সাত খুন : বিকল্প রাজনীতি ভাবতে হবে

নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় ভয়ঙ্করভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্র ও সরকার। নারায়ণগঞ্জে সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির কথা কারও অজানা ছিল না। তিন বছর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেটা স্পষ্ট হয়ে আসে। সেলিনা হায়াৎ আইভীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী গ্রুপ সরাসরি প্রতিপক্ষ গ্রুপের বিরুদ্ধে রাহাজানি সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করে। মেধাবী ছাত্র ত্বকি হত্যার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ ওঠে, প্রতিপক্ষ গ্রুপ নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি টর্চারসেল স্থাপন করেছে এবং অবশেষে সেই টর্চারসেল ধরাও পড়ে। এসব বিষয় রাষ্ট্র ও সরকার, এমনকি নারায়ণগঞ্জ তথা সারা দেশের মানুষও জানে। কিন্তু সরকার এগুলো রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
অপহরণ, গুম-খুন নিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। প্রতি বছর এ ব্যাপারে তারা বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সরকার এগুলো বন্ধ করতে কী করেছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। তারা নিজেরা এগুলো দমন করতে বা কমাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সব সময় বলে আসছিল এই সময়ের চেয়ে আগের সময় খারাপ ছিল। যদি সেটা সত্য হয়ে থাকে তাহলেও কি কর্তৃপক্ষের মুখে এরকম কথা শোভা পায়?
৫ জানুয়ারি ভোট ছাড়া যে সরকার গঠিত হলো তাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। স্বচ্ছ, সুজন বলে তার একটা সুনাম ছিল। হতে পারে এ জন্য এলাকায় অনেক ‘কুতুব’ থাকা সত্ত্বেও তাকে তেজগাঁও-কাওরান বাজারের মতো একটি সন্ত্রাসের এলাকা থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে সৎ ও ভালো মানুষদের ধারণা অনেকটা সুধী ধারণার মতো। ভালো কাকে বলব সেটাও সংজ্ঞায়িত হওয়া দরকার। দেশজুড়ে যখন গুম-খুনের প্রচুর অভিযোগ উঠছে, বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকও যখন অপহৃত ও নিখোঁজ হয়ে গেলেন তখন নিয়োগ পেয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন অপহরণ, গুম-খুনের ঘটনা গত বছরের তুলনায় এখনো কম। এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। আর বিরোধী দল যখন সরকার তাদের লোকজনকে গুম করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করছে তখন তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী মামলার আসামি, গ্রেফতারের ভয়ে তারা নিজেরাই আত্দগোপন করে আছেন।
প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দলের কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে আওয়ামী লীগ খুব ভালোবাসে। দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো এগুলো রীতিমতো উপভোগ করেন। এই যেমন ১ মে গাজীপুরের শ্রমিক জনসভায় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বললেন, উনি বিদেশিদের কাছে নালিশ করে বালিশ পেয়েছেন। আর বাড়ি ফিরে দেশের মানুষের ভাঙা স্যান্ডেলের বাড়ি খেয়েছেন। কথা বলার সময় টেলিভিশনে তার চেহারায় ছিল মজা করার ঝলক।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অবশ্য ওরকম করে বলেননি, উনাকে হয়তো কেউ সংখ্যাতত্ত্ব বুঝিয়েছেন; কিন্তু সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি নিষ্ঠুর রসিকতা।
প্রতিমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের সিটি কাউন্সিলর অপহৃত হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলেন, তাকে হত্যা করা হবে। যারা তাকে হত্যা করতে চায়, তাদের নামও তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে বলেছিলেন। এর প্রায় দুই সপ্তাহ পরে আরও চারজনসহ সত্যি সত্যি অপহৃত হলেন কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম। নজরুলের বৃদ্ধা মা, স্ত্রীসহ আত্দীয়-স্বজনরা এবার প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গেলেন, কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে আকুতি জানালেন নজরুলকে ফিরে পাওয়ার। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাদের কাছে কী বলেছিলেন জানি না; কিন্তু পত্রিকা মারফতে জানতে পারলাম তিনি বলেছেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। অতঃপর জীবিত লাশ নজরুল তার সহযোগীদের নিয়ে শীতলক্ষ্যার বুক চিরে ভেসে উঠলেন। প্রতিমন্ত্রী বোধহয় খুব কষ্ট পেলেন। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, আমার কাছে নজরুল এসেছিল, নামও বলে গিয়েছিল। আবার সকালে তার ছেলেমেয়েগুলো এসে কান্নাকাটি করে গেল। সবাই ভালো ছাত্রছাত্রী। জিপিএ-৫ পাওয়া। আমি এখন তাদের কাছে গিয়ে কী বলব?
বেচারা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী! কেউ কি শিখিয়ে দেবেন তাকে কী বলবেন তিনি। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তিনিই হচ্ছেন সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। অবশ্য তার উপরেও একজন আছেন, পূর্ণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীও বটে। তার কথায় পরে আসছি। নজরুলের পরিবার প্রতিমন্ত্রীর কাছে এসেছিলেন, প্রতিমন্ত্রী একবার তাদের কাছে যেতে পারতেন কিছুই করতে না পারুন, দেখতে, সান্ত্বনা দিতে। তা যাননি কেন? কী আশ্চর্য। ঢাকা বা কেন্দ্র থেকে একজনও এ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ যাননি। আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকে কি পারিবারিক আত্দিক সব সম্পর্ক উঠে গেছে। নাকি কী জবাব দেবেন তা জানেন না বলেই কোনো নেতাই যাননি সেদিকে।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নাকি এই অপহরণের পরে বুঝেই উঠতে পারেননি কী করবেন তিনি। কেন? কী বোঝেননি তিনি?
ঘটনা ঘটার পর থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী বা পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। কেন? রবিবার ৪ মে নারায়ণগঞ্জে রাইফেল ক্লাবে সাংবাদিকদের কাছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করেন নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে র‌্যাব তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। এর জন্য আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ কয়েকজনের কাছ থেকে ছয় কোটি টাকা নিয়েছেন র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা। এ সময় নারায়ণগঞ্জ চার আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
পাঠকবৃন্দ বুঝে দেখুন কী গুরুতর অভিযোগ। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেন, কেউ অভিযোগ করলেই তা সত্য হয়ে যায় না। ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। এখনো তদন্ত চলছে। তদন্ত আগে শেষ হোক। তারপর সব জানা যাবে। এর আগে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
অভিযোগ কিন্তু এই উদ্ধৃতিটুকুই নয়। নজরুলের শ্বশুর বলেছেন, তারা অকূলস্থলে গিয়েছিলেন, সেখানে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ঘটনা জানতে পারেন। র‌্যাব-১১ লেখা একটি গাড়ি সকাল থেকেই সেখানে ছিল। পাঠকের মনে থাকতে পারে পুলিশের এক বড় কর্মকর্তাও ওই এলাকা ঘুরে দেখেছিলেন। পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শী কাউকেই পায়নি। সে জন্য তারা ঘটনাটিকে অপহরণ না বলে নিখোঁজ বলে উল্লেখ করতে চেয়েছিলেন। কোনটা সত্য, নজরুলের শ্বশুরের কথা, নাকি পুলিশের কাউকে খুঁজে না পাওয়া?
কোনো সন্দেহ নেই নিহত নজরুল শামীম ওসমানের লোক ছিলেন। সেলিনা হায়াৎ আইভীও বলেছেন সে কথা। অতএব নজরুলের শ্বশুর শামীম ওসমানের কাছে গিয়েছিলেন। শামীম ওসমান তাকে র‌্যাবের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শ্বশুর সাহেব সেখানে যান। তার অভিযোগ, সেখানে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। চার-পাঁচ ঘণ্টা পর রাত ৯টায় র‌্যাবের সিইও তাদের দেখা দেন। সিইও তাদের বলেন, শামীম ওসমানের সঙ্গে আপনাদের কি কোনো ঝামেলা আছে? আপনারা শামীম ওসমানের কাছে যান।
নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলামের এ বক্তব্য কি সত্য? র্যাবের সিইও শহীদুল ইসলামকে শামীম ওসমানের কাছে যেতে বললেন কেন? শামীম ওসমানের সঙ্গে তাদের কোনো সমস্যা আছে সে কথা সিইও জানল কীভাবে? সে প্রসঙ্গ সিইও তুললইবা কেন? সিইও এবং শামীম ওসমানের সঙ্গে কোনো বিশেষ যোগসূত্র আছে? সিইওর নিজের ঘনিষ্ঠ কোনো আওয়ামী কানেকশন আছে? লোকজন যে কথা বলছে!
শহীদুল ইসলাম যে অভিযোগ করেছেন সে অভিযোগ অবশ্য দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। খোদ হাইকোর্ট তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন এবং হাইকোর্ট এও নির্দেশ দিয়েছেন যেন তদন্তে র‌্যাবকে না রাখা হয়। কিন্তু শহীদুল ইসলাম তো পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। পুলিশও কি এ ঘটনার তদন্ত করতে পারবে? অথচ ঘটনা খুবই সিরিয়াস। এত বড় পাশবিক নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে আর কখনো দেখা যায়নি। বিবেক এখানে নীরব থাকতে পারে না। অথচ আমরা অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করছি ৬ মে মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় এ লেখা লেখার সময় পর্যন্ত একজন আসামিকেও গ্রেফতার করা হয়নি। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানকে অবশ্য আসামি করা হয়নি। কিন্তু নজরুলের স্ত্রী তার ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছেন। নারায়ণগঞ্জের মানুষ তার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আর তিনি, সেই সংসদ সদস্য ভয়াল চোখ ঘুরিয়ে সারা নারায়ণগঞ্জ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে র‌্যাবের সিইও পুলিশ সুপারসহ পাঁচজন কর্মকর্তাকে হঠাৎ করে বদলি করে দেওয়া হলো। কেন? বদলি কেন? তাদেরকে সরকার কোন কারণে দায়ী মনে করছে? তাহলে তো তাদের কর্ম থেকেও সাময়িক অব্যাহতি দেওয়ার কথা ছিল। অথচ আমরা শুনেছি তারা স্বপদে বা অন্যত্র দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত কোথা থেকে এলো? আরও উপরের মহল কী বুঝছেন? কী করছেন?
আমি একটু আগে বলেছি, এত বড় অমানবিক হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে আর কখনো ঘটেনি। আর ১০টি হত্যাকাণ্ডের মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা স্মৃতিতে ধূসর হয়ে যাবে। সত্যিকার বিচার হবে না, তা হতে পারে না। আমরা যদি এরকম করি তবে তা হবে মানবতার বিরুদ্ধে আরেকটি জঘন্য অপরাধ। অতএব আমি প্রস্তাব করছি একজন সর্বজন গ্রহণযোগ্য আস্থাভাজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচারবিভাগীয় কমিটি গঠন করা হোক পুরো ঘটনা তদন্তে।
এত বড় পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পর আমরা সবাই চাইব যাতে নিরপেক্ষ নির্মোহভাবে সমগ্র বিষয়টি দেখা হয়। প্রধানমন্ত্রী ১ মে গাজীপুরের জনসভায় বিএনপিকে দোষারোপ করে যে একটি অবিবেচক বক্তব্য রেখেছিলেন তা যেন এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব না ফেলে। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। মামলার এক নম্বর আসামি নূর হোসেনের উত্থানের যে ইতিহাস মানুষ পত্রিকার মারফত জেনেছে তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি সবাই করেছে। পেলে-পুষে এরা সবাই এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেছে। এ মুহূর্তে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ কাঠগড়ায়; কিন্তু ইতিহাসের চাকা যদি পেছনে যেতে থাকে তাহলে তো বিএনপি, জাতীয় পার্টিও একেক সময় কাঠগড়ায় উঠবে। এরা কি সেটা বোঝে? স্বীকার করে? গুম-খুন, অপহরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার কথাও ভাবতে হবে।
লেখক : রাজনীতিক, আহবায়ক নাগরিক ঐক্য।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *