সন্ত্রাসবাদ এবং শিক্ষার সর্বনাশ

সন্ত্রাসবাদ আজ গোটা পৃথিবীতে সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। এই সর্বনাশের ছোবলে নিপতিত হয়েছে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সাথে সন্ত্রাসবাদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আরোপিত সন্ত্রাস আমাদের বিপর্যস্ত করেছে ক্ষণিকের জন্য। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই। যা ছিল দূরের বিষয় তা যখন কাছে এলো, তখন অযাচিত অনভিজ্ঞতা এবং আকস্মিকতা দিয়ে আমরা তা মোকাবেলা করতে গেছি। ফলে প্রাথমিক বিপর্যয় ঘটেছে। আর এই বিপর্যয় কঠিন ও কঠোরভাবে কৌশলতার সাথে প্রতিরোধ করার পরিবর্তে আবেগ উত্তেজনা ও অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করার কারণে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রচারযন্ত্র আমাদের সর্বনাশের খবর অতি উৎসাহের সাথে প্রচার করেছে। আমাদের প্রশাসন স্বাভাবিক অবস্থাকে অস্বাভাবিকতায় পরিণত করেছে। নিñিদ্র নিরাপত্তার নামে শূন্যতা নিশ্চিত করেছে আমাদের নির্বাহী কর্মকর্তারা। কূটনৈতিকপাড়ায় ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আবাসিক এলাকায় সাধারণ ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে অসাধারণ অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরের লাখ লাখ নাগরিকের বসবাস কঠিন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে ‘তিন পা যেতে দুবার থামতে’ বাধ্য করা হয়েছে। এই সাঁড়াশি অভিযান থেকে বাদ পড়েনি বাড়িওয়ালা কিংবা ভাড়াটিয়া, ব্যবসায়ী অথবা খেটে খাওয়া মানুষ, যুবক কিংবা ধার্মিক প্রবীণ। বোরকার ওপর মহা গোস্যা এদের। দাড়ি-টুপি ওয়ালা মানুষ দেখলেই জঙ্গি জঙ্গি ভাবনা তাদের। অনর্থক অন্যায়ভাবে কত মানুষ ইতোমধ্যে হয়রানি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এদের সবচেয়ে বেশি রাগ, ক্রোধ এবং ক্ষোভ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এরা বিশ্বাস করে ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার’। তাই ছাত্র যুবাদের প্রতি মহাক্ষিপ্ত তারা। যখন দেখা গেলো, শুধু তালেবানেরাই সন্ত্রাসের ‘সোল এজেন্ট’ নয়, তখন তারা ইংরেজি পড়–য়াদেরও তালেবানের সমান করে ফেলে। সন্ত্রাসের বিষয়টি যে ঐতিহাসিক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক এবং মনঃস্তাত্ত্বিক, তা তারা ভুলে গিয়ে আপাত বিষয়নির্ভর হয়ে পড়ে। গুলশান ট্র্যাজেডির পরে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ঘটনার গহিন গভীরে প্রবেশ করতে হবে। উৎসমূল নির্ণয় করতে হবে। তাতে সরকারের আগ্রহ সামান্যই। বরং সরকার এ থেকে ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ লুটতেই অতি ব্যস্ত। অবশ্য সব কিছুতে স্থায়ী চিকিৎসার পরিবর্তে আমরা মলম লাগাতেই ব্যস্ত বেশি।
উন্নত দেশগুলোতে শাসক এলিটরা ক্ষমতার পরিবর্তে দেশ ও জনগণের স্থায়ী কল্যাণ চিন্তার পরিকল্পনা নেয়। আপাতত সমাধানের পরিবর্তে এরা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজেন। আমাদের ক্ষমতাসীনদের দূরদৃষ্টির অভাবে বাংলাদেশে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ সাধিত হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় ধস নেমেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রে। প্রকৃত শিক্ষার পরিবর্তে সার্টিফিকেট ব্যবসা জমজমাট হয়েছে। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা পার্সেন্টেজের ক্রমাগত ঊর্ধ্বারোহণকে বহির্বিশ্বের শিক্ষা ক্ষেত্রে শনৈ শনৈ উন্নতির ধারক বলে প্রচার করতে ব্যস্ত। শিক্ষার এই আকালে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো নিপতিত হলো সন্ত্রাস। আর মওকা পেয়ে গেলো শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা তাদের ওপর চড়াও হওয়ার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মনঃস্তত্ত্ব গড়ার যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়ার কথা এরা তা চিন্তা না করে ‘সন্ত্রাসবিরোধী ট্যাবলেট’ খাইয়ে দিয়ে রাতারাতি রোগ-বালাই দূর করতে চান। তারা শুধু মিটিং-মিছিল এবং মানববন্ধন করেই তাদের দায় খালাস পেতে চান। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ যে মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে তা কত যে শিক্ষা ঘণ্টা নষ্ট করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। গুলশান ট্র্যাজেডি, শোলাকিয়া হামলা এবং কল্যাণপুরের আস্তানা আবিষ্কারÑ সারা দেশে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এই ভীতিতে সবচেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত করা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থাকে। আদেশ-নিষেধের ছড়াছড়ি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরো উদ্বেগ ব্যাকুল করেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের ইমেজ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এমনিতেই বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রমাণ করানোর লোকজনের অভাব নেই। নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো কিছু লোক গত এক দশক ধরে বাংলাদেশকে ‘তালেবান স্টেট’ প্রমাণ করার জন্য চেষ্টা করে আসছে। পরিকল্পনা মাফিক তারা ক্ষমতায় এসেছে ঠিকই কিন্তু এখন তারা সেই ‘ভাঙা রেকর্ড’ মেরামতে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ বহির্বিশ্বে যখন শিক্ষার জন্য, চাকরির জন্য এবং ব্যবসায়ের জন্য যোগাযোগ করছে, তখন একটা শব্দই প্রতি উত্তরে পাওয়া যাচ্ছে, তা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র’। বিদেশে অবস্থানরত আমাদের লাখ লাখ কর্মজীবীর কপালে সন্ত্রাসের তকমা লাগানোর প্রয়াস চলছে। সেই প্রয়াসে নিকট ভবিষ্যতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গমনেচ্ছুরা।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘকালীন অবক্ষয়ের একটি ব্যতিক্রম দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের স্বকীয়তা ও নিষ্ঠা দিয়ে বিদেশে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুনাম ছড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়টির যে অবদান ডামাডোলে তা চাপা পড়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, জন হব্স কিন্স এবং ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষার্থী বিনিময়ের চুক্তি করে। এখন আরোপিত বদনামের কারণে এসব চুক্তি যদি বাতিল হয়ে যায় তাহলে ক্ষতিটি কার হবে? শুধু নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আরো কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিনিময় চুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসী (!)Ñ এই পরিচয় নিশ্চয় তাদের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনবে না। ‘শিক্ষার বাণিজ্যকরণ’ সত্ত্বের বিশ্ববিদ্যালয়টি যথার্থ মান ও মর্যাদার সাথে পরিচালিত হচ্ছিল। গুলশান শোলাকিয়ার ঘটনায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন ছাত্রের সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যায়। আর যায় কোথায়? সবাই মিলে ‘দশ চক্রে ভগবান ভূতের’ মতো নর্থ-সাউথকে আলিয়া মাদরাসা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমে গেলেন। একজন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী মাদরাসা ও ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একাকার করে ফেললেন। বলা হয়ে থাকে যে, অপরাধকে ঘৃণা করো অপরাধীকে নয়। ক্ষমতাসীন সরকার সন্ত্রাসী ঘটনাবলির পরে এমন কিছু ব্যবস্থা নিলেন, যা ‘মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা’র শামিল। তারা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছেন। অভিযোগ দু’একজন সাবেক ছাত্রের সংশ্লিষ্টতা। আসলে বড় কারণ, যা সরকার বলেছেÑ দলাদলি বা মালিকানা বিরোধ। কোন্দল দূর না করে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়া কি যুক্তিসঙ্গত হয়েছে? সরকার ড. জাকির নায়েকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের পিস স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। জাকির নায়েকের লাখ লাখ ভক্তের মধ্যে দু-একজন যদি অতি উৎসাহী হয়ে প্রাণ দিতে যায় তাহলে তা কি ব্যক্তিবিশেষের বোঝার ভুল নয়? পিস স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে সরকার ‘পিস’-এর বিপরীত কাজটিই করেছে। আরো অভিযোগ রয়েছে, কিছু কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আরো শোনা যাচ্ছে, দেশের কয়েকটি মাদরাসা বন্ধের পাঁয়তারা করছে। শিক্ষামন্ত্রী বললেন, অননুমোদিত ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেয়া হবে। এসব কার্য ব্যবস্থার ফলে গোটা শিক্ষা জগতে সর্বনাশের কালো ছায়া নেমে এসেছে।
সন্ত্রাসবাদের ওপর এ যাবৎ পরিচালিত গবেষণা এবং শিক্ষাবিদদের অভিমত এই যে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিষয়ভিত্তিক এবং আদর্শভিত্তিক ব্যক্তি বা নাগরিক সাধারণের সন্ত্রাসী হওয়া কারণ নয়। কারণ হলো ক্ষোভ-হতাশা, হিংসা-প্রতিহিংসা, ধর্ম ও আদর্শের বিকৃতি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অভাব দারিদ্র্য এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রবণতা। আমাদের কপট বুদ্ধিজীবীরা যখন পুনঃ পুনঃ ইসলামের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন, তখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের অভিমত এই যে, ধর্মের সঠিক শিক্ষাই সন্ত্রাসবাদ থেকে পৃথিবীকে রেহাই দিতে পারে। কারণ, কোনো ধর্মেই হিংসা-প্রতিহিংসা অনুমোদন করে না। বাংলাদেশের মানুষ ‘ধার্মিক কিন্তু ধর্মান্ধ নয়’। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা এবং অনুশীলন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথার্থ নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারে। যদি আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রে দীক্ষিত করতে পারি তাহলে সবার জন্য সন্ত্রাসমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ তথা নিরাপদ পৃথিবী অর্জন করা সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ব প্রকাশিত : নয়া দিগন্ত 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *