ান বাহিনী এই ব্যাটল অব স্টালিনগ্রাদে জীবন-মরণ যুদ্ধ করে জার্মান বাহিনীর অগ্রযাত্রা স্থগিত করে। অতঃপর রাশিয়ান বাহিনীর অগ্রযাত্রা ও জার্মান বাহিনীর পশ্চাৎপসরণ শুরু হয়। জনাব গাফফার চৌধুরী গাজীপুরকে স্টালিনগ্রাদের সাথে তুলনা করেছিলেন, যিনি আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগ বিএনপির অগ্রযাত্রাকে রুখে দেবে। আমার মূল্যায়নে গুরুত্বের দিক থেকে ব্যাটল অব স্টালিনগ্রাদ এবং গাজীপুরের যুদ্ধ সমান তাৎপর্যপূর্ণ। তফাত হলো আওয়ামী লীগ হেরে গেছে এবং আওয়ামী লীগের পরাজয় যাত্রা আরো দ্রুত হবে। কারণ বাংলাদেশে দু’টি রাজনৈতিক বড় শক্তি যথা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট উভয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম মতাদর্শগত তফাত আছে। উভয়ে পুঁজিবাদে বিশ্বাস করে। উভয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে। উভয়ে ধর্ম-কর্ম করে। উভয়ে ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়। এ চার মিলের জায়গা, কম-বেশি। একটি জায়গায় মিল নেই। সেটি হলো ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সম্পর্কিত। মহাজোট বিশ্বাস করে ধর্ম হলো প্রাইভেট ম্যাটার বা ব্যক্তিগত বিষয়। এটি আলমারিতে থাকবে, বেডরুমে থাকবে, প্রয়োজনে ঠোঁটের আগায় উচ্চারিত হবে। ১৮ দলীয় জোট চায় মূল্যবোধ লালিত হবে এবং পালিত হবে, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে এবং মানুষের ব্যক্তিগত আচার-আচরণের মাধ্যমে সব ধর্মের মূল্যবোধগুলো পরিস্ফুটিত হবে। এই দুই শিবিরের মধ্যে এই যে মতাদর্শগত পার্থক্য এটা আগামী নির্বাচনে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে। ওপরের কথাগুলো এ জন্য বললাম যে, যুগে যুগে মতাদর্শগত পার্থক্য অত্যন্ত নাজুক ও স্পর্শকাতর সময়ে উপস্থিত হয়েছে। সেই সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া মানুষের জন্য কঠিন হয়ে যায়। মহান আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন হয়। রমজানের ১৭ তারিখ এ রকম একটি দিবস। সম্মানিত পাঠককে উজ্জীবিত ও প্রেরণা দিতেই এই কলামের বাকি অংশ। আজকের আলোচনাটি সাদামাটাভাবে করা, সম্মানিত পাঠকও সাদামাটাভাবে গ্রহণ করবেন বলে আশা করি। একজন গবেষক হিসেবে লিখিনি এবং গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা না করার অনুরোধ করছি। যেহেতু ঐতিহাসিক ঘটনা এবং পবিত্র কুরআন কর্তৃক সমর্থিত ঘটনা, তাই ভুলভ্রান্তি না হওয়াই উচিত; এতদসত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃত ছোটখাটো ভুলত্র“টি পাঠকদের মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রাখছি। ইতিহাসে যত যুদ্ধ মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কিংবা বিধর্মীদের সাথে সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বদরের যুদ্ধের তাৎপর্য ছিল ঐতিহাসিক। এই যুদ্ধ ছিল ইতিহাস নির্ধারণকারী একটি যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধে যদি মুসলমানেরা পরাজিত হতেন তা হলে দ্বীন ইসলামের ভাগ্যে কী ছিল কিংবা মহান আল্লাহকে ডাকার মতো কোনো লোক এই পৃথিবীতে থাকত কি না, তা কেবল সেই মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো জানা ছিল না। শত্র“দের দৃষ্টিতে বদরের যুদ্ধ ছিল সবে মাত্র চারা গজাচ্ছে সেই ইসলাম ধর্ম নামক অঙ্কুরকে আল্লাহর জমিন থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের অপর একটি তাৎপর্য হলো দ্বীন ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে একজন সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। বদরের যুদ্ধের তৃতীয় তাৎপর্য হলো যে মহান আল্লাহ তায়ালা অনেকটাই অদৃশ্যমানভাবে তার প্রিয় বান্দাদের বিপদে কিভাবে সাহায্য করেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই যুদ্ধে বিদ্যমান। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরি দ্বিতীয় সালে রমজান মাসের ১৭ তারিখ; আজ থেকে কয়েক দিন পর ১৭ রমজান আমাদের কাছে উপস্থিত হবে সেই বদরের কথাকে স্মরণ করিয়ে দিতে। আমি আশা ও প্রার্র্থনা করব মুসলিম সমাজের কাছে, আগামী ১৭ রমজান আপনারা বদরের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করবেন, দোয়া করবেন এবং সেসব শহীদের রূহের মাগফিরাত কামনা করবেন, যারা এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন দ্বীন ইসলামকে আল্লাহর জমিনে টিকিয়ে রাখার জন্য। বদরের কথা বলতে গিয়ে বলতে হয়, বদর একটি জায়গার নাম। মক্কা শরিফ থেকে কিছুটা উত্তরে, মদিনা শরিফ থেকে কিছুটা দণি-পশ্চিমে। প্রায় চৌদ্দ শ’ চৌত্রিশ বছর আগে ওই আমলের আরব দেশে মক্কা নগরীর কুরাইশদের সাথে যে বাণিজ্য হতো, সেই বাণিজ্যের কাফেলাগুলো চলাচল করার যে পথ ছিল সেটি ‘বদর’ নামক জায়গার পাশে দিয়েই যেত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে চলে এলেন। তার পর মদিনাতে নতুন একটি নগররাষ্ট্র, নতুন সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা ও দ্বীন ইসলামের মূল কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন। এটা দেখে মক্কার কুরাইশরা ঈর্ষান্বিত হলেন। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তারা নানা ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজতে লাগল। মক্কার কুরাইশরা চিন্তা করল, আমরা তো সবাই মিলে মক্কায় তাঁকে (মুহাম্মদ সা:) দমন করে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন মদিনায় গিয়ে তিনি নতুনরূপে বাধাহীনভাবে ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন। যদি তাঁর এই সংগ্রাম সামনে অগ্রসর হতে থাকে তা হলে অচিরেই মদিনার মুসলমানেরা মক্কার লোকজনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অতএব অঙ্কুরেই বিনাশ করা প্রয়োজন। অন্য দিকে কেবল জন্ম নেয়া মদিনা নামক নগররাষ্ট্র তথা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ক্রমবর্ধমান হলেও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: এবং তাঁর সাথীরা চিন্তা করলেন যে, আমরা মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছি ঠিকই কিন্তু মক্কার হুমকি থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। আমরা এখনো তেমন শক্তি অর্জন করতে পারিনি। তাই আগে আমাদের শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন এবং আল্লাহর দ্বীনকে তাঁর জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে শত্র“দের মোকাবেলা করার কোনো বিকল্প নেই। মোটামুটি এ ধরনের চিন্তাভাবনার প্রোপটের পরই মক্কা ও মদিনা এই দুই শহরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠেছিল। তা ছাড়া পরোভাবে আল্লাহ তায়ালার প থেকে নির্দেশ এসেছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার। অবশেষে রাসূল সা:-এর নেতৃত্বে মদিনা থেকে মুসলমানদের একটি দল বের হলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মক্কা নগরীর আরবদের বাণিজ্য কাফেলা যেটা সিরিয়া থেকে ধন সম্পদ নিয়ে মক্কায় ফেরত যাবে, তাদের মোকাবেলা করা এবং তাদের কাছ থেকে কিছু সংগ্রহ করা। সে জন্য তারা চলাচলের রাস্তার পাশে ওঁৎ পেতেছিল। অন্য দিকে ধন-সম্পদ নিয়ে মক্কা নগরীর ব্যবসায়ীদের কাফেলা সিরিয়া থেকে ফেরত যাওয়ার সময় সংবাদ পেল যে, এই পথ ধরে গেলে পথিমধ্যে তাদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তারা সবার সিদ্ধান্তক্রমে তাদের গতিপথ একটু পরিবর্তন করে মক্কায় যাওয়ার জন্য নতুন পথ আবিষ্কার করল এবং সেই পথ ব্যবহার করে তারা মক্কার কাছাকাছি চলে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে অন্য একটি ঘটনার উদ্ভব হলো। বাণিজ্য কাফেলার অনুরোধে মক্কা থেকে একদল সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রওনা দিয়েছিল বাণিজ্য কাফেলাকে এগিয়ে আনার জন্য। উত্তর দিক থেকে দণিমুখী যেই পথ ধরে বাণিজ্য কাফেলা মক্কার দিকে আসছে, সেই পথ ধরে যাতে পথিমধ্যে বাণিজ্য কাফেলার ওপর কোনো বিপদ আপদ হলে যেন তারা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু বাণিজ্য কাফেলা মদিনার মুসলমানদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে গেল এমনকি মক্কা থেকে আসা সাহায্যকারী লোকদেরও দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। মক্কা থেকে আগত কাফেরদের সাহায্যকারী দল যখন বদর নামক স্থানে এসে অবস্থান করছিল, তখন তারা সংবাদ পেল মুসলমানেরা তাদের আশপাশে আছে। আবার মুসলমানেরা বদর নামক স্থানটির কাছেই অবস্থান করেছিল, ফলে তারাও জানতে পারল মক্কা থেকে আগত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একদল সৈন্যবাহিনী তাদের পাশে অবস্থান করছে। যুদ্ধটি চূড়ান্তরূপে দেখা দিলো। বদর নামক স্থানে কাফেররা এক দিকে অবস্থান নিলো অন্য দিকে মুসলমানেরা অবস্থান নিলো। মুসলমান বাহিনী যে স্থানটিতে অবস্থান নিলো সেখানে একটি পানির কূপ ছিল। পানি আহরণের জন্য কুয়ায় সহজে যাওয়া যেত। যেহেতু পানির কূপটি মুসলমানদের দখলে, সেহেতু কাফেররা পানিসঙ্কট অনুভব করল। কূপের পাশেই একটি পাহাড় সেখানে মুসলমানদের সদর দফতর স্থাপন করা হলো। একটি তাঁবুর বন্দোবস্ত করা হলো, সেখানে রাসূল পাক সা: অবস্থান নিলেন। এলাকাটি ছিল সমতল কিন্তু তিন দিকে ছিল পাহাড়বেষ্টিত। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা আর কাফেরদের সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে ছোটখাটো মতপার্থক্য আছে। তবে যে মতামতটি জোরালোভাবে গ্রহণযোগ্য সেটা এ রকম : ‘মুসলমানেরা ছিলেন ৩১৩ জন অপরপে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি বাকি সবাই ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আওশ গোত্রের আর বাকি ৬৯ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের। পুরো ৩১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি আর ঘোড়া ছিল মাত্র দুইটি। অপরপে কাফেরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছে ছিল দেহরাকারী বর্ম, এবং তাদের কাছে ঘোড়া ছিল ২০০টি। যুদ্ধত্রেটির অবস্থান ও পরিবেশের বর্ণনা দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। যে স্থানে মুসলমানেরা অবস্থান নিয়েছিল সেখানে সূর্যের তেজ সরাসরি তাদের মুখের ওপরে পতিত হয়। কিন্তু কাফেরদের মুখে দিনে সূর্যের আলো পড়ে না। মুসলমানেরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবে সেখানের মাটি একটু নরম, যা যুদ্ধেেত্রর জন্য উপযুক্ত নয়। অন্য দিকে কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিল সেখানের মাটি শক্ত এবং যুদ্ধের জন্য স্থানটি উপযুক্ত। কিন্তু অবস্থান নেয়ার ফলে অবশেষে কী হলো? পাঠক মনে করুন আমরা সবাই সেই রাতে অবস্থান করছি! রমজান মাসের ১৬ তারিখ দিনটি শেষ, মাগরিবের পর তারিখ বদলে গেল অতঃপর ১৭ রমজান শুরু হলো। সেই রাতে উৎকণ্ঠিত মুসলমানেরা এবং উৎকণ্ঠিত কাফেররা নিজ নিজ ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। সেই রাতে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সেজদায় পড়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সা:। কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন অনেকটা এ রকম : ‘হে দয়াময় আল্লাহ, আগামীকালের নীতিনির্ধারণী যুদ্ধে তোমার সাহায্য আমাদের অতি প্রয়োজন। এই যুদ্ধে আমরা তোমার সাহায্য ছাড়া বিজয় লাভ করতে পারব না আর আমরা যদি পরাজিত হই হয়তো তোমাকে সেজদা করার কিংবা তোমার নাম ধরে ডাকার লোক এই পৃথিবীতে আর নাও থাকতে পারে। অতঃপর তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো কী করবে, কারণ তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মালিক। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রাণপণ য্দ্ধু চালিয়ে যাবো। আমরা আমাদের জীবন তোমার পথে উৎসর্গ করলাম। বিনিময়ে তোমার দ্বীনকে আমরা তোমার জামিনে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তুমি আমাদের বিজয় দান করো। আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই।’ রাসূল সা:-এর আন্তরিক আকুতি-মিনতি মহান আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে গেল। হজরত জিব্রাইল আ:-এর মাধ্যমে আল্লাহর প থেকে জবাব এলো, সাহায্য আসবে তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও তোমাদের শিরকে উঁচু করো এবং দৃৃঢ়পদেেপ দাঁড়াও। পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালের ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা এই ঘোষণা দিয়েছেন। ওই রাতে মরুভূমিতে প্রবল বৃষ্টি হলো। যেটি একটি ব্যতিক্রমি ঘটনা। বৃষ্টি মুসলমানদের উপকারে লাগল। কারণ বৃষ্টির কারণে কাফেরদের যুদ্ধের মাঠের শক্ত মাটি কাদায় ভরে পিচ্ছিল হয়ে গেল। অন্য দিকে মুসলমানদের যুদ্ধের নরম মাঠ পানি পেয়ে শক্ত হয়ে গেল। বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া শীতল হলো এবং এর ফলে উৎকণ্ঠিত উদ্বিগ্ন মুসলমানদের চোখে তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে প্রশান্তি এসে গেল। অপর একটি ঘটনা যেটি মহান আল্লাহ তায়ালা ঘটিয়েছেন। কাফেররা যখন মুসলমানদের ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল, ঠিক তখন কাফেরদের চোখে মুসলমানদের ক্যাম্প অনেক বড় মনে হচ্ছিল। তারা চিন্তায় পড়ে গেল এত মুসলমান কোত্থেকে এলো!! অপরপে মুসলমানেরা যখন কাফেরদের ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল, তখন কাফেরদের ক্যাম্প মুসলমানদের চোখে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল এবং তারা ভাবতে লাগল কাফেররা তো তেমন বেশি না, আগামীকালের যুদ্ধে এদের আমরা পরাজিত করতে পারব। অতঃপর এমন মনে হচ্ছিল যে, মুসলমানদের চোখে দেখা দিয়েছিল অন্য এক স্বপ্ন, যে আমরা তাদের সমান সমান। আর এ ধরনের চিন্তা-চেতনা মহান আল্লাহ তায়ালার প থেকে মুসলমানদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে মুসলমানেরা তাদের মনোবল হারিয়ে না ফেলে। অতঃপর দিনে যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথমে তিনজন করে উভয় প থেকে এলো এবং কাফেরদের তিনজনই মৃত্যুবরণ করল। অতঃপর কথা মোতাবেক উন্মুক্ত প্রান্তরে উন্মুক্তভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সেই আমলের যুদ্ধের অস্ত্র হতো তরবারি, তীর-ধনুক, বর্ম, বল্লম প্রভৃতি। মুসলমানেরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিশ্র“তি মোতাবেক মুসলমানদের সাহায্যের জন্য ফেরেশতা পাঠিয়ে দিলেন। সাধারণত ফেরেশতারা মানুষের চোখের অদৃশ্য থাকে। কিন্তু যুদ্ধের পর সাহাবিগণ সাী দিলেন যে, আমরা মানুষ দেখিনি তথা পরিচালনাকারী দেখিনি কিন্তু আমরা দেখেছি দীর্ঘ আকৃতির তরবারি যেগুলো শত্র“পকে ঘায়েল করছিল। আবার আরেকটি পর্যায়ে যুদ্ধ চলাকালে, জিব্রাইল আ: এসে মহানবী সা:-কে এসে জানালেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি আপনার হাতে একমুষ্ঠি ধুলা নিন আর শাহাদাত আঙুল ইশারা করে কাফেরদের দিকে ছুড়ে দিন। রাসূল সা: একমুষ্ঠি ধুলা তাঁর হাতে নিলেন এবং শত্র“পরে দিকে নিপে করলেন। সম্মানিত পাঠককুল বিষয়টি আসলেই আশ্চর্যের। আমরা চাইলেই একমুষ্ঠি ধুলা কিংবা বালু হাতে নিয়ে এ কাজ করতে পারি। শিশুরা খেলার মাঠে দুষ্টুমিবশত এ কাজ করে। কিন্তু চিন্তা করার বিষয়টি হলো একমুষ্ঠি ধুলা যদি কেউ কারো দিকে ছুড়ে দেয়, তা হলে তা কত দূর উড়ে যাবে? কিন্তু অসংখ্য প্রমাণে এসেছে সেই বদরের মাঠে রাসূলের ছুড়ে দেয়া ধুলা সেই দিন অনেক দূর পর্যন্ত গেছে এবং সব কাফেরের চোখে-মুখে-নাকে গিয়ে লেগেছে। এ ছাড়া পবিত্র কুরআনের সূরার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে রাসূল সেই দিন সেই ধুলা আমি সবার চোখে পৌঁছে দিয়েছি। আপনি কেবল নিপে করেছেন। এর কারণ ছিল কাফেররা যেন ভালোভাবে তাদের যুদ্ধের অবস্থান না দেখতে পারে এবং অতি দ্রুত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এমনকি বলা হয়েছে, তারা তাদের হাতের অস্ত্র ছেড়ে চোখ কচলাতে শুরু করেছিল। একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, যদিও আমরা জাগতিক দৃষ্টিতে দেখলাম ধুলাগুলো রাসূল সা: তার হাত দিয়ে ছুড়েছেন, কিন্তু এই একমুষ্ঠি ধুলা কিভাবে শত্র“বাহিনীর চোখে গেল? তাই বলতে হচ্ছে এটি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সম্ভব নয়, এটি হয়েছে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে। যা স্বয়ং আল্লাহ ঘটিয়েছেন। আর এটিই হলো ঐশী বা গায়েবি সাহায্য। বোখারি শরিফের হাদিস মোতাবেক যুদ্ধের শেষে সাহাবিগণ সাী দিয়েছেন কেউ কেউ যে, আমরা সাদা পোশাক পরা কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে য্দ্ধু করতে দেখিছি। তাদের আমরা যুদ্ধের আগে কখনো দেখিনি এমনকি যুদ্ধের পরও দেখিনি। আবার কিছুসংখ্যক সাহাবি বলেছেন, আমরা তরবারি ব্যবহারকারীকে দেখছি না কিন্তু তরবারিটি দেখছি। তাদের তরবারিগুলো আমাদের তরবারিগুলোর চেয়ে দৈর্ঘ্যে অনেক লম্বা এবং সেগুলো শত্র“পকে ঘায়েল করছিল। সেই দিন সাদা পোশাক পরা ফেরেশতাদের আকৃতি কারো চোখে দেখা গিয়েছিল আবার কারো চোখে দেখা যায়নি। মূলত তারা ছিল আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা। মুসলমানদের হয়ে বদরের প্রান্তরে তারা যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল যে কাফেরদের মধ্যে থেকে ৭০ জন নিহত হয়েছে এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছে। অপরপে মুসলমানদের মধ্যে থেকে শহীদ হয়েছিলেন ১৪ জন তার মধ্যে ছয়জন ছিলেন মোহাজের সাহাবা অপর আটজন ছিলেন আনসার সাহাবা। এ যুদ্ধের আরেকটি ঘটনা হলো আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন ফেরেশতা দিয়ে। অপরপে মক্কাবাসী কাফেরদের পে যুদ্ধ করার জন্য অভিশপ্ত ইবলিশও এসেছিল সেই দিন। আর ইবলিশ এসেছিল সোরাকা নামক একজন ব্যক্তির আকৃতি ধরে। কিন্তু মক্কাবাসী পোত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঠে নেমে যখন সেই ইবলিশ দেখল আল্লাহর ফেরেশতারা মুসলমানদের প হয়ে যুদ্ধরত মাঠে বিদ্যমান, ঠিক তখন ইবলিশ পালিয়ে যেতে লাগল। কাফেরদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, সোরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছো? সোরাকা তুমি কি বলোনি যে, তুমি আমাদের সাহায্য করবে? আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে না? সেই সময় ইবলিশ (ছদ্মবেশে সোরাকা) বলল, আমি এখানে এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি, যা তোমরা দেখতে পাও না। আল্লাহকে আমার ভয় হচ্ছে, তিনি কঠোর শাস্তিদাতা। এরপর ইবলিশ আত্মগোপন করেছিল। বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম সমন্বিত এবং যতটুকু সম্ভব পরিকল্পিত যুদ্ধ। যুদ্ধের ময়দানে সুবিধাজনক অবস্থান নেয়া, পানির উৎস নিয়ন্ত্রণে রাখা, সূর্যের আলোর গতিবেগ ল্য করে সৈন্যদের দাঁড় করানো এবং যুদ্ধের আগে শত্র“দলের চার পাশ পর্যবেণে রাখা ইত্যাদি বিষয় শিণীয়। সবচেয়ে বড় শিণীয় বিষয় ছিল অজাগতিক তথা সব কিছুর জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা বা তায়াক্কুল করা। তায়াক্কুলের সংপ্তি ব্যাখ্যায় আমরা বলতে পারি যে, নিজের দ্বারা সম্ভব সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে, কিন্তু সাফল্যের জন্য সে প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করা যাবে না, সাফল্যের জন্য নির্ভর করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ওপর। বদরের যুদ্ধে মুসলমানেরা জয়ী না হলে কী হতে পারত সেটা কল্পনা করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তায়ালার দয়া আর মেহেরবানির বদৌলতে মুসলমানদের অগ্রযাত্রার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল এবং বদরের যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। আজ চৌদ্দ শ’ চৌত্রিশ বছর পর বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলমানেরা সেই অকুতোভয় সৈনিকদের স্মরণ করবেন এবং নিজেদেরও প্রয়োজনে বদরের মতো যুদ্ধ েেত্র যেতে পারেন, সেই মানসিকতায় বলীয়ান রূপে সজ্জিত করবেন বলে আশা করি। তবে বদরের যুদ্ধ যেমন ছিল আত্মরার্থে তেমনি মুসলমানদের সব যুদ্ধ হবে আত্মরার্থে, সত্যের অনুকূলে, নির্যাতিত-নিপীড়িতদের অনুকূলে এবং কল্যাণ কামনায়। বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে বদরের যুদ্ধ সমাগত। দ্বীনের খাতিরে, আল্লাহর বান্দাদের খাতিরে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মঙ্গলার্থে বাংলাদেশের মানুষকে যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। এ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ এ কলামে দেয়া সম্ভব নয়। ব্যাটলস অব ইসলাম নামক বাংলা ভাষায় লিখিত একটি পুস্তকে বদরের যুদ্ধের, যুগপৎ সামরিক ও ধর্মীয় আঙ্গিকের মূল্যায়ন আছে। আগ্রহী পাঠক পুস্তকটি পড়তে পারেন। সারসংপে নিম্নে উল্লিখিত ওয়েবসাইটে আছে। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি www.generalibrahim.com

(বি:দ্র: পূর্ব প্রকাশিত নয়া দিগন্ত)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *