সাবধানে খাবার খান ক্যান্সার দূরে রাখুন

প্রতিদিন সকাবেলা অফিসে গিয়ে সবার আগে যে কাজটি করি তা হল কম্পিউটার লগঅন করে ঈমেইল একাউন্ট থেকে অবাঞ্ছিত জাঙ্কমেঈলগুলো না দেখে না পড়েই মুছে ফেলি। বেশিরভাগ কম্পিউটার ভাইরাস জাঙ্কমেঈল মারফত এসে থাকে এবং কম্পিউটার যন্ত্রকে কেবল সংক্রমিতই করে না বরং মাঝেমধ্যে রীতিমত জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে পুরো হার্ডড্রাইভকে খেয়ে ফেলে। তবে এটাও ঠিক, কদাচিত্ নাম না জানা উত্স থেকে একই মাধ্যমে মূল্যবান তথ্যও আসে। ঢালাওভাবে মেঈল না খুলে কিংবা এটাচমেন্ট না পড়ে সবকিছু মুছে দিলে এমন ক্ষতি হতে পারে। এধরণের সর্বনাশের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জাঙ্কমেঈল ঢালাওভাবে ডিলিট না করার কোনো বিকল্পও আমার জানা নেই, কারণ প্রতিদিন ডজন ডজন অবাঞ্ছিত ঈমেইল এসে আগাছার মত ভীড় জমায় ইনবক্সে।

যা হোক কী মনে করে সেদিন এরকমই একটি জাঙ্কমেঈল না মুছে সাহস করে খুলে ফেললাম। পড়ে দেখি স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশ মূল্যবান কিছু তথ্য রয়েছে ঈমেইলের টেক্সটে। লম্বা ঈমেইল। পুরোটাই গড়গড় করে একবারেই পড়ে ফেললাম। পড়ার পরে ১৯৬০ এর দশকে বড়লেখা পি.সি. হাই স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে আমাদের বাংলা ও অঙ্কের শিক্ষক প্রমথ চক্রবর্তীর কথা মনে পড়লো। স্যার কোনো এক প্রসঙ্গে একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, ‘পথের ধারে পড়ে আছে ছাই/
উড়াইয়া দেখো তাই/ পাইলেও পাইতে পার মানিক রতন’। প্রতিদিন পথের ধারে পড়ে থাকা ছাই পাশ কেটে চলে যাই। আজ সত্যি সত্যি ছাই উড়িয়ে মানিক রতন পেয়ে গেছি। এই মানিক রতনই আমার নিয়মিত পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্যে দু’কলম লিখতে বসেছি।

নাম না জানা ভদ্রলোক ঈমেইলের শুরুতে লিখেছেন, কিছুক্ষণ আগেই তিনি খবর পেয়েছেন তাঁর এক ঘনিষ্ট বন্ধুর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। খবরটি শোনে তিনি যতটা না অবাক হয়েছেন তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছেন, আঘাত পেয়েছেন। এমন খবর আমরাও অহরহ পাই, পেয়ে থাকি। যারা পান নাই তারা ভাগ্যবান। তবে এই ভাগ্যকে প্রলম্বিত করতে হলে, এবং ধরে রাখতে হলে কী করতে হবে পুরো ঈমেইল জুড়ে তারই এক নাতিদীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়েছেন সহৃদয় ব্যক্তিটি। আজকের আমার এই নিবন্ধের পুরো কৃতিত্বই তাঁর। তাঁকে আমার এবং আমার পাঠকদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে লেখাটি শুরু করছি।

পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি বছর পৃথিবীতে যে পরিমাণ মানুষ মরে তার প্রায় ১৩ শতাংশের মৃত্যু হয় ক্যান্সারজনিত কারণে। অনেকে মনে করেন ক্যান্সার একটি হেরিডিটারি রোগ, যা কীনা বংশানুক্রমে এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে ছড়িয়ে যায়। যেসব ক্যান্সার রোগীর বংশে এই কঠিন রোগের কোনো ইতিহাস নেই তারা মনে করেন ভাগ্যই এজন্য দায়ী। মুসলমান হিসেবে আমরা যাকে ভাগ্য বলি বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলে ‘র‌্যান্ডম ফ্যাক্টার’। ভাগ্য বা ‘র‌্যান্ডম ফ্যাক্টার’ যাই বলি, এ কারণে ক্যান্সার হলে কারো কিছু করার নেই। তবে ‘কজ অ্যান্ড ইফেক্ট’ কিংবা কার্য-কারণের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যায় জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাসের জন্যও অনেক সময় মানুষ কর্কট রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর এখানে সাবধানতা অবলম্বন করে আমরা অনেক সময় ক্যান্সারকে আমাদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। নিজে বাঁচতে পারি, প্রিয়জনকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারি। ডাক্তারি পরিসংখ্যানে আরো জানা যায়, বিশ্বব্যাপী এক তৃতীয়াংশ ক্যান্সারের কারণ খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সংযুক্ত। আরো দেখা যায়, শুধু ধুমপান ছেড়ে দিলেই ক্যান্সারের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। যাদের পরিবারে ক্যান্সারের কোনো ইতিহাস নেই তাদের ঝুঁকি আরো ১৫ শতাংশ কম। এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেলে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার আশংকা আরো ৩০ শতাংশ কমে যায়। ক্যান্সার নিয়ে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য গবেষণায় দেখা যায় যেসব লোক তাজা ফলমূল, শাকসবজি, এবং তরিতরকারি খুব কম খান অথবা একেবারেই খান না তাদের ক্যান্সার ঝুঁকি ফল-তরকারি খাওয়া লোকদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি।

ক্যান্সার মানুষের দেহের সেল বা জীব কোষের একটি রোগ। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে থাকে ৬০,থেকে ৯০ লক্ষ কোটি সেল। এর যে কোনো একটি বা একাধিক সেলকে কেন্দ্র করে ক্যান্সারাস টিউমার দানা বাঁধতে পারে, তবে এটা হঠাত্ করে হয় না। এ প্রক্রিয়ায় সময় লাগে অনেক। এই দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের জন্য একটি সুখবরও বটে, কারণ আমরা যদি সঠিক কৌশলে এগোতে পারি তাহলে বিদ্রোহী সেলের ক্যান্সারাক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দিতে পারি, এমন কী বন্ধ করেও দিতে পারি। অন্যথায়, আমরা গাফেল হয়ে থাকলে ধীরে ধীরে ক্যান্সার সেলটি শক্তি সঞ্চয় করে আমাদেরকে অতি সহজেই মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারে।

ক্যান্সার সেলকে মেরে ফেলা কিংবা তার প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেওয়া, কমিয়ে দেওয়া, অথবা ধীর লয়ে নিয়ে আসার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে যেমন, সার্জারী, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, ফোটন থেরাপি, ইত্যদি। ভবিষ্যতে হয়ত আরো অনেক প্রযুক্তি বেরোবে। তবে ইতিমধ্যে আরেকটা পদ্ধতি আছে যা দিয়ে ক্যান্সার সেলকে আক্রমণ করা যায়। এটাকে বলে অ্যান্টাই-অ্যাঞ্জিওজেনেসিস মেট্রোমনিক উপায়। এ উপায়ে ক্যান্সারাস টিউমারের রোগাক্রান্ত সেলে রক্তসঞ্চালন লাইনে বাধা দিলে ক্যান্সারারস টিউমার খাদ্যাভাবে দ্রুত বাড়তে পারবে না এমন কী মরেও যেতে পারে। তবে এ পদ্ধতি কাজ করে খুব ক্রমান্বয়ে এবং খুব ধীর গতিতে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে ক্যান্সার যেমন আছে তেমনি মানবকুলের জন্য সুসংবাদ আছে। কারণ যেসব ফলমূল, শাকসবজি, এবং তরিতরকারি আমরা হরহামেশা খেয়ে থাকি তার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টাই- অ্যাঞ্জিওজেনেসিস মেট্রোমনিক অনু রয়েছে।

যেসব ক্যান্সার সেল স্বতঃস্ফুর্তভাবে আমাদের শরীরে জন্ম নেয় তারা শুরুতে এতই ক্ষুদ্র থাকে যে মাইক্রোস্কোপ ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না এবং দেখা যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ওই অবস্থায় আমাদের শরীরে কোনো অসুবিধাও হয় না তাই আমরা নিজ দেহে ক্যান্সার সেলের উপস্থিতি বুঝতে পারি না। এই জাতীয় ক্যান্সার সেল দেহে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ফলমূলে যেসব অ্যান্টাই- অ্যাঞ্জিওওজেওনসিস মলিকুল থাকে সুযোগ পেলে তারা উতসমুখে ক্যান্সার সেলকে আক্রমণ করে এবং সেগুলোকে বাড়তে দেয় না। তাই দেখা যায় ক্যান্সার আসলে একটি ক্রোনিক রোগ এবং দৈনিক ভিত্তিতে ঠিকমত খ্যাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে আমরা এই মারাত্মক মারণব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, এমন কী ধ্বংসও করে দিতে পারি। ফলমূলের যেসব উপাদান ক্যান্সার বিনাশী তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ফাইটোকেমিক্যাল্্স্ নামে এক ধরণের রাসায়নিক উপাদান। যেসব ফলমূল, শাকসবজি, তরিতরকারি, এবং মসলার মধ্যে এই উপাদান পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে – রসালো ফলের মধ্যে ব্লুবেরি, স্ট্রোবেরি, আঙ্গুর, তরকারির মধ্যে – সয়বিন, টমেটো, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ফুলকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউট (বাঁধাকপির মত জলপাই আকারের এক জাতের ছোট্ট তরকারি)। ক্যান্সার সেলের বিরুদ্ধে এ সবই ধন্বন্তরির মত কাজ করে। এ এছাড়াও লেবু এবং গ্রিন টি’তে আছে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোকেমিক্যাল্্স্। ফাইটোকেমিক্যাল্্স্ মানব দেহে ক্যান্সার প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে সহজেই বাঁধাগ্রস্ত করে দিতে পারে। তাজা সবজির মধ্যে ক্যান্সার রোগে ব্রোকলি সবচেয়ে ভাল ও কার্যকর। তরকারি হালকা সিদ্ধ কিংবা স্টার ফ্রাই করলে অ্যান্টি ক্যান্সার মলিকুলের কার্যকারিতা বেশি থাকে। মসলার মধ্যে হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, কর্কট রোগে খুবই উপকারী। প্রায় চার হাজার বছর ধরে মানুষ এসব মসলা ব্যবহার করে আসছে। রান্নার চেয়ে তাজা পেয়াঁজ রসুন ক্রাশ করে (ছেঁচে) খেলে উপকার বেশি পাওয়া যায়। নিয়মিত সয়বিনের তেল, সয় দুধ, সয় সস, টফু ইত্যাদি খেলেও ক্যান্সার সেলের প্রবৃদ্ধির গতি রোধ করা সম্ভব। স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য সয়জাতীয় খাবার খুবই উপকারী। গবেষণাতে দেখা গেছে মেয়েরা অল্প বয়স থেকে সয় প্রডাক্ট খেয়ে থাকলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।

গ্রিন টি আরেকটি অতি উপকারী ক্যান্সার প্রতিষেধক পানীয়। তবে গ্রিন টির মধ্যে চায়নিজ গ্রিন টি থেকে জাপানি গ্রিন টি অনেক বেশি কার্যকর। গ্রিন টি খাওয়ার আগে একটি বিষয় ভাল করে জানা থাকা প্রয়োজন। খুব অল্পক্ষণ কিংবা এবং খুব বেশিক্ষণ আগুনে জ্বাল দিলে গ্রিন টি থেকে সর্বোত্তম উপকারিতা পাওয়া যায় না। গবেষণায় দেখা যায় কর্কট রোগে ৮ থেকে ১০ মিনিট জ্বাল দেওয়া গ্রিন টির কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন ধরণের জাম জাতীয় ফলও ক্যান্সারের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরি, র‌্যাস্পবেরি, ইত্যাদি সবই ভাল। তবে এদের প্রক্রিয়াজাত রসের চেয়ে তাজা বেরি অধিক উপকারী।

সাইট্রাস ফলের মধ্যে আছে কমলা, বাতাবী লেবু বা জাম্বুরা, সবুজ কাগজি লেবু, এবং হলুদ লেবু। এগুলো সবই ক্যান্সার প্রতিষেধক। এগুলো শধু ও ক্যান্সার বিনাশীই নয় বরং প্রচুর পরিমাণ ভাইটামিন সি ও বিভিন্নজাতের খনিজ পদার্থের মাধ্যমে শরীরের সাধারণ রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। কোকো থেকে তৈরি হয় চোকোলেট। এটাও ক্যান্সারের জন্য খুব উপকারী। তবে দুধ চোকোলেটের চেয়ে তিতা কালো চকোলেট অনেক বেশি কার্যকর। মাছের মধ্যে সারডিন, স্যামন, এবং ম্যাকরেল কর্কট রোগের মহৌষধ। শুকনো ফলের মধ্যেও ক্যান্সার প্রতিরোধক অনেক গুণাগুণ রয়েছে। সাধারণ চীনা বাদাম থেকে শুরু করে কাজু বাদাম পর্যন্ত সব ধরণের বাদামই এ রোগে উপকারী। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপকারি হল আমন্ড যা বাংলাদেশে কাঠবাদাম নামে পরিচিত। এখানে যেসব খাবারের আলোচনা করলাম তার মধ্যে টক, ঝাল, মিষ্টি সবই রয়েছে। কোনোটার স্বাদ একটু বেশি কোনোটার কম। কোনোটা দামে সস্তা আবার কোনোটা অনেক দামি। সবগুলো বাংলাদেশে হয়ও না, আবার অনেকগুলো সহজেই অল্পমূল্যে দেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। আসুন আমরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং ক্যান্সার থেকে দূরে থাকি।

লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর – জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ।

Loading


Comments

সাবধানে খাবার খান ক্যান্সার দূরে রাখুন — 5 Comments

  1. ধন্যবাদ সচেতন করার জন্য। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।

  2. আপনার পোস্ট খুবই উপকারী ধন্যবাদ।

  3. অনেক দরকারী পোস্ট. ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *